উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/ প্রথম পর্ব
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// দ্বিতীয় পর্ব
- উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/পর্ব তিন
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব চার
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব পঞ্চম
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব ছয়
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব সাত
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// পর্ব আট
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব নয়
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব দশ
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব এগারো
- উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব বারো
- উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী// শেষ অধ্যায়
তেজকুনীপাড়ার তিনরুমের এই ফ্ল্যাটটিতে অনেক দিনের বাসিন্দা পার্থ। ফ্ল্যাটের মালিক পার্থের রক্ত সম্পর্কে কেউ না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচয়। সেই সূত্র ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটটিতে উঠে আসে পার্থ। মকবুল সাহেব বিদেশী সওদাগরী অফিসের বড় কর্মকর্তা। দু’সন্তান নিয়ে সংসার। সন্তান দুটো এখানো মাইনর স্টেজে। মকবুল সাহেবের স্ত্রী পার্থের প্রতি মাতৃসুলভ আচরণ করে। পার্থের কাছে মহিলা মাতৃমুগ্ধ। এই সংসারের পরিত্যক্ত এই রুমটিতে বিগত দু’বছর যাবত বাস করছে পার্থ।
মকবুল সাহেব পার্থের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের স্মৃতি লালন করে। তাই পার্থের ব্যাপারে তার অন্যরকম মমতা আছে।
ইতোমধ্যে জুডির কল্যাণে আন্তর্জাতিক মানবকল্যাণ অধিকার সংস্থায় ভলান্টিয়ার হিসেবে চাকরি পেয়ে যায় পার্থ।
ক্রাচে ভর দিয়ে পার্থ অফিসে যায়। এ যেন আরেক জীবন।
একদিন মকবুল সাহেবের স্ত্রী সালমা বেগম বলে, ‘মনিকা এসেছিলো। ওই আয়ারল্যান্ডের মেয়েটি। ভারী সুন্দর মুখ।’
এভাবে আরো অনেকদিন মনিকা পার্থকে সন্ধান করে। পার্থ ইচ্ছে করেই মনিকার মুখোমুখি হতে চায় না। মনিকাকে পার্থ সহ্য করতে পারে না। ওর চোখের দৃষ্টির দিকে তাকালে অজানিত ভয় ওর গা রি রি করতে থাকে। অন্তর জুড়ে শূন্যতা বিরাজ করে।
হতাশায় নুয়ে যায়। বুকের ভেতর এক অবলম্বন ঘুরে বেড়ায়।
হ্যাঁ, পার্থ মনিকাকে ভালোবাসা শোনাতে চায় না। হয় তো বা মনিকা শোনাতে চায়।
পার্থ জুডিকে বলে, ‘জুডি, মনিকা আমার মতো দুঃখী। আমি শুধু ওর ভালোবাসাটুকু ধারণ করতে পারবো। জীবনকে নয়। আমার সে শক্তি কোথায়?’
জুডি বলে, ‘পৃথিবীটা আশ্চর্য রকম জটিল সুন্দর।’
পার্থ বেশ ক’দিন অফিসে যায় না। অফিস থেকে টেলিফোন করলে জানিয়ে দেয় শরীর খারাপ। সারা দিনরাত জানালায় চোখ রেখে এক চিলতে আকাশ দেখে। মধ্য দুপুরে মেঘের কাছাকাছি সোনালি ডানার চিল উড়ে। গাঢ় অন্ধকারে কালপুরুষের চোখ জ্বলে। পার্থ কিছুই মেলাতে পারে না।
‘যুদ্ধ পাখি, যুদ্ধ পাখি তোমার ঘুম ভেঙেছে?’
আচমকা কারো ঝাঁকুনি খেয়ে পার্থের ঘুম ভেঙে যায়। ডিমলাইটের আলোয় পার্থ তাকিয়ে দেখে টিংকু দাঁড়িয়ে।
‘তোমার শরীর খারাপ?’
‘না, টিংকু মনি, এমনি শুয়ে আছি।’
‘আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। আজ কিন্তু যুদ্ধের গল্প বলতে হবে।’
‘অবশ্যই বলবো। কোন গল্পটা তুমি জানতে চাও?’
‘ওই যে তোমার পায়ে গুলি লেগেছিলো, সেই গল্প।’
‘সে গল্পটাতো তুমি অনেকদিন শুনেছো।’
‘আবার শুনবো।’
‘ঠিক আছে, হাত মুখ ধুয়ে আসি, তারপর বলবো।’
পার্থ বাথরুমে ঢুকে যায়। টিংকু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ও রুমে চলে যায়।
পার্থ যখন এ বাসায় আসে তখন টিংকু বেশ ছোট। ভালো করে কথা বলতে পারতো না। চার বছরের টিংকু বেশ বড় হয়েছে। ও ওর বাবার মতো লম্বা হবে।
প্রথম প্রথম পার্থের নাম উচ্চারণ করতে টিংকুর কষ্ট হতো। পার্থই ওকে যুদ্ধপাখি বলে ডাকতে শিখিয়েছে।
বাথরুম থেকে ফিরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় পার্থ। বেশ ঝলমলে রোদ খেলা করছে পাশের সজনে শাখায়। অনেকক্ষণ মুগ্ধ তাকিয়ে থাকে।
আহ্ সত্যি সুন্দর তো।
এটা কী মাস?
নভেম্বর না!
আর ক’দিন পর ঝাঁকিয়ে শীত নামবে।
ক’ তারিখ?
দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায়।
আশ্চর্য! আজ ১৭ নভেম্বর।
মিরাকল।
টিংকু আজ পার্থের গুলিবিদ্ধ হবার গল্প শুনতে চাইলো কেন?
অনেকক্ষণ মৌন কাটলো পার্থের। বেদনাবিদ্ধ দিনটির মুহূর্তগুলো ইতিউতি উঁকি মারতে থাকে। আর পিছনে ফেরা নয়! সময়কে অতিক্রম করার মধ্যে জীবন।
‘তোমার কি শরীর খারাপ?’
‘না বুবু।’
‘এমনি! রেস্ট নিচ্ছি। ওরাও আমাকে করুণা করে কিছু বলে না। সুযোগ নিচ্ছি।’
মকবুল সাহেবের স্ত্রী সালমা বেগমের সঙ্গে কখনোই পার্থ ভালো করে কথা বলতে পারে না। অনাহত পঙ্গু এই মানুষটির প্রতি অযাচিত স্নেহ মমতার কারণে।
পার্থ ভাবে এ দেশে এ রকম খুব কমই ঘটে। কে আর ছোট পরিবারের মধ্যে উটকো ঝামেলা পুষতে চায়।
তারপরও বিগত তিন বছর যাবত তার মাতৃসুলভ আচরণ পার্থকে অপরাধী করে রেখেছে। সম্ভবত মা’র পর সালমা বেগমকেই অন্যরকম মেয়ে মানুষ হিসেবে বুকে লালন করছে।
‘জানেন বুবু আজ ১৭ নভেম্বর। আজ টিংকু আমার যুদ্ধ দিনের গল্প শুনতে চাইলো?’
‘মিরাকল। তোমার ভাই আজকের দিনটি মনে রেখেছে। আমিও! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
‘মনিকা, জুডির সঙ্গে কথা হয় না?’
‘হয়, ওরা খুব ভালো মেয়ে।’
‘মন খারাপ করো না। তোমার ত্যাগের বিনিময়ে এই দেশ। আমার তো খুব গর্ব হয়। টিংকুর বাবা প্রতিনিয়ত তোমার কথা ভাবে। আমিও।’
পার্থ কোনো কথা বলে না। একসময় চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়ায়। সালমা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে রুম ত্যাগ করে।
পার্থের অসম্ভব সুখকর জ্বর হয়।