ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব ষোল
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব এক
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব তিন
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// নয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// দশ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব এগার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব বার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।।পর্ব -তের
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব চৌদ্দ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব -পনেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব ষোল
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব সাত
উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।।
॥ ষোল ॥
গ্রামের মানুষ চোখ কপালে তুলে শুনতে পায় রিলিফ চোর আর কম্বল চোরেরা নাকি স্বাধীনতাও চুরি করেছে। এই চুরির শানে-নজুল কেউ বুঝে, কেউ বুঝে না। সেই চোরদের দেশের এখানে ওখানে রাতের অন্ধকারে খতম করে বেড়াচ্ছে যারা, তারা নাকি নকশাল। এ আবার কি? নকশাল না খেঁকশিয়াল তা জানার মাথার ঘিলু কয়জনের? সেই নকশালদেরই পাল্টা খতমে নেমেছে জলপাই রংঅলা রক্ষী বাহিনী। কথাটা কানে গেলে কেমন থমকে যায় তপনের পিতা অধরচন্দ্র। স্ত্রীকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে অধরচন্দ্র বলে, ‘লোকে কি বলে শুনেছ? তোমার ছেলে নাকি মানুষ খুনের চাকরি করে?
অধরের স্ত্রী চন্দ্রমুখী সামনে যেন সেই লাশটি দেখে যা সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে করতোয়ার চরে আশ্রয় নেবার যাত্রাপথে পড়ে থাকতে দেখেছিল। খুব ভয় পায় সে। কেননা ইতিমধ্যে গ্রামের নানা গুজবে মনটা তার ভালো নেই। গুজবের পেছনে ছুটেই সে গিয়েছিল কামাখ্যাচরণের বাড়ি। গুজবটা যে গুজব নয়, বরং সত্য তা সে নিজ চোখে দেখে এসেছে। স্বামী পরিত্যক্তা আরতিকে ‘মাতঙ্গী পেত্নী’ ধরেছে। কিংদন্তির সেই পেত্নী। কোথাকার পেত্নী তা কেউ জানে না। কিন্তু বংশ-পরম্পরায় এই অঞ্চলে সে বিরাজমান। স্বামীর মৃত্যুর পর সে আত্মঘাতী হয়েছিল। সুযোগ পেলেই সদ্য বিবাহিতা নারীর উপর ভর করে সে। আরতিকেও ভর করেছে। না হলে আরতি তপনের যুদ্ধের ছবিকে স্বামী জ্ঞানে সেবা করে কেন? সে নিজেকে বিধবা দাবি করে এবং জীবিত তপনকে মৃত স্বামী বলে প্রচার করে। এ যেন বিধবার একাদশী পালন।
অথচ পিতা ছাড়া কন্যার এই আচরণের অর্থ সবার কাছে অজ্ঞাত। পিতা কামাখ্যা জানে তার মেয়ে কোনো মনোরোগে আক্রান্ত নয়, যা করছে সবই সুস্থ মনে। কিন্তু পিতা যা জানে না তা হচ্ছে আরতির মনের গোপন রহস্য। এটা কি তপনের প্রতি তার ঘৃণা, নাকি পিতার প্রতি প্রতিশোধ? এই জটিল প্রশ্নের উত্তর জানার কথা নয় কামাখ্যার।
ছুটিতে এসে বিষয়টি শুনতে পায় তপন। সেই ছুটে যায় আরতির কাছে। নির্বিকার আরতি তাকে স্পষ্ট করে জানায়, এ ছবি তার মৃত স্বামীর। মৃত স্বামীর স্মৃতি নিয়েই সে বেঁচে থাকবে। তপন তার মুক্তিযোদ্ধাবেশের ছবিটি তুলে আনতে চেয়েছিল। পারেনি। আরতি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে দিতে বলে, ‘আমি বিধবা, মৃত স্বামীর সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়, সে-ই আমাকে বেঁচে থাকার সাহস যোগায়।’
তপন বাড়ির পথ ধরে একথা ভাবে যে, আরতি পাগল হয়ে গেছে। সেই রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয় আরতিকে বিয়ে করবে। পিতাকেও জানায়। সেবার বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার কথা মনে পড়ে অধরচন্দ্রের। কিন্তু এবার যে ফিরিয়ে দেবার সাহস নেই কামাখ্যাচরণের এ কথা না বুঝার কথা নয় অধরের। তার মনের ভেতর অহংকারের নেউল ল্যাজ নাড়ায়। যতই ভূমির মালিক হোক অধর, তার মেয়ে যে স্বামী পরিত্যক্তা। বিয়ে হওয়া মেয়েকে বৌ করে ঘরে তুলতে মনটা সায় দেয় না।
তবু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিত্যানন্দ আর গিরিশকে সঙ্গে করে অধরচন্দ্রের বাড়ি হাজির হয়। প্রকৃতপক্ষে তারা বুঝতে চায় আরতি উন্মাদ কিনা। দীর্ঘক্ষণ কামাখ্যার সঙ্গে কথা বলার পর আরতির সঙ্গেও কথা হয়। কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না আরতিকে। আরতি কি মানসিক বিকারে আক্রান্ত, না কি সবার প্রতি অবিশ্বাস? কিন্তু যখন তারা বাড়িটি পরিত্যাগের জন্য ওঠে দাঁড়ায় তখনই আচমকা কেঁদে ওঠে আরতি, ‘একজন বিধবা আর স্বামী পরিত্যক্তা অন্যজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে?’
এর উত্তর কারো জানা নেই। তাই তারা তপনের উপরই ছেড়ে দেয় বিষয়টি। সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে তপন বুঝতে পারে, তার উপর আরতির জটিল একটি অভিমান আছে। ওর জীবনের আজকের যে বিপর্যয় তার জন্য আরতি তপনকেই দায়ী করছে। সেদিন ওকে নিয়ে তপনের নিরুদ্দেশ হবার ব্যর্থতাকে ক্ষমা করতে পারেনি আরতি।
রক্ষী বাহিনীর পরিবার-বিচ্ছিন্ন ব্যারাকে বসবাসের জীবনটা তপনের জন্য নতুন। ঠিক তেমনি ছিল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শিবিরও। খাপ খাওয়াতে শরীর এবং মনের লড়াই লাগে। তাছাড়া দিন-রাত অপরাধী এবং অপরাধের ভিন্ন এক দুনিয়ায় ডুবে থাকতে থাকতে এক এক সময় তার মনে হয়, পুরানো জীবনে আর বুঝি ফেরা হবে না। পারিবারিক জীবন আর সৈনিকের জীবনের ব্যাখ্যাটাই বুঝি আলাদা। অন্যদিকে আরতিকে নিয়ে এক জটিল ভাবনা। বুঝি এর কোনো ব্যাখ্যা নেই, সমাধানও নেই।
ব্যারাকে এক সকালে তপনের হঠাৎ মনে হয় পিতা এবং পুত্রের অজান্তেই ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফসলের মাঠকে ঘিরে কৃষক পিতার যে জীবন তা থেকে সে বুঝি দূরে সটকে পড়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মাটি থেকে। কৃষক জীবনের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে একটি মাত্র চাইনিজ রাইফেল। রাইফেল তো প্রাণ নেয় অথচ মাটি সৃষ্টি করে প্রাণ।
অথচ যুদ্ধের সময় এমনটা মনে হয়নি। একটা স্বপ্ন ছিল, অন্ধ একটা উত্তেজনা ছিল, যার ব্যাখ্যা ছিল না। যুদ্ধে কোনো জীবনদান, এই নিয়ে ছিল মনের টানাপড়েন। কখনও স্থির সিদ্ধান্তও ছিল। যুক্তিও ছিল। তবে যুক্তির চেয়ে আবেগের ভারটা ছিল অধিক। তখন না-বুঝলেও এখন বুঝছে।
অথচ আজ রাতে যে পাঁচজন সশস্ত্র রক্ষী এবং একজন স্থানীয় ইনফর্মার খোলা মাঠ ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের যাত্রার কোথায় শেষ তা জানে না তপন। জানে কি কমান্ডার? তারপর সেই হতদরিদ্র একটি বাড়ি। চালাঘর থেকে টেনে বের করা হয় যে ছেলেটিকে, তাকে চেনে কি তপন? কমান্ডার এক ঝলক তার চোখে টর্চের আলো ফেললে তপনের মনে হয় ছেলেটিকে কোথায় যেন দেখেছে সে। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পে কি?
দু’হাত এবং চোখ বেঁধে ছেলেটিকে টেনে নেয়া হচ্ছিল। কোথায়? কমান্ডারই জানে। দ্রুত পায়ে হাঁটছে ওরা ছয়জন এবং একজন বন্দি। আশ্চর্য, ছেলেটি নির্বিকার। যা ঘটছে এবং ঘটবে তা যেন ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। যেমনটা ঈশ্বরপুত্র যিশুর জন্য নির্ধারিত ছিল।
‘পরে তাঁহারা গেৎশিমানী নামক এক স্থানে আসিলেন। যিশু আপন শিষ্যদের কহিলেন, আমি যতক্ষণ প্রার্থনা করি, তোমরা এখানে বসিয়া থাক। পরে তিনি আরও কহিলেন, আমার প্রাণ মরণ পর্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়াছে। তোমরা জাগিয়া থাক। পরে যিশু অগ্রে গিয়া ভূমিতে পড়িলেন। এবং প্রার্থনা করিলেন, ‘পিতা: সকলই তোমার ইচ্ছা, আমার নিকট হইতে এই পানপাত্র দূর কর, তবে তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক।’ পরে তিনি আসিয়া দেখিলেন শিষ্যগণ ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তখন তিনি তাহাদের জাগাইয়া কহিলেন, সময় উপস্থিত, মনুষ্যপুত্র পাপীদের হস্তে সমর্পিত হইবেন। দেখ যে প্রিয় শিষ্য আমাকে পাপীদের হস্তে অর্পণ করিবে সে আমার নিকটে আসিতেছে। পরে সে আসিল এবং যীশুকে চুম্বন করিয়া শত্রুদের চিনাইয়া দিল।’
– রাইবেল নিউ টেস্টমেন্ট
তপন বুঝতে পারে তারা ওই বন্দি নকশার ছেলেটিকে নিয়ে একটি নদীর দিকে এগোচ্ছে। নদীর পাড় খাড়া। নীচে প্রবল স্রোতে। বাতাস স্রোতে ভাঙে। শব্দ হয়। চরাচর অন্ধকার নির্জন। কাছে-ভিতে কোনো বাড়ি নেই। কমান্ডারের হাতে টর্চের আলো। এর বাইরে সবই গোপন রাখে রাতের অন্ধকার।
দু’রাত দুচোখের পাতা এক হয়নি তপনের। চোখ বুঁজলেই ভেসে ওঠে গ্রাম্য এক হতদরিদ্রের পর্ণকুটির। একটি যুবকের অতল জলের দেশে হারিয়ে যাওয়া। রক্ত আর জলের গন্ধে কি জলের ক্ষুধার্ত প্রাণীরা ছুটে এসেছিল? জলে ছড়িয়ে পড়া রক্তে কি মানুষের গন্ধ সন্ধ্যাকালের প্রদীপজ্বলা তুলসীতলায় ধূপের গন্ধের মতো তো তার শরীরের ঘ্রাণের সঙ্গে একাকার হযে গিয়েছিল? এতো এক রূপকথা। শোনাতে পারতো পৃথিবীর মাত্র একজনকেই। আরতি, আরতিকে। কেননা আরতি মানুষের নিষ্ঠুরতাকে চেনে।
কি করছে আরতি এখন? একটি হত্যাকাণ্ডের রক্ত-গন্ধ সারা শরীর এবং মনে ছড়িয়ে দিয়ে বিনিদ্র তপন। হয়ত আরতি রাত গভীরের ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছে। পলাতক স্বামীর খোঁজে সীমান্তের দিকে হেঁটে যাচ্ছে সে। সীমান্তের কাঁটাতার। পথ বন্ধ। নয় তো দেয়ালে ঝুলে থাকা একজন মুক্তিযোদ্ধার ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। যে মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত ঘোষণা করে শুকনো ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছে, আরতি কি জানে সে একজন ঘাতক। একটি হত্যাকাণ্ডের পর ব্যারাকে ফিরে মাছের মতো শরীরে আর আত্মায় খুনের তাজা রক্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বিষ হয়ে?