উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব এগারো

জুডি বলল, ‘সিঙ্গাপুরে কি এর আগে কখনও এসেছো?’
‘না। কখনও আসা হয়নি। কানেকটিং ফ্ল্যাইট না থাকলে হয়তো আসাই হতো না। অথবা এ জনমে তোমার সঙ্গে দেখা হতো না। কী অবাক কান্ড!’
‘আমি এবার নিয়ে তিনবার এলাম। বিয়ের পর হানিমুন করতে এসেছিলাম। মাঝখানে একবার। আর আজ।’
‘তুমি কেমন আছো জুডি?’
‘ভালো! এক অর্থে ভালো। আমার জন্য জীবনের নিয়ম উল্টো। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় হৃদয়ের মূল্য বেশি নয়, কিন্তু এ্যাটকিনশন হৃদয়বান। খুব বড় কোনো সমস্যা হয়নি। বলা যায়, আমা ব্যতীত এ্যাটকিনশনের ভুবন অন্ধকার। খুব বেশি সরল। তোমাদের মতো।
‘আমার খুব ভালো লাগছে জুডি। তোমাকে যেন কষ্ট স্পর্শ করতে না পারে।’
‘তোমার সন্তান-বউ! আহ্। মা মারা গেছে। আমার প্রচুর কষ্ট হয়েছিল। মনিকার কাছে প্রথম শুনেছিলাম। ও আমাকে টেলিফোন করে জানিয়েছিল। চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকলে, এ্যাটকিনশন বিস্মিত কণ্ঠে বলে, ‘জুডি কি করে সম্ভব! দূর দেশের এক বৃদ্ধা মাতার জন্য তোমার এ বিলাপ! আমি কাউকে এ রকম কাঁদতে দেখিনি।’
আমি ওকে বলেছিলাম, ‘পার্থের মাকে তুমি দেখনি, দেখলে আমার মতোন বেদনায় জর্জরিত হতে। ওরকম মাতৃমুগ্ধ মুখ জীবনে আর কখনো দেখিনি।’
‘রিনি এ পঙ্গুত্ব মেনে নিয়েই আমাকে বিয়ে করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে ওর পরিবারের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কন্যা মিমিকে নিয়েই আমাদের জগত-সংসার। তোমাদের বদৌলতে যে চাকরি জুটেছিল তা আজ ফুলে ফেপে সংস্থার বৈদেশিক সেমিনারে যোগ দেবার যোগ্যতা অর্জন করেছি। শুরুতেই শিক্ষাটা শেষ করে নিয়েছিলাম। তাও মনিকার অবদানই বেশি। প্রতিনিয়ত ওর তাগিদ আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেছে।’
‘পার্থ তুমি তো সিঙ্গাপুরে প্রথম এলে, তোমাকে সিটি ঘুরিয়ে দেখাই।’
‘আমার সবকিছুই বিস্ময়। এত বিন্যস্ত শহর। আমরা চিন্তাই করতে পারি না।’
ইতোমধ্যে দু’বার জুডির মেয়ে বলল, ‘ম্যাম, পাপা আসবে কবে?’
জুডি বলল, ‘শিগগির আসবে। যন্ত্রণা করো না। তোমার আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলতে দাও।’
জুডি গাইডের মতো বলে যাচ্ছে, দর্শনীয় জায়গার নাম, স্থান, ঐতিহাসিক মূল্য, নৃ-তত্ত্বগত বৃত্তান্ত, বর্তমান বাণিজ্যিক ভ্যালুসহ ইত্যাকার বিষয়-আশয়।
কানাই মাস্টারের মতো ‘পড় মোর বেড়াল ছানাটি।’
প্যাগাডা রোডে আসতেই জুডি বলে, ‘সমুদ্রের পাড়ের ওই রেস্তোরাঁয় বসি। ভালো লাগবে। তাতশিও বিরক্ত করবে না। এ্যাটকিনশনের পদবী ‘পেকাউড।’ ওর নাম রেখেছি তাতশি পেকাউড। তাতশি ওর পাপাকেই বেশি ভালোবাসে।’
টেক্সির বিল মিটিয়ে জুডি পার্থের হাত চেপে ধরে। জুডিকে তখন খুব সাধারণ মেয়ের মতো দেখায়। জুডির প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে যায়।
পার্থ জুডিকে অনুসরণ করে। দুপুর এখন পৌনে দু’টো বাজে। লাঞ্চ আওয়ার। হোটেলে ভিড় লেগে আছে। জুডি এসবে অভ্যস্ত। কীভাবে কী করতে হয়, ওর জানা। সমুদ্র সংলগ্ন শেষ প্রান্তে একটি টেবিল দখল করে ওয়েটারকে ডাকল। ওরা মা-ঝিয়ে মিলে এক ধরনের খাবার অর্ডার দেয়। তাতশির জন্য লাচ্ছি টাইপের তরল খাবার। আর পার্থের দিকে মেনু বুক এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘পার্থ তোমার পছন্দ মতোন খাবার খুঁজে নাও।’
পার্থ মেনু বুকে আঁচড় কাটে। খুব সিম্পল অর্ডার দেয়। রুটি আর চিকেন। জুডি বিস্ময় প্রকাশ করে। ওয়েটার চলে যেতেই তাতশি বলে, ‘যুদ্ধপাখি।’
পার্থ চমকে ওঠে। কষ্টের দিনগুলোতে মকবুল ভাইয়ের মেয়ে টিংকুমণি যুদ্ধপাখি নামে ডাকতো। পার্থ জুডির দিকে তাকায়।
জুডি বলে, ‘তাতশি একটি মাত্র বাংলা শব্দ জানে। আমি ওকে শিখিয়েছি। ও গ্রহণ করেছে। ওকে বলেছি, তোমার এ আঙ্কেল যুদ্ধপাখি। ও বলে, ‘ডানা কই?’
আমি বলেছি, ‘কামানের গুলি লেগে উড়ে গেছে। ও তোমাকে ভয় পাচ্ছে।’
পার্থ তাতশিকে চুমু খায়। জড়িয়ে ধরে আদর করে। কন্যা মিমির কথা মনে পড়ে। রিনি খুব আশ্চর্য হবে!
‘ও পার্থ, তোমার মা’র হাতে তৈরি পাটিসাপটা পিঠার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। মনিকা, যতবার টেলিফোন করবে ততবার বলবে।’
‘রিনিও খুব মজা করে ওই পিঠা বানায়। ঠিক মা’র মতো।’
‘পার্থ, মনিকার খুব জানার ইচ্ছে, তোমার বউ কেমন আদর করে তোমাকে। তোমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে না। আচ্ছা, আজ আমার কেন জানি মনে হয়, মনিকা তোমার প্রেমে পড়েছিল। তুমি ওকে বিয়ে করলেই পারতে।’
‘কিন্তু জুডি, মনিকার ধারণা তুমিই আমার জন্য কাঙাল ছিলে।’
‘আমি তোমাদের মতো না, মনিকা তোমার মতো। ওর হৃদয়ে উত্তাপ আছে।’
‘জুডি, আমি তো তোমাদের নিয়ে বাড়তি কিছু ভাবিনি। ছেলেবেলায় মাছরাঙ্গার পেছনে ঘুরে ফিরে যে জীবন, যৌবনের প্রথম প্রান্তে যুদ্ধক্ষেত্রের নির্মমতা আমাকে এমন এক দিগন্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, তা কেবল করুণার। আর সেখানেই তোমাকে-মনিকাকে আবিষ্কার করি। অতো ভেবে দেখিনি। তবে মনিকা আমাকে পুরুষ বানিয়েছে। নইলে কবে কোন দূর পাড়াগাঁয়ের আহত মুক্তিযোদ্ধার ক্রাচে ভর দেয়া যে জীবন, তাকেই বরণ করে নিত। জানা হতো না কোনো কিছু, দেখা হতো না ভুবনের সহস্র দায়ভার।
ওয়েটার খাবার নিয়ে আসে। জুডি তাতশিকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
পার্থ সমুদ্রের দিকে তাকায়। দূরে সাগরের বুক ঘেঁষে কিছু গাংচিল ওড়াউড়ি করছে। দুপুরের রোদে ডানায় প্রতিফলন হচ্ছে বর্ণিল কারুকাজ।
হঠাৎ করে পার্থের মনে হলো, ‘এ জীবন দোয়েলের ফডিংয়ের…। অথবা বরাট ফ্রস্টের কবিতা ‘কাজল গভীর বন, বড়োই মধুর লাগে, এখন আমার ঢের কাজ আছে বাকি, চলে যেতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে, চলে যেতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে…।’
‘কী তুমিতো খাবার শুরুই করলে না।’
পার্থ লজ্জিত হয়।
জুডি বলে, ‘চল হোটেলে ফিরি। তাতশিকে ঘুম পাড়াতে হবে। তোমার ফ্লাইট তো আগামীকাল সকাল দশটায়। এ সময়টুকু তুমি আমার অতিথি।’
ওর যুদ্ধক্ষত তেতিয়ে ওঠে। ও জুডির মুখের দিকে অবাক তাকিয়ে থাকে।
জুডি বলে, ‘পার্থ, আমি আরো চৌদ্দ দিন এ শহরে থাকবো। এ্যাটকিনশনকে নিয়ে ছুটির সময়গুলো কাটাতে চাই। আর আমরা এভাবে প্ল্যান করেই এসেছি। কোনো সমস্যা নেই। শুধু বাড়তি পাওনা দীর্ঘসময় পর তোমার সঙ্গে দেখা হলো। এ্যাটকিনশন থাকলে খুশি হতো। তুমি নিয়তি বিশ্বাস করো?’
‘করি। আবার করি না।’
‘ধন্যবাদ। আমিও।’

হোটেলে ফিরে তাতশিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তাতশিও দ্রুত তন্দ্রার কোলে আশ্রয় গ্রহণ করে। ইন্টারকমে জুডি দু’টো বিয়ারের ওয়ার্ডার দেয়। রুমের মিঠে আলোতে তাতশির মুখ দেবশিশুর মতোন মনে হয়। ঠিক যেন সুবর্ণতলী গ্রামের ফাতেমা ফুপুর বড় মেয়ে রাহেলা বুজির তিন বছর বয়সী শিশু কন্যার আদল। কোনো পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। একই মুখ। ঘোরের মধ্যে বিচরণ করে পার্থ। জীবনের সংজ্ঞা খুঁজতে যায়।
প্রতিটি অনুভ‚তি স্পর্শ করে। পাল্টায় না। প্রবহমান স্রোতধারা অনাদি অতীত থেকে ধেয়ে আসছে। শেষ নেই। ধ্বংসের মধ্যে থেকে জন্ম নেয় অযুত ঢেউয়ের কল্লোল। প্রকৃতির এ বিধানকে মেনে নেয় পার্থ।
তন্ময়তা ভাঙে জুডির ডাকে। বাথরুম থেকে পরিপাটি হয়ে বের হয় জুডি। সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সতেজ করে তুলেছে।
‘তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও। সন্ধে নাগাদ বাইরে বের হবো। রাতের সিঙ্গাপুর নগরী আরো বাহারী।’
বাথরুম থেকে ফিরে পার্থ দেখে ওয়েটার টেবিলে বিয়ার রেখে গেছে।
জুডি মুচকি হেসে বলে, ‘তোমাদের তো আবার ভিন্ন নিয়ম। অন্যরকম ব্যাপার-স্যাপার।’
‘ঠিক আছে। অল রাইট। আমি কোনো কিছুকেই বাড়াবাড়ি হিসেবে নেই না। সবকিছুকেই মেনে নিয়েছি।’
জুডি বিয়ারে চুমুক দেয়। হালকা পারফিউমের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। উনিশ তলা থেকে দূরতম সমুদ্রগামী জাহাজের মাস্তুল দেখা যায়। শেষ বিকেলের সূর্যের মাতামাতি। বুকের ভেতর উদাস করে তোলে। আজকে রিনিকে জানাতে হবে, ‘জুডিকে আমি পেয়েছি।’
কানাই মাস্টার চশমার আড়ালে যেটুকু মানুষ, তার নাম ভালোবাস। মমতার নারী। ইতোমধ্যে জুডি ওর পারিবারিক এ্যালবাম মেলে ধরে পার্থের সামনে। মি. এ্যাটকিনশনের একটি পোট্রেট। খুবই উজ্জ্বল পুরুষ এ্যাটকিনশন। পার্থের মনে ধরলো। অমন উন্নত নাসার পুরুষ ক’জন হয়। জুডি ভাগ্যবান। এ রকম রূপবান পুরুষরা কিছুটা হলেও বোকা হয়। এ্যাটকিনশন মেরিনের মানুষ। সমুদ্র উত্তাল দেখেছে। সমুদ্র বশীকরণ মন্ত্র তার জানা।
তবে জুডিই ভালো বলেছে, ‘ও হৃদয়বান।’
জুডি-এ্যাটকিনশনের ফটোগ্রাফ এক সহজ দম্পতির প্রতিমূর্তি। পার্থ মুগ্ধতা নিয়ে জুডির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমাকে দেখলে রিনি হিংসা করবে।’
‘তুমি কি বিশ্বাস করো, নিজস্ব পুরুষে ক্ষেত্রে নারীরা নির্মম স্বার্থপর হয়। এক্ষেত্রে আমার-রিনির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
‘আমি মাকে দেখেছি, বাবাকে মনে করতেন ঈশ্বর। বাবাও তাকে সে সম্মানটুকু দিয়েছেন। আর রিনি! আমার যে জীবন, আমাকে পোষমানা টিয়ের মতোন লালন করে। কাজেই আমার এ নির্মমতার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেনি।’
একদিন মনিকা টেলিফোনে বলে, ‘জুডি আমার মেয়ের চেহারার মধ্যে পার্থের ছায়া আছে। আমি খুব হেসে বলেছিলাম, তুমি পার্থকে নিয়ে ভাবো। জর্জ কী বলে? ও কি তোমাকে পরকীয়ার চরিত্রে ফেলে দিয়েছে। আসলে এগুলো সাইক্লোজিক্যাল প্রতিক্রিয়া, আত্মার আকাক্সক্ষা প্রকাশ পায়।’
‘আমি তো মনিকাকে মনে রেখেছি। এ জীবনে যতটুকু রাখা যায়।’
জুডি হা হা করে হাসতে থাকে।
একটু লজ্জিত কণ্ঠে বলে, ‘তাহলে সত্যি তোমরা প্রেমে পড়েছিলে!’
‘আসলে তাও না। কী রকম যেন একটি সম্পর্কের সেতুতে জড়িয়ে গেলাম। বরঞ্চ এটাই অপার আনন্দের। আমরা পরস্পরকে সম্মান করতে শিখেছি।’
‘মনিকা তোমাকে সম্মান করে।’
‘জানি।’
এক সময় গভীর মৌনতায় ডুবে যায়। সন্ধ্যা নামে সিঙ্গাপুরের আলোকসম্ভার নিয়ে। শুধু হোটেলের এ রুমের একজন, অনন্তকাল হেঁটে এলো জীবনের অলিগলি। মৌনতা ভেঙে তাতশি জেগে উঠলো। ওকে সামলাতে ব্যস্ত জুডি। তাতশিকে প্রস্তুত করে নিজেকেও পরিপাটি করে তোলে।
‘পার্থ রাতের সিঙ্গাপুর তোমাদের ঢাকার মতো নয়। এরা অনেক জীবন্ত, কোলাহল মুখর, বর্ণাঢ্য।’
টেক্সী অনেক দূরে পিকাভেলী স্কোয়ারে এসে থামে। অনেক নির্জন জায়গা। অন্যান্য রেস্টুরেন্টগুলোর মতো ডাস্মিজিকের হুল্লোড় নেই। জানালার কাঁচের সমুদ্রে জলের ফোঁটা এসে আঘাত করে।
সারা হোটেল জুড়ে সুনসান নীরবতা। জানালা খুললেই সমুদ্র সঙ্গীতের মাতম শোনা যায়।
‘হানিমুন করতে এসে আমি আর এ্যাটকিনশন এখানে বসেছিলাম। দারুণ ভালো লেগেছিল জায়গাটা। যেন হাত বাড়ালেই সাগর ছোঁয়া যায়।’
‘তোমার চোখে বর্তমান চশমা সুন্দর মানিয়েছে। ওই সময়ের চশমায় সত্যি সত্যি কানাই মাস্টারের মতোন লাগতো।’
‘বয়স বেড়ে যাওয়ায় তোমার চেহারায় পৌরুষ ফুটে উঠেছে। এসেছে ব্যক্তিত্বের ছাপ। চেহারায় অন্য রকম সজীবতা।’
জুডি পার্থের হাতে চুমু খায়। ঈষৎ নীলাভ আলোয় পার্থ জুডির চোখের তারায় স্থির তাকিয়ে থাকে।
তাতশি বলেই চলছে, ‘যুদ্ধপাখি, যুদ্ধপাখি।’
তাতশি এখন অনেক সহজ। টুকটুক করে এ টেবিল ও টেবিল করছে। মাঝের টেবিলে বসা এক ভারতীয় দম্পতি তাতশিকে নিয়ে মজা করল কয়েকবার। পার্থের সঙ্গে কতক্ষণ খুনশুটি করে ক্লান্ত হয়ে ভিটাকোলা খাচ্ছে। পার্থের শিশুর কথা মনে পড়ছে। শিশুর বয়স ছয়। ও প্রতিদিন সকাল বেলা পেছনে স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে ওর মা’র সাথে স্কুলের পথে হেঁটে যায়।
রাতের ডিনার জুডির মেনুতে শেষ করতে হবে। তাছাড়া পার্থের খাবার কালচার জুডি-মনিকা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানে। কোনো সমস্যা হবার কথা নয়।
ওয়েটার টেবিলে খাবার রাখতেই জুডি বলল, তাড়াতাড়ি রাতের খাবার সেরে নিলাম। কাল সকালে তোমার ফ্লাইট। আচ্ছা পার্থ তুমি কি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সী’র সেই বুড়োর মানসিক শক্তি ধারণ করো?’
‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে, পরাজিত নয়।’
‘ধারণ করি। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন ছুটে গিয়েছিলাম, তখন কৈশোরিক দুরন্ততায় বহমান, আর মাতৃভ‚মির প্রতি সরল বিশ্বাস। সময় সময় এমন এক দিগন্তে এসে দাঁড়াই, তখন দুই ভুবনের দুই নারী মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য শক্তি যোগায়।’
‘পার্থ, তুমি সব সময় বেশি বলো।’
‘আমি যা অনুভব করি তাই বলি। সত্যকে চিরকাল স্বীকার করে নিতে হয়।’
জুডি জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সমুদ্রের বুকে অসংখ্য বাতি জ্বলছে। যা রাতের পৃথিবীকে অন্যরকম করে তুলেছে। যেন তারার দেশে স্বাপ্নিক ভ্রমণ।
‘আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে দ্বিধায় ভুগছি। শুধু ভাবছি প্রশ্নটা একজন যোদ্ধাকে করা ঠিক হবে কিনা। অথচ বিগত অনেক বছর এ প্রশ্ন আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে।’
ঠিক এ সময় তাতশি বলে ওঠে, ম্যাম, আমি হিসি করবো।’
তড়িৎ জুডি তাতশিকে নিয়ে টয়লেটের দিকে ছুটে যায়। আর তখন পার্থ বুকের ভেতর পাড়ধসের শব্দ শোনে। অযাচিত প্রশ্ন উঠে আসে, ‘জুডিকে জীবনের সব কথা বলা হয়ে গেছে। জুডি আর কী জানতে চায়।’
জানালা খুলে বাইরে মুখ করে দাঁড়ায়। সমুদ্রের মাতম শোনে। বুকের ভেতর বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে। যে ভাবে ভূখণ্ডের জন্য পার্থের মতো অসংখ্য দামাল ছেলে জীবন তুচ্ছ করে স্টেনগানের ট্রিগার টিপে ধরেছিলো।
‘সব ঠিক আছে পার্থ, কোনো সমস্যা হয়নি।’
পার্থ তাতশির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘যুদ্ধপাখি। অল রাইট!’
‘অল রাইট।’
‘থ্যাঙ্কস।’
‘এ্যাটকিনশন থাকলে এ ঝামেলাগুলো সামলাতো। এসব কারণে তাতশির বাবার প্রতি পক্ষপাত বেশি।’
‘আমার মিমিও এ আচরণ করে। এজন্য রিনির দুঃখের অন্ত নেই।’ পার্থ শব্দ করে হাসে।
বিয়ারের ক্যান-এ চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘প্রশ্নটা করতে আমারও কষ্ট হচ্ছে পার্থ।’
পার্থ আবার পাড়ধসের শব্দ শোনে।
‘তোমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেললে কেন? যে মানুষ তোমাদের দিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম একখন্ড জমিন, একটি নিজস্ব পতাকা। সত্যি ইটস এ মিস্টেরিয়াস ইভেন্ট। আই কান্ট বিলিভ ইট।’
বেশ কিছুক্ষণ শব্দহীন থাকে ওরা। পার্থ কথা বলে না। শুধু তাতশি পার্থ এবং জুডির সঙ্গে টুকটাক খুনশুটি করে। ওদিকে মন যায় পার্থের। যেন এ আশঙ্কা করছিল। জুডি কি শেখ মুজিবকে ভুলে গেছে?
আসলে জুডিকে কিছু বলা হয় না। অথবা পার্থ বলার ইচ্ছে হারাতে থাকে। মাথার রগগুলো দাপাদাপি করতে থাকে। কোথায় যেন এক অসীম শূন্যতা কষ্ট দিতে থাকে। সত্যি তো! জুডির এ রকম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যায় না। লজ্জা, ভয়, আতঙ্ক চারপাশের পরিবেশকে গুমোট করে তোলে।
আর তার মধ্যে তাতশি বলছে, এটা করো সেটা করো। পার্থ অনেকক্ষণ মৌন থাকে। কিছু বলা হয় না ওর।

’১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর ডাবলিন থেকে মনিকা টেলিফোনে অঝোর কান্নার মধ্যে দিয়ে সংবাদ জানায়। ও ছেলে মানুষের মতো কাঁদতে থাকে। আমাকে প্রচন্ড কষ্টবিদ্ধ করে। চোখের জলে সময় অতিবাহিত করেছি। ‘আচ্ছা পার্থ, এমন একজন মানুষ হত্যা করা যায়?’
পার্থের যুদ্ধক্ষত তেতিয়ে ওঠে। পার্থও শিশুর মতো কাঁদতে থাকে।
তাতশি বলে, ‘ম্যাম, যুদ্ধপাখি কাঁদছে কেন?’
জুডি কোনো কথা বলে না। বেশ কিছু সময় ওরা কথা বলে না। সুনশান নীরবতা। এক সময় জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে জলের রেখা চিকচিক করে ওঠে।
‘সেনাবাহিনী এ রকম সাহস পায় কী করে? একজন গণপ্রতিনিধি হত্যা করে দিব্যি মাফ পেয়ে যায়। আর যে দেশের মানুষ তার নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। আজ তাদের মধ্যে কোনো প্রতিরোধের চেতনা কাজ করেনি। সত্যি তোমরা সব পারো।’
জুডি তাতশিকে সামলাতে ব্যস্ত থাকে।
তাতশি বলে, ‘ম্যাম, যুদ্ধপাখি কাঁদছিল কেন?’
‘জুডি বলে, ‘ও তুমি বুঝবে না ডারলিং। তুমি শান্ত হয়ে বসে থাকো। বি কোয়াইট।’
পার্থ অপরাধীর মতো তাকিয়ে বলে, ‘জুডি তুমি আমাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছো, কিন্তু এ প্রশ্ন তো আমার। তারপর একটি কথা বলি, বঙ্গবন্ধুর মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয় দ্বারা চালিত হতেন বেশি। আর এ রকম মানুষেরা হৃদয়বান হয়ে জন্ম নেয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এসে, যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিলেন। হয়ত তিনি আর রক্তপাত চাননি, কিন্তু সাপের ধর্ম ছোবল দেয়া। পরবর্তীতে ওরা এবং বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য মিলে তার হত্যাকে ত্বরান্বিত করেছে। দুর্ভাগ্য।’
পার্থ সমুদ্রের দিকে চোখ রেখে বলে।
‘তুমি খুব সরলভাবে বিষয়টি দেখেছো, কিন্তু ঘটনা তো তা নয়। জাতির পিতা হত্যাকারী এবং তাদের দোসররা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। একটি জাতি এত দ্রæত বদলাতে পারে না!’ জুডির কণ্ঠে অভিযোগের পাহাড় গজিয়ে ওঠে।
‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ প্রশ্নটা আমারও। তিন হাজার বছর বাঙালি ইতিহাসে কখনও ঘটেনি, ঘটবেও না।’
‘কী ট্রাজিক?’ জুডি আঁতকে ওঠে।
‘মাম, মাম কার্টুন দেখবো।’ তাতশি ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকে।
জুডি দ্রুত হোটেলের বিল মিটিয়ে তাতশির হাত ধরে হোটেল থেকে বের হয়।
‘পার্থ তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমারও বিশ্রাম নেয়া দরকার। আগামীকাল তো তোমার ফ্লাইট।’
অনেকক্ষণ পরিবেশ গুমোট থাকে। ট্যাক্সি চলে সিঙ্গাপুরের আলোকজ্জ্বল নগরীর বুক চিরে। কেউ কথা বলে না। এমন কি তাতশিও না।
‘জুডি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, এ জনমে কী আর আমাদের দেখা হবে?’
পার্থ ম্লান কণ্ঠে বলে, ‘হতে পারে, এ রকম ভাবে।’
‘তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’
‘তোমরাও। ভালো থেকো।’
অরচার্ড রোডের ‘মীরামার’ হোটেলের সামনে জুডি পার্থকে উগড়ে দিয়ে রাতের সিঙ্গাপুরে হারিয়ে যায়।
পার্থ একবার ভাবে, ভালোই হলো! এ জীবন দোয়েলের ফড়িংয়ের…।

Series Navigation<< উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব দশউপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব বারো >>

One thought on “উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব এগারো

  • জুলাই ১১, ২০২০ at ৭:৪৫ অপরাহ্ণ
    Permalink

    চমৎকার একটি উপন‍্যাস। জাতির পিতাকে নিয়ে হৃদয় নাড়ানো লেখা। একই সাথে উপন‍্যাস এবং বর্হি বিশ্বের বৈচিত্র্য।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *