ছোটগল্প// কৃষ্ণপক্ষের জোছনা// মোজাম্মেল হক নিয়োগী

রাত গভীর। শহরের বৈদ্যুতিক আলো ছাড়া প্রকৃতির কোনো আলো নেই এখন। দূরের আকাশ থেকে নক্ষত্রের আলো মিটমিট করছে। এই আলো অন্ধকার দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়। নক্ষত্রগুলো নিভছে-জ্বলছে। এদের মধ্যে তেমন কোনো দ্যুতি ছড়ানোর ভাবসাব দেখা যাচ্ছে না। গাছের পাতারা মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে। মৃদুমন্দ বাতাস পাতাদের সঙ্গে আপন মনে খেলে যাচ্ছে। আকাশে কোনো মেঘের চিহ্ন নেই। একদম ঝকঝকে আকাশ। বাসেত যে রুমটিতে আছে সে রুম থেকে আকাশ দেখা যায়। পাঁচতলায় একটি রুম। সেটিও আবার হোটেলটির এক কোণে। এখান থেকে তিন দিক দেখা যায়। উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণ দিকের আকাশ দেখা যায়। শহরের গাছগুলোকে দেখা যায়। গাছগুলো এখন কাকের পালকের মতো অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। সবকিছুই কালো। কিংবা ছাই রঙের মতো হয়ে গেছে। স্বাতন্ত্র্য বলতে কিছু নেই। কাকের পালকের মতো অন্ধকার সব একাকার করে দিয়েছে। অন্য কোনো রং এখন বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জ্বলছে নিরন্তর। এগুলো সারা রাতই জ্বলবে। জ্বলতে এতের কোনো অসুবিধা নেই, কোনো ক্লান্তি নেই। দু-একটি রিকশা এখনো রাস্তায় এলোপাতাড়ি ঘোরাঘুরি করছে। কোনো প্যাসেঞ্জার পাচ্ছে না। হয়তো পাবে, এই আশা তাদের মনে রয়েছে। দু-একজন পথচারীও সাপের মতো পড়ে থাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কারও সঙ্গে কোনো কথা নেই।
বাসেতের রুমের দরজায় টোকা পড়ে। বাসেত দরজা খোলে এবং বিস্ময়াহত হয় মেয়েটিকে দেখে। যে লোকটি তাকে এই রুমে নিয়ে এসেছে সে রুমটিতে কিছুক্ষণ বসল। বাসেত এক পেগ ব্ল্যাক ডগ দিল। লোকটি চুমুক দিয়ে তুলে নিল একবারেই। দ্বিতীয়বার গ্লাসে মুখ দিতে হয়নি। বাসেত জিজ্ঞেস করল, আরও এক পেগ চলবে? লোকটি বলল, আর লাগবে না। আপনারা থাকেন, আমি যাই। আপনার সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
বাসেত যে রুমটিতে উঠেছে সেটি বেশ বড়। বলা যায় এই হোটেলের সবচেয়ে ভালো রুমটিই তাকে দেওয়া হয়েছে। এই রুমটিতে বাসেত প্রায় সময়ই আসে। তার জন্য এই রুমটি স্পেশাল বরাদ্দ। বিরাট রুম। সোফা আছে। এয়ারকনটি অবিশ্রাম হিম ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটু পরেই হয়তো কম্বল গায়ে জড়াতে হবে। এখন স্যান্ডো গেঞ্জি গায়েই চলে যাচ্ছে। তবে মেয়েটির মনে হয় শীত লাগছে। সে বুকের ওপর দুটি হাত জড়িয়ে খাটের ওপর বসে আছে।
বাসেত এক চুমুক গিলে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
মেয়েটি হাসল। নাম দিয়ে আপনার কী হবে? কাস্টমারদের এই একটা অভ্যাস—কাছে আসলে প্রথমেই নাম জানতে চায়। কারণটা কী?
বাসেত হাসে। এই হাসির মধ্যে পাপ আছে। সে বলে, তুমি সারারাত আমার সঙ্গে থাকবে। তাহলে তোমার নাম না জানলে কী বলে ডাকব?
আমরা যারা এই কাজ করি তাদের নামের কি ঠিকঠিকানা আছে? এই নাম ধরে ডাকলে লাভ কি? তার চেয়ে আপনি নিজে একটি নাম দিয়ে ডাকেন—তাতেই চলবে।
রুমের হিম আরও একটু সবল হলো মনে হচ্ছে। মেয়েটি ভাবছে খাট থেকে কম্বলটা গায়ে জড়ালে খারাপ হয় না। কিন্তু ইতস্তত করছে। সে পারছে না। কারণ, আজ রাতের জন্য সে বাসেতের। বাসেতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার তার কোনো অধিকার নেই। এখানে তার ইচ্ছার কোনো মূল্যই নেই। সে বাসেতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশ পুরুষ্ট বাহু দুটি। রোমশ হাত। একটা হাফপ্যান্ট পরা। ঊরুগুলোও শক্ত ও পুরুষ্ট। একজন বলিষ্ঠ পুরুষ।
তোমার নাম কিন্তু জানা হলো না।
আজ রাতের জন্য আমার নাম রুমি। কাল কী হবে জানি না। পরশু কী হবে, তাও জানি না। অন্য দিন কী হবে তাও জানি না। আজ যখন হোটেলে নাম এন্ট্রি করা হয়েছে তখন রুমি নামে এন্ট্রি করা হয়েছে।
তোমার আসল নাম কী?
আমাকে রুমি নামেই ডাকেন। আপনার তো নাম ধরে ডাকারই ইচ্ছা, তাই না?
বাসেত কোনো কথা বলে না। সে কিছুক্ষণ ব্ল্যাক ডগের বোতলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন মেয়ে তো আর দেখিনি। মনে মনে হিসেব করে বাসেত, এই হোটেলে সে কত দিন এসেছে। কিন্তু এমন মেয়ের পাল্লাায় তো আর কোনো দিন তাকে পড়তে হয়নি। বড় বেশি ঘাড়ত্যাড়া মনে হচ্ছে। বাসেত এবার গ্লাসটা মুখে তুলে নিয়ে আর এক চুমুক মুখে ঢালে। উত্তরের জানালাটার দিকে তাকায়। উত্তর দিকটা একেবারে ফাঁকা। কিছু গাছ ছাড়া বাসাটাসা কিছু চোখে পড়ে না। একবার ইচ্ছে হচ্ছিল জানালার একটা কপাট খুলে দেয়। কিন্তু তারপর আবার কী মনে করে সে আর খুলতে চায় না। তবে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ সে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার এসে সোফায় বসে। রুমির মধ্যে সে যেন কী খুঁজে বেড়াচ্ছে। না হয় এমন করে কোনো মেয়েকে সে আর কোনো দিন বসিয়ে রাখে না।
বাসেত একবার বলে, চলবে। মদ ও সিগারেট এই দুটির দিকেই ইঙ্গিত করল।
রুমি বলল, না। এখন না।
‘এখন না’ বলে কি সে অনভ্যাসের বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছে কি না তাও পরিষ্কার নয়। না কি বাসেত যদি জোর করে তাহলে সে নেবে—তাও পরিষ্কার নয়। বাসেত চিন্তা করতে থাকে।
রুমি এবার নড়েচড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পায়ের কাছের কম্বলটা টেনে বুকে জড়িয়ে দেয়। এয়ারকনের হিম তাকে যেন কাঁপিয়ে তুলছে। গায়ের ত্বকে শুষ্কতার ভাব চলে এসেছে। মনে হচ্ছে ত্বক খসখসে হয়ে উঠছে।
বাসেত জানতে চায়, এসিটা কি বন্ধ করে দেব?
না, প্রয়োজন নেই। তবে আপনার খারাপ লাগলে বন্ধ করতে পারেন। আমার ইচ্ছায় তো আর কিছু হবে না।
বাসেত এবার নড়েচড়ে বসে। তাহলে কার ইচ্ছায় হবে?
এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ রাতের জন্য আমি আপনার সেবাদাসী। যা বলবেন তাই আমাকে করতে হবে। এই বিষয়ে তো কোনো সংশয় নেই, তাই না?
বাসেত ভাবে মেয়েটি এত সুন্দর করে কথা বলে কীভাবে? এমন মেয়ে তো আর কোনো সময় দেখিনি। জীবনে অনেক মেয়ের সঙ্গে মিশেছি কিন্তু এমন করে কথা বলার সাহস তো আর কেউ দেখায়নি? ও এভাবে কথা বলছে কেন?
বাইরে মনে হয় শিশির পড়ছে। কিন্তু শিশির পড়ার শব্দ শোনা যায় না। শব্দ হলে ভালো হতো। বাসেত ভাবে বৃষ্টি হলে ভালো হতো। বৃষ্টির শব্দ আর রুমির কথার সুর একাকার হয়ে যেত। শরীর ও মন একাকার হয়ে যেতে পারত। কিন্তু না বৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই।
বাসেত মেয়েটিকে খুব ভালো করে দেখে। মোনালিসার চিবুকের মতো চিবুক। ঝকঝকে সাদা দাঁত। মোনালিসার দাঁত কেমন ছিল? লিওনার্দো যদি দাঁত দেখাত তাহলে হয়তো ভালো হতো। ফর্সা গায়ের রং যেন কাঁঠালচাঁপার পাপড়ি, শরীরের ত্বক কেমন কোমল? সে কি মাখনের মতো হবে? বাসেত আরও এক চুমুক ব্ল্যাকডগ গলার ভেতর ঢেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, এই কাজে কত দিন ধরে?
মেয়েটি এবার উত্তর দেয়নি। সে চুপ থাকে। কিন্তু চোখ দুটি বিস্ফারিত। মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় কিন্তু বলবে না। তার চিবুক এই মুহূর্তে শক্ত মনে হচ্ছে।
বললে না যে?
কী বলব?
এই কাজে কত দিন?
অনেক দিন। সন তারিখ মনে নেই। আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?
করো।
আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি যে কাজের জন্য আমাকে রাতের জন্য ভাড়া করছেন তা করেন? কথা বলার প্রয়োজন কী?
আছে। তোমাকে আজকে ভাড়া করেছি কথা বলার জন্য। অন্য কিছু করার জন্য নয়। সুন্দর করে কথা বলতে পারে এমন নারীদের সঙ্গে আমি কথা বলেই কাটাতে চাই।
রুমি হাসে। আপনি তো আজব মানুষ।
হ্যাঁ। আমি আজব মানুষ।
এই লাইনে কেন এলে?
এবার রুমি যেন আগুনের ফুলকি। সে উঠে বসে। আস্তে আস্তে গায়ের কম্বলটা সরিয়ে নিচে নামিয়ে আনে। বাসেতের সামনের সোফাটায় বসে। তার চোখ দুটি বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে, আপনি কেন এলেন?
বাসেত অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে বলে, আমার চরিত্র ভালো না। নারী আর মদই আমি পৃথিবীর কাছে চাই। এই পৃথিবীতে আমার আর কোনো চাওয়া নেই।
রুমি বলল, নারী আর মদই যদি আপনার চাওয়া হয় তাহলে একটু ভেবে বলুন। যদি আমি বা আমরা এই লাইনে না আসতাম তাহলে নারী কোথায় পেতেন?
বাসেত কথা বলতে পারে না। এক সময় থেমে যায়। তার মুখে কোনো কথা নেই। গ্লাসের সবটুকু মদ মুখের ভেতর ঢেলে দিয়ে রুমির দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ পাথরের মতো স্থির হয় রুমির দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, আমি প্রচুর অবৈধ টাকা রোজগার করি। এই টাকা বৈধভাবে খরচ করার কোনো উপায় নেই। অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। জানো রুমি, যারা অবৈধ টাকা রোজগার করে তারা রাতের গোপন অন্ধকারে অবৈধভাবে নারী আর মদের পেছনে খরচ করে। এ ছাড়া তাদের টাকা খরচের আর দ্বিতীয় কোনো রাস্তা নেই।
বাসেত কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, অবশ্য কোনো কোনো অবৈধ রোজগারি মসজিদ-মন্দির বানিয়ে পরকালের পথ পরিষ্কার করে… আমার সে ধরনের কোনো অভিলাষ নেই। যে কালো পথে টাকা আসে আমি সেই কালো পথেই তা ওড়াই। ফুর্তি করি।
রাত আরও গভীর হয়। বাসেত বোতল থেকে গ্লাসে আরও কিছুটা মদ ঢালে। ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো নিয়ে এসে গ্লাসের ভেতরে টুকরোগুলো ফেলে। রুমি সামনেই বসে আছে। তারপর আবার বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। তোমরা না থাকলে আমাদের মনোরঞ্জন কে করত? এখন রাত অনেক হয়েছে। তুমি যদি ইচ্ছা করো তাহলে ঘুমাতে পারো।
একজন কেনা মেয়েমানুষকে ঘুমানোর জন্য বলছেন? আপনি তো খুব আশ্চর্য। কেন ঘুমাতে বলছেন?
জানি না। তবে তোমার সঙ্গে কোনো খারাপ কাজ করতে আমার ইচ্ছা হচ্ছে না। তোমাকে কেন জানি খুব পবিত্র লাগছে। আমি পবিত্র কোনো কিছুকে অপবিত্র করি না।
মহত্ত্বও আছে আবার দেখছি। রুমির চোখে জল। রুমি বলল, আপনাকে বিকেলে লাউঞ্জে দেখেছিলাম। আপনাকে একজন পুরুষ হিসেবে আমার ভালো লেগেছিল। এখন দেখি আরও ভালো লাগছে। কোনো ক্ষুধার্ত বাঘ কি তার সামনে খাবার পেয়েও ছেড়ে দিতে পারে? আমি যত ভাবছি তত অবাক হচ্ছি।
পারে। অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। বিকেলে তুমি কি বোরকা পরে লাউঞ্জে বসেছিলে?
হ্যাঁ।
তোমার দিকে আমি কয়েকবার তাকিয়েছিলাম। তুমি কি লক্ষ করেছিলে?
হ্যাঁ।
বোরকা পরে এলে কেন? তোমার সঙ্গে যে লোকটি ছিল সে কে?
সে আমার স্বামী। বিবাহিত স্বামী। তাকে আমি বিয়ে করেছি। বোরকাটা আমাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখে। কারণ আমি অভিজাত। সাধারণ না।
তোমার স্বামী তোমাকে নিয়ে এসেছে? তোমার স্বামী এই কাজ করতে দিচ্ছে?
অসুবিধা কোথায়? আপনি কি বিয়ে করেননি? আপনার স্ত্রী নেই?
আছে।
তাকে রেখে যদি আমার কাছে এবং আমার মতো অনেকের কাছে আসতে পারেন তাহলে আমার স্বামী আমাকে নিয়ে আসতেই পারে। আপনার টাকা আছে, আপনি আমাকে কিনতে পারেন। আমার স্বামীর টাকা নেই সে আমাকে বিক্রি করতেই পারে। আপনার টাকা দিয়ে মানুষ কেনেন আর যাদের টাকা নেই তারা বিক্রি হয়। মানুষ তো আর অন্যান্য প্রাণীর মতো নয়। মানুষের নির্ভরতা টাকা। টাকার ওপর ভর করে চলে। টাকা পেলে মানুষ করতে পারে না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই। রুমি স্মিত হাসে।
বাসেত অনেকক্ষণ নীরব থাকে। কোনো কথা বলতে পারে না। মনে হয় তার গলায় সব কথা আটকে যাচ্ছে। তারপর একবার রুমির চোখের দিকে তাকায়। ওর চোখের জ্যোতি অত্যন্ত উজ্জ্বল। চোখে কাজল দিয়েছে। কাজল দিলে মেয়েদের ভালো লাগে। চোখের গভীরতা বেড়ে যায়। চোখের গভীরতা যেন সাগরের গভীরতায় রূপ নেয়। রুমির চোখে আজ বাসেতের হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। বাসেত একবার রুমির চুলের দিকে তাকায়। চুলগুলো কোঁকড়ানো। তবে সারা পিঠ ছড়িয়ে পড়ে আছে অনুভূতিহীন। এসির বাতাসে মাঝে মাঝে চুলগুলো কেঁপে উঠছে। রুমি এবার গায়ের ওড়নাটা টেনে ফেলে দেয়। কিন্তু বাসেত তার বুকের ওপর আর তাকাতে পারছে না। বাসেত আজ অন্যরকম। রুমিকে কেন জানি নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না। ওর মনে হচ্ছে রুমি ওর সামনেই সারা রাত বসে থাক। এভাবেই সুন্দরকে উপভোগ করা যাক। সুন্দরকে দলিত করে উপভোগ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বাসেত একবার জানতে চাইল, তোমার স্বামী কি টাকার জন্যই তোমাকে এই কাজে নামিয়েছে?
নয় তো কি?
তাহলে তুমি তাকে বিয়ে করলে কেন?
আপনাকে যে বিয়ে করেছে সে কি জানে আজ রাত আপনি আমার সঙ্গে কাটাচ্ছেন?
না।
পার্থক্য কিন্তু খুব কিঞ্চিৎ। একজন জেনেশুনে। অন্যজন লুকিয়ে। কিন্তু কাজ একটাই। আপনার মুখোশ আছে। আমারও বোরকা আছে। আবার রাতের অন্ধকারে আপনার মুখোশ নেই এবং আমার বোরকাটাও নেই। আমরা এখন একই সমান্তরালে। আপনার যেমন জৈবিক চাহিদা, আমারও জৈবিক চাহিদা। আপনার চাহিদা যৌনতা আর আমার পেটের খিদে। আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে কপট, আমার স্বামী আমার কাছে অকপট।
কথাটা শুনে ধাক্কা খায় বাসেত—মনে হয় যেন তাকে এমনভাবে ঠেলে নিয়ে দেয়ালে ভীষণ ধাক্কা দিয়েছে। ধাক্কা খেয়ে ওর মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মাথা ঘুরছে। ঘরের সব আসবাবপত্র ঘুরছে। রুমি ঘুরছে সীমাহীন চক্রাকারে। টেবিলের ওপর রাখা ব্ল্যাকডগের বোতলটা ঘুরছে অবিশ্রাম। বাসেত ভাবছে আমাকে সামলে নিতে আর কতক্ষণ লাগবে? ওর চোখ দুটিও ঝিমঝিম করছে। চোখে সবকিছু আবছা দেখছে। একবার রাগে-দুঃখে উত্তরের জানালা খুলে দেয়। উত্তর দিক থেকে দমকা বাতাস রুমটির মধ্যে ঢোকে। দরজাটা খুললেই রুমের গন্ধটা ছিটকে পড়তে পারত বাইরে। কিন্তু রুমের দরজা খোলা নিরাপদ নয়। বাসেতের মগজে হিবিজিবি কী যেন শুধু আকুলিবিকুলি করে। অন্যদিন তো এমন হয় না। তবে আজকে কেন এমন হচ্ছে? অন্যদিন তো তার এমন মনে হতো না—আজকে এমন মনে হচ্ছে কেন? এ কীসের দুর্দমনতা?
রুমির হাতের আঙুলের দিকে তাকায় বাসেত। অনামিকায় একটি স্বর্ণের আংটি। বেশ সুন্দর। আঙুলের রংয়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেছে। পৃথক করার জন্য চাই খুব সূক্ষ্ম চোখ। এত সহজে পৃথক করা সম্ভব নয়।
বাসেত উত্তরের জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলে। অবান্তর কিছু ভাবনা তাকে আরও কাতর করে তোলে। আকাশে এক চিলতে চাঁদ দেখা যায়। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। তা তো অন্ধকার দূর করার জন্য কম নয়। এখন ছাই রংয়ের আঁধারে ঢাকা পৃথিবীর ওপর সোনালি আলোর ছটায় আঁধার কিছুটা ম্লান। জানালা গলে একবার রুমের মধ্যে কিছুটা জোছনা পড়ে। পশ্চিম পাশের দেয়ালে একটা মোটাসোটা টিকটিকি ঘোরাফেরা করছে। সেও খাবাবের অন্বেষণ করছে। সন্ধ্যায় একটা প্রজাপতি এসে ঢুকেছিল রুমে। বাসেত ভেবেছিল হয়তো আজকে কোনো সুখবর পাবে। কিন্তু সে সুখবরটা কী হতে পারে সে বিষয়েও অনেকক্ষণ ভেবেছে। তখন রুমি রুমে আসেনি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সে কোনো সুখবর পায়নি। হঠাৎ প্রজাপতিটা টিকটিকির মুখে পড়ল। টিকটিকির সামর্থ্যরে বাইরে থাকলেও সে এটিকে এমনভাবে মাথা থেকে গ্রাস করেছে যে প্রজাপতির আর ওড়ার ক্ষমতা নেই। বাসেত অনেকক্ষণ টিকটিকিটির দিকে তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে প্রজাপতিটি কীভাবে হারিয়ে গেল টিকটিকির গলায়, তারপর পেটের ভেতরে। এখন টিকটিকিটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। তার ক্ষুধা মিটেছে—হয়তো সে ঘুমুতে গেছে।
রুমি বাসেতের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে সাগরের গভীরতা। বাসেত জিজ্ঞেস করে, তোমাকে আজকে যে টাকা দেওয়া হবে সে টাকা কি তোমার থাকবে, না তোমার স্বামীর হাতে তুলে দেবে?
রুমি কোনো কথা বলেনি। এবার রুমিও উত্তর পাশের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। এক ফালি চাঁদ—কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। স্পষ্ট দেখা যায় না। বাতাসের স্তরে স্তরে আটকে পড়ে আছে জোছনা। পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতে তার অনেক বাধা। কুয়াশা, ধুলোবালি এবং অন্ধকারের বাধায় কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলোকে ম্লান দেখাচ্ছে। তবুও অনেক আগ্রহ নিয়ে রুমি সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
রুমি এক সময় জানালার কাছ থেকে চলে আসে। কামিজটা শরীর থেকে নামিয়ে ফেলে। বাসেত দেখতে পায় ওর শরীরে সাপের মতো কালো কয়েকটি দাগ। বাসেত অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সে আস্তে আস্তে উঠে আসে রুমির কাছে। বাসেত বলল, তোমাকে বিবস্ত্র হতে হবে না। আমি শুধু তোমাকেই দেখব আজ কৃষ্ণপক্ষের জোছনা দেখার মতো। কৃষ্ণপক্ষের জোছনা সবাই দেখতে পারে না। মানুষের চোখ তখন মরে যায়। আমি এখনো মরিনি। আমি দেখতে পারব। রুমির কাছে গিয়ে কামিজটা পরিয়ে দেয় বাসেত। ওর শরীরেও হাত রাখেনি। কোথাও স্পর্শও করেনি। রুমি ম্লান হাসে।
বাসেত সোফায় বসে। গ্লাসে আর একবার চুমুক দেয়। ওর চোখ দুটি লাল হয়ে আসছে। কিন্তু এই লাল চোখেই সে দেখতে পায় রুমির অন্য একটি রূপ—শান্ত সৌম্য মূর্তি। এই মূর্তিতে পাপের কোনো ছায়া নেই। পাপের ছায়া আছে বাসেতের শরীরে। পাপের ছায়া আছে রুমির স্বামীর শরীরে। বাসেত ছায়াদের খুঁজতে থাকে অতলান্তে। এক সময় সে হারিয়ে যায় ভাবনার অতল গভীরে।
রুমি ডাক দেয়। রাত যে শেষ হয়ে এল। আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই চলে যাব। আপনার সাধ মেটাবেন না?
বাসেত বলে, সাধ এবং তৃষ্ণা মেটাচ্ছি। তোমাকে দেখেই আমার সাধ মেটাচ্ছি। আজ রাত শেষ হলেও কাল রাতের জন্য আমি তোমাকে কিনে নেব?
কাল আমার অন্য জায়গায় বায়না করা আছে। আমাকে পাবেন না।
বাসেত এবার স্থির চোখে রুমির দিকে তাকায়। সে যেন কী আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু পারছে না। বাসেতের মাথাটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তাও পারছে না। সে নিজেকে খুব অসহায় ভাবছে। রুমিকে কেন এত ভালো লাগছে। নাকি একবার জিজ্ঞেস করবে এই রুমি কে? কী তার আসল পরিচয়?
বাসেত খুব সাহস করে জিজ্ঞেস করেই বসে, তোমার সত্যিকারের পরিচয়টা কি বলবে না?
তার আর প্রয়োজন নেই। এখন আমি আস্তাকুঁড়ের মানুষ। মানুষ আমাকে কিনে নেয়—চেটেপুটে খায়। তাদের আনন্দ শেষ হওয়ার পর লাথি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। এই আমার পরিচয়। রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখনই হয়তো আজান পড়বে। তারপর আমি চলে যাব। আমাকে কিন্তু আটকাতে পারবেন না। আপনার কৃষ্ণপক্ষের জোছনা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
তোমার পাওনাটা বুঝে নাও। বাসেত উঠে আসে। বিছানার পাশেই ড্রেসিং টেবিল। তার ওপরে ব্রিফকেসটা রাখা ছিল। বাসেত ব্রিফকেস খুলে টাকাগুলো দেখায়। সে ব্রিফকেসটা নিতে রুমিকে বলে। রুমি উত্তর দেয়—আমার পাওনাটুকুই আমি নেব। এর বেশি এক কড়িও না।
তুমি না চাও তোমার খিদে মেটাতে। তাহলে নেবে না কেন?
আমি আমার পাওনার বাইরে কিছুই নিই না। আপনি আমার পাওনা টাকা দিলেই আমি চলে যাব।
বাসেত উপায়হীন। বাসেত বলে, এই রাতে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। তার একটা পবিত্র চিহ্ন তোমার কাছে রাখতে চাই। তোমার ডান হাতটা দাও।
রুমি ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়। বাসেত ডান হাতে চুমু খেয়ে হাতের দিকে তাকায়। তারপর তার শরীর ক্রমে ঘামতে থাকে। রুমি তুমি কি হারিয়ে যাওয়া আমাদের আসমা? এই যে তোমার হাতে দা দিয়ে কুপ দিয়েছিলাম। তখন এমন একটি দাগ তোমার হাতে ছিল। তুমি ছোট মামার মেয়ে আসমা! এবার বাসেত রুমিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ে। সত্যি করে বলো, তুমি কি সেই ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া আমাদের আসমা কি না?

সকাল হয়ে গেছে। দরজায় টোকা পড়ে। রুমি আস্তে আস্তে পাওনা টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

২ thoughts on “ছোটগল্প// কৃষ্ণপক্ষের জোছনা// মোজাম্মেল হক নিয়োগী

  • জুন ৫, ২০২০ at ৭:৫৭ অপরাহ্ণ
    Permalink

    খুব ভাল লাগল।
    গল্পের উপস্থাপনা খুবই চমকপ্রদ।
    ভাষা ঝকঝকে। শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত যুতসই। মনোযোগ ধরে রাখার উপযোগী।
    পরিনতিতে প্রয়োজনীয় অতৃপ্তি ও নতুন জিজ্ঞাসার উৎপত্তিতে সৃষ্ট আকর্ষণ বেশ সফল করেছে গল্পটাকে।

    Reply
  • জুন ১৭, ২০২০ at ৬:০৪ অপরাহ্ণ
    Permalink

    Kub valo laglo galpo but old history ………………..

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *