ধারাবাহিক উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/ প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/ প্রথম পর্ব
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// দ্বিতীয় পর্ব
- উপন্যাস/কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে/আলমগীর রেজা চৌধুরী/পর্ব তিন
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব চার
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব পঞ্চম
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব ছয়
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব সাত
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী// পর্ব আট
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে//আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব নয়
- উপন্যাস//কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী//পর্ব দশ
- উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব এগারো
- উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব বারো
- উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী// শেষ অধ্যায়
বিমান আকাশে উড়াল দেবার পর পার্থের প্রথমে মনে হয়, বছর দুই আগে পোল্যান্ডের একটি যাত্রীবাহী বিমান টেকঅফ করার সঙ্গে সঙ্গেই ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। পাইলটের যথাসাধ্য চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শহর ছেড়ে এক পাইন বনের ভিতরে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। এতে দু’শ চুরাশিজন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। বিমানের উদ্ধারকৃত ব্ল্যাকবক্সের সর্বশেষ কথা ছিলো, ‘হে পৃথিবী বিদায়।’
পৃথিবীর প্রতি চালকের এ মমত্ববোধ অনেকদিন অযাচিত পার্থকে কষ্ট দিয়েছে। সূত্র এক ধরনের বেদনায় বুক টন টন করত।
কেন?
এর উত্তর পার্থ খুঁজে পায়নি।
এই পৃথিবীতে অনেক রকম ঘটনা ঘটে। যা মর্মান্তিক, কষ্টকর। মানব কল্যাণের জন্য অসহনীয়।
তাকে তো পার্থ মনে রাখেনি!
অথচ হতভাগ্য চালকের প্রতি পার্থের পক্ষপাত নিয়ে অনেক হেসেছে। বন্ধু-বান্ধবের তুখোড় আড্ডায় বিষয়টিকে কাব্যের যন্ত্রণা হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছে।
পার্থ কখনো দূর পোল্যান্ডের যাত্রীবাহী বিমানচালকের উক্তিকে শেষ আর্তি হিসেবে মেনে নেয়নি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতি মানুষের এক রকম কাতরতা আছে। হয়তো মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর মানুষ শেষ অশ্রু ফেলে পৃথিবীর বুকে তার শেষ চিহ্নটুকু রেখে যায়। চোখের জলের মধ্যে নিহিত থাকে তার মমত্ববোধ। হয়তো চালকের প্রকাশ করার ছিলো। সংবাদ মাধ্যমের জন্য পৃথিবীর অগণন মানুষ বিষয়টি জেনেছে। কেউ কেউ মনে রেখেছে।
অধিকাংশ মানুষ মনে রাখেনি।
জগত-সংসারের নিয়ম।
বিমানের জানালা দিয়ে নিচে জমাট নীলাকাশের দিকে চেয়ে এই ঘটনা কেনই বা মনে পড়লো পার্থের! ঈষৎ কষ্ট দিতে থাকে।
বিমান ভ্রমণের রোমান্টিকতা উবে গিয়ে সমস্ত পরিবেশটা বিবমিষায় পরিণত হয়। আবার পাখার সঙ্গে মেঘের আঘাতে ছিটকে পড়া বরফের চূর্ণের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ওই চূর্ণটিকে আমি আর কখনো দেখবো না।
পার্থ একবার ভাবে।
ঘর ছেড়ে এলে এরকম হয়। নিজস্ব পরিচিত পরিবেশ না হলে মানুষ একাকী হয়ে যায়। মাত্র একমাস।
দেশ, আপনজন, স্ত্রী, কন্যা, বাসার গলির মোড়ে পরিচিত মুদি দোকানীর সাথে দেখা হবে না।
এ বড় কষ্টের ব্যাপার।
বিমানবন্দরে শেষ বিদায় বেলায় স্ত্রী রিনির অশ্রুভেজা চোখ, কন্যা মিমির গভীর ক্রন্দন, এতোক্ষণ মনে হয়নি কেন? হৃদপিণ্ড আরেকবার ছলকে উঠে পার্থের। এক ধরনের ক্রন্দন বুকের ভেতর তোলপাড় করতে থাকে।
দূর বিমান যাত্রা।
ঢাকা-সিঙ্গাপুর-সিউল।
পরীর মতোন সুন্দরী বিমানবালাদের মধুর সহাস্যময় সময়ের মধ্য দিয়ে বিয়ারের ক্যান নিয়ে নিজের মধ্যে ফিরে আসে পার্থ। ও কিছুই মনে করতে চায় না। ও এখন মুক্ত বলাকা। বিমান যেন উড়ন্ত বলাকা। যার অধিশ্বর পার্থ একা। ভাসমান বিমানের মৃদু ঝাঁকুনির সঙ্গে বিয়ারের ক্রিয়ায় তন্দ্রালুতা অনুভূত হয় পার্থের।
জানালা দিয়ে বাইরে মেঘের আস্তরণ ভেদ করে অজানা পথ বেয়ে উড়ে চলা যাত্রাপথ বারবার পার্থকে ক্লান্ত করে তোলে। অজানা অশুভ চিন্তা আচ্ছন্ন করতে থাকে ওর মগ্নচৈতন্য। এখন এই মুহূর্তে যদি বিমানটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে বিধ্বস্ত হয়?
এতগুলো মানুষের সব আশা বেদনার ইতি ঘটিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়ে যাবে।
তা কি করে সম্ভব?
এ রকম তো প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে।
হঠাৎ করে পার্থের উরু চিন চিন করে ওঠে।
পার্থকে অনেক অনেক পেছনে নিয়ে আসে।
১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর মধ্যরাতে অনন্তপুর সেক্টরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত একজন ষোল-সতেরো বছর বয়সের তরুণের গুলিবিদ্ধ কাতর আকুতি পার্থের মনে পড়ে।
হ্যাঁ, ওইদিন পার্থের সবকিছু শেষ হতো পারতো।
ত্রিশ লাখ শহীদের সঙ্গে আরো একটি নাম যুক্ত হতে পারতো! তা হয়নি।
পার্থ অনেকদিন যুদ্ধক্ষেত্র, যুদ্ধ শেষে ঢাকার অর্থোপেডিক হাসপাতালে কাটিয়ে ক্রাচে ভর করে দিব্যি বেঁচে আছে। আজ বহুদিন পর সুস্থ মানুষের মতো এক সেমিনারে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
ওই দিন মরে গেলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেত পার্থের। পৃথিবীর এত অজানা বিষয় জানা হতো না। এত বর্ণাঢ্য জীবনচরিত্র দেখা হতো না। অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যের আনন্দ, কন্যা মিমির বাবা ডাক শোনার তীব্র আবেগ, পৃথিবীকে নতুন রূপময়তায় চিহ্নিত করার সুখ একান্ত পার্থের।
এ সুখ পার্থ হারাতে চায় না।
মেরুদণ্ডে হিমশীতল শিহরণ বয়ে যায়। চোখের কোণে জলরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে তন্দ্রাকে আহব্বান করে।
এক মুহূর্তের সুখের অনুভব তন্দ্রার মধ্যে মিশে থাকুক।
এই সুখটুকু পার্থ নিদ্রাকে উৎসর্গ করে।
বিমানবালার মৃদু ঝাকুনিতে পার্থের ঘুম ভাঙে। যেন আচমকা উজ্জ্বল নগরে গমন।
পার্থের অদ্ভুত ভালোলাগে।
সামনেই সিঙ্গাপুর নগরী। যেখানে ওর দু’রাত্রি যাপন করার কথা।
তারপর সিউল যাত্রা।
ইমিগ্রেশনের গেটে ঢুকতেই আবারো ধাক্কা খায় পার্থ। জুডির মতো একজন, সঙ্গে তিন-চার বছরের একটি মেয়ে হেঁটে আসছে।
‘জুডি না?’ পার্থ জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ, তুমি এখানে?’ মেয়েটির পাল্টা প্রশ্ন।
‘অলৌকিক ব্যাপার! তা’হলে তোমার সঙ্গে দেখা হলো? আশ্চর্য।’
‘তুমি আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছো। আমি একটু মুটিয়ে গেছি। বোঝো না, সন্তানের জননী হয়েছি, কতো রকম সমস্যা ফেস করতে হয়।’
খুব ঝড়ের মতো কথা বলে জুডি।
পার্থ হেসে বলল, ‘তুমি এখন অন্যরকম সুন্দর হয়েছো। মাতৃত্বের সুন্দর।’
জুডি ম্লান হেসে বলল, ‘তাই!’।
‘তোমার বর কই? একা কেন? কি যেন নাম? মিঃ এ্যাটকিনশন সাহেব।’
‘চলো ইমিগ্রেশন পেরিয়ে লবিতে দাঁড়িয়ে কথা বলি।’
পাশাপাশি দুই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ওরা সব রকম ফরমাল দায়িত্ব শেষ করে লবিতে আসে।
ঠিক তখন জুডির মেয়ে বলে উঠলো, ‘ম্যাম, বিছানায় শোবো।’
জুডি বলল, ‘পার্থ, আমার মেয়েটা দীর্ঘ প্লেন ভ্রমণে ক্লান্ত। বিছানা চাচ্ছে। সম্ভবত ঘুমুতে চায় অথবা অসুস্থবোধ করছে। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফেরা দরকার। আমরা হোটেল রিভারভিউতে উঠেছি। তিনশ’ তেরো নম্বর রুম। এসো, কথা বলা যাবে। অনেকদিন পর আমরা কথা বলতে পারবো। কাল এসো, আজ তো রাত অনেক।’
জুডি দ্রুত একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলের পথ ধরে।
অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিমায় জুডি চলে যাবার পর বুকে ধাক্কা খায় পার্থ।
পরিচিত পরিবেশ থেকে ভিন্ন পরিবেশ।
বাংলাদেশ নামক দেশের মুক্তিযোদ্ধা পার্থ। যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান নড়বড়ে। তার জন্য বর্তমান পরিবেশ অত্যন্ত সুখকর। ভালোলাগার।
তাই হয়তো ভালোলাগতে শুরু করে ওর।
সিঙ্গাপুর সত্যি সুন্দর তো!
এয়ারপোর্ট থেকে আঠারো কিলোমিটার দূরে শহর। একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ে পার্থ। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে সিঙ্গাপুরের রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে পার্থ অনুভব করতে চায় বাংলাদেশের রাতের আকাশ আর সিঙ্গাপুরের রাতের আকাশ কি একই রকম?
সমুদ্র প্রকৃতির মধ্যে একটা নতুন ভাব অনুভব করে পার্থ। নতুন পরিবেশের সবকিছু উপভোগ করে আনন্দ ভরে। হোটেলের শীতাতপ কক্ষে মৃদু আলোয় গভীর ঘুমের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।
পার্থের ঘুম ভাঙে একটু বেলা করে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা পঁয়তাল্লিশ। দ্রুত বিছানা ছেড়ে জানালার স্ক্রীন টেনে দেয়।
আকাশ বেশ বিষণ্ন। মেঘলা মেঘলা ভাব। জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশচুম্বি অট্টালিকার মধ্যে পার্থের অবস্থান হোটেলের উনিশ তলায়। নিচে ব্যস্ততম সিঙ্গাপুর শহর। জানালায় দাঁড়িয়ে অনেক কিছু ভাবে পার্থ। সিগারেট টানে।
দ্রুত একবার ঢাকা থেকে বর্তমান অবস্থান ভেবে নেয়।
জুডির কথা ভাবে। মাত্র দু’দিন এখানে অবস্থান। অতি সত্বর শহরটাকে দেখতে হবে।
জুডিকে জানতে হবে। পার্থ টেলিফোন করে।
রিসিপশনে নম্বর চেয়ে কতক্ষণ অপেক্ষা করে। বেশ প্রফুল্ল মনে হয় নিজকে।
জুডি টেলিফোন ধরে।
‘জুডি, আমি পার্থ’।
‘তুমি! আসছো তো? বাচ্চা ভালো আছে?’
‘আমি হোটেল গাইড খুঁজছি এবং খুব শিগগির তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসছি। তুমি সময় দিচ্ছো তো?’
‘চলে এসো।’
টেলিফোন রেখে বড্ড মন খারাপ হয় পার্থের। জুডির সঙ্গে অনেক পুরোনো দিনের স্মৃতি আছে। যার মধ্যে সুখ আছে, কষ্ট আছে। জুডির সাথে কথা বলার জন্য অদম্য ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
গোসল সেরে কাপড় পরতে গিয়ে পার্থ অনুভব করে ওর মন অনেক ভালো হয়ে গেছে। হোটেল ডাইনিং-এ এসে দেখে অনেক খাবার ও খায় না। শুধু নুডলস খেয়ে নেয়।
খাবারের ব্যাপারে পার্থ সনাতনি বাঙালি।
ভাত মাছ প্রিয়। পোশাকে মধ্যবিত্ত।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গর্ববোধ আছে। যুদ্ধস্মৃতি আছে শরীরের মধ্যে। যা ওর ডান পা’টাকে একটু টেনে টেনে হাঁটতে সাহায্য করে।
বয়স পঁয়ত্রিশ। দু’সন্তানের জনক। রিনির স্বামী হিসেবে সুখীজন।
অসম্ভব ভালোলাগা নিয়ে রুম থেকে বের হয় পার্থ।