তিনটি অণুগল্প আনোয়ার রশীদ সাগর

একাঘুম-নির্ঘুম

একাই যখন ছিলাম তখন একা থাকতে দোষ কী?
করোনাকালে একা থাকার স্বাধ গ্রহণ করছি।
যখন মাস্টার্স পাশ করলাম তখনও একা থাকতাম।একা ঘরে ঘুমাতাম। কখনো কখনো মনে হতো আমি যেন বোতলে পুরা খলসে মাছ। আবার মনে হতো খাঁচায় বন্দী পাখি।
মাছ মনে হলে নদী খুঁজতাম সারারাত।আর নিজেকে পাখি ভাবলে,গাছ খুঁজতাম,মুক্ত আকাশ খুঁজতাম,উড়ার জন্য।
তাকিয়ে দেখছি চারিদিকে অন্ধকার। লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছি,ঘুম-ঘুম চোখে এপাশ-ওপাশ করছি। গাঢ় অন্ধকারে দরজার পাশে এসে শফিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। হ্যান্ডসাম বোকা বোকা ষোল মাছের মত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, হাত ইশারায় ডাকলাম, চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করছি।
শফিক একপা দু’পা করে এগিয়ে এসে, আমার সিথানে বসলো। ওর লম্বা হাত দুটো নিজ কোলের উপরই রাখলো। ঝাউবনে বিছানা পাতা যেন। সে বিছানায় অনেক অনেক ফুল ছিটানো। সে ফুলের উপর ফুলপরী হয়ে শুয়ে আছি আমি। আকাশটা জোছনার আলোয় ঝলমল করছে। বালিশে আমার মাথাটা আটকিয়ে ছিল, যেন কেউ চেপে ধরে রেখেছে। কতবার চেষ্টা করলাম, একটু উঠে বসি ওর পাশে। আমি ওকে গাঢ় একটি চুম্বন দিতে চাই।অথচ আমি উঠতে পারছি না। দেহের সব শক্তি প্রয়োগ করছি, পাশমোড়া দিয়ে উঠার জন্য।ধীরে অতি ধীরে জোনাকিরা উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। আমি জোনাকিও ধরতে পারছি না। জোছনা আলোও ছুঁয়ে দিতে পারছি না। শফিক কয়েক বার ডাকলো নীলা-এই নীলা। আমি কথাও বলতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট শফিক।কতবার যে ডাকলো তার হিসেব নেই।
আমি যখন শফিকের সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছি, ওকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, তখন ও আমার ব্রা খোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার পেটিকোর্টটা ছিড়ে গেছে। শুধু শাড়িটা এলোমেলো বিছানায় লুটোপুটি খাচ্ছে, ফুলে সাথে মিশে যাচ্ছে।
একা একা শুয়ে থাকার এ এক যন্ত্রণা।
আমি সাপিনীর মত প্যাঁচ খেলে এড়িয়ে যাচ্ছি আর শফিক আমাকে চেপে চেপে ধরছে। একদম বুকের মধ্যে নিয়ে, জোর করে রেপ করার চেষ্টা করছে।
অথচ আমি মোটেও ওর নাগাল পাচ্ছি না।পিপাসায় কণ্ঠনালি শুকিয়ে যাচ্ছে।সেই জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝোপের মধ্যে আমরা দু’জন।সে সময় এমন তো হয়নি কোনোদিন। বরং খোলামেলা আদরে আদরে মিশে যেতাম দু’জনে এক সাথে।কতদিন ঘুরেছি হাত ধরাধরি করে।শফিক তো জোর করে কিছু আদায় করার মত ছেলে নয়, নম্র ভদ্র, সদা হাস্যজ্জল।
আজকে কেন এমন হচ্ছে?- চিৎকার করছি আমি।ভীষণ চিৎকার শফিক ছাড়ো-ছাড়ো। খানিক আগে তো আমিই তোমাকে ডাকলাম। তখন হাবাগোবা শরীর নিয়ে বোকার মত বসেছিলে। অথচ একি হাঙ্গরের মত খাবলে ধরেছো, আমার দম আটকিয়ে আসছে।
শফিক শফিক-শফিক…
হঠাৎ আমার শরীরটা ঝাকি দিয়ে উঠলো। আমার স্বামী শামস্ আমাকে চেপে ধরে বলছে, কী হলো স্বপ্ন দেখছিলে?
আমি শামস্ এর কাধে মাথা এলিয়ে দিয়ে অলসভাবে ঘুমানোর ভান করলাম।

বিদায়

তুমিও কী জেগে আছো?-এই রাত যে,বড় গভীর! অথচ কীভাবে কখন জ্যোৎস্না হারিয়ে যায়,মোরগ ডেকে ওঠে,আযানও হয়।খুব কমই টের পায়।
শুধু আমিই আকাশ হয়ে সব-সব নির্মমতাগুলো পুষে রাখি,কখনো মেঘ,কখনো বা আলোকিত চাঁদ।
সেই যে,ট্রেন এসে থামলো,তারপর
‘প-অ-অ’ শব্দ করার সাথে সাথে দৈত্যের মত ভুঁস করে, হুংকার দিয়ে চলতে লাগলো নির্মম হত্যাকারী ট্রেনটা। সে ট্রেনের রাক্ষসী পেট যেন, তোমাকে খেয়ে হজম করে ফেলেছে। তাই আর কখনো দেখিনা তোমায়।
কী এক অদ্ভুদ মায়াবী ছন্দে জানালার পাশে এসে,হাত নেড়ে, আসি বলতেই মনে হলো, কোনো সমুদ্রআঁধার তোমাকে গ্রাস করছে-চাঁদের পূর্ণগ্রহণ হচ্ছে। তারপর আমি প্লেনের সিঁড়ি বেয়ে হারিয়ে যায় তার গর্ভে।এতগুলো বছর হয়ে গেল, তোমাকে দেখিনি।
করোনার এই দিনে বিদেশের মাটিতে খুব,খুব আতঙ্কিত আমি মা।
মাগো, তুমি কী জেগে আছো?
আমি কী ফিরে যেতে পারবো তোমার শাড়ির নিচে?
নাকি সেটায় ছিল শেষ বিদায়?

রঙিলা

বৃষ্টিবেলা যেতে না যেতেই শীত লাগছে রঙিলার। এ সব নাকি দূর্দিন ও দূর্ভিক্ষের লক্ষণ।
রঙিলা তার দাদির কথাগুলো, নিয়ে ভাবছে আর হাঁটছে, এরাম রাত বা দিনহলি, অভাব হয়; মান্সি না খাইয়ি মরে,সম্মানী লোকের সম্মান যায়-ঘাট অঘাট হয়।
তখনও পশ্চিম আকাশে হড়াম-হড়াম মেঘ ডাকছে।অথচ পূর্ব আকাশ মেঘহীন ঝকঝকে পরিস্কার ।
করোনা ভাইরাসের আগমণে ঘর থেকে বের হয়নি দু’সপ্তাহ।পাশের বাড়ি করোনা ভাইরাস পজিটিভ হওয়ায় ওই এলাকা লকডাউন করা হয়েছে।
বাড়িতে ঝাল-লবন-চাল-ডাল কিছুই নেই। বাবা বাড়িতে বসে থেকে থেকে এই কদিনেই অনেকটায় পঙ্গুমত হয়ে গেছে। ঠিকমত সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না। আগে থেকেই তার বাতের সমস্যা ছিল।বসে থেকে থেকে পা’দুটো সোজা করে,খাঁড়া হয়ে, হাঁটা সমস্যা হচ্ছে।
তিনকিলোমিটার দূরে শহরে, এক টিভি-ফ্রীজের দোকানের কর্মচারী ছিল, রঙিলার বাবা। সে দোকান একমাস ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এত দ্রুত দিন-দুনিয়া পাল্টিয়ে যাবে রঙিলা ভাবেনি।একাদশ শ্রেণিতে ফাইনাল পরীক্ষা দিবে সে।
সে পরীক্ষাও বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষাও প্রস্তুতিও শেষ।বিয়ের কথা ছিল, বাবার বন্ধুর ছেলে করিমের সাথে।করিম ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরি করে। করিম আগে খোঁজ-খবর নিতো। এ কয়দিনেই করিমও বদলিয়ে গেছে। কোনো খোঁজই নেয় না।ফোন করলে দুঃখিত বলে। এখন ফোন রিচার্চ করার মত টাকাও নেই।
মা মারা যাওয়ার পর রঙিলার বাবা বিয়ে করেছিল। দু’মাস ঘর সংসার করার পর, দ্বিতীয় মা থাকেনি। তখন রঙিলার দ্বিতীয় মা’র বয়স নাকি,তার বাবার চেয়ে বিশ বছরের কম ছিল।
রঙিলা দাদির কাছেই বড় হয়েছে।দ্বিতীয় মায়ের গল্প দাদির কাছ থেকেই শুনেছে। মাত্র পাঁচদিন হলো, দাদিও মারা গেছে সর্দি, কাশি ও ঠাণ্ডা-জ্বরে।
কবরস্থানে গ্রামের মানুষ কেউ আসেনি। অনেক কষ্টে রঙিলা ও তার বাবা একসাথে ধরাধরি করে, লাশটি রেখে এসেছে কবরে। লাশটি গোপনেই রেখে এসেছে।
শুধু দাদির মুরুব্বি এক ভাই এসেছিল। গতকালই তার দেহেও করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে। তাকে পুলিশে নিয়ে গেছে। জেলা শহরের এক হাসপাতালে রেখেছে।
রঙিলাদের বাড়ি থেকে বেরানো নিষেধ। কিন্তু খাবে কী?

রঙিলা পাশের বাড়িতে যাচ্ছে। ওই বাড়িওয়ালার ঝুপছি ঘরের মধ্যে মোদির দোকান রয়েছে। ছোট গরিব মানুষের দোকান।আম-কাঁঠালের গাছের নিচ দিয়ে সেখানে পৌঁছায়।দোকানদার রঙিলাকে দেখে খুশি হয়,আগেও খুশি হতো।তবে আগের রঙিলা আর এখনকার রঙিলার মধ্যে ফারাক আছে।তখন রঙিলা এক হাতে টাকা এবং অন্যহাতে ব্যাগ নিয়ে নাচাতে নাচাতে আসতো।এখন শুকনো মুখে, টাকাবাদে শুধু ব্যাগ হাতে, নীরব পায়ে আসে।দোকানদার সোরাব আলি এখনকার রঙিলাকে,তার আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়,রোজ আইসো-যা লাগে নিয়ি যাইও।
রঙিলা শুকনো ঠোঁটে একটু হেসে ঘাড় নেড়ে, হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিয়ে, মালগুলো নিয়ে চলে যায় গোপনেই।প্রতিবেশিরা দেখলে,হৈচৈ শুরু করবে,এই ভয়ে।
রঙিলার ময়লা কামিজ ও হেঁটে যাওয়া নগ্ন পা’র দিকে, সোরাব আলি চেয়ে থাকে।
রঙিলা তার পা’টা আর ঢাকতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *