ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব এগার
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব এক
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব তিন
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// নয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// দশ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব এগার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব বার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।।পর্ব -তের
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব চৌদ্দ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব -পনেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব ষোল
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব সাত
পঞ্চপল্লবে আচ্ছাদিত এই গ্রম। আম্র, অশ্বত্থ, বট, পাকুড় আর যজ্ঞডুমুর। এই পঞ্চ বৃক্ষের সবুজ পল্লব। তাছাড়া রয়েছে পঞ্চবটী। অশ্বত্থ বট, বেল, আমলকী আর অশোক বৃক্ষ রচিত অরণ্য। পঞ্চবটী আর পঞ্চপল্লবের সন্তানেরা বিচ্ছিন্ন রঞ্জধারার পুনর্মিলনের উৎসব শেসে যুদ্ধবিজয়ের বাজনার দূরাগত ধ্বনি শুনতে শুনতে পরিত্যক্ত গ্রামে ফিরছে। সঙ্গী হয়েছে বিধর্মী অথচ রক্ত সম্পর্কে জ্ঞাতি ভ্রাতাগণ। কি কি সঙ্গে করে এনেছিল, আর ফেরার সময় কি কি ফেলে যাচ্ছে করতোয়ার বালিময় নির্জন চরে, যাত্রীগণ তা নিয়ে বলাবলি করছে। উলুখাগড়ার ঝুঁপড়ি, মাটির লালভাঙা বসনপত্র, জীর্ণ-ছিন্ন কিছু বসন। আর কি? ক’মাসের গাঙের বিশাল চরার মতোই চিকমিক স্মৃতি। বর্ষা আসলে তখন যদি বন্যা হয় তবে এই চর হারিয়ে যাবে জলের তলায়। বন্যার স্রোত ভাসিয়ে নেবে সব। হয়তো নতুন বালির ঘন জমাট তলায় চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে স্মৃতির সব চিহ্ন। তাই যাত্রিগণ বারবার ফিরে দেখে স্থানটিকে। কারও কারও মনে হয় করতোয়ার এই তীর্থপটে পবিত্রস্নান শেষে পাপ মক্ত হয়ে ওরা ঘরে ফিরছে। ওরা শুদ্ধ শরীরের মানুষ। পাপ শূন্য।
হারানোর বুঝি কিছু নেই। কেননা পঞ্চপিতার দান করা ভূমিতে ফিরছে তারা। তাড়া আছে। প্রবল উত্তেজনা আছে মনে। হঠাৎ তাদের মনে হয় ওই যে সঙ্গী হয়েছে চারজন যুবক, চালের বস্তা মাথায়, তারাই বড় প্রাপ্তি। একটি যুদ্ধ চিরদিনের মতো হারানো অন্ধকার অতীত রক্ত সম্পর্কের সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটিয়ে দিয়েছে তাদের। দুনিয়ায় এমন প্রাপ্তি আর কিসে হয়? নিশ্চয়ই অন্য কিছুতে নয়। এটা ওদের বিশ্বাস।
পথ চলতে চলতে চারজন সঙ্গীর একজন বলে, ‘নিশ্চয়ই আমরা বাবা দরবেশের ইচ্ছায় তোমাদের গ্রাম চেনার জন্য কিছু খাদ্য সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। বাবা দরবেশ কবর থেকে সবই দেখছেন।’
পূর্ণচরণ কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। অদৃশ্য কেউ যেন তার কণ্ঠে বসে বলে দিচ্ছে, ‘তোমাদের বাবা দরবেশ হচ্ছে আমাদের দেবতা শিব, মিথ্যা হলে আমার জিহ্বা পচে যাবে।’
তখন চারজন যুবক সঙ্গীর একজন বিড়বিড় করে রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণ পাঠ করে-
ধর্ম হৈলা যবনরূপী শিরে পরে কাল টুপী
হাতে ধরে ত্রিকচ কামান
ব্রহ্ম হৈলা মুহম্মদ বিষ্ণু হইলা পেগম্বর
মহেশ হইলা বাবা আদম
দেখিয়া চণ্ডি তা কী তেঁই হইল হায়া বিবি।
তখন বিদ্যুতের ঝলক ছড়িয়ে পড়ে যাত্রীদের শরীরে-চেতনায়। তারা সঙ্গী বিধর্মী অথচ আপন রক্তবাহী তার যুবকের মুখের দিকে তাকায়। আচমকা অচেনা একটি ঢেউ আছড়ে পড়ে তাদের উপর। একি অভিন্ন রক্তধারার ঢেউ? সেই ঢেউ ডুবিয়ে দেয় ধর্মের ভেদ। ধর্মে ওরা আলাদা, কিন্তু অভিন্ন জিন আর রক্তধারার অধিকারী। সেই রক্তধারা ফুটন্ত লাল জবাফুলের গাছ হয়ে তাদের চলার রাস্তার দু’ধারে বাতাসে দোল খায়। সেই রক্ত জবা ফুলই চিনিয়ে নিচ্ছে পথ। ঠিক যেমনি ঘরে ফেরার আগের দিন ওরা হারানো বংশধরদের গাঁয়ের পথে হাঁটতে গিয়ে রক্তজবা ফুলে ছাওয়া পথ দেখেছিল। কি ফুল, আর কি ফুল, বাতাসে দুলছে।
সেদিন কি ঘটেছিল ওই গাঁয়ে? বাস্তুহারাগণ ওই গাঁয়ে পৌঁছলে অসময়ে আজানের ধ্বনি পড়ে। সারা গাঁয়ে কোলাহল ওঠে। দুই শতাব্দী পর হারানো বংশধরেরা। ফিরে এসেছে আপন রক্তের ঠিকানায়। কেউ বলে দেয়নি। রমণীগণ আজানের আওয়াজ না-থামতেই উলুধ্বনি দিয়ে ওঠে। আজান এবং উলুধ্বনি একাকার হয়ে যায়।
করতোয়া চরের স্মৃতির ভেতর হাঁটছে মানুষগুলো।। পথ সুগম নয়; বরং দুর্গম। যুদ্ধশেষের দেশ। পথ-ঘাট সাঁকো, খেয়া, রেল, নদীপথ সব লণ্ডভণ্ড। পদতল ভরসা। রাস্তার দু’ধারের গাঁয়ের যুদ্ধ পলাতকেরা ঘরে ফিরেছে। ভিটে পোড়া। এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে নতুন কবর নেই। এ যেনো কবরের দেশ। একটি টিনের চালের আধাখোলা প্রাইমারি স্কুলের পাশে এলেই সন্ধ্যা নামে। কাফেলাটির রাত্রি যাপনের ঠিকানা। কিন্তু ঘরে ফেরার তাড়না বড় অসহ্য।
রাত নামে। চাঁদহীন কাঁই আঁধারের রাত। চিড়ে-মুড়ি সঙ্গের পানীয় যা ছিল তাতেই পথক্লান্ত মানুষগুলোর ভরসা। রাত গভীর হয়। একফালি চাঁদ উঁকি দিয়েই দ্রুত কালো আসমানে হারিয়ে তলিয়ে যায়। এ চাঁদ বড় কৃপণ। দয়া নেই। যুদ্ধশেষের এই কবরের দেশটার প্রতি বুঝি মমতাও নেই। দূর থেকে আচমকা গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। দুরাগত গুলির শব্দ ক্রমেই নিকটবর্তী হতে থাকে। স্কুল ঘরে আশ্রয়প্রার্থীগণ জেগে ওঠে। ওদের চোখে চোখে জোনাকির ঝিলিক। ওরা ভয়ার্ত। যুদ্ধশেষের দেশে পুনরায় যুদ্ধ কেন? ওরা পরস্পর জড়াজড়ি হয়ে দৃষ্টি ফেলে আছে কাঁই-আঁধারের ডোবা সামনের মাঠ আর শূন্য ফসলের ক্ষেতে। ওখানে সশস্ত্র একদল যোদ্ধার ছায়া মূর্তি ছুটাছুটি করছে। গুলি ছুড়ছে। অস্ফুট আর্তনাদের শব্দ। কিন্তু বাতাস মৃদু বইলেও তা ছির শীতল। ছায়ামূর্তিদের দম ফেলার শব্দ বাতাসে ভাসে। বাতাস আরও শীতল হয়ে ওঠে। এবং কালচে ঘন।
আচমকাই গোলাগুলি থেমে যায়। আশ্চর্য এই, ছায়ামূর্তিগুলো পলকেই অদৃশ্য হয়ে যায়। চারদিকে মৃত্যুর স্তব্ধতা নামে। মাটির পতঙ্গদের থেমে থেমে ডাক শোনা যায়। এক সময় তাও থেমে যায়। ভয়ার্তগণের নিদ্রাশূন্য রাত কাটে। রাত পোহালে দূর কাছের মানুষেরা স্কুল ঘরে মানুষের আলামত শুনে ছুটে আসে। ওদের গাঁয়ে যুদ্ধশেষের দেশের দুর্ভিক্ষের ঘ্রাণ। তবু তারা ওই দূরযাত্রীদের জল-মুড়ি খেতে দেয়। রাতে ছায়ামূর্তিদের যুদ্ধের রূপকথা শুনে তারা ফিসফিস স্বরে যা জানায় তার মর্মার্থ হচ্ছে, এক ভয়ংকর যুদ্ধ। তিনমাস পূর্বে এখানে মুক্তিযোদ্ধা আর হানাদারদের যুদ্ধ বেঁধেছিল। দু’পক্ষেরই বহু সৈন্য মারা পড়ে। তারপর থেকেই গ্রামবাসী মাঝেমধ্যে এখানে ভৌতিক যুদ্ধের শব্দ শুনতে পায়। তারা বিশ্বাস করে যেহেতু মৃতগণ জানাজা ছাড়াই গণকবরে প্রবেশ করে যুদ্ধের দু’দিনপর, তাই তাদের প্রেত ছায়ামূর্তি ধরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
তিনদিন তিনরাত ক্রমাগত পায়ে হেঁটে পঞ্চপিতার সন্তানেরা গাঁয়ে সীমানায় পা ফেলে। এরই ভেতর বাস্তুত্যাগীরা যে যার ভিটায় ফিরে এসেছে। বাঁশবনে শব্দ হয়, পুড়ে ফেলা ভিটায় পুনরায় চৌচালা, দু’চালা ঘর ওঠবে। বাঁশ, বেত, শন আর তালপাতার। গৃহনির্মাণ বিদ্যায় মানুষ আর পাখিরা এক হয়ে যায়। নিত্যানন্দ, পূর্ণচরণ আর গিরিশেরা গাঁয়ে ফিলে প্রতিবেশীগণ ছুটে আসে। ভগ্ন শরীর, জীর্ণ বস্ত্র, কংকালের মতো মানুষগুলো গাঁয়ে ফেরার পর অপরাপর কংকালসার মানুষগুলো তাদের চিনতে ভুল করে না। দৃষ্টি আর স্মৃতি তাদের বিভ্রম ঘটায় না।
সবার মুখে রূপকথা। দৈত্য-দানবের গল্প। শ্রোতা নেই, সবাই বক্তা। যে যার দুর্ভোগ আর মৃত্যুর সংবাদ বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। শেষে হারানো মানুষ আর গৃহপালিত পশু-পাখির শোকে হাজাকার করে ওঠে। এ যেনো আরব্যরজনীর গল্প। ফুরাতে চায় না। বুঝা যায় এই দুঃসময়ের স্মৃতি ওরা কোনোকালে ভুলবে না। বংশ পরম্পরায় মনে রাখবে। অথচ যুদ্ধের কথা বললেও আশ্চর্য, স্বাধীনতার কথা বলে না। ক্ষণ মুহূর্তের জন্য ওরা স্বাধীনতাকে ভুলে যায। কেননা দুর্ভোগ, মৃত্যু, গৃহদাহ আর উদ্বাস্তু-যাত্রা মানুষগুলোকে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ আর শব্দের মতো পঞ্চগুণে দগ্ধ করেছে, কিন্তু স্বাধীনতাটা ঠিক ঈশ্বরের মতো, দেখাও যায় না, স্পর্শও করা যায় না। এ যেন স্বপ্নে দেখা সরল সমুদ্রে লুকানো মুক্তো।
মনে হয় বহু শতাব্দী পর মানুষগুলো ঘুমের বিছানায় অচেতন হয়ে পড়ে। এত সুখ নিদ্রা নয়, যেনো মৃত্যুর পূর্বের দীর্ঘ অচেতন-আচ্ছন্নতা। কিন্তু যাদের মৃত্যুর মতো নিদ্রা-আচ্ছন্নতা স্পর্শ করতে পারেনি, তাদের একজন পূর্ণচরণ। হস্তান্তরের দু’জন বৃদ্ধ জেলে দূর গ্রাম থেকে তার অপহƒতা কন্যা মালতিকে নিয়ে হাজির হয়। পিতা চিনতে পারে না কন্যাকে। কন্যাতো নির্বাক-নির্বিকার। মালতির শরীর কংকালসার, চোখ জোড়া বিস্ফারিত, সারা শরীর ময়লায় ছোপছোপ, জীর্ণ শাড়ি। ভয়ংকর বিস্ময় এই, ওর শরীরের সব মাংস এক জায়গায়ই জমাট বেঁধে বিশাল স্তূপ হয়ে আছে। সেই জায়গাটির নাম উদর। গর্ভভূমি। যেন সব কিছুই যাদুবিদ্যার দুনিয়ার বিষয়। জটিল বিষয়।
বৃদ্ধ জেলেরা পূর্ণচন্দ্রকে জানায় তার মেয়েকে তারা ঘাটে বাঁধা জেলে ডিঙির পাঠাতনে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পায়। তার শাড়ি এবং পাটতন ছির রক্তে চটচটা। জ্ঞান ফিরলেই তারা ওকে জেলে পাড়ায় নিয়ে আসে এবং সব বৃত্তান্ত জেনে নেয়। জেলেরা চেষ্টা করেছির যুদ্ধ চলাকালনি মালতিকে পিতার কাছে ফিরিয়ে দিতে। শত বিপদ মাতায় নিয়েও গ্রামে এসেছিল জেলেরা। দেখতে পায় গ্রামশূন্য। তাই যুদ্ধ থেমে যাবার অপেক্ষায় থাকে। অথচ যুদ্ধ থামতে নয়টি মাস কেটে যায়। যেন হাজার বছর।
পিতা চূর্ণচরণের কাছে ঘরে ফেরা আপন ঔরসজাত কন্যা অস্ত্রহাতে উদ্ধত পিতৃঘাতক হয়ে যায়। পূর্ণচরণ মৃত্যু ভয়ে ভীত। ভয়ার্ত গলায় মালতিকে সে নানা প্রশ্ন করে। মেয়ে নির্বাক। জেলেরা জানায় ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দিন যে বিজয় দিবস আসে, সেদিনই এই সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মালতি। কেবর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পিতা পূর্ণচরণ সারা বাড়ি এবং গ্রামে কেবল মৃত্যুর ঘ্রাণ খুঁজে পায়। গর্ভবতী কুমারী কন্যা যে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে জন্মের চিহ্ন নিয়ে তার সামনে দাঁড়াবে, এ ছিল তার বোধ এবং বিশ্বাসের অগম্য। সে একবারই মাত্র আর্তনাদ করতে পেরেছিল, কিন্তু কাঁদতে পারেনি। ঈশ্বর তার চোখের গাঙে এক বিন্দুও জল অবশিষ্ট রাখেনি।