উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব সাত

বিছানায় শুয়ে শুয়ে পার্থ আজকাল আকাশের বিচ্ছিন্ন মেঘরাজির সঙ্গে স্মৃতির এক্কাদোক্কা খেলায় মেতে থাকে। জিততে জিততে হেরে যায়। হারতে হারতে জিতে যায়। বর্ণিল ব্রহ্মাণ্ডের সহকারি সেলুলয়েড দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হতে থাকে।

এতো দ্রুত সবকিছু ঘটে কেন? এতো ছোট জীবন! বাবা-মা মুক্তিযুদ্ধ, এই জীবন! আশ্চর্য!

বেশ উচ্চকণ্ঠে দু’বার টিংকুকে ডাকে পার্থ। কোনো সাড়া না পেয়ে ভাবে, ওরা বাইরে গেছে। আজ শুক্রবার না। মকবুল ভাই সন্তান নিয়ে নগর দর্শনে বেরিয়েছেন।

বেশ কিছু সময় পার্থ নিজের মধ্যে বিরাজ করলো। স্তব্ধ নিঃসঙ্গতার মধ্যে বসবাস করেও একা মনে হলো না। বরঞ্চ জীবনকে আবিষ্কার করার সুতীব্র ইচ্ছেগুলো বেঁচে রইলো। পার্থ নিজেই বুঝতে পারলো না জীবনকে কীভাবে আবিষ্কার করতে হয়। কোথায় তার দুর্বিনিত পথের সন্ধান? তারও অনেকক্ষণ পর দরোজায় টোকা পরে।

‘তোমার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘সন্ধান কী ছিলো?’
‘আমি তোমার খোঁজ করছি।’ মনিকা বেশ উজ্জ্বল করে হেসে ওঠে।
‘সত্যি, মনিকা আমার শরীর খারাপ ছিলো।’
‘আজকের দিনে তোমার জন্য গিফট।’

গিফট বক্সের ভেতর একটি রক্তগোলাপ দেখতে পায় পার্থ।
পার্থ অবাক হয়। মনিকা আজকের দিনের কথা জানলো কী করে! অলৌকিক তো!’

‘বড্ড সুখ পেলাম মনিকা? তোমার কল্যাণ হোক।’
পার্থ কথা বলতে পারে না।

অসম্ভব নীরবতার মধ্যে মনিকা বলে, ‘পার্থ আমি চলে যাচ্ছি। ডাবলিন। খুব বেশিদিন এ দেশে থাকতে পারবো না। বড় জোড় দু’হপ্তা।’

পার্থ কথা বলে না। অবাক! মনিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘পার্থ, আমার আয়ারল্যান্ডের মতো করে এদেশটিকে আবিষ্কার করতে চেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিব এবং তোমার মধ্য দিয়ে। নিজকে আবিষ্কার করতে পারিনি। শুধু কিছু কষ্ট লালন করছি!’ মনিকা বেশ আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে কথা বলে।

‘মনিকা, আমি তোমার এবং জুডির প্রতি কৃতজ্ঞ। মৃত্যুর গহ্বর থেকে জীবনে ফেরা একজন মানুষের প্রতি তোমাদের প্রেম-মমতায় জীবন নির্মাণে ব্রত হয়েছি। একজন নারীকে আমার জানা হয় নাই। একজন নারীর উষ্ণতার কোনো দিনরাত্রি আমার বেড়ে ওঠেনি। হ্যাঁ তুমি মনিকা। তুমি একজন। আমার স্বপ্নিল, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।’

‘এভাবে কথা বলছো কেন! আমি তো তোমাকে ভুলতে চাই না। আমার অনেক কাজ পার্থ। আয়ারল্যান্ডে স্যান্ডনিস্টরা যুদ্ধ করছে। তাদের আমার প্রয়োজন। তোমরা তো স্বাধীনতার মতো একটি মহৎ কর্মকে সম্পন্ন করতে পেড়েছো। আমরা তাও অতিক্রম করতে পারিনি। স্বাধীনতা বড়ো মধুরতম জিনিস পার্থ।’

পার্থ মনিকাকে একজন সহযোদ্ধা মনে করে। যে বাঙ্কারের বসে গ্রেনেডের ক্লিপ খুলতে সাহায্য করছে।
রুমের ভেতর অতলস্পর্শী নিঃশব্দতা। হৃদপিণ্ডের টুকটুক শব্দ অনেক সময় বিরামহীন বেজে যাচ্ছে। কেউ জানে না।

মনিকা রীভ জানে। বঙ্গদেশ থেকে সুদূর আয়ারল্যান্ডের উনিশের মমতাময়ী দীপ্ত রমণী তার প্রচণ্ড প্রেম, এবং বয়সের সহজাত প্রকৃতিকে অস্বীকার করে বেড়ে ওঠা একজন নারী জানে।

পার্থের মগ্নচৈতন্য জুড়ে একজন প্রার্থিত রমণী। ভালোবাসায়, কষ্টে, কামে মনিকা অলৌকিক মানবী। পার্থের অনুভূত হয় ১৭ নভেম্বর অনন্তপুর সেক্টরে রক্তাক্ত বাঙ্কারে শুয়ে আছে। চারপাশে গুলি ফোটার শব্দ।

আহ্! কাতরোক্তি করে পার্থ।

ইতোমধ্যে কিচেনে গিয়ে দু’কাপ কফি করে নিয়ে আসে মনিকা। এ বাসার সবকিছুই মনিকা-জুডি জানে। পরিচিত সংসারের মতো।

‘তোমার কফিতে চিনি দেবো কতোটুকু?’
‘আমি বেশি চিনি খাই না।’
কফির কাপ থেকে গরম ধোঁয়া ওড়ে।
সারারুম জুড়ে পোড়া পোড়া গন্ধ।

মনিকা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘তোমার মতো মানুষ আমি দেখিনি।’
‘আমিও তোমার মতো নারী দেখিনি।’

পার্থ মনিকার হাত স্পর্শ করে। মনিকাকে খুব উদ্বেল দেখায়। আইরিশ সাদাটে চোখে মনিকাকে আবিষ্কার করতে চায় পার্থ। ভালোবাসায় আবিষ্কার করতে চায়। মনিকা চুম্বনে চুম্বনে পার্থের মুখ ভরে দেয়। কোনো কথা বলে না ওরা। অন্তর্লীন চখাচখির মতো মুগ্ধতায় ডুবে থাকে।

‘তুমি আমাকে মনে রাখবে পার্থ?’
‘রাখবো! এ জীবনে যতটা সম্ভব।’
‘ডাবলিনে ফিরে তোমার মতো মানুষ খুঁজে বেড়াবো!’

Series Navigation<< উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব ছয়উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// পর্ব আট >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *