উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব তেরো

তেরো
‘যদি বলা হয় আপনি একজন প্রথম শ্রেণীর প্রাতরক, লম্পট এবং টাউট; তবে আপনি উত্তরে কি বলবেন?’ আমি প্রথমেই এক টুকরাে মােলায়েম হাসি উপহার দেব, মােলায়েম হাসি বড় ভালাে কাজ দেয়, তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। তারপর সবিনয়ে বলবাে, আপনি বােধহয , নাহ, বােধহয় নয়, বলবাে আপনি অবশ্যই ভুল শুনছেন। দেখুন তো, এইতাে আমি আপনার সামনে বসে আছি, দেখুন দেখি— আপনি আমাকে যেসব বিশেষণে ভূষিত করলেন তার একটিও কি আমার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য? ‘দেখুন, এভাবে বিচার করা বােধহয় ঠিক হবে না। বাইরে থেকে একজনকে কতটুকুই আর বােঝা যায়, বলুন?‘ যায, নিশ্চয় যায়। কেন যাবে না, বলুন? আপনি এক বিচক্ষণ ব্যক্তি। আপনার দৃষ্টি স্বচ্ছ। আপনি নিশ্চয় বাইরে থেকেও প্রকৃত অনুধাবনে সক্ষম হবেন। আপনি আমাকে নরম কথায় ভােলাতে চাচ্ছেন। সােজা এবং প্রচলিত বাংলায় একে তৈলমর্দন বলা হয়। আপনি কি এভাবেই এত উচুতে উঠেছেন?
আপনি একটু ল করলেন মহাশয়। তৈলমর্দনে কি উচুতে ওঠা সম্ভব? আমার। তাে মনে হয় তাতে বরং পিছলে পড়ার সম্ভাবনা।……. তাছাড়া উচুতে ওঠা বলতে আপনি ঠিক কি বােঝাচ্ছেন তা আমার বােধগম্য নয়। আমি এটুকু নিশ্চিত হয়েই লতে পারি, আমার পদযুগল উচুতে নয় বরং এখনাে মাটির সঙ্গেই সংযুক্ত। আপনারও একটা ভুল হয়ে গেল। উচুতে ওঠা বলতে আপনি যদি মই কিংবা বশি। বেয়ে ওঠা বুঝে থাকেন তবে আমি বলতে বাধ্য হব, আপনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাছেন। আমি আপনার এই সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি, এই অফুরন্ত অর্থ ও অন্যান্য। সম্পদ, এ বিষয়ে জানতে চাচ্ছিলাম।’ “ছি ছি, আপনি আমাকে এভাবে অপমান করলেন! কষ্ট পেলাম। দেখুন , আপনি নিশ্চয় জানেন আমি পৈত্রিক-সূত্রেই যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হয়েছিলাম। পৈত্রিক সূত্র বলতে আপনি কি বােঝাতে চাচ্ছেন?” কেন, আপনি কি জানেন না, আমি একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জমিদার বংশের নাকি? জী, তাই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাকে বিশেষ কিছুই করতে হয়নি। আমি পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ সময় এবং পরিবেশ অনুযায়ী ব্যবহার করেছি মাত্র।‘ বাহ, তাতেই এই অবস্থা!” ‘ নিশ্চয়ই। আসলে আপনি কোন খাতে অর্থ বিনিয়ােগ করছেন সে সম্পর্কে আপনার পূর্ব ধারণা থাকলে বিনিয়ােগের পর নিশ্চিত থাকতে পারেন — সে অর্থ দ্বিগুণ কিবা তিন গুণ হয়ে ফিরে আসছে। বেশ বেশ। তবে জনাব, আমার একটা প্রশ্ন— পৈত্রিক সূত্রে আপনি যে ধন সম্পদের মালিক হয়েছেন, অস্বীকার করতে পারেন, তার সঙ্গে মিশে নেই নিরীহ প্রজাকূলের আর্তনাদ এবং কখনাে কখনাে রক্ত? আপনি আবার বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছেন। আমার পূর্ব পুরুষ অত্যন্ত প্রজাবৎসল, দয়ালু, পরােপকারী, ধর্মভীরু এবং সজ্জন ছিলেন, তাছাড়া আপনি যা বলছেন, তা যদি সত্যিও হয়— যদিও সে সম্ভাবনা নেই, আমি জানি— তবু কি পূর্ব পুরুষের কোনাে কৃতকর্মের জন্যে আপনি আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন? এতে কি প্রতীয়মান হয় না যে… ’চুপ, শালা জমিদার-নন্দন। এমন কঠিন বাংলা তােকে কে শিখিয়েছে?’ ’দিলি, দিলি তাে তুই নষ্ট করে’ — সে বিরক্ত হয়ে হাত নাড়ে— ’কি চমৎকার চলছিল। তাের শালা কোনাে রস-কষ নেই।’ আর তুই অ্যা ব্যাড ক্যারেক্টার অল ধু, বড় বেশি কঠিন বাংলা বলছিস আজকাল। সে হাসে— ’শিখছি দোস্ত, শিখছি। বিলিভ মি, জীবনে শেখার শেষ নেই।‘ শেখার শেষ নেই, না? মাই বলস।

’আসলেও নেই’ — সে রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে টাইয়ের নট একটু ঢিলে করে — কিন্তু তুইও কম যাচ্ছিস না। মাইণ্ড ইট, আমার চেয়ে কঠিন বাংলা শব্দের স্টক তাের বেশি হয়ে গেলে আমি ডাষ্টিক কোনাে অ্যাকশন নিতে বাধ্য হব। বুদ্ধিটা আসলে বিডির। হঠাৎ সে একদিন এসে বলে—’ আয়, বাংলা শিখি। এটা একটা খেলা, কঠিন বাংলা শেখা খেলা। ‘কেন, কী দরকার এই অদ্ভুত খেলার’ — সে খুব অবাক। ‘সব কিছুই শিখে রাখা ভালাে দোস্ত। ধর, হঠাৎ একদিন উঠে দেখলাম সব বাংলা হয়ে গেছে। তখন বাংলা শব্দের স্টক কম থাকলে পস্তাতে হবে। আয় শিখে রাখি, আখেরে কাজে দেবে।’ ‘ঠিক ঠিক’ — সে তখনই এ খেলায় রাজী হয়ে যায়। ‘আরেকটা ব্যাপারও আছে বৈকি’ – বিডি কৃত্রিম গম্ভীর গলায় জানায়—‘ ধর, যেভাবে তুই উঠছিস, হঠাৎ তাের ডাক পড়লাে বাংলা কালচারের কোনাে অনুষ্ঠানে সভাপতি হওয়ার, কিংবা মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে কিছু তুই উদ্বোধন করতে গেলি— তখন তাে বায়ান্ন আর একাত্তরের চেতনা নিয়ে তােকে বাংলা বলতেই হবে। সেই থেকে এ খেলাটা চলছে। অবশ্য পূর্ব শর্ত হচ্ছে মন ভালাে থাকতে হবে। আজ তার মন খুব ভালাে। ভালাে না থাকার কারণও নেই কোনাে, সবকিছু স্মৃদলী এগােচ্ছে। আবদুল্লাহ সাঈদ এসেছে দু’দিন হল। এখন পর্যন্ত কোনাে কাজের কথা যদিও হয়নি, তবে আবদুল্লাহ সাঈদ তাদের ওপর খুশি। তাকে এমন একটা ইমপ্রেশন দেয়া গেছে, সে এখন প্রায় হাতের মুঠোয়। এখন অন্য পাটি চেষ্টা করেও তাকে ভাগিয়ে নিতে পারবে না। এর মধ্যে একরাতে সে আবদুল্লাহ সাঈদকে বাসায় ইনভাইট করেছে। বাসায় আনা দরকার, সে জানে, তাতে মেন্টাল অ্যাটাচমেন্টটা ডেভলপ করে। তার বাসা বাদে আবদুল্লাহ সাঈদের বাকী সময় কেটেছে এখানে তার কিছু আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করে। কাজের কথা আজ হবে। কথা আর কি হবে, বরং বলা যায় বিষয়গুলাে আজ ফাইনাল হবে। আবদুল্লাহ জানিয়েছে আজ বারােটা নাগাদ সে আসবে। কথা ফাইনাল হয়ে গেলে কাল সে একটু কক্সৰাজার-রাঙ্গামাটি বেড়াতে কে। ব্যবস্থা অবশ্য সেই করে দেবে। বিডি সব গুছিয়ে রেখেছে। আবদুল্লাহ সাঈদ প্রয়ােজন মনে করলে সঙ্গী হিসেবে একটি মেয়েও নিতে পারবে সঙ্গে। সে ব্যবস্থাও করা আছে। লাল বাতি জ্বলছে তার ঘরের সামনে। অর্থাৎ ভীষণ জরুরী দরকার ছাড়া তাকে এখন বিরক্তি করা যাবে না। পি, এ, কে অবশ্য আবদুল্লাহ সাঈদের কথা বলা আছে। তবে লাল বাতি সে এখন খামােখাই জ্বালিয়েছে। আবদুল্লাহ’র আসার এখনও ঘন্টা খানেক দেরি। আসলে তার ইচ্ছে এ সময়টুকু বিডির সঙ্গে একটু আয়েশ করে কাটানাে। বিডিকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে। তাই দেখে সে একটু ঘাবড়ে যায়— ‘কোথাও কোনাে অসুবিধা?’ বিডি মাথা নাড়ে—’ না, তেমন কিছু নয়। … তাের ব্যাপার না।’ তবে?
‘আমার দোস্ত পাবলিকের কষ্ট সহ্য হয় না’— ‘বিড়ি করুণ গলায় বলে, পর্ণোর। ম্যাগাজিনের এক পাতা তার মুখের দিকে ধরে বলে—’ছেমরীর শরীরটা দেখছােস, আহারে, আমগাে মাতারীরা কেন যে ঢ্যাপসাইয়া যায়।’ হ দোস্তি ’— সেও করুণ গলায় বলে— এইটাও বড় দুঃখের কথা।’ বিডিকে পরমুহূর্তে সিরিয়াস দেখায়— বাদ দে, শােন, চেনা-জানা ট্রেড ইউনিয়নের নেতা আছে?’ ‘সে তাে অনেকই আছে’ — সে অবাক হয়। ’আরে না , সেরকম না, দুই নাম্বার মাল দরকার।…. অবশ্য আমরা যাদের চিনি। তারাও প্রায় সবাই দু-নম্বর মাল।’ ‘তাের দরকারটা কি?’ কাশেম সাহেবের কাজটা করেই দেব ভাবছি। তা, ইণ্ডাষ্ট্রি তার হয়ে গেলে শ্রমিক নেতা সাল্লাই তাে আমাকেই দিতে হবে।‘ তাে তুই মাহফুজকে ধর। ও তাে আমাদেরই লােক। এতবড় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, একটা শ্রমিক নেতা ও সাল্লাই দিতে পারবে না? ‘খবরদার’— বিডি মৃদু ধমকায়— গাজী ফরহাদ আমাদের পুরনাে বন্ধু। সেই সত্তর– একাত্তর সাল থেকে। ও ওর মিলের ট্রেড ইউনিয়ন চালানাের জন্যে শ্রমিক নেতা চাইলাে। মাহফুজকে আসল অবস্থা জানিয়ে দিতে বললাম একজনকে। দিল। কিন্তু ওরে শালা, ছয়-সাত মাস যেতে না যেতেই দেখা গেল ঐ ব্যাটা জেনুইন লােক। পুরাে দস্তুর কাজ করছে শ্রমিকদের স্বার্থেই। সে এক কেলেঙ্কারী। গাজী ফরহাদের তাে মাথায় হাত। আমিও লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না। ‘সে খুক খুক করে হাসে—’ তুই আবার কি মুখ দেখাবি? ‘চুপ শালা’— বিডি একটু রেগেই যায়— গাজী ফরহাদের মিলে তাে শ্রমিক আন্দোলন তুঙ্গে উঠলাে। সে কত চেষ্টা ঐ ব্যাটাকে সরানাের জন্যে, কিন্তু একটাও কাজে দেয় না। শেষে কি ভাবে বাঁচা গেল জানিস? সে মাথা ঝাঁকায়— জানি। গত আন্দোলনে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলাে যখন খুব লােক দেখানাে লড়ছে তখন আবার কিছু লােক সত্যিই লড়তে চাচ্ছিল। এক হরতালে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের খুব লাগলো। ফরহাদ গাজীর মিলের শ্রমিকরাও ছিল অন্যান্য শ্রমিকদের সঙ্গে। তােরা তক্কে তক্কে ছিল। ঐ সুযােগে, হৈচৈ-এর মধ্যে দিলি ঐ শ্রমিক নেতাকে শেষ করে। এই তাে? ‘হ্যা, এই দিলাম। কী শান্তি যে তখন পেয়েছিলাম। বেশ। কিন্তু তাের ঐ সব নেতা-ফেতা আমি খুঁজে দিতে পারবাে না।’ ‘পারবি না জানি। তােকে খামােখাই জিজ্ঞেস করেছি।…. কিন্তু আবদুল্লাহ সাঈদ ব্যাটা আসছে না কেন?’ টিক এ সময়েই এসে পৌছায় আবদুল্লাহ সাঈদ। পি, এ, হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সে তখনই চেয়ার ছেড়ে উঠে দ্রুত দরােজায় ছুটে গিয়ে আবদুল্লাহ সাঈদকে রিসিভ করে। খুব বিনয়ের সঙ্গে হাত মেলায়, কুশল জিজ্ঞেস করে। জানতে চায় কোনাে অসুবিধে হয়েছে কি-না।


আবদুল্লাহ সাঈদ মাথা নাড়ে, বিডিকে দেখিয়ে বলে— ’তিনি থাকলে কোথাও কোনাে অসুবিধের কিছু নেই, সবকিছু সাে স্মথ। বিডি দীত মেলে প্রশংসাটুকু গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে সে ফ্রিজ খুলে বােতল বের করেছে। গ্লাসে ঢালতে গিয়ে আবদুল্লাহর দিকে ফেরে — ‘আপনাকে কয়টা আইস কিউব?’ ‘এখন, এই দুপুর বেলা’ — আতকে ওঠে আবদুল্লাহ — যে গরম।’ বিডি আবার তার দীত মেলে — আমাদের তাে যখন তখন চলে। এখন আপনার অনারে না হয় একবার হােক…… আর এছাড়া কথা কি জমবে? আবদুল্লাহ সাঈদ হাসিটা ফিরিয়ে দেয়— ’অলরাইট। দু’টো কিউব দেবেন আমারটায়। সবার একটি করে সিপ শেষ হলে আবদুল্লাহ বলে —’ এবার তবে কাজের কথায় আসা যাক। আমার আবার আরাে কয়েক জায়গায় যেতে হবে। না, না, নাে বিজনেস। নিতান্তই কিছু ক্লোজ ফ্রেণ্ডের সঙ্গে দেখা করবাে। দে আর ফ্রম মাই কান্ট্রি। আবদুল্লাহ তার দিকে ফেরে, একটু হাসে— ’আপনার সঙ্গে আমার আগেই সব কথা হয়েছে। এখানে এসে, টু বি ফ্রাঙ্ক, কিছু খবর আপনার সম্বন্ধে নিয়েছি। নিতেই হয়, জানেন তো। বুঝলাম আপনি জেনুইন লােক, ….. এবার কাজের কথা। এরপর আর কাজের কথা কি হয়! কিছু কাগজপত্র গুছিয়েই রেখেছে সে। সে গুলাে আবদুল্লাহর দিকে এগিয়ে দেয়। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে আবদুল্লাহ। তারপর মুখ তুলে তাকায়, প্রথমে বিডি তারপর তার দিকে। মুখ অবশ্য বিডিই খােলে— ’বিষয়টা খুব সিম্পল সাঈদ সাহেব। প্রবলেম একটাই— কনসার্ন মিনিস্ট্রিকে দিয়ে একটা নােট লেখাতে হবে, এই তাে? ’আবদুল্লাহ ভু কুঁচকোয় —’ এত ইজি? ’বিডি রুমালে ঘাম মােছে — ‘ইয়েস।…. আপনার আর ওর ব্যাপার। ও আপনার দেশ থেকে কিছু গুডস্ আনবে, আপনি সাপ্লাই দেবেন। আপনাদের দু’জনের জন্যে এটা হচ্ছে আমদানী-রফতানী। সমস্যা হচ্ছে, ও যা আনবে, অর্থাৎ আপনি যা পাঠাবেন তা আমাদের দেশেই তৈরী হচ্ছে এবং কোয়ালিটি বেশ ভালাে… ‘তাহলে? ’তাহলেও একটা ব্যবস্থা হবে। ব্যবস্থা তাে একটা হবেই। যারা এটা ডিল করে তাদের জন্যে মােটা কমিশনের ব্যবস্থা হবে। তারা তখন বলবে, লােকাল জিনিস ইজ নট গুড এনাফ। বলবে, লােকাল কোম্পানীগুলাের কোয়ালিটি কন্ট্রোল করতে মিনিমাম আরাে এক বছর লাগবে। সুতরাং, এই এক বছর বাইরে থেকে প্রয়ােজনীয় গুডস্ আনতেই হবে। অ্যাণ্ড চিয়ার আপ মিষ্টার সাঈদ, সাপ্লাই আপনিই দিচ্ছেন। আবদুল্লাহ সাঈদের মুখ হাসিতে ভরে যায়। বিডি তখন বলে— তা, এক বছর আপনি এদেশের বাজারে থাকতে পারলেই তাে হল। তাই না? আপাতত।’


‘চমৎকার’ — আবদুল্লাহর মুখে হাসি থেকেই গেছে – ‘কি মামেলা হবে না তে। বিড়ি সিগারেট খায় না সচরাচর। এই মুহূর্তে সে একটি ধরায়। শূন্য লের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চোখ ফিল্লিয়ে এনে খুব হেলাফেলায় বলে- ‘ইয়েসস্থল। শুনে চমকৃত হয় আবদুল্লাহ সাঈদ— ’আসলে আপনি এতো সহজে বলছিলেন, শূন্য গ্লাস ভরে নেয় বিডি, হাসেনা, মাইও করিনি। দেখুন সাঈদ সাহেব, কাজটা যত সহজে বলছি তত সহজ কিন্তু নয়। বেন জনসন ১০০ মিটার দৌড়ে ওয়া এ কথাটা শুনতে বা বলতে কোনাে সমস্যা নেই, যুব সহজ-সরল কথা। কিন্তু বেন জনসন নিজে তাে জানে কী গেছে তার। তেমনি সহজে বললেও আমি। আবদুল্লাহ সাঈদ তখনই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, বিডির সঙ্গে হাত মেলায় ‘ব্রাভাে, ব্রাভাে। আপনাকে আমার খুব পছপ হয়েছে । যেখানে যেখানে পয়সা চলতে হয়।‘ বেশ। পরেরটা পরে দেখা যাবে।’ সব? ’রিমেম্বার, হােয়েন আই সে ইয়েস, আই মিন ইট। তাই কেমন যেন লাগছিল। আপনি মাইও করেননি তাে?’ রেকর্ড করেছে। জানি, কী যাবে আমার। তবে বলছি, কাজটা হবে। ঢেলে যাবেন, মানি ইজ নাে প্রবলেম।… আর আপনার জন্যে অবশ্যই ভালাে কমিশন। বিডি মুচকি হেসে গ্লাসে চুমুক দেয় — তা পাঁচ – ছয় হাতকে তাে পয়সা খাওয়াতে হবেই। আর আমার কথা বলছেন? না বললেও চলতাে, কমিশন তাে আমার প্রাপ্যই। শুনে ঠা ঠা করে হাসে আবদুল্লাহ সাঈদ। সে এতক্ষণ পর মুখ খােলে— ‘তাহলে এভরিথিং অলরাইট, মিস্টার সাঈদ?’ ‘ইয়েস, ইয়েস, সবকুছ বিলকুল ঠিক হ্যায়।’ তারা গ্রাসে আবার পানীয় ঢালে।’ তাহলে এবার দ্বিতীয় কন্ট্রাক্টের কথায় আসা যাক। এক চুমুকে গ্লাসটা প্রায় খালি করে আবদুল্লাহ সাঈদ ফেরে — ‘হ্যা, সেকেণ্ড ওয়ান। বলুন, আপনাদের অগ্রগতি কন্দুর?’ অনেক দূর। এখানেও ঝামেলা নেই কোনাে। ‘চালান ঈদের আগেই আমাদের দেশে পৌঁছাবে তাে?‘ পৌছবে, না পৌছনাের তাে কোনাে কারণ দেখি না। আবদুল্লাহ সাঈদ কাঁধ ঝাকায় — ওয়েল। তাহলে আর ঝামেলা কি।…. আপনি ব্লেট। একটু বাড়াতে বলেছেন…।‘ তা তাে বলবােই’ — সে তখনই প্রতিবাদ করে আপনি আমার ঝামেলাটা দেখবেন। এই এতােগুলাে মেয়ে ইণ্ডিয়া হয়ে এতটা পথ যাবে- পথে কত হাতকে পয়সা। খাওয়াতে হবে তা তাে জানেন। হাত তুলে তাকে থামায় আবদুল্লাহ— ঠিক আছে, আপনার রেট আমরা বিবেচনা করবাে। তবে এইটাই শর্ত, ঈদের আগে পৌছাতে হবে চালান পৌছবে। সব তাে গােছানাে প্রায় শেষ।


‘গুড। তবে আসুন আমরা পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করি।’ বােতল থেকে পানীয় ঢালতে গিয়ে আবদুল্লাহ সাঈদ হঠাই থেমে যায়— ‘ইফু ডােন্ট মাইশু, আরেকটা ব্যাপার… আপনারা কি পরবেন?’ ‘বলে ফেলুন। আবদুল্লাহ একটু ইতস্ততঃ করে। আহা, না বললে হবে কি করে?’ আবদুল্লাহ সাঈদ আরেকটা চুমুক দিয়ে নেয়— ‘আমাদের কিছু প্রপার্টি ছিল এখানে। সেভেন্টি-ওয়ানের শেষ দিকে আমাদের রিলেটিভরা সব ফেলে রেখে চলে গেল। এখন সব বেহাত হয়ে গেছে। ঐ প্রপাটি, মানে বাড়ি দু’টো ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন?’ এটা তার বিষয় নয়, বিডির বিষয়। সে চুপ করে থাকে। বিডি মুখ খােলে, একটু অবশ্য ভেবে নেয় সে— ‘কাগজপত্র, ডকুমেন্ট সব আছে?’ আছে।’ বিডি আরেকটা সিগারেট ধরায়— ‘তবে বােধহয় পারা যাবে। অবশ্য বেশ কিছু পয়সা খরচ করতে হবে আপনাকে।’ ‘সে করবাে, সে আমার হেডেক, কত পয়সা লাগবে?’ ‘দেখি খোজ নিয়ে।’ বাড়ি দুটোয় দেখলাম কি সব প্রতিষ্ঠানের সাইনবাের্ড ঝুলছে। জুলুক। নেমে যাবে। ‘কি করে নামাবেন?’ আবদুল্লাহ সাঈদের মুখে হাসি। বিডিও হাসে— ‘সাঈদ সাহেব, বহু কর্তাব্যক্তিকেই তাে প্রতি মাসে মােটা অ্যামাউন্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতি মাসে তাে উপকার চাই না। বছরে দু’বছরে চাই একটা কি দুটো। তাও যদি না করে তবে সারা বছর পয়সা খাওয়াবাে কেন?’ ‘বােঝা যাচ্ছে এটাও আপনি পারবেন।’ পারবাে। বাড়ি দু’টো ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেব। তা আপনি বাড়ি দু’টো বিক্রি করে দেবেন না নিজের হাতেই রাখবেন?’ বিক্রি? ‘নাে নাে আবদুল্লাহ মাথা নাড়ে— বিক্রি কেন করবাে! আমরা বাড়ি দুটো ফেরত চাই। আমরা আসলে এই সয়েল ব্যাক করতে চাই। অর্থাৎ ওখানেও থাকবাে, এখানেও থাকবাে।’ অলরাইট’— বিডি তার গ্লাস আবার ভরে নেয়— ব্যবস্থা করবাে। ‘আপনি একটা জুয়েল’— আবদুল্লাহ মিটিমিটি হাসে। সে এতক্ষণ চুপ ছিল— ‘কাল আপনার কক্সবাজার যাওয়ার প্ল্যান বাদ দিন’ এতক্ষণ পর সে বলে। ‘কেন, কেন?’ সে একটু হাসে— ‘বি মাই গেষ্ট। আমাদের সব কথা যখন ফাইনাল হয়েই গেল তখন একটু স্পেশাল সেলিব্রেশন দরকার, কাল হােল-ডে প্রােগ্রাম—কি বলেন?

Series Navigation<< উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।।পর্ব বারোউপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চৌদ্দ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *