উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/পর্ব তিন

পার্থ খুব সাধারণ ঘরের ছেলে।
বাবা রেলওয়ের গার্ড সাহেব।
প্রতি দিনরাত্রি ডাউন ট্রেন চলে যাবার শব্দে পুলক লাগার বয়স।
অকারণে চন্দ্রাহত, জেগে থাকার সুখ, ইনসমনিয়ায় কষ্ট পাবার অনুভ‚তি অতিক্রম করার সময়।
ভুল বানানে নীল খামে ভালোবাসার চিরক‚ট আদান-প্রদান, ঘোরলাগা সন্ধার কাছে আত্মসমর্পণের আনন্দ। ভালোবেসে অচম্বিতে বিরহ গণনা।
পার্থের অনেকদিন বিষণœ যাচ্ছে। প্রতিদিন বুকস্টলটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিশেল পত্রিকা পড়ে সময় কাটায়। দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো উত্তপ্ত।
একদিন সকালবেলায় স্টেশনের দেয়ালে একটি পোস্টারে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে পার্থ।
‘জেলের তালা ভাঙবো।
শেখ মুজিবকে আনবো।’
বোধে কিছু কাজ করে না ওর।
শুধু নিজেকে একজন ন্যুনতম মানুষ ভাবতে থাকে।
দেশ, সমাজ নিয়ে যে মিছিল গমন করে, তার সমান বয়সী হয়ে একত্রে হেঁটে যায়। পার্থ প্রতিদিন মিছিল, শ্লোগানে নিমগ্ন হতে থাকে। এইভাবে দিন যায়। রাত যায়।
একদিন ২৫ মার্চ কালোরাত্রির মধ্যে জেগে ওঠা কিশোর অস্ত্র হাতে বাঙ্কার থেকে বাঙ্কারে লাফিয়ে পড়ে। পার্থের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কৃচ্ছতায়পূর্ণ। যথার্থ প্রেমিকের মতো রাইফেলের ট্রিগারে টিপ দেয়। ওর সবকিছুতেই ভালোবাসার সতেজ আমেজ। মানুষের স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেবার আকর্ষণ। এই সরলতাটুকু অনন্তপুর সেক্টরে ওর ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হবার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
আহ! মুক্তিযুদ্ধের সেই অস্থির দিনগুলো বড্ড কষ্টকর। উত্তেজনাপূর্ণ।
সাথী-বন্ধুদের ভালোবাসার মধ্যে শুয়ে থেকে একদিন আবিষ্কার করে, ও সোহরাওয়ার্দী অর্থোপেডিক হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।
ষোলোই ডিসেম্বরের চ‚ড়ান্ত বিজয়ের একজন আহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্থান পায় পার্থ। শেখ মুজিব পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।
তাঁর তড়িৎ সিদ্ধান্তে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য দু’জন বোনস্পেশালিস্ট এনেছিলেন ডা. ডিডম্যানশন এবং ডা. গাস্ট। ওরা এসেছে জার্মানি থেকে।
নিউজিল্যান্ড থেকে সেবিকা হিসেবে এসেছে জুডিএল। আয়ারল্যান্ড থেকে মনিকা রীভ। জুডির বয়স বিশ পেরিয়ে গেছে। কানাই মাস্টারের মতো চশমা পরে। অনন্তকালের মমত্বময় দুটি চোখ নিয়ে পার্থকে আবিষ্কার করে।
একজন কিশোরোত্তীর্ণ পঙ্গু যুবকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে।
যুদ্ধ শেষ হবার তিন মাস পর পার্থের যন্ত্রণা যখন অনেক স্তিমিত। শুধু পঙ্গু জীবন বয়ে বেড়ানো ঈষৎ কষ্টের যন্ত্রণা।
ডাক্তার বলে পা’টা কেটে ফেলে দিতে হতে পারে। অথবা জটিল অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে পার্থ হয় তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
এই সময় জুডি একদিন মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুমি ভালো হয়ে যাবে। তোমার রিপোর্ট পড়লাম। ডা. গাস্টের পক্ষে অত্যন্ত মাইনর অপারেশন।’
‘তোমার মুখে জয় হউক।’ পার্থ স্বাগত কণ্ঠে বলে।
‘তুমি ভালো হয়ে যাবে।’
‘করুণা করছো?’
‘না। আচ্ছা তুমি এতো হাসো কেন? আমাকে দেখলে অকারণে তুমি চোখ লুকিয়ে হাসো।’
‘সত্যি বলি?’
‘বলো।’
‘ছেলেবেলায় রিপিড বইতে লেখা এবং পড়া বেড়ালছানার গল্পে কানাই মাস্টারের মতো চশমা পরো তুমি। তোমাকে দেখলেই কানাই মাস্টার ভাবতে থাকি। আমার হাসি পায়।’
পার্থ ম্লান হাসে।
‘ভালোই তো। মজাদার ব্যাপার।’
‘তুমি কিছু মনে করোনি তো?’
জুডি পার্থের গলায় তেতো ঔষধ ঢেলে দিয়ে বলে, ‘তুমি ভয়ানক ছেলে মানুষের মতো কথা বলো। তুমি অতো ওজনের রাইফেলটি বহন করেছো কেমনে?’
পার্থ কোনো কথা বলে না। ভাবনার অতলান্তে হারিয়ে যায়। যুদ্ধের মধ্যে বেঁচে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও নিজেকে বিলিয়ে দেবার মাঝে আনন্দ আছে, জয়ের আনন্দ। অথবা ঠকে যাবার আনন্দ।
পার্থ সবকিছুই পেতে চায়। একটা রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এতটা প্রত্যাশা পার্থের ন্যায়সম্মত। কষ্টের মাঝেও হাসপাতাল থেকে জুডির সঙ্গে পার্থে অলিখিত নিবিড় আত্মীয়তা আবিষ্কার করে। একজন মানুষের প্রতি দূর নিউজিল্যান্ডের একজন নারী হৃদয় মিশে থাকে।
আর পার্থ আস্তে আস্তে ক্রাচে ভর দিয়ে নিজেকে সুস্থ করে তোলে। পার্থ এখন হাঁটে। উৎফুল্ল যুবকের মতো। জুডির ইস্কাটনের বাসায় যাতায়াত বেড়ে যায়।
জুডি কারণে-অকারণে পার্থকে বলে, ‘তোমাদের সরলতা আর আছে অন্ধ আবেগ। জাতি হিসেবেও তোমরা মহান।’
পার্থ জুডিকে বলে, ‘তুমি জানো না, ভাষার জন্যও আমরা রক্ত দিয়েছি। নরওয়ের পরে আমরাই ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের পর স্বাধীনতার জন্য লড়াই করি।’
‘তোমরা যোদ্ধা হিসেবে বিজয়ী।’ জুডি হেসে বলে।
ওরা দু’জন এইভাবে ইতিউতি কথা বলে রাত ভারি করে তোলে।

কখনো কখনো জুডি পার্থের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। গ্রামের বাড়িতে ওর বৃদ্ধা মাকে দেখে জুডি বলে, ‘জানো পার্থ, তোমার মাকে দেখলে মনে হয়, কোনো অপবিত্রতা তাকে স্পর্শ করেনি। সন্তানকে শরীরে উত্তাপে ধরে রাখতে চায়। যা প্রেমময় একটি পারিবারিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। আহ্। তোমাদের গ্রামের মতো আমাদের গ্রাম এতো সবুজ নয়। সামান্য রুক্ষ। এখানে তোমার মা তোমার জন্য দরোজায় অপেক্ষা করে। বাংলাদেশে চাকরি নেবার আগের মাসে মা’র সঙ্গে বাবার বিচ্ছেদ ঘটেছে। আমার বাবার সাথে মা’র বিবাহিত সম্পর্ক বিশ বছর। এতোদিন পর তারা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস হারায়। বাবা বিয়ে করেছে এক প্রাক্তণ অভিনেত্রীকে। মা প্যারিসে চলে গেছে চিত্রকলা শিখতে। এখান থেকে দেশে গেলে আমার এক ব্যাচেলর বন্ধুর ওখানে উঠতে হবে।’
পার্থের জুডির প্রতি মমতা বেড়ে যায়। একজন দুঃখী মানুষের মলিন মুখ দেখে ক্লান্ত হয়।
‘বাংলাদেশে এসে বাবা-মাকে চিঠি দিয়েছি। বন্ধু এ্যাটকিনশনকে লিখেছি বাবা-মাকে জানানোর জন্য। আমি ভালো আছি। তুমি চিন্তা করো, আমি যাদের রক্ত ধারণ করি, তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। দু’মেরুর বাসিন্দা। তাই তোমার মাকে দেখলে কাতর হয়ে পড়ি।’
জুডির কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠে।
পার্থের ভয়ানক মন খারাপ হয়।
মেয়েটির কষ্টের কাছে নিজেকে সমর্পিত করে।
ভাবে, জুডির মতো কোনো মেয়ের এ রকম দুঃখ থাকতে নেই।

পাথের মা সাদাসিধে বাঙালি। একজন রেলওয়ে কর্মচারীর স্ত্রী। অতোসতো জটিলতা জানতে চায় না। পার্থের বাবা মারা যাবার পর একমাত্র সন্তান পার্থকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।
তাই সাধারণ দুঃখে তার মন কেঁপে ওঠে। তার সঙ্গে জুডির মতোন একজন দুঃখী মেয়ের ভালোবাসা মা বুঝতে পারে।
ভাষা জটিলতার দেয়াল তাদের স্পর্শ করে না। মা এবং জুডির সম্পর্ক অনেকটা আত্মজের মতো। পার্থের মতো পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার জন্য জুডি এক অবলম্বন।
জুডি একজন পঙ্গু সন্তানের মাকে সান্ত্বনা দেয়।

ততোদিনে জুডি বেশ ভালো বাংলা শিখে ফেলেছে। সময়ে অসময়ে মা’র কাছে ছুটে গিয়ে নিজ দেশের গল্প করে।
মা জুডির গল্পের মুগ্ধ শ্রোতা।
পার্থ জুডিকে বলে, ‘আমার মা তোমাকে পছন্দ করেছে। তোমার যে কোনো ব্যাপারে মা’র পক্ষপাত আছে।’
জুডি চশমার আড়ালে দুঃখী চোখটায় সুখের দুলুনি মেরে বলে ওঠে, ‘আমার এখন আর কষ্ট হয় না। পৃথিবীতে সব মা এক রকম। শুধু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আদল পাল্টে যায়।’
এভাবেই পার্থ জুডিকে ধারণ করে বেড়ে উঠতে থাকে।

Series Navigation<< উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// দ্বিতীয় পর্বউপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব চার >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *