ছোটগল্প//মৈত্রেয়ী অথবা প্রার্থনার কথা//হরিশংকর জলদাস

২৭.৫.১৬

রাত ২টা ৪১ মিনিট

৪১/সি আসাদ এভিনিউ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা

প্রিয় রাজকুমার সিংহ বাবু,

এখন রাত গভীর। তিনটে বাজতে উনিশ মিনিট বাকি। চোর আর রোগী ছাড়া এত রাতে কেউ জেগে থাকে না। আমি চোরও নই, রোগীও নই। তবুও আমি জেগে আছি। ইচ্ছে করে জেগে নেই, জেগে থাকতে বাধ্য হয়েছি। একটি ঘটনার ঘূর্ণিতে পড়ে আমাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়টি তৈরি করবার জন্য আপনিই দায়ী।

আপনাকে দেখে আমার একজন সাধারণ ছাপোষা মানুষ বলে মনে হয়েছে। মাঝারি গড়ন। চোখের নিচে কালি। চুলে কলপ। কলপটা ঠিকঠাক মতো লাগেওনি। কপালের দু’পাশে, জুলফির আড়ালে কিছু কিছু চুল সাদা রয়ে গেছে। বহু যত্নে ইস্ত্রি করা একটা হাফশার্ট পরে এসেছেন আপনি। সামনের দিকে বাঁকানো এক জোড়া চামড়ার জুতা পায়ে। খুঁড়িয়েই হাঁটছিলেন। আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি, অনুষ্ঠানের জন্যই জুতাজোড়া কিনেছেন। স্যান্ডেলেই অভ্যস্ত আপনি। জুতায় যদি অভ্যস্ত হতেন, তাহলে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন না। জুতার চাপে ফোসকা পড়েছে কি পায়ে! পড়াটা স্বাভাবিক। সুদূর মৌলভীবাজার থেকে এসেছেন। গতকালকেই এসেছেন। ঢাকায় এসেছেন সাহিত্য পুরস্কার নিতে। যিনি টুকটাক চিঠিপত্র ছাড়া কোনোদিন অন্যকিছু লেখেননি, সেই আপনি একটা আস্ত বই লিখে ফেলেছেন। ‘মৈত্রেয়ী নেই মৈত্রেয়ী আছে’ লিখে আপনি আজ ব্র্যাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার নেওয়ার জন্য মঞ্চে উঠলেন। পুরস্কার পেয়ে সবাই আনন্দিত হয়, আর আপনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাঁদলেন। যাকে নিয়ে আপনার কান্না, আপনার ছোট্ট মেয়ে মৈত্রেয়ী আমার ভেতরটা ওল্টাপাল্ট করে দিল। এমন একটা আবর্ত তৈরি করল আপনার মেয়েটি, সেই আবর্তে আমি অবিরত ঘুরছি, সেই সন্ধে থেকে এই রাত অবধি।

সেই আবর্ত থেকে বেরোবার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই বেরোতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত, এই গভীর নির্জন রাতে, আপনাকে চিঠি লিখব বলে ঠিক করলাম। তাই আপনার বরাবরে চিঠিটি লেখা।

আমার পরিচয়টা আপনাকে দেওয়া দরকার। তারও আগে বলি- আপনার চেয়ে আমি বয়সে বড়। আপনি পঞ্চান্ন আমি একষট্টি। আপনার যে পঞ্চান্ন, মঞ্চে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বললেন। আপনি বললেন, আপনি গণিতের শিক্ষক, একটা হাইস্কুলের। গণিতের শিক্ষকরা মনের দিকে একটু জটিল হন, জটিল অংক করাতে করাতে কিনা জানি না। জানি না এখন হাইস্কুলে পাটিগণিত পড়াতে হয় কিনা। তবে শুনেছি-সুদকষা, শতকরা, অনুপাতের চেপ্টার বাদ দেওয়া হচ্ছে। ওই যে বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠা-নামা, চৌবাচ্চার এক পাইপ দিয়ে গলগল করে পানি ঢোকা আর অন্য পাইপ দিয়ে চিনচিন করে পানি বেরিয়ে যাওয়ার অংক, পানির সঙ্গে দুধ মিশিয়ে গোয়ালার দুধ বিক্রি করার অংক। এসব জটিল এবং কুটিল অংক যাঁরা করান, মনের দিক থেকে তাঁদেরও একটু কুটিল হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু আপনাকে আমার তার ব্যক্তিক্রম বলে মনে হলো। মনে হলো- ত্রিভুজের দুই বাহুর সমষ্টি তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর, জ্যামিতির এই সমস্যার সমাধান করার মতোই সহজ আপনার মানসিক গড়ন। নইলে আপনি কাঁদলেন কেন? কাঁদলেন ঠিক আছে, কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে বীভৎস জিঘাংসার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া বাংলাদেশের কল্যাণ কামনা করলেন কেন দুই হাত তুলে? তাই বলছিলাম, আপনি অন্য ধরনের।

আপনার সঙ্গে আরও দুজন এই পুরস্কার পেয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউই বাংলাদেশের শুভকামনা করলেন না তো! একজন নিজেকে ক্রিকেট প্লেয়ার সাজিয়ে মঞ্চে ছক্কা আর চার মেরে গেলেন। দর্শকরা হেসে কুটিকুটি। অন্যজন, তরুণ সাহিত্যিক তিনি, তাঁর লেখার রীতিপদ্ধতি ও ভবিষ্যৎ উচ্চাশার কথা বললেন।

আমার পরিচয় দিতে গিয়ে আমি কথান্তরে চলে গিয়েছিলাম। এবার আসি আত্মপরিচয়ে। আমি পোস্টমাস্টার ছিলাম। কাজ শুরু করেছিলাম ডাকপিয়নগিরি দিয়ে। পরে ডাকপিয়ন থেকে পোস্টমাস্টার হয়েছি। যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকি, তখন আমার বিদ্যের পুঁজি ছিল না। তাই কমবেতনের ছোট চাকরি। কিন্তু পোস্টমাস্টারকে দেখে দেখে আমার ভেতর একটা লোভ বাসা বাঁধল, পোস্টমাস্টার হবার লোভ। তাই আমি হাইয়ার সেকেন্ডারি দিলাম। পাসও করলাম। তারপর বড় সাহেবকে ধরে পোস্টমাস্টারের চাকরি। এই সময় ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও ওই সময় এরকম চাকরি প্রাপ্তি আকচার ঘটত।

ভালোয়-মন্দোয় গেছে আমার চাকরিজীবন। পোস্টমাস্টার হয়েই বিয়ে করেছি। একটা মেয়ে আমার। একসন্তানে থেমে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমাদের। আমাদের মানে আমার আর আমার স্ত্রীর। কিন্তু বিধাতা একাধিক সন্তান পাবার বাসনাটাকে গলা টিপে মারলেন। কন্যাটি হবার পর ডাক্তার বললেন- আপনাদের আর সন্তান না নেওয়াই ভালো। আপনার স্ত্রীর ভেতরের কলকব্জা ঠিক নেই। আর সন্তান নিতে গেলে তাঁর জীবন সংশয় হবে। ডাক্তারের কথাকে মেনে নিলাম আমরা। প্রার্থনাকে মানুষ করতে লাগলাম।

নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে একেবারে ব্যক্তিগত কথা বলে ফেললাম। মাফ করবেন। বয়স হলে এই এক অবস্থা হয় মানুষের। আত্মকথনটা বেড়ে যায়। অন্যের কথা বলতে গিয়ে বারবার নিজের কথা ঢুকিয়ে দেয় বুড়োরা। আমারও হয়েছে তা-ই। বয়েস হয়েছে তো! হাসছেন আপনি? বলছেন- একষট্টি বছর আবার বয়স নাকি? প্রকৃতপক্ষে আমার একষট্টি নয়, পঁয়ষট্রি। নাইনে রেজিস্ট্রেশনের সময় আমাদের হেডমাস্টার ফজলস্যার আমার বয়স দুই বছর কমিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- যা বেটা। দুই বছর বয়স কমাইয়া দিলাম তোর। চাকরিবাকরি পেলে কোনো সময়, এই চার বছর তোর কাজে লাগবে। আপনাকে বলতে দ্বিধা নেই, সেই সময় একটু রাগ লাগলেও এখন ভাবি- কী উপকারটাই না করেছিলেন ফজল স্যার! ওই দেখুন- আবার ব্যক্তিগত কথা এসে গেল হুড়মুড় করে।

মৈত্রেয়ীকে আমি চোখে দেখিনি। কিন্তু আপনার বর্ণনায় আমি তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম আজ সন্ধ্যায়। আপনার সেই তুলতুলে দশ বছরের মৈত্রেয়ী, সেই পিতা-অন্তঃপ্রাণ মৈত্রেয়ী, কলকণ্ঠের মৈত্রেয়ী যেন মঞ্চের ওপর আপনার পাশেই দাঁড়িয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। আপনি তার অসুখের বিবরণ দিচ্ছিলেন। বলছিলেন- এক সন্ধ্যায় হঠাৎ মৈত্রেয়ীর বাম চোখের ওপর আমার চোখ পড়ল। দেখলাম- ওই চোখের ওপরের পাতাটি নিচের দিকে নেমে এসেছে। মৈত্রেয়ী বারবার চেষ্টা করছে পাতাটি ওপর দিকে তুলবার জন্য। কিন্তু তুলতে পারছে না।

আপনার এই কথা শুনে বেশ অভিমানী চোখে মৈত্রেয়ী আপনার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আপনার বাম হাতটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল- বাবা, এ তুমি কী বলছ? দেখ, এই দেখ, আমার চোখটা ঠিক আছে তো! এই দেখ না আমার চোখের পাতাটি ওপর দিকে তুলতে পারছি তো বাবা।

বক্তৃতায় এত বেশি মগ্ন ছিলেন যে, মৈত্রেয়ীর আকুলকরা কণ্ঠ আপনি শুনতে পেলেন না, তার ঝাঁকুনিও আপনি টের পেলেন না। আমি কিন্তু স্পষ্ট চোখে মৈত্রেয়ীকে অবলোকন করলাম। আমি ইচ্ছে করে এখানে অবলোকন কথাটি লিখলাম। আমি দেখতে পেলাম কথাটি লিখতে পারতাম। কিন্তু দেখতে পাওয়া আর অবলোকন করা শব্দ দুটোর মধ্যে তো পার্থক্য আছে! সেই পার্থক্যটুকু বোঝাবার জন্য অবলোকন শব্দটি ব্যবহার করলাম আমি। নিবিড় চোখে দেখার নামই তো অবলোকন।

আমার কন্যা প্রার্থনার দিকেও আমি নিবিড় চোখে তাকাতাম। ছোট্ট প্রার্থনা যেদিন হামাগুড়ি থেকে প্রথম দুপায়ে দাঁড়াল, সেদিন থেকে প্রার্থনাকে না দেখে আমি অবলোকন করতে লাগলাম। ছোট ছোট পায়ে সে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে হাঁটতে শিখল। আমার হƒদয়টাও প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল। কী শিহরণ, কী অপূর্ব জীবন আস্বাদ! মনে হতে লাগল- আমার ভেতরের আরেকজন আমি ছোট্ট প্রার্থনাটি হয়ে সারাঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, প্রার্থনার মুখে প্রথম যেদিন রা ফুটল, সেদিন প্রথম শব্দটিও বাব্বাই বলল। তার মা সামনে ছিল। সুরভি বলল- দেখছ, দেখছ মেয়ের কাণ্ডটি। কী বলে বাব্বা! সব সন্তান মা-ই ডাকে প্রথমে, আর এই পুঁচকি মেয়েটি ডাকল কিনা বাবা! বলেই বুকে জড়িয়ে নিল প্রার্থনাকে।

আমি জানি, কন্যার সঙ্গে পিতার কী নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্কের চিত্রটি দু’চার দশটা শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। আপনি বুঝেছেন। নইলে আপনার কলম দিয়ে এরকম অপূর্ব বিবরণ বেরিয়ে আসত না। ওহো, আপনাকে একটি কথা লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম।

আমি যখন প্রার্থনার দিকে বিস্ময়ভরা চোখে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, আমার মা তা খেয়াল করত। একদিন মা আমার কাছে এল। টুলটি টেনে পাশে বসল। প্রশান্ত একটু হাসল মা। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, দেখ বাপ তোরে একখান কথা কই। আমি মায়ের দিকে তাকাই। মা বলে, মাইয়া যহন ছোড থাহে, মা-বাবার বুক তহন বিরাট ফুটবল খেলার মাডের মতন থাহে, মাইয়া যতই বড় হইতে থাহে সেই মাডখান আস্তে আস্তে ছোড হইতে থাহে।

মায়ের কথা শুনে মায়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছিলাম সেদিন। মা গলায় মমতা ঢেলে বলেছিল, আমি আশীর্বাদ করি বাছা, তোর বুকের মাডটা যাতে কইমা না যায় কুনুদিন। মা দরাজ দিলে আশীর্বাদ করেছিল সেদিন। কিন্তু মায়ের আশীর্বাদ আমার বা প্রার্থনার জীবনে কোনো কাজে লাগেনি।

রাজকুমারবাবু, আপনি আপনার মেয়ের চোখ নিয়ে ভীষণ রকম উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। হবেনই তো! এই মৈত্রেয়ী তো আপনাকে পিতৃত্বের স্বাদ দিয়েছে। একজন মানুষ যে তার সন্তানের মধ্যদিয়ে নিজকে কালান্তরে নিয়ে যায়, মৈত্রেয়ীর মাধ্যমে তা-ই আপনি অনুভব করতে শুরু করলেন। এই অনুভব থেকেই উৎকণ্ঠা। উৎকণ্ঠায় তাড়িত আপনি মৈত্রেয়ীকে নিয়ে লোকাল চোখের ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তারের কাছে এ এক নতুন রোগ। তিনি মৈত্রেয়ীকে ঢাকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাতে বললেন। আপনি তা-ও করলেন। মৌলভীবাজারের একটা প্রত্যন্ত গাঁ থেকে ঢাকায় যাতায়াত সহজতর নয়। অনেক কঠিন এবং ব্যয়সাপেক্ষ। আপনি মৈত্রেয়ীর কল্যাণের জন্য সেই কাঠিন্যকে পাত্তাই দিলেন না।

ঢাকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ব্যর্থ হলেন। বললেন এ রোগ এখানে সারবার নয়। ওকে বিদেশে নিয়ে যান। আপনার কাছে বিদেশ মানে ভারত। এর মধ্যে মৈত্রেয়ীর কী রকম যেন ভাবান্তর হতে শুরু করল। ওই যেমন নদীতে জোয়ার থেকে ভাটা হয়, তেমনি করে মৈত্রেয়ীর প্রাণময়তা কী রকম যেন একটু একটু করে ম্লান হতে দেখলেন আপনি। এসব আমি আপনার বই পড়ে জানিনি, জেনেছি মঞ্চে দাঁড়ানো আপনার কথা শুনে। সত্যিকথা বলতে কী, আপনার নামও শুনিনি কখনো। আপনার সঙ্গে পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্য দুজনকে চিনি একটু-আধটু। কোথায় কোথায় যেন তাঁদের দু’একটি লেখা পড়েছিও। আপনার লেখা কখনো পড়িনি। পড়ব কোথেকে আপনি তো এই বইটি ছাড়া এর আগে একছত্রও লেখেননি কোনোদিন।

একটা ব্যাপার স্বীকার করে নেওয়া ভালো, এই পুরস্কার দেওয়ার আসরে আসার কোনোরূপ উপযুক্ততা আমার ছিল না। তাপরও আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আমন্ত্রিত হয়েছি ব্র্যাক ব্যাংকের ক্লায়েন্ট হিসেবে। চমকে উঠছেন আপনি? ভাবছেন, কত ক-ত ক্লায়েন্ট ব্র্যাক ব্যাংকের! আমি কোনো কোটিপতি বা শিল্পপতি যে, ব্যাংক আমাকে এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাবে! কিন্তু বিশ্বাস করুন, ব্যাংক আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কারণ? কারণ একটা আছে বটে।

রিটায়ারমেন্টের পরে বেশ কিছু টাকা পেয়েছিলাম, আমার স্ত্রীর ব্যক্তিগত কিছু জমানো টাকা ছিল। গ্রামের বাড়িটিও বিক্রি করে দিয়েছিলাম আমি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা শেষজীবনটা ঢাকা শহরে কাটাব। প্রার্থনাকে যে এই ঢাকা শহরেই বিয়ে দিয়েছি। একমাত্র মেয়েকে দূরে রেখে শেষজীবনটা কাটাব, এরকম আমার স্ত্রী এবং আমি ভাবতেই পারিনি।

তো এসব মিলে বেশ কিছু টাকা হলো আমাদের। ঢাকার মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিওতে একটা বাসা ভাড়া নিলাম। টাকাগুলো ব্র্যাক ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করলাম। তো ফিক্সড ডিপোজিটার হিসেবে এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম আমি। এসেছিলাম একটা আনন্দানুষ্ঠান দেখার আশায়, কিন্তু দেখে এলাম একটা ক্রন্দনানুষ্ঠান।

হ্যাঁ, আপনি আমাকে কাঁদিয়েছেন রাজকুমারবাবু। আমি চোখে রুমাল চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলাম, ওই জায়গাটিতে, যেখানে আপনি কলকাতার ফুটপাতে মৈত্রেয়ীর মৃতদেহ রেখে খাবার খাচ্ছিলেন। কী নিদারুণ মর্মান্তিক চিত্র! একদিকে একমাত্র কন্যার নিথর দেহ, অন্যদিকে ক্ষুধা! কোনটি বড় মানুষের কাছে? আপনার কাছে? শোক মর্মান্তিক, ক্ষুধা দেহান্তিক। শেষ পর্যন্ত কোনটা প্রবল মানুষের কাছে? মর্মযাতনা না ক্ষুধা? অপত্য পিতৃবাৎসল্য না ক্ষুধা? আপনি বলেছেন ক্ষুধা। আমারও তাই মনে হয়েছে। তা নইলে কেন, সর্বহারা অসহায় আপনি কন্যার মৃতদেহটিকে সামনে রেখে আহার করলেন?

ঢাকার ডাক্তারের পরামর্শে মৈত্রেয়ীকে আপনি চেন্নাই নিয়ে গিয়েছিলেন। ওরা চেষ্টা করেছিল প্রাণপণ। আপনি এর মধ্যে আমাদের জানালেন মৈত্রেয়ীর অসুখ শেষ পর্যন্ত চোখে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বুকে পেটে মাথায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আপনি ওসব রোগের নামও বলেছিলেন আর বলেছিলেন মৈত্রেয়ীর যন্ত্রণা কাতরতার কথা। আমি স্বল্পশিক্ষিত বয়স্ক মানুষ। রোগের নামগুলো মনে রাখতে পারিনি, কিন্তু অনুভব করতে পেরেছি হাসপাতালের বেডে শোয়া আপনার মেয়েটির যন্ত্রণাময় কাতরতা। এই কাতরতা শেষ পর্যন্ত আমাকে দখল করে বসল। দর্শকসারির চেয়ারে বসা আমার মধ্যে মৃদু কাঁপন টের পেলাম। সামনের টেবিলের কানাচটা আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে যেতে লাগলাম আমি।

আপনার কথা ওখানে থামিয়ে দিলে ভালো হতো। কিন্তু আপনি থামলেন না। আপনার আগের বক্তা অসাধারণ উইটি। হলভর্তি মানুষদের তিনি হাসিয়ে ছেড়েছেন। গোটা হলে বেলিফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। আপনি মঞ্চে উঠে হলের বাতাবরণ পাল্টে দিলেন। নিস্তব্ধতা নেমে এল চারদিকে। আপনার মুখে মৈত্রেয়ীর হৃদয়বিদারক শেষ পরিণতির কথা শুনে অন্যরা কেঁদেছিলেন কিনা জানি না, আমি ফুঁপিয়ে উঠেছিলাম। শক্ত মনের এক শ্রোতা আমার দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়েছিলেন। তাঁর চোখের ভাষা ছিল একী করছেন হ্যাঁ! যত্তসব পাগলামি! বয়স হলে সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। আমিও হয়ত তা-ই। ওঁর কড়া চোখ দেখে আমি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। করুণ চোখে মাফ চেয়ে নিয়েছিলাম তাঁর কাছে। কম বয়সের সেই শ্রোতা করুণার হাসি হেসেছিলেন।

মৈত্রেয়ীর প্রাণ থাকতেই হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ওরা বলেছিল- মৈত্রেয়ীর বাঁচার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- মৈত্রেয়ীকে তার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন। এম্বুলেন্সে করেই কলকাতার দিকে রওনা দিলেন আপনারা। ছত্রিশ ঘণ্টার জার্নি। কিন্তু ছত্রিশ ঘণ্টা বাচঁল না মৈত্রেয়ী। কুড়ি ঘণ্টা পর পথিমধ্যে এম্বুলেন্সের ভেতর আপনাদের সামনেই মৈত্রেয়ী মারা গেল।

আপনি এরপর আরও কী কী বলেছিলেন। কিন্তু শুনবার শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। দ্রুত পায়ে আমি হলরুমের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম।

ওয়াশরুমে ঢুকে যতক্ষণ না আমার হাত ব্যথা করে, ততক্ষণ পর্যন্ত চোখমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে গেলাম আমি।

হলরুমের বাইরে বিরাট বারান্দা। তা অতিক্রম করে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালাম। কী আশ্চর্য! দাঁড়িয়ে প্রথমেই আমার প্রার্থনার কথা মনে পড়ল। প্রার্থনা এখন মিরপুরের এক তেতলাঘরে দাম্পত্যজীবন যাপন করে যাচ্ছে।

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়তে পড়তেই প্রার্থনার বিয়ে দিয়েছিলাম। প্রার্থনা বিয়ে করতে চায়নি। বলেছিল- বাবা, এমএটা পাস করি, তারপর বিয়ে দিও। মেয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু তার মা ছিল নাছোড়। বলেছিল- এরকম ছেলে পাবে কোথায় তুমি। ঢাকায় বাড়ি। গাড়ি ব্যবসা। সুখের জীবন হবে প্রার্থনার। মেয়েকে চেপে ধরেছিল। বলেছিল- দেখ মা, আর মাত্র কটি বছর তোর বাবার চাকরি আছে। এই সময়ে যদি তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে পারি আমরা তাহলে নিশ্চিত হতে পারব।

প্রার্থনা আমার বড় অভিমানী মেয়ে। চুপচাপ মায়ের সামনে থেকে সরে গিয়েছিল। আমরা অনেকটা যাচাই না করেই তুহিনের সঙ্গে প্রার্থনার বিয়েটা দিয়ে দিয়েছিলাম। আমারাও সবকিছু গুটিয়ে মোহাম্মদপুরে বাসা নিলাম।

কিন্তু বিয়েটা সুখের হয়নি প্রার্থনার। টেনেটুনে বছরখানেক চালানোর পর প্রার্থনার পড়াশোনাটা বন্ধ করে দিল তুহিন। আরও কিছুদিন পর টের পেলাম তুহিন মাদকাসক্ত। আস্তে আস্তে প্রার্থনার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। আমরা প্রার্থনাকে বললাম চল মা, ফিরে চল। আবার পড়াশোনাটা শুরু কর। জীবনটা নতুন করে শুরু কর।

প্রার্থনা ম্লান একটু হেসে বলে, পড়াশোনাটা শেষ করে জীবনটা শুরু করতে চেয়েছিলাম, তোমরা দাওনি। তারপর আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন রাজকুমারবাবু, প্রার্থনা শেষে বলল- আমি কখনও এখান থেকে তোমাদের কাছে ফিরে যাব না বাবা। বলে সে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়েছিল।

প্রার্থনা ফিরে আসেনি আমাদের কাছে। নিত্যদিনের মানসিক নির্যাতনে তিলতিল করে ক্ষয় হচ্ছে প্রার্থনা, তার শ্বশুরবাড়িতে। সেদিন গিয়ে শুনলাম- প্রার্থনার গায়ে হাত তুলেছে তুহিন। শ্বশুর উদাসীন, শাশুড়ি তুহিনের সহযোগী।

আমার মেয়েটি, আমাদের সোনার টুকরা প্রার্থনা তিলতিল করে মরছে, আপনার মৈত্রেয়ী একেবারে মরে গেছে। আপনার চোখের সামনে হঠাৎ মরে গেল মৈত্রেয়ী, আর আমাদের চোখের সামনে একটু একটু করে মরে যাচ্ছে প্রার্থনা। কোনটা বেশি বেদনার রাজকুমারবাবু? আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কি বুঝতে পারছেন?

আমার আর লিখতে ইচ্ছে করছে না রাজকুমারবাবু। বারবার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।

ভালো থাকবেন- এই কামনা।

ইতি

জনৈক বাবা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *