ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব- ০২
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব- ০২
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। তৃতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।।পর্ব বারো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের ।। পর্ব ষোল
তার গম্ভীর মুখ দেখে শম্পা বোঝে— একটু বেশি টিউন করে ফেলেছে। অবস্থা বদলানো দরকার। সে তাই দাঁত মেলে হাসলো,
—’য়ু লুক গ্লুমি পাপা… ইস্তিয়াকের কথা শুনে? তা, ইস্তি তো কত কিছুই বলে!’
আবারো চমকায় সে — ‘অ্যাঁ, বলে! আর কী কী বলে?’
—’না না, তোমার সম্পর্কে তেমন কিছু বলেনি আর। আসলে আমি বলেছিলাম কি, ইস্তি তো কত আজব আজব কথাই বলে। ও খুব পিকুলিয়র ক্যারেক্টার, তাই না পাপা?’
‘ইয়েস’, ইয়েস ইনডিড।’— সে মাথা ঝাঁকালো।
অবস্থা সহজ হচ্ছে। বেশ, বেশ! আবারো দাঁত বের করে হাসলো শম্পা।
—’তুমি যদি আমাকে স্টেটসে পাঠাও না পাপা, আমি তোমার জন্য একটা স্পেশাল গিফট আনবো।’
—’তাই ঝুবি?’ সেও এবার একটু হাসলো।
—’দেখা যাক, তোমার যাওয়া হয় কি না…।’
—’হবে। অনেস্টলি তুমি যদি একটু কনসিডার্ড হও, তবেই হয়ে যাবে।’
— ‘আচ্ছা? বেশ। তা, বাড়ির আর কার জন্য কী আনবে?’
একটু ভাবলো শম্পা।
— ‘ইস্তির জন্যেও আনবো। এজন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। স্টেটসে কতো কি আবিষ্কার হচ্ছে। ধরো, ওরা একটা স্বপ্ন দেখার মেশিন বানিয়েছে… সিম্পল। জাস্ট পুশ বাটন সিস্টেম। যদি তাই হয়, তবে ওর জন্যে আমি ওরকম একটা মেশিনই আনবো। ও আবার খুব স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। আই নো হিম।’
—’গুড, আর রুপার জন্যে কী আনবে?’
‘নাথিং’— শম্পা মাথা নাড়লো। ‘আই উইল ব্রিনগ্ হার নাথিং। বিয়ের পর ও তো স্টেটসের পাশে যাচ্ছেই। তাছাড়া এমনিতেও ওর জন্যে কিছু আনতে আমি ইন্টারেস্টেড নই। শি অলওয়েজ কিপস্ মি অ্যাট আমর্স লেন্থ…!’
‘ওয়েল’— সে কাঁধ ঝাঁকালো। ‘দ্যাট য়ু নো বেটার। তোমার মা’র জন্যে কিছু আনবে না?’
— ‘মা’র জন্যে? প্রবলেম, ভাবতে দাও। … হ্যাঁ পেয়েছি। আই উইল ব্রিনগ হার আ মিঙ্ক কোট।’
‘মিঙ্ক কোট?’— সে হাসতে হাসতে বিষম খেল।
— ‘তোমার মা’র জন্যে মিঙ্ক কোট? মাই গড! দেখার মতো যা একটা ব্যাপার হবে না…!’
তাদের কথা শেষ হয় না। তার আগেই মা ঘরে ঢোকে। এতোক্ষণ সে রুম্পা আর ইস্তিয়াককে ওঠাতে ব্যস্ত ছিল। বাবা-মেয়ের হাসাহাসি লক্ষ্য করে সে একটু উৎসুক হয়।
— ‘কি রে, বলবো তোর মাকে? কী আনবি তুই?’
শম্পা হাসে। মাথা নাড়ে।
— ‘না বাবা, ডোন্ট, আমি তো মা’কে সারপ্রাইজ দেবো।’
মেয়ের দিকে একবার তাকায় মা। আগ্রহটুকু তখনই নিভে গেছে তার। জীবনে এরকম বহুবার ঘটেছে। সামান্য হয়তো আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে কখনো। কিন্তু তাকে কেউ কখনো জড়ায়নি। এদের বহু কিছুই সে বুঝতে পারেও না। সে চেষ্টাও সে ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল আর বোঝার ইচ্ছেও হয় না। তার পেছনে রুম্পা আর ইস্তিয়াক এসে দাঁড়িয়েছে। রুম্পার মুখ সামান্য ভার। বোঝা যায়, রাতে ঘুম হয়নি ভালো। টোস্টে আলতো কামড় বসিয়ে সে হালকা চোখে বাবার দিকে তাকায়।
— ‘বাবা, হাজার দু’য়েক টাকা দরকার আমার। আজ। দেবে?’
‘দেবো, নিশ্চয়ই’— সে তখনই মাথা ঝাঁকায়।
— ‘কিন্তু তোমাকে তো খুব চিন্তিত মনেহচ্ছে! কিছু হয়েছে? ক্যান বি অব এনি অ্যাসিটেন্স?’
— ‘কিছু না বাবা, নাথিং সিরিয়াস।’
— ‘গুড, তা ইস্তি তোমার কি হয়েছে? মুখ কেন ভার!’
মাও একই সঙ্গে মুখ খোলে,
— ‘হ্যাঁ, কি যে হয়েছে? ছেলেটা সব সময় এরকম মুখ ভার করেই থাকে। ইস্তি বলতো সত্যি করে, কি হয়েছে তোর?’
‘ভিমরতি, ‘আই নো হিম।’ — শম্পা বলে।
ইস্তিয়াক খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল। সে বিরক্ত হলো। তাকালো না কারোর দিকে।
— ‘কী যে কর না তোমরা, খাওয়ার সময়ও একটু স্বস্তি নেই! তোমাকে বলছি বাবা, তুমিই আরম্ভ করেছিলে।’ — ইস্তিয়াক এক পলক তাকালো বাবার দিকে।
— ‘শোনো, কেমন আছি, এসব আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করো না তো? আমি কখনো খারাপ থাকি না।’
কতক্ষণ সে তাকিয়ে থাকলো ইস্তিয়াকের দিকে। তারপর জোর করে হেসে বললো,
— ‘বেশ বেশ, ভালো খবর।’ মনেমনে সে ঠিক করে নিল, এরপর থেকে নিয়মিত নজর রাখবে সবার প্রতি। বিশেষ করে ইস্তিয়াককে এতটা নজরের বাইরে রাখা উচিত হয়নি। শুধু অল্প বয়সের জন্য নয়, আরো কিছু আছে। ওর গলার সুরটাই অন্যরকম। আসলে নজর রাখতে হয়— সবদিকেই। ছোটখাট বিষয়েই পরে পস্তাতে হয় অনেক সময়। এসব সে হাড়ে হাড়ে জানে। জানে ছোট ছোট ঝামেলাই এক সময় ডালপালা মেলে বড় হয়ে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।
সাড়ে বারোটায় আবদুল্লাহ সাঈদের অ্যারাইভাল। এয়ার পোর্টে সে সময়, কিংবা দু’চার মিনিট আগে-পড়ে পৌঁছালেও চলবে। আপাতত অফিসে যাওয়া দরকার। বিডি আসবে। তার সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে ফেলতে হবে। এখনো অবশ্য হাতে বেশ সময় আছে। এক আধ ঘন্টা পর রওনা হওয়া যায় অফিসের উদ্দেশে। কিন্তু এ মুহূর্তে বাড়িতেও কিছু করার নেই তার। মাঝখানে রুম্পা এসে দু’হাজার টাকা নিয়ে গেল। এ মেয়ের এত টাকার দরকার কেন যে হয়, জানে না সে। তা নিক, এখন আর জানারই বা কি দরকার? মাঝখানে আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। কিন্তু ইস্তিয়াকের ব্যাপার ভাবাচ্ছে তাকে। ছেলেটা বেয়াদব— এমন নয়। বেয়াদব হলে ভাবার কিছু ছিল না, বয়স বাড়লে সব ঠিক হয়ে যেত— সে জানে। কিন্তু বেয়াদব নয় অথচ কথাবার্তা অন্যরকম। এ ব্যাপারটাই ভাবাচ্ছে তাকে। তাছাড়া শম্পা বললো, আজব আজব সব কথা বলে আর স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। খারাপ। দু’টোই খারাপ। আজব আজব কথা আর স্বপ্ন— এ দু’টো সে কাউন্ট করে রাখে। সে যখন অফিসে পৌঁছালো তখন দশটা বাজে। অফিসটা তার খুব বড় নয়, ছোটই। ছিমছাম। একটা মান্টি-স্টোরিড বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার একাংশ। নিজের রুমটা সে চমৎকার করেই সাজিয়েছে। ডেকোরেশন এ লাখ তিনেক গেছে। তা যাক লাখ কয়েক টাকা। দেখলে চোখ জুড়োয়। গ্যাসটপ নিখুঁত ফিনিশিংয়ের তার নিজের টেবিলের ওপর তিনটে টেলিফোন। তিনটের একটা একান্ত ব্যাক্তিগত। ওটার রঙ লাল। লাল রঙ তার খুব পছন্দ। এ টেলিফোনটায় অবশ্য বাড়তি সুবিধা আছে। সরাসরি ডায়েল করে দেশের বাইরে কথা বলা যায়। এজন্য সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক টাকা তার বাড়তি খরচ হয়েছে। পিএ কে ইন্টারকমে প্রয়োজনীয় ইফরমেশন দিয়ে আয়েশ করে বসে। দিনের প্রথম সিগারেটটা ধরায়। বিডি’র জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া এ মুহূর্তে তার আর কিছুই করার নেই। বিডি পুরানো বন্ধু। আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো। সেই একাত্তর সালে একই লাইনে কাজ করতে গিয়ে পরচিয়। তারপর বন্ধুত্ব ক্রমান্বয়ে গাঢ় হয়েছে। সে জানে, বিডির ওপর নির্ভর করা যায়। কোনো ফিক্সড চাকরি কিংবা ব্যবসা কোনটাই নেই। একাত্তরে পাক-আর্মির সঙ্গে ঘেঁষটিয়েছে। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বিভিন্ন সাপ্লাই দিয়ে মোটা পয়সা কামিয়েছে। সে পয়সা অবশ্য রাখতে পারেনি। তাছাড়া একাত্তরের পর কিছু ধকলও গেছে। তাতে অবশ্য দমেনি বিডি। এজন্যই বিডিকে খুব পছন্দ করে। ঠিক তার মনের মতো। ঠিকই জানে, অবস্থা যতই খারাপ হোক, সামাল দিতে পারলে সুদিন আসবেই। সামাল দিয়েছে বিডি। এখন তার কাজ হচ্ছে বন্ধু-বান্ধব, চেনা-জানা লোকের টুকটাক উপকার করা। খুব উঁচু মহলে তার উঠাবসা। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে দু’দিনের মধ্যে কোনো পরিচিত লোককে খুঁজে বার করতে পারবে না সে। আর তাছাড়া সবার হাড়ির খবরও সে রাখে। হাড়ির খবর অনেক সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। বন্ধুরা প্রয়োজন পড়লেই তাকে ডাকে। তার দু’একটা ফোন কিংবা ব্যাপারটা জটিল হলে দু’একদিনের ছোটাছুটিতেই কাজ হয়ে যায়। কাজ অনুযায়ী তার পারসেন্টেজ থাকে। তবে বিডি’র খুব খরচের হাত। শুধু এসব টুকটাক কাজেই চলে না। স্ত্রীর এবং মৃত ভাইয়ের দু’টি সহ মোট পাঁচটি ছেলেমেয়ের খরচ যোগাতে হয় তাকে। গ্রামের বাড়িতে আছে বুড়ো মা-বাবা। টাকা পাঠাতে হয় তাদেরকেও। তাই সে আরও চারপাঁচটা কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। সে সুযোগ মতো খবর বিক্রি করে। এক পার্টির গোপন খবর অন্য পার্টির কাছে। তাছাড়া বিভিন্ন বয়সের চমৎকার চেহারার মেয়েও সে সাপ্লাই দিতে পারে। কোত্থেকে, কি করে জোগায় কেউ তা কেউ জানে না। জানতে চায়ও না। তবে চমৎকার সব মেয়ে। তাদের দেখে কেউ কখনো বলবে না তারা এ লাইনের।