উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব চার

॥ চার ॥

পরদিন ধরিত্রী দাস রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কামানের কথা বলে। কাকেশ্বর তাকে যে বয়ান দিয়েছিল তাই হুবহু বর্ণনা করে গ্রামবাসীদের কাছে। ধরিত্রী দাস একথাও জানায় যে, কাকেশ্বর তার পাপ স্বীকার করেছে। কেননা সে নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি করেছে ক্লাইভের পক্ষে। তার পাপের কারণেই পঞ্চপিতা পরমেশ্বর মানুষকে কেবল দানই করেন না, দুঃখও প্রদান করেন। সেই পাপ আর দুঃখের স্মৃতিচিহ্ন হচ্ছে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কামান। এ হচ্ছে পঞ্চপিতার অক্ষয় কলঙ্ক।

ঝড়-বৃষ্টির ভেতর পলাশির যুদ্ধ শেষ। নবাবের বিরুদ্ধে ক্লাইভের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের যে সৈন্যরা এসেছিল তারা ইংরেজের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ফিরে চলেছে। ক্লাইভ খুশি হয়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে যে পাঁচটি কামান উপহার দেন, সৈন্যরা তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাজবাড়ি। চারটিকে পারলেও একটি কামান কিছুতেই টেনে নিতে পারছিল না। মাঝপথে সেটিকে তারা পরিত্যাগ করে রাজবাড়ি ফিরে যায়। পরদিন রাজা রাজবাড়ির হাতিশালের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটো হাতি পাঠান কামান টেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু শত চেষ্টায়ও হাতিরা একচুলও নড়াতে পারল না কামানটি। এ যে অভিশপ্ত কামান। হতভাগ্য নবাবের রক্তেভেজা।

রাজার পরামর্শে রাজপুরোহিত এসে গণনা করে দেখে কামানটির গায়ে লেপটি আছে নবাবের সেনাপতি মোহনলাল আর মির মর্দানের কলজের অদৃশ্য রক্ত। রাজপুরোহিতের পরামর্শে নর-বলির ব্যবস্থা করেন রাজা। কেননা ইংরেজের কামান রক্ত চায়, তাজা রক্ত। তখন ক্লাইভের হাতে বন্দি নবাবের আহত এক সৈনিককে ক্ষুধিত লৌহের উদ্দ্যেশে বলিদান করে রক্ত ছিটিয়ে দেয়া হয়। তারপর ইংরেজের পলাশি যুদ্ধের স্মৃতিবাহী রক্তপিপাসু কামান গভীর রাতে সাপের মতো হেঁটে রাজবাড়িতে প্রবেশ করে। কিংবদন্তি এই, রাজবাড়িতে ঈশ্বর জ্ঞানে পলাশির কলংকিত কামানটিকে রাজা বরণ করে নেন। গোপাল ভাঁড়কে সাক্ষী রেখে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কামানটির সামনে করজোড় হয়ে মাথা নত করে উচ্চারণ করেন, ‘হে লৌহ দেবতা, তুমি শ্বেতবর্ণ দেবতা ইংরেজের দান, তুমি মহাপবিত্র, তুমিই আমার ঈশ্বর।’

ধরিত্রী দাস এবার খানিক নীরবতা পালন করে। এক সময় ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আজ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নেই, আছে রাজবাড়ি, আছে সেই সব কামান। তোরা কি জানিস, আজও পলাশি যুদ্ধের দিবসগত রাতে নবাবের নিহত সৈন্যদের আত্মা ফিরে আসে সেই কামানের ঠিকানায়। ছায়ামূর্তি ধরে খোঁজে তাদের নবাব সিরাজকে। কলঙ্কিত কামানেরা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। নবাব নেই।

সমবেতদের মধ্যে হাহাকার ওঠে। স্বজনের মৃতদেহ দাহ শেষে শ্মশান থেকে ফেরা শোকাহতদের মতো নীরবে ওরা ঘরে ফেরে। কেননা তারা ভূমিদাস। শস্যভূমিতে মন পড়ে আছে। পঞ্চপিতার সন্তান ওরা। তিনিই তাদের এই সমুদ্রসারি নব্য পালন ভূমি এবং প্রাচীন অচল সুউচ্চ শৈলভূমি বেষ্টিত দেশে জন্ম দিয়েছেন। তিনি অগ্নিভয়, শত্রুভয়, জরা-মৃত্যু ভয়ের ত্রাতা। বংশরক্ষার জন্য তিনি দান করেছেন কন্যাদের। দান করেছেন শস্য ফলনের বিদ্যা। তিনিই জীবনদায়ী অন্নদাতা। কিংবদন্তির রাজন্যবর্গ, সিংহাসন, যুদ্ধ, রক্তপাত এবং ভয়করের রূপকথার যে দুনিয়া, তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে আছে শস্যভূমি আর দিনান্তের পিদিমজ্বলা গৃহকোণের অন্য এক জগৎ। দুটো দুনিয়ার মিশ্রণ তাদের অন্তরে জড়িয়ে আছে নদীর জল আর বৃষ্টির জলের একাকার হয়ে থাকার মতো রহস্যের ভেতর। এ রহস্য বড় জটিল। দুর্লঙ্ঘ্য।

তাই তো ধরিত্রী দাস ঘুমের বিছানায় স্বপ্ন দেখে। পঞ্চপিতা পঞ্চরূপ ধরে ধরিত্রী দাসকে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘পলাশির যুদ্ধ-পলাতকের বংশধরেরা, তোরা ভীরু, দুর্বল। নবাব সিরাজকে রক্ষা করতে পারলি না তোরা। বিনাযুদ্ধে নবাবের বুকের রক্তে ভেজা মাটিতে পা ফেলে রাতের আঁধারে পালিয়ে এলি তোরা। অন্ধকার অমাবস্যার দেবী, মৃত্যুর দেবী কালীর পূজা করে শ্মশান ভূমিতে দাঁড়িয়ে; ভয়জয়ের বর প্রার্থনা কর তোরা। ব্যর্থ হলে মৃত্যু তোদের বংশপরম্পরায় তাড়া করে বেড়াবে।’

পঞ্চপিতার পঞ্চরূপ অন্তর্হিত হলে ঘুম কেটে যায় ধরিত্রী দাসের। হু হু করে কেঁদে ওঠে। নবাব সিরাজের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয় সে। নবাব তাদের ক্ষমা করুন। তখনই তার মনে হয় বাইরের অন্ধকার রাতের বুক ফালা ফালা করে নবাব সিরাজের অশ্বখুরধ্বনি শুনতে পাচ্ছে সে। ধরিত্রী দাস উঠে বসে। দুয়ার খুলে অন্ধকার উঠোনে এসে দাঁড়ায়। বাতাস তার নাকে কি নিহত নবাবের খুনের তাজা রক্তের গন্ধ ছিটিয়ে দিচ্ছে? হঠাৎ সে অনতিদূরে একটি অশ্বের ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। অশ্ব দ্রুত ছুটে যাচ্ছে প্রান্তরের দিকে। ভয়ে তার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। দ্রুত পা ফেলে বিছানায় ফিরে আসে ধরিত্রী দাস। কবরের অন্ধকার গুহার ভেতর থেকে কি নবাব জেগে উঠেছেন? গঙ্গা-ভাগীরথী পেরিয়ে তার হারানো রাজ্যের পদ্মা-মেঘনার তীরে ঘোড়ায় চড়ে তরবারি হাতে ক্লাইভের উদ্দ্যেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন? ওই যে, ওই যে নবাব ঘোড়ার পিঠে। স্পষ্ট দেখছে ধরিত্রী দাস। চাঁদহীন অন্ধকার রাতে একটি আলোর বৃত্ত ঘিরে আছে নবাবের শরীর। সেই অলৌকিক আলোয় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বদন-মুবারক নয়, বরং পৃষ্ঠদেশ দেখতে পায় ধরিত্রী দাস। ওখানে লালবর্ণ বৃত্ত। ওকি সূর্য! নাকি জমাট রক্তচিহ্ন?

আরে একি! নবাবের ঘোড়ার খুর কি দেবে যাচ্ছে নরম মাটিতে? একি কারবালার হোসেনের অশ্বের ভাগ্য! সিমারের অশ্বখুরধ্বনি কি শোনা যাচ্ছে? ক্লাইভের ঘোড়া কি ছুটে আসছে নবাবকে নিশানা করে? নবাব, নবাব, বলে আর্তনাদ করে ওঠে ধরিত্রী দাস। পর মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে সবই তার মতিভ্রম। কেউ কোথাও নেই। কিন্তু ভয় তাকে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে। এখনও অশ্বখুরধ্বনির প্রতিধ্বনি অনুরণিত!

রাত পোহালে ধরিত্রী দাস ছুটে যায় গ্রামে। বর্ণনা করে তার স্বপ্নের কথা। শ্মশান কালীর পূজা না করলে যে ভয় মুক্তি ঘটবে না তা জানায় সে গ্রামবাসীকে। পূজা না হয় হলো, তাই বলে এই ভয়ংকর শ্মশানে? এসে যে দুষ্ট আত্মার বাসভূমি। বাতাসে মৃত্যুর ঘ্রাণ! কখনও কায়া ধরে, কখনও ছায়া হয়ে নরকের লীলা কীর্তন করে তারা। তারপরও মানুষগুলো ভয়কে জয় করতে চায়। শস্যের মাটি আঁকড়ে উবু হয়ে পড়ে থাকা মানুষগুলো শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে চায়। তাদের পূর্ব-পুরুষেরা ভয়ে জড়সড় হয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাতির পিঠে নবাব সিরাজের লাশ প্রতিশোধ আর প্রতিরোধ ভুলে নিরাসক্ত হয়ে দেখতে গিয়ে যে মহাপাপ করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। কিন্তু এই মহাপাপের কি প্রায়শ্চিত্ত হয়?

তাই ঘোর অমাবস্যার রাত দুপুরে লোকালয় শূন্য নির্জন নদী তীরের শ্মশানে জ্বলে উঠে মশাল। ধ্রিম ধ্রিম শব্দে বাজে রুদ্র দেবীর বুক কাঁপানো বাজনা। নিশাচর পাখি আর পশুরা থমকে যায়। অন্ধকারে ওদের জোড়া জোড়া চোখ জ্বল জ্বল করে। বাতাসে ডানার শব্দ। প্রেতভয়ে সাহসী মানুষগুলোও গুটিয়ে যায়। ওরা জানেনা কোন দুঃসময় সমাগত।

মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে প্রেত-প্রেতিনীর শীতল নিঃশ্বাস পড়ে সমবেতদের শরীরে। অনতিদূরে ওরা দেখতে পায় প্রেতনৃত্য। পিশাচী, ডাকিনী, যোগিনীদের ভয়ংকর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে লোলজিহ্বা। রক্তরস ঝরছে টসটস। ভয় তাড়–য়ারা মু- আর চণ্ড নামের ভয়ংকর দৈত্য বিনাশিনী দেবী চামুণ্ডাকে দেখতে পায়। ওরা দেখে পায় খড়গ হাতে আপন মুণ্ড পেছন করে রক্তমাখা মুণ্ড হাতে ছিন্নমস্তা দেবী সামনে দাঁড়িয়ে। ভয়কর অন্ধকার বর্ণের সেই দেবীকে প্রণিপাত করে গ্রামবাসী।

‘হে ভয়করের দেবী, মৃত্যুর দেবী, আখরা ভূমি দাস। গ্রামের শস্যভূমির রাইরের জগৎ আমাদের অচেনা। শস্যভূমি হারাবার ভয়ে আমরা গ্রামান্তরে যাইনি। নবাব সিরাজকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। আমাদের ভয় হরণ কর। লাঙল ধরার হাত আমাদের অস্ত্র ধরার হাতে পরিণত কর। দূর-গ্রামান্তরে যাবার সাহস দান কর। নবাব হত্যার পাপ থেকে মুক্তি দাও তুমি দেবী। নবাবকে পরিত্যাগ করে পলায়নের পাপ মোচন কর।’

তারপর ছাগবলির রক্ত কপালে ধারণ করে গ্রামবাসী রাতের শেষ প্রহরে গ্রামে ফেরে। তাদের বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, এবার নারীদের গর্ভে পঞ্চপিতা এমন বীর যোদ্ধা ক্ষত্রিয় শিশু সন্তান জন্ম দেবেন, যারা ভূমিপুত্রদের ক্লাইভের ইংরেজ জাতির অরাজকতা, উপদ্রবের ক্ষত হতে রক্ষা করবে। নিশ্চয়ই তারা তাদের প্রিয় নবাব হত্যা আর বিদ্রোহী সিপাহীদের খুনের প্রতিশোধ নিতে পারবে। যে ইংরেজ বণিক আর নীলকর লালমুখে বাঁদর ইংরেজ সাহেব নিষ্ঠুর অত্যচার করে, তাদের দেশ ছাড়া করতে পারবে নিশ্চয়ই। এ-নাহলে বৃথাই তাদের পূজা।

দ্বিপ্রহরে নদীঘাটের পঞ্চবটীর ছায়ায় বসে অতীত সময়ের গোলকধাঁধায় ডুব দেয় তারা। চণ্ডরব উচ্চস্বরে বলে, ‘কেন আমরা এই দেশে আগত ইংরেজ, পর্তুগিজ, ফরাসিদের মতো সাতসমুদ্দুর পেরিয়ে পালতোলা জাহাজ নিয়ে বাণিজ্যযাত্রা করতে পারি না? কেন আগুনে-কামান, বন্দুক বানাতে পারি না? ইংরেজগণ পারলে বাঙালি কেন পারবে না?

ধরিত্রী দাস আক্ষেপ করে উত্তর দেয়, ‘আমাদের আত্মা মাটি আর শস্যবীজ দিয়ে তৈরি, মাতা শস্যভূমি বুকে আগলে রেখেছে আমাদের। আমাদের মাটির বন্ধন ছিন্ন হবে না?

‘মাতা শস্যভূমি কি আমাদের তার অন্ধ ভালোবাসার কোল থেকে মুক্তি দেবেন না? দেবী কালী কি ভয় দূর করবেন না? নিশ্চয়ই করবেন। আমরা কি ভয় মুক্তির জন্য ছাগবলির রক্ত কপালে ধারণ করিনি?’ দমনকের এমনি কথায় চমকে ওঠে সবাই।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব তিনধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব পাঁচ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *