ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব সাত

‘ইস্তিয়াক কি ল্যাংড়ার৷ ওখানে যায়?
প্রচণ্ড গরম পড়েছে । দরদর করে ঘামছে বিডি। তার প্রশ্ন শােনেনি। বিডি’কে সময় দিল সে। গাড়ি মাত্র চলতে আরম্ভ করেছে। এয়ার কুলার চলছে।
পাশাপাশি বিডির রুমালও চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সুস্থির হওয়া যাবে ।
মিনিট পাঁচেক পরে সে প্রশ্নটি আবারও করে— ‘তুই জানিস নাকি— ইস্তিয়াক কি ল্যাংড়ার কাছে যায়’
বিডির রুমাল এখনও চলছে— ‘কে,—ল্যাংড়া কে’— সে জিজ্ঞেস করে।
আমি মাহমুদের কথা বলছি, সে গম্ভীর গলায় বলে।
‘কেন, কি হল আবার’—বিজি তাকে লক্ষ্য করে।
‘আর বলিস না’— ‘সে সেই গম্ভীর গলায়ই সকালের ঘটনাটা খুলে বলে। বলে— ‘একটু নজর রাখিস তো। কোনাে লােককে না হয় লাগিয়ে দিস।’
বিডি কতক্ষণ বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হেসেই উড়িয়ে নিতে চায় সবকিছু—‘আরে ধ্যাৎ, তুই বড় অল্পতে ঘাবড়াস। এত বেশি বেশি চিন্তা করতে নেই।’
সেও ফেরে বিডি’র দিকে, চোখ তুলে সােজা তাকায়, বলে— ‘তুই বুঝতে পারছিস না, বিষয়টা আসলেই সিরিয়াস। আমি জানি মাহমুদ প্রায়ই ঢাকা আসে, আর নিশ্চয়ই ইস্তিয়াক ওর ওখানে যায়। ছেলেটা প্রথম থেকেই একটু কেমন যেন। আমাকে এড়িয়ে চলে। এরপর গােদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতাে আমি চাই না ল্যাংড়ার সঙ্গে ওর কোনাে সম্পর্ক থাকুক।’
তার গম্ভীর মুখ দেখে বিডিও গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর— ‘কেন, ভয় কি মাহমুদ তো তোরই চাচাতাে ভাই’— বলে সে মুচকি হাসে।
সে এবার রাগে— ‘দেখ বিডি, তাের প্রায় সবটাই ভালো। খারাপ যেটুকু সেটুকু হচ্ছে— তুই মাঝে মাঝে কিছু কিছু বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিস না।’
বিডি’র ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ঝুলেই থাকে—বেশ, বুঝি না। তারপর? ‘মাহমুদ আমার ভাই না কে ম্যাটার্স আ লিটল। ইস্তিয়াক ওর সঙ্গে মিশলে ও কি কি কাহিনী শােনাবে আর খবর দেবে ইস্তিয়াককে তা কি তুই বুঝতে পারছিস? আমি কি শেষে নিজের ছেলের শত্রু হব? ওতাে এমনিতেই আমাকে দেখতে পারে। না ……শােন বিডি, ওদের এনি হাউ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।’
বিডি’র ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির বিন্দুটুকু মুছে যায়। সে ঘনঘন মাথা নাড়ে— ‘হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস। আমি নজর রাখবাে। তোর ছেলেকে মাহমুদের সঙ্গে মিশতে দেয়া যায় না।’
সমস্যাটা বিডি বুঝতে পেরেছে এই বােধ তাকে বেশ তৃপ্তি দেয়। সে আয়েশ করে সীটে হেলান দেয়, বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বলে— ‘কালই কাউকে পাগাস ….. ল্যাংড়া তাে আজ থেকে জ্বালাচ্ছে না।’
‘হ্যাঁ দোস্ত, সেই সেভেন্টি ওয়ান থেকে।… ও নাকি খুব ভালাে ফাইটার ছিল।’
‘ভালাে ফাইটার ছিল মাই বলস। এসব বলিস না আমাকে।’
বিডি হাসে—‘সত্যি কথা স্বীকার করতে দোষ কি? সেভন্টি–টুতে তুই বাঁচতে পারতি? মারাই হয়তো পড়তি। শুধু তো গ্যালান্ট–ফাইটার মাহমুদের ভাই —এভাবে বেঁচেছিলি।’

‘ওসব অনেক পুরনাে দিনের কথা। এখন চাইলে প্রতিদান দেব।’ সে গম্ভীর গলায় বলে।
‘চাইবে না। আমি ওর রগ চিনি। বরং পারলে……’
‘আমাকে বিপদে ফেলবে, এইতো?’
‘হ্যাঁ, ফেলবে। যদি সুযোগ পায় অবশ্য……..’
‘তা এতই যখন বুঝিস তখন এর সম্পর্কে সাবধান।’
গাড়ি এয়ারপাের্ট পৌঁছে যায়। জানা গেল ফাইট আধঘন্টা লেট। এই বাড়তি আধটা কাটে কি কার? বিডি পারে তাে তখনই বারে – এ গিয়ে বসে। মাত্র দুটো খেয়েছে তখন, আসতে আসতে আর কথা বলতে বলতে ঘাের কেটে গেছে, তার বক্তব্য। কিন্তু সে রাজী হয় না। আরাে অনেক কথা আছে তার জরুরী। বার – এ গিয়ে বােতলের ছিপি খুলে বসলে তা আর হবে না।
‘পরে হবে, তােকে আমি পেট পুরে খাওয়াবাে’— সে বলে— ‘এখন প্রােজেক্টের অগ্রগতি সম্পর্কে কি কি জানবি বলেছিলি জানা।
বার – এ গিয়ে বসতে না পারায় বিডি একটু মনক্ষুন্ন— ‘তাের জেনে দরকার নেই। সবকিছু ঠিক আছে।’
‘আহা, ক্ষেপছিস কেন! বললাম তাে পেটপুরে খাওয়াবাে তােকে, পচিশ বছরের পুরনাে শিভাস রিগ্যাল। এখন বল।’
‘কি বলব। সবকিছু ঠিক ঠিক চলছে। পরিস্থিতি আণ্ডার কন্ট্রোল।
‘আহা, খুলেই বল না।’
বিডি লেগে যায়— ‘তুই এত নার্ভাস কেন? যেন এই কাজে এই প্রথম তুই এলি! কেন, এর আগে বেশ কয়েকবার এই একই প্রােজেক্টে কি আমরা সফল হইনি?’
‘হয়েছি, অলরাইট; কিন্তু আমি একটু নাভাসই বটে, তুই জানিস।’
‘ তবে শােন’— বিটি বড় রুমাল দিয়ে তার মাড় আর মুখ মুছে নেয়— ‘তিন চার জায়গা থেকে খবর পেয়েছি। খুব সুন্দরভাবে এগােচ্ছে সবকিছু। আমাদের এজেন্টরা চমৎকার কাজ করছে
এখন পর্যন্ত কালেকশন ভালাে। ঈদের আগে চালান দিতে কোনাে অসুবিধাই হবে না।’
‘হবে না?’
‘না।’
‘আমার ভয় লাগেরে মাঝে মাঝে। সেই সেভেটি – ওয়ানের কথা মনে পড়ে যায় ।… তাছাড়া এখন পত্রিকাগুলাে মুখিয়ে থাকে। এসব খবর পেলে এমন রঙ – চঙ চড়িয়ে ছাপে।’
খ্যা খ্যা করে হাসে বিডি — ‘তা তাে করবেই ওরা, ওটাইতাে ওদের কাজ। রঙ না দিলে পাবলিক খবর পড়বে কেন?’
‘এত সহজে নিস না। পত্রিকায় নিউজ হলে বহুত ঝামেলা পােস্ত।’
বিডি অনেকক্ষণ কিছুই বলে না। এদিক – ওদিক তাকায়। তারপর হঠাৎ করে তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে যায়। সকৌতুকে জিজ্ঞেস করে – তাই বুঝি? তা শোন, যদি খবরও পায় লোকজন তবে কি নিউজ করবে ওরা? ওরা লিখবে অমুক সিমান্তে পাচারের সময় এতজন মেয়ে উদ্ধার করা হয়েছে, সঙ্গে— ‘এতজন’ দালাল ছিল। ব্যাস, এইতাে দোস্ত। অর্থাৎ ধরা পরবে সংখ্যা— এতজন দালাল।’ সংখ্যা ছাড়া আর কি? আর তো কিছু জানবে না দোস্ত পত্রিকার লোক, আর তাই পাবলিক আনবে না।’ তার মুখে এবার হাসি ফোটে, বিডির দিকে স্বস্তির চোখ তুলে তাকায়, ‘হ্যাঁ এটা তুই ঠিক বলেছিস। দালালরাতো আসলে সংখ্যাই, ওরা নিজেরাও তেমন কিছু জানে না।’
‘তবে এখন আর জ্বালাস না আমাকে’ — বি ডি থেমেছে বইয়ের দােকানের সামনে।
‘আরে তােকে তাে আসল কথাটাই বলা হয়নি’ — বই দেখতে দেখতে সে হঠাৎই ফেরে।

‘কি কথা, কি কথা?’ সে চমকায়।
‘হু হু’— বি ডি চোখ নাচায়— ‘সে এক মজার ব্যাপার দোস্ত। একটা বই বের হয়েছে, জানিস? একাত্তরে যারা পাকিস্তানের ফরে ছিল তাদের, অর্থাৎ ওদের ভাষায় দালালদের নিয়ে একটা বই। কে কি করেছিল তখন, এখন তারা কে কোথায় আছে এসব নিয়ে লিখেছে বই। কে কি করেছিল তখন, এখন তারা কে কোথায় আছে—
এসব নিয়ে লিখেছে বই।’

‘বই লেখার আর সাবজেক্ট পেল না’ — সে নাক সিটকোয় — যত্তোসব।’
‘সে না হয় লিখলাে, ওদের ব্যবসা ওরা ভালাে বুঝবে। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানিস— তোর নামও আছে এ বইয়ে —বি ডি হাসে।
‘কি।’ মুহূর্তের মধ্যে তার নাক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
‘তাের নাম আছে ঠিকই, কিন্তু তোর এখনকার অবস্থা জানতে পারেনি, লিখেছে জানা যায়নি… তাের জন্যে এটা নিশ্চয় সুসংবাদ— বি ডি খুব হাসে—’ এরকম অবশ্য। আরাে অনেক আছে। অনেকের নামের পাশেই লিখে দিয়েছে বর্তমান অবস্থা জানা যায়নি। তা আমি বলি কি— এখনকার অবস্থা জানা কি অতই সহজ। বরং লিখে দিলেই পারতাে — এরা এদেশেই আছে ভেতরে ভেতরে, সব জায়গায় তুই’ই বল — কোনায় নেই’ বি ডি – র হাসি ফুরােয় না।
সে হাসি তাকে স্পর্শ করে না। সে গম্ভীর ও কিছুটা বিমর্ষ হয়েই থাকে। তাকে অমন দেখে বিডির হাসি বিস্কৃত হয় শেষে সে তার পিঠ চাপড়ে দেয় — ‘ঘাবড়ে গেছিস বলে মনে হচ্ছে।’
‘ঘাবড়ানােরই তাে কথা’ — সে গম্ভীর গলায় বলে। বিডি হাত ঝাড়ার ভঙ্গি করে— ‘ঝেড়ে ফেল ঝেড়ে ফেল । তুই সুড়ি বুঝিস? এসব বই হচ্ছে সুড়সুড়ি। এদেশের পাবলিককে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি দোস্ত। এ বই পড়ে তারা খুব তৃপ্তি পাবে। ভাববে, বিপ্লব ওদের হয়ে গেছে— তারপর নাক ডেকে ঘুমােবে, ব্যস।’
তবু সে সুস্থির হতে পারে না— ‘এ সবের পেছনে মাহমুদ নেই তাে?’ — সে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে।
বি ডি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে— ‘তোর দেখি ঐ মাহমুদ কে ফোবিয়া হয়েছে।’
সে একটু ভাবে, বলে— ‘আমার কেন যেন মনে হয় মাহমুদ আমাদের পেছনে লেগেই আছে। মনে হয় ও সব জানে আমাদের। সুযােগ পেলেই আমাদের কোনাে কোনো কোনাে বিপদে ফেলবে, এ ব্যাটা মুক্তিযােদ্ধা।’
বি ডি অনেকক্ষণ ধরে হাসে— ‘মাঝে মাঝে কী যে বলিস তুই! পুরাে সুস্থ যারা আছে তারাই পারে না আর ঐ ল্যাংড়া ফেলবে বিপদে… আর যদি কখনাে বুঝি ও সত্যিই সেরকম কোনাে চেষ্টায় আছে — ওকে শেষ করে দিলেই হবে। দু’একটা ল্যাংড়া মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে কেউ কিছু ভাববে না।
সে অনেকক্ষণ ধরে বি ডি কে দেখে, এক সময় বলে— ‘ঠিক।’
প্লেন এসে গেছে। বিডিরও বই দেখা শেষ। এগােতে এগােতে সে হঠাৎ থামে, বি ডি র দিকে তাকায়, বলে— ‘নানা ঝামেলায় তােকে তাে জরুরী একটা কথাই বলা হয়নি। রুম্পার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।…… ছেলে কানাডায়, বাবা এখানে বিগশট। বিয়েটা হয়ে গেলে বলতে পারিস — আমাদের একটা নতুন লাইন ওপেন হবে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব ছয়ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব আট >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *