উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব নয়

কথাটা সালমা বেগম বলেন প্রথম।

‘পার্থ তোমার এখন আলাদা ঘর হওয়া দরকার। তোমার বৃদ্ধা মাকে কাছে আনতো পারো। তোমার জন্য বাড়ি খোঁজা শুরু করে দিয়েছে টিংকুর বাবা। তার ধারণা, যত টানাপোড়েনের মধ্যে কাটবে ততই তুমি দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। আমারও ধারণা তাই।’

পার্থ কথা বলে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ভাবে। সম্ভবত মকবুল ভাই স্বপ্ন দেখেন। বসবাসযোগ্য মানুষের স্বপ্ন। তার দু’সপ্তাহ পর পার্থ চলে আসে মালিবাগের এই দু’রুমের ফ্ল্যাটে।

মালিবাগের এ ফ্ল্যাটটি পার্থের পছন্দ। দোতলায়। জানালা খুললেই লেকের টলমল জল দেখা যায়। ঝিলিকমারা সূর্যের কিরণ চোখ জ্বলসে দেয়। আবার বিকেলের ¯সিগ্ধতায় ভরে থাকে নিরলস মুগ্ধ সন্ধ্যা। মা থাকে এক রুমে। সিঙ্গেল খাট। মা’র কাপড় রাখার জন্য একটা ছোট ওয়ার্ডড্রপ। তার এককোণে রিহেলের উপর নকশাছাপা মা’র জীর্ণ কোরান শরীফ।

অনেক দিনের সঙ্গী এই কোরান শরীফ। পার্থ জন্মের পর থেকে দেখছে ভোরবেলায় সুর করে মা কোরান পড়ছে। খাটের উপর সবসময় জায়নামাজ পাতা থাকে। জায়নামাজের এককোণায় বিয়ের রাতের উপহার বাবার এক ছড়া আতশী তসবিহ। মা সারাক্ষণ বিছানায় থাকে। কত রোগে কষ্ট পায়। মা’র রুম আর বারান্দার প্যাসেসের কোণে রহমত আলী থাকে।

খুব ছোটবেলা থেকে মা’র সাথে আছে রহমত আলী। মা’র প্রতিক্ষণের সহচর। পার্থদের আত্মীয়ই। গ্রামেই মানুষ। লেখাপড়া শেখেনি। পার্থের পরিবারভুক্ত।

সংসারে পার্থের কোনো কাজ নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুম সেরে নাস্তা করে নয়টার মধ্যে অফিসের ট্রান্সপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করে ডিআইটি রোডের মাথায়। নয়টা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই দাঁড়ায় মাইক্রো। ওখান থেকে আরো উঠে শিশুশ্রম বিভাগের যুথি মীরজা।

দুপুরে ক্যান্টিনে খেয়ে নেয়। অফিসের কাজ করে। ইতিউতি নিজকে নিয়ে ভাবে। পাঁচটায় বাসায় ফেরে। মা শাসিত রহমত আলী সংসারের খুটিনাটি কথা বলে।

মা’র প্রতিদিন ঔষধ খাবার টাইমের হিসেব নেয়। অকারণে উৎকণ্ঠার ছাপ ফুটিয়ে তোলে চোখে মুখে।

একদিন সংবাদপত্রে চে’গুয়েভারা সংক্রান্ত নিউজ ছাপা হয়। কীভাবে ফ্যাসিস্ট সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি তল্লাশী করছে। এক সৈন্য এক বাড়িতে ঢুকতে পাচ্ছে না, কারণ দেয়ালে চে’র একটা পোস্টার টানানো আছে।

অদ্ভুত আলোড়িত হয় পার্থ। জুডিকে টেলিফোন করে।

‘জুডি, তুমি চিলির নেরুদার কবিতা পড়েছো?’

‘পড়েছি, ‘একুশটি কবিতা এবং একটি বিষন্ন কোকিল।’ রোমান্টিক। ড্রীমিম্যান। নাজিমের চেয়েও বিশুদ্ধ কবি।’

‘জুডি, আমি কবিতা বুঝি না।’

জুডি বলে, ‘তুমি কবিতা বোঝো বলেই যুদ্ধ করেছো।’

চে’গুয়েভারার উপর নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ তৈরি করে ফেলে জুডির সহযোগিতায়। ছাপা হয় কোনো এক দৈনিকের পাতায়। তার বদৌলতে কিঞ্চিৎ সুনাম জুটে যায়। অফিসের লোকজন অন্য চোখে তাকিয়ে দেখে পার্থকে।

অফিসের ঠিকানায় মনিকা রীভের পাঠানো পার্সেল আসে। পার্থ চমকালো না। ছোট পার্সেল। বেশ গোছানো হাতে লেখা, প্রাপক এবং প্রেরকের নাম। খুলতে সাহস পেলো না ও। বাসায় গিয়ে খুলবে, এ রকম ভাবে। অহেতুক পাড়ধসের শব্দ শোনে। এ জীবনে মনিকার সঙ্গে কোনোদিন দেখা হবে না। ভাবনা ও হৃদয়িক রক্তক্ষরণ ভাবতে শেখায় এ প্যাকেটে মনিকা রীভ নামক আয়ারল্যান্ডের এক মমতাময়ী সংগ্রামী নারীর স্পর্শ আছে। যার নিকট ভাবতে শিখেছে, ব্রহ্মাণ্ডে যাপিত জীবন কেবল স্বপ্নকে নির্মাণ করা। প্রতিনিয়ত নিজেকে চিরে চিরে আবিষ্কার করা। প্রকৃতির সন্তান হিসেবে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। মধ্যদুপুর। ঢাকা শহরে তো আর ঘুঘুর ডাক শোনার উপায় নেই। তবুও হঠাৎ করে নিজকে একাকী মনে হয়। মনোটনাস এ শহর ছেড়ে দূরে কোথায় চলে যেতে ইচ্ছে করে। জন্মের পর গ্রামে বড় হয়েছে। পার্থ যখন ক্লাস নাইনে, হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান বাবা। ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, অনন্তপুর সেক্টরে রক্তাপ্লুত বেদনাবিদ্ধ সময় বাহিত আজকের এ অবস্থা। ভাবতে ভাবতে বেশ আনমনা হয়ে যায় পার্থ।
পিয়ন মাকসুদের ডাকে তন্ময়তা ভাঙে।
‘স্যার, লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে।’
‘ও তাই নাকি? শরীর ভালো লাগছে না। বাসায় চলে যাবো। মবিন স্যার কি আছেন?’
‘জ্বি’।

বাসায় ফিরে ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় পার্থ। ঘুম ভাঙে শেষ বিকেলে। মা না ডাকলে আরো ঘুমাত। এ সময়ে একবারও মনিকার পাঠানো প্যাকেটের কথা মনে হয়নি পার্থের। যেভাবে ব্যাগের ভেতরে রেখেছিল, তেমনি রয়ে গেছে। সারা ঘরময় চোখ বুলোয়। ব্যাগ খুলে প্যাকেট বের করে। প্যাকেট খুলতে গিয়ে অন্যরকম শিহরণ অনুভ‚ত হয়। যার ভাষার সঙ্গে পার্থ পরিচিত নয়।
তারপর একটু সময়।
না, খুব বেশি কিছু পাঠায়নি মনিকা রীভ। তারিখসহ ডায়েরীর পাঁচটি পাতার ফটোকপি। দুটো ফটোগ্রাফ। ডায়েরীর পাতাগুলো কালক্রমিক স্টেপলার দিয়ে আটকানো। মনিকা রীভ কর্ম উপলক্ষে বাংলাদেশে অবস্থানকালীন সময়-বিদায় মিলিয়ে অনুভ‚তিগুলো প্রকাশ পেয়েছে। বৈপ্লবিক একজন নারীর স্বপ্ন-আশা-আকাক্সক্ষার চালচিত্র।
আর ব্যক্তি পার্থ! মনিকা রীভ নামক আয়ারল্যান্ডের এক তরুণীর জন্য বরাদ্দ রেখেছে সম্মানিত অহংকার।
একটি ফটোগ্রাফে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর-এর সঙ্গে মনিকা রীভের ছবি। বঙ্গবন্ধু তিহাত্তরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে তোলা হয়েছিল। সাংবাদিকদের ক্যামেরায়। যা পরদিন দৈনিকের পাতায় প্রকাশ পায়। অন্য ফটোগ্রাফটি ববি স্যান্ডস-এর। আঠাশ বছর বয়সে স্যান্ডনিস্ট গেরিলাদের মুক্তির জন্য অনশনে আত্মাহুতি দিয়েছেন। মানুষের মুক্তির পক্ষে ববি স্যান্ডস একটি সম্মানিত নাম।
পার্থ অনুভব করে, ওর হাত কাঁপছে। বুক দুরু দুরু। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দূরে রামপুরা টিভি সেন্টারের এন্টেনা দেখা যায়। ঈষৎ কুয়াশায় মোড়ানো। বসুন্ধরা প্রজেক্টের বালির উপর গোধূলি বেলার আলোয় মনিকার মুখচ্ছবি আবছায়ার মতো রঙের খেলায় মেতে থাকে।

Series Navigation<< উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// পর্ব আটউপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব দশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *