কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। প্রথম পর্ব

সায়েন্স ফিকশন কিশোর উপন্যাস।।

এক।।

জয়িতার মুখের দিকে তাকালে কাশেম পাটোয়ারী স্থির থাকতে পারেন না। এক প্রকার কষ্টে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। আর তখন তার সারা শরীর জুড়ে এক প্রকার কষ্ট ছড়িয়ে পড়ে। তখন কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কাশেম পাটোয়ারীর প্রায়ই এমন হয়। এতো মিষ্টি একটি মেয়ে চোখে দেখতে পায় না এই কষ্টটা তিনি মেনে নিতে পারেন না।

জয়িতার জন্য যখন কাশেম পাটোয়ারীর মন খারাপ হয় তখন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কখনও ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। কখনও মনে মনে বলেন, একি হলো? কেন এমন হলো? জয়িতার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলাম।

আজ বিকেলে জয়িতাকে ছাদে নিয়ে গেলেন কাশেম পাটোয়ারী। জয়িতাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে তিনি ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। কিছুক্ষণ সময় কেটে যাওয়ার পর জয়িতা ডাকল, বাবা।

কাশেম পাটোয়ারী আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন, বলো মা।

বাবা, তুমি সেই যে আমাদের নিয়ে বেড়াতে গেলে আর কোনো দিন বেড়াতে নিয়ে যাওনি। কেন বাবা?

বাবা আনমনা হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, সে কথা থাক মা। সেই বেড়াতে যাওয়াটাই আমাদের জীবনের বড় অঘটন ঘটে গেল। জীবন থেমে গেল। আর বেড়াতে ইচ্ছে করে না।

দুর্ঘটনার জন্য বাবা সব সময়ই নিজেকে দায়ী করেন, নিজেকে অপরাধী ভাবেন। কিন্তু এ যে ভাগ্য, বাবার কী দোষ? হঠাৎ কেন বৃদ্ধ লোকটি এভাবে গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল? এটা নিয়তি ছাড়া আর কী? বাবা নিজেকে অপরাধী করে কথা বললে জয়িতার খুব খারাপ লাগে। ভীষণ কষ্ট পায়। বাবাকে সান্ত¦না দেওয়ার ভাষা খোঁজে, নানা কথা দিয়ে সান্ত¦না দেয়। ছোট শিশু কী আর বলবেই বা। বাবাকে সে আর কীভাবেই বা সান্ত¦না দিতে পারে?

জয়িতার স্মৃতিতেও সেই দুর্ঘটনার কথা মনে হয়। কষ্টে তার কান্না পায়। তবে কান্না লুকিয়ে বাবাকে বলে, জীবন থেমে যায়নি বাবা। মানুষের জীবনে কত দুর্ঘটনাই তো ঘটে। এই যে দেখো আমি তো থেমে থাকেনি। লেখাপড়া করছি। দিব্যি করছি। হাসছি। খেলছি। শুধু চোখে দেখতে পাই না। তাতে কী হয়েছে? আমার মতো কতো মানুষ আছে পৃথিবীতে যারা চোখে দেখতে পায় না। তারা কি বেঁচে নেই। তাদের জীবন কি থেমে আছে?

মেয়ের সপ্রতিভ মুখের দিকে তাকিয়ে কাশেম পাটোয়ারীর পুরনো কষ্টটা ছড়িয়ে পড়ে ভীষণভাবে। মনে পড়ে এক বিকেলে তিনি গাড়ি চালিয়ে পরিবার নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছিলেন। ঢাকা থেকে অনেক দূরে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে একটা বৃদ্ধ লোককে বাঁচাতে গিয়ে গাড়িটা দুর্ঘটনায় পড়ে। সেদিনই কাশেম সাহেবের পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। স্ত্রী ফারজানা আর ছেলে অভীক মারা যায়। আর একমাত্র মেয়ে জয়িতা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে কোনোক্রমে বেঁচে আছে। কাশেম পাটোয়ারীও শরীরে ও মনে অনেক আঘাত পেলেও ভালো আছেন। তিনি সুস্থভাবেই বেঁচে আছেন।

বাবাকে নিরুত্তর দেখে জয়িতা বলল, বাবা।

কাশেম পাটোয়ারী ছাদের কিনার থেকে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। চেয়ারে পাশে নিলডাউন হয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বলো মা।

বাবা জানো, আমার খুব গাড়ি চালাতে ইচ্ছে করে।

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি তো চোখে দেখতে পাও না। কীভাবে গাড়ি চালাবে?

জয়িতা বলল, আচ্ছা, বাবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের গাড়ি চালানোর জন্য কোনো গাড়ি আবিষ্কার করা যায় না?

বাবা হো হো করে হাসলেন। এটাও কি সম্ভব মা?

জয়িতা কৃত্রিম রাগ করে বলল, হাসবে না বাবা। পৃথিবীতে অনেক কিছুই সম্ভব। তুমি দেখো আমি বড় হয়ে একটা গাড়ি আবিষ্কার করব। এই গাড়িটি শুধু শব্দের তরঙ্গ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। শব্দের তরঙ্গ-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি, বুঝলে বাবা। যেকোনো মানুষই চালাতে পারবে। পারবে দৃষ্টিহীন মানুষও।

হঠাৎ তোমার মাথায় এমন ধারণা এলো কেন? বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

আমার গাড়ি চালাতে ইচ্ছে করে তাই, জয়িতা বলল।

জয়িতার কথা শুনে বাবার মন আরও খারাপ হয়। চোখমুখ কালো হয়ে যায়। একি বলে মেয়েটা? শব্দের তরঙ্গ-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি বানাবে। এটা কীভাবে সম্ভব? না, বাবার মাথায় কুলোয় না। জয়িতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তার অন্তর মায়ায় ভরে যায়। জয়িতা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ব্রেইলে লেখাপড়া করলেও বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল ঝোঁক। একজন টিউটর রেখে দেওয়া হয়েছে যিনি শুধু জয়িতাকে পড়ে শোনান। গল্পের বই থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের বই। বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি আর জটিল জটিল সমস্যা ও সমাধানের বই জয়িতাকে পড়ে শোনাতে হয়। জয়িতা যখন যা চায় তাই পড়ে শোনাতে হয়। নিয়োগ ম. হকের বিজ্ঞানের একটা কল্পকাহিনি পড়েই শব্দতরঙ্গ-নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ধারণাটি জয়িতার মাথায় চলে আসে। বাবাকে বোঝায়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যদি ক্রিকেট খেলতে পারে তাহলে গাড়ি বানাতে পারবে না কেন? শব্দের তরঙ্গ দিয়েই এটা সম্ভব।

বাবা আরও অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকান। তিনি কিছু বলতে গিয়েও থ মেরে যান। মুখ থেকে একটা বের হয়, হুম।

জয়িতার পাশ থেকে উঠে বাবা আবার ছাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়ান। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, কীভাবে সম্ভব? তবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করতেই হবে। জয়িতা যে আমার জীবন। আমার জীবনের চেয়েও দামি। তার কোনো ইচ্ছেকেই আমি অপূরণ রাখব না। প্রয়োজনে আমার সমস্ত ধনসম্পদ বিক্রি করে হলেও আমি তার ইচ্ছেকে পূরণ করব।

ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। শব্দের তরঙ্গ-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি কীভাবে বানানো যায়? একথা তো ঠিক যদি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা ক্রিকেট খেলতে পারে তাহলে গাড়ি চালাতে পারবে না কেন? কীভাবে বানানো যায়। জয়িতার ধারণাটিকে বাস্তবে রূপ দিতেই হবে।

কাশেম পাটোয়ারী জয়িতার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, মা, এই কাজটি কীভাবে করা যেতে পারে? তুমি কি একটা প্ল্যান দিতে পারো?

হ্যাঁ দিতে পারি।

তাহলে বলো শুনি।

জয়িতা বলে, দুজন ইঞ্জিনিয়ার দরকার। একজন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার আরেকজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তবে আমি আগে একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

কাশেম পাটোয়ারী চিন্তা করে বললেন, আমি সে ব্যবস্থা করছি। কালই তোমার কাছে একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানীকে পাকড়াও করে আনা হবে।

Series Navigationধারাবাহিক উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব দুই >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *