সৃজনশীলতার সঙ্গে মননশীলতার প্রয়োগ জাহিদুল হকের কবিতাকে একান্তভাবে বিশিষ্ট করেছে // হাসনাত আবদুল হাই

জাহিদুল হকের নয়টি কবিতার বই নিয়ে ‘কবিতাসংগ্রহ’ বের করেছে পাঠক সমাবেশ।কবিতা গুলি পড়ার পর যা সব চেয়ে বেশি মনে দাগ কাটে সেটি কবির আন্তর্জাতিকতা,বোধে এবং চর্চায়। নিচের আলোচনায় যথাস্থানে এর উল্লেখ থাকবে। কিন্তু তার আগে বলতে হয় এই বইতে কি নেই।
এই কবিতাসংগ্রহে কোনো ভুমিকা নেই, এমন সংকলনে যা একটা বড় ত্রুটি; এমন কি কবিতার বইগুলির সময়কালও নেই। কবির জীবন থেকে যতটুকু জানি তার ওপর ভিত্তি করে অনুমান করি প্রথম চারটি বইতে রয়েছে সত্তর থেকে আশির (নব্বুইও হতে পারে) দশকে লেখা কবিতা যখন তিনি বাংলাদেশে আর পরবর্তী পাঁচটি (চারটি?) বইয়ের কবিতা তিনি লিখেছেন ইউরোপে প্রবাসকালে।শেষের বইটি,”কেন করে তোল ঢাকাকে একাকী” দেশে ফেরার পরও বের হতে পারে। এমন অনুমান পাঠককেও করে নিতে হবে, যার কোনো দরকার হত না যদি সংকলনে ভুমিকা থাকত।
কবির যে আন্তর্জাতিকতাবোধের উল্লেখ করেছি তার সুচনা দেখা যায় দেশে থাকার সময় লেখা কবিতায় যেখানে নজরুল ইসলামের পাশাপাশি রিল্কে, রেমব্রাঁ, রাফায়েল এসেছেন, কচ-দেবযানীর সঙ্গে দেখা যায় বাগদাদের আবুল হোসেনকে। আর প্রথম পর্বের(প্রথম চারটি বই)কবিতায় কবি আরো একটি কাজ করেছেন যা আমি এর আগে আর কারো কবিতায় দেখি নিঃ, দেশি এবং বিদেশি রেফারেন্স এবং উপমার একসঙ্গে ব্যবহার।এই ভাবে তিনি স্হান এবং কালের সীমানা মুছে দিয়েছেন। একটা দৃষ্টান্তঃ তুমি সেই সুখ, নজরুল দেখেছিল যাকে/কুমিল্লায় বৃষ্টিতে মুখর/তুমি সেই সুখ,রিল্কের বুকের মধ্যে/একদা যে সুখ পুড়ে গিয়ে ফুটেছিল সোনা।
প্রথম পর্বের কবিতায় প্রেম-ভালবাসা আছে অবধারিত ভাবে কিন্তু এর প্রকৃতি প্রচলিত বোধের চেয়ে ভিন্ন,অনেক ব্যাপক।”একটি প্রেমের কবিতা’-য় তিনি লেখেনঃভালবাসা নামে আমাদের যেই দেশ/বাংলাদেশের মানচিত্রের মত/সেই দেশ যেন আমাদেরই দেশ হয়।” তারপর তিনি বলেন,এসো হাত ধরি প্রেমের অধিক গানে/আমাদের গান শষ্যের প্রার্থনা।”
মানবী রুপী প্রেমাষ্পদও কবির আছে যাকে না পাওয়ার বেদনা বিষন্নতা নিয়ে এলেও তিনি অস্থির বেপথু না হয়ে বলেনঃতোমাকে অমর করে রাখি/মনে নয়,শিল্পে/গোলাপ কাঁটায় নয়/যুদ্ধে আর শিল্পে ছিন্ন এ যুগের রিল্কে।” প্রথম পর্ব থেকে দ্বিতীয় পর্বের কবিতায় মাঝে মাঝেই যেমন স্বদেশপ্রেম এসেছে, একই ভাবে স্থান পেয়েছে তার অধরা প্রেমিকা। প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য তার মরিয়া হয়ে ওঠা নেই, আছে প্রশান্তি মাখা বিষন্নতা,যাকে তিনি মনে করেন রিল্কের এলেজি দুয়েনো। তিনি লেখেনঃতুমি যাবে কই? কই যাবে?তুমি ত আমারই/রক্তমাংসে মিশে আছ,বসে আছ স্বপ্নের ভেতরে।” না পাওয়ার ভেতর এই ভাবে পাওয়াটাকে কবি খুব বড় করে দেখেন, তিনি লেখেন অন্য এক কবিতায়ঃ তোমাকে আজ কি উপমায় সাজাই/এলদোরাদো শব্দটা কি মানায়?
জাহিদুল হক মননে প্রবল ভাবে আধুনিক এবংজীবন যাপনে প্রায় সর্বাংশে নাগরিক। গ্রামের সঙ্গে তার যে ক্ষনিকের সম্পর্ক তার অনেকটা জুড়ে রয়েছে আবেগ। ষ্টিমারে নিজ গ্রামে যেতে যেতে তিনি দেখেন “মায়ের মুখের মত আশেপাশে কয়েকটি দুক্ষিত গ্রাম।” গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে “বসতি” শিরোনামে যে কবিতা লিখেছেন সেটি ভাবনার ব্যপকতা এবং ক্ষোভের তীব্রতায় তুলনাহীনঃআমি দেখি কি মলিন এই গ্রাম/যার দিকে ছুটে আসে নির্মম হনন /আসে বন্যা, মাড়ি ও মড়ক, কালে ভদ্রে আমি আসি বিপন্ন শহর থেকে/অকাল বৃষ্টির মত আসে রাজনীতিবিদ-।” গ্রামের দুরবস্থা দেখে কবির আক্ষেপঃতবু কেন যুদ্ধোত্তর এই বাংলাদেশে আমি শুধু ক্রাচে ভর দিয়ে হাটি? এই কি জীবন তবে?”
গ্রাম নিয়ে যে মনস্তাপ নাগরিক কবির,শহরও তার জন্য শান্তি ও স্বস্তির নয়, যার জন্য তিনি লেখেনঃসন্ধ্যা নামল শহরের ছাদে, সন্ধ্যা ত নয়,দুক্ষ-কষ্ট থমকে দাঁড়াল আমাদের মাঝে–।” আরেক কবিতায় তিনি লেখেন, শহর মানে কি মৃত্যু?”(শহর)।অন্য এক কবিতায় তিনি লিখেছেনঃ আমাদের শোকার্ত শহরে সন্ধ্যা নেমে এল আজ” (সমস্ত দুপুর ষ্টেডিয়ামে)।তবু তার প্রিয় শহর ঢাকা যার জন্য আকুতির সঙ্গে তিনি একাধিক কবিতায় লিখেছেন,কেমন আছ আমার ঢাকা?। হতাশ না হয়ে “শোকযাত্রা” কবিতায় তিনি লেখেনঃআমাদের এইখানে নোংরা পুরনো শহর গুলো/মুছে ফেলি তোয়ালে দিয়ে পুনর্বার-।”
প্রথম পর্বের কবিতায়,” বাড়ি” এসেছে বেশ কয়েকবার।এই বাড়ি তার কাছে সুখ-দুক্ষের প্রতীক।দুক্ষের ইট দিয়ে মানুষেরা যেমন বাড়ি তৈরি করে তাতে তার মন সায় দেয় না, তিনি ভাড়াবাড়িতেই থাকতে চান যতদিন না দুক্ষকে অতিক্রম করে যায় সুখ।”সে রকম বাড়ি কই” কবিতায় তিনি লেখেনঃ আমি শুধু টোকা মেরে যাই/বাড়ি খুঁজি, বাড়ি খুঁজি,স্বপ্নের ভেতরে খুব নেমে/গেরিলার মত ছুটে মরি, বাড়ি খুজি পাড়ায় পাড়ায়/গ্রামে গঞ্জে, শহরে বন্দরে,রোমে,লন্ডনে,মস্কোয়–“
প্রথম পর্বের ৪টি ব্ইতে বৃষ্টি আছে দুইটি আর শীত একটি কবিতায় যা থেকে মনে হয় ঋতু এই পর্বে কবিকে তেমন টানেনি। এই তিনটি কবিতাও খুব উল্লেখযোগ্য , তা বলা যাবে না।
প্রথম পর্বের কবিতায় কবির শিল্পনির্মানের কি পরিচয় পায় পাঠক?বেশ পর্যাপ্ত এবং সন্তোষজনক,এ কথা বলা যায়। জাহিদুল হক প্রথম থেকেই কবিতার ছন্দের প্রতি যেমন মনোযোগ দিয়েছেন, কবিতার ভাষা তৈরিতেও তিনি সচেতন হয়ে নতুন উপমা আর ইমেজারি সৃষ্টি করছেন। অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, সব ব্যবহার করলেও মাত্রাবৃত্তই তার পছন্দের বলে মনে হয়।গদ্যকবিতা তিনি প্রায় পরিহার করেই চলেছেন।ছন্দ নির্বাচনে বিষয় কি ভুমিকা পালন করেছে তার ক্ষেত্রে? মনে হয়।
ছন্দে অন্ত্যমিলের জন্য তিনি মাঝে মাঝে এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা শুধু অপ্রচলিত না, বেশ চমকে দেয়ার মত। প্রশ্ন জাগতে পারে এই সব শব্দ কি শুধু অন্ত্যমিলের জন্যই ব্যবহৃত? কয়েকটা দৃষ্টান্ত দেখা যাক।
“ঘুম ভেঙ্গে যায় মধ্যরাত্রে/জেগে উঠে বসি, ভীষন নিস্ব/দেয়ালে কাঁপলো জাঁ পল সার্ত্রে।” এখানে শুধু মিলের জন্যই কি সার্ত্রে কে টেনে আনা?, তার সঙ্গে আগের বাক্যের অর্থ কি সামঞ্জষ্যপুর্ন? একটা ব্যখ্যা হতে পারে যে চরিত্র মাঝরাতে জেগে উঠে নিজেকে নিস্ব ভাবছে তার অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে, যদি এমন মনে করা যায়।তবে অনেক পাঠক এই ব্যখ্যা farfetched বলে মনে করবে।এমন আরো কিছু দৃষ্টান্ত আছে, যা স্থানাভাবে বলা যাচ্ছে না।
প্রথম পর্বের কবিতাগুলিতে খুব বেশি উপমা -উতপ্রেক্ষার ব্যবহার নেই, তবে যা আছে সে সব মনে রাখবার মত। যেমনঃমায়ের মুখের মত দুক্ষিত গ্রাম;দুক্ষ মলিন হয়েছে শালিকের মত; আকাশে শুন্য টবের মত ফুটেছে চাঁদ;চিবুকে তিল নয়,ছোট কালো মাছি; সেই কথা নৃত্য পটিয়সী সুন্দরী কমলার মত নাচে; ইবনে বতুতার মত হেটে হেটে; আজ দিনটাকে খুব তুমি মনে হল; কর্নফুলী পাথরঘাটায় কই -মাছের মত উঠে আসে কানকোয় হেটে,; কাকটিকে মনে হচ্ছে হোমারের কোনো চোখ, আমার তুমুল ইচ্ছে গুলি রুই কাতলের মত তুলে আনো বিমুখ ডাঙ্গায় ইত্যাদি।
প্রথম পর্বের কবিতা সম্ম্বন্ধে বলার পর থামছি, কেননা একসংগে বেশি পড়তে অসুবিধা হবে। আশা করি এরপর বাকি পাঁচটি কবিতার বই নিয়ে নিয়ে আমার সামান্য কথা বলতে পারব। সেই পাঁচটিতে জাহিদুল হকের প্রবাস জীবনের কবিতা রয়েছে আর সেখানে তিনি প্রবল ভাবে আন্তর্জাতিক।

হাসনাত আবদুল হাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *