উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।৬ষ্ঠ-পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।। ১ম পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।২য় পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৩য় পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।।মনি হায়দার।।৬ষ্ঠ-পর্ব
- অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।।৫ম- পর্ব
- অধ্যাপক কোনো মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।। ৭ম- পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ৮ম পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না ।। মনি হায়দার ।। ৯ম- পর্ব
- অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১০ম-পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১১-পর্ব
- উপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১২তম-পর্ব
- উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। শেষ-পর্ব
জয়পুরহাটের প্রিন্সিপাল কাম প্রশাসক মোদাব্বে হোসেনের নাক, চোখ, মুখ সবসময় কি এক অজানা কারণে কুঁচকে থাকে। যখন তিনি লেখাপড়া করেন, তখনও যেমন কুঁচকে থাকে, যখন তিনি হাসেন তখনও ঐ কুঁচকানো অবস্থাতেই হাসেন। তখন হাসিটাকে দেখায় শিম্পাঞ্জীর হাসি। তাতে দোষের কিছু নেই- কেননা শিম্পাঞ্জী, ডারউইন তত্তে¡ মানব বিকাশের একটি ধারায় বানর বা শিম্পাঞ্জীর ভূমিকারও উলেখ আছে। সেই মোদাব্বির হোসেন কলেজেন প্রিন্সিপালের চেয়ারে বসে সবেমাত্র পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছেন, দেখছেন কোথায় কয়টা ধর্ষণ বিষয়ক খবর আছে, ধর্ষণের খবর খুঁজছেন- কারণ, তিনি ধর্ষণ পাঠ সংবাদ পড়তে পছন্দ করেন। তাঁর এই প্রিয় বাতিক তিনি ছাড়া কেউ জানে না- হঠাৎএই মহেন্দ্রক্ষণে, যখন তিনি পড়ছিলেন স্কুল ছাত্রীকে গৃহশিক্ষক কর্তৃক ধর্ষণ- টেলিয়োনটা বেজে ওঠে। বিরক্তির সঙ্গে তিনি রিসিভার কানে তোলে- হ্যালো?
এটা কি জয়পুরহাট কলেজ?
হ্যাঁ, জয়পুরহাট কলেজই এটা-মোদাব্বির হোসেন অবাক হচ্ছেন- এক মহিলার কন্ঠ অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে? কে এই মহিলা?
প্রফেসর আলী আসগরকে একটু ডেকে দেবেন? মহিলার কন্ঠে মিনতি।
উনি তো ঢাকায় ছুটি নিয়ে বাড়িতে গেছেন। আপনি কে বলছেন?
জ্বী, আমি ওনার স্ত্রী মাকসুদা বেগম।
আচ্ছা, কেমন আছেন আপনি?
জ্বী ভালো, কিন্তু উনি তো গতকাল জয়পুরহাটে চলে গেছেন।
চলে আসলেও এখনও তিনি পৌছাননি। পৌঁছুলে আপনার সম্পর্কে বলব কি কিছু?
জ্বী, বলবেন আমরা ওনার জন্য চিন্তিত আছি-
ঠিক আছে।
মাকসুদা বেগম ফোনের রিসিভার রেখে অবার। কোথায় গেল মানুষটা? যতই কামে- উপ কামে মগ্ন থাকুন না কেন-ঐ মানুষটাই তার স্বামী। খুবই ভালো মানুষ। ফোনের ভাড়া দিয়ে মাকসুদা হাঁটতে আরম্ভ করে বাড়ির দিকে।
জীবনে আলী আসগরের মতো নির্বিবাদী মানুষকে স্বামী পেয়েছিলেন বলে সংসারচা এখনও বেঁচে আছে। লোকটা খুবই ভালো। তার সঙ্গে মাকসুদা যে ব্যবহার করেন তাতে এই সংসার অনেক আগেই তাসের ঘর হয়ে যাবার কথা। কিন্তু আলী আসগরের নিরীহ চরিত্রের কারণে সংসারটা এখনও টিকে আছে। মাকসুদা বেগমের মনে একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠে। কেন আমি অমন ভালো মানুষটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি? করা কি উচিত? সারাটা জীবন আমার সুখ আর শান্তির জন্য নিবেদিত থেকেছে। না, এরপর আর করব না। সাঈদ হোসেন দেলোয়ারকেও সুযোগ দেব না। পাকা হারামজাদা তাকে নিংড়ে নিংড়ে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। ছোটলোক। ইতর-আপন মনে বকতে বকতে বাসায় এসে পৌঁছুলে মেয়ে মৌলি জিজ্ঞেস করে- কি খবর মা?
হতাশ চেহারা নিয়ে সোফায় বসে পগেন মাকসুদা- নারে, তোদের আব্বা জয়পুরহাটেও যায়নি।
যায়নি?
না।
কোথায় গেল তাহলে?
কি করে বলব? সেই কাল দুপুরের আগে বাসা থেকে চলে গেছে, জয়পুরহাটে কলেজেও পৌঁছায়নি- তাহলে কি হল মানুষটার? কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে মাকসুদা বেগমের। মৌলি তার মায়ের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে তাকে- জগৎ সংসারের মানুষ চেনা বড় দায়। মৌলির মা মাকসুদা বেগম কাঁদছেন তার স্বামী অধ্যাপক আলী আসগরের জন্য! জগৎ সংসারের কেউ বিশ্বাস করবে না। দেখলেও বিশ্বাস করবে না। বলকে- কোথাও কোনো গল্প বা ভিন্ন ঘটনা আছে। যেমন মাকসুদা বেগমের পেটের মেয়ে মৌলিই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মা কাঁদছে আর বাবার জন্য! তার মায়ের বুকের মধ্যে বাবা আলী আসগরের জন্য সারা জীবন ঘৃণা আর উপহাস ছাড়া প্রেম বা ভালোবাসার বিন্দুও দেখেনি, পিতা বা স্বামী হিসেবে যে মানুষটিকে কখনও যাকে সামান্যতম করুণাও করেনি, সেই মা আজ কাঁদছে।
খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কান্না থামিয়ে ভেজা কন্ঠে প্রশ্ন করে মৌলিকে।
মৌলি কলেজে যাবার জামা পড়ে অপেক্ষায় আছে, সাঈদ হোসেন দেলোয়ারের কন্যা, কবিতা আসবে, তার সঙ্গে মিলে একত্রে কলেজে যাবে।
কি করব?
তোর দামড়া ভাইটা কই? সারাদিন খায় আর ঘুমায়। আর বাইরের বদ ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারে-
ওকে কি দরকার?
তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে?
আচ্ছা তুমি শুধু রাগ করছো। ও কোথায় তুমিও যেমন জানো না, আমিও তেমন-
হয়েছে, আর দরকার নেই। আলী এলে-
আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় খোঁজ-খবর নিতে হবে না! লোকটা মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
দেলোয়ার আংকেলকে ডেকে আনি?
হঠাৎ সোজা হয়ে যান মাকসুদা বেগম- না। ঐ কুকুরটাকে এই বাসায় আর ডাকাযাকির দরকার নাই। তুই কলেজে যা, যা করার আমি একাই করব-
মৌলির মনে হচ্ছে সে জেগে নেই, ঘুমিয়ে আছে এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। আজব-আজগুবী সব স্বপ্ন দেখছে সে। যার কোনো মাথা মুণ্ডু নেই। রক্তাক্ত, ভয়াবহ সব অলীক স্বপ্ন-
রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল তাঁর ছোট্ট পা জোড়া কাঁপছে। ভয়ে চমকে উঠলেন, তাকালেন পায়ের দিকে অধ্যাপক আলী আসগর। হ্যাঁ, তাঁর পা জোড়া কাঁপছে একটু একটু। সঙ্গে কাঁপছে ছোট্ট শরীরটাও। কারণ কি? ভূমিকম্প? হঠাৎ আপন মনে তিনি হেসে উঠলেন। আসলে অনেক দূর থেকে ট্রেন আসছে, ট্রেন আসলে রেল লাইন কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরই দেখা গেল ট্রেনের ভোঁতা ভয়ংকর মাথাটা। তিনি ডানা মেলে দিলেন আসমানে। ট্রেন এসে পড়ে। তিনি উড়তে উড়দে ট্রেনের ছাদে, একটা খাঁড়ে নেমে পড়েন। ট্রেন যেখানে নিয়ে যাবে-কোনো একটা শহরে গেলেই তিনি বুঝতে পারবেন কোথায় কতদূর এসে পড়েছেন।
গতরাতে নিজের ঘরে, নিজের শয্যায়, নিজের চোখে দেখা দৃশ্যটা ভুলে যেতে চান, অথচ মুহূর্তে মুহূর্তে শরীর কেটে গেলে যেমন রক্ত বের হয়, তেমনি মনে পড়ে যাচ্ছে দৃশ্যটা। কেন মনে পড়ছে? ট্রেনের ছাদে যেতে যেতে তিনি দেখতে পান- জগৎ সংসারের মুঠি মুঠি সৌন্দর্য। ধানক্ষেত, পানের বরজ, পাটের পানা, জেলেদের মাছ ধরা, মাঝিদের বৈঠা টানা, ন্যাংটো বাচ্চাদের কলরব তুলে খালের স্রোতে লাফিয়ে পড়া, অথচ বারবার ঘুরে ফিরে রাতের মনোরম অথচ কুৎসিত দৃশ্যটা কেন আসে মাথায়? চোখে? কেন? এই তাহলে সংসার? বিশ্বাস? ভালোবাসা? মাকসুদা কতদিন থেকে এই খেলায় মেতে আছে? কতদিন পুরোটা শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে অধ্যাপক আলী আসগরের। ঘন্টাখানেক ট্রেন চলার পর থামে একটা স্টেশনে। অধ্যাপক আলী আসগর তাকিয়ে দেখেন- জায়গাটার নাম জয়দেবপুর। হ্যাঁ জায়গাটা চেনা। বছর দশেক আগে এখানেও তিনি ছিলেন বছর দুয়েক। এখানকার কলেজে পড়িয়েছেন। ভালো লাগে তাঁর পথ খুঁজে পাওয়ায়। বের করতে পারবেন রাতের আম গাছ? সকালের পানি পানের বিশাল দিঘি? মনে হয় পারবেন না। কেননা তিনি তো কৃত্রিম পাখি। আসল পাখিরা নিশ্চয়ই পারবে। তারা একবার সে পথে আসে যে পথ কখনও ভোলে না। শীতের আগে সাইব্রেরিয়ায় বরফ হীম অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ পাখি আসে- এদেশে, আবার গ্রীষ্মে ফিরেও যায়, এতটুকু ভোলে না পথ।
মানুষের ভেতরও এমন কৃত্রিম মানুষ আছে। তার স্ত্রী মাকসুদা, বন্ধু সাঈদ হোসেন দেলোয়ার- আচ্ছা এরা ছাড়াও তো চারপাশের মানুষগুলো কি এখনই? কৃত্রিম? সাজানো? মাকাল ফল? অস্তিত্বের জায়নামাজে এভাবেই কি গোপনে সর্বনাশের পোকা বাসা বাঁধে? মাকসুদাকে তিনি সত্যি ভালবাসেন। ভালোবাসেন? সত্যি? এখনও? না- বোধহয় নিজের ভালবাসাকে তিনি নিজেই স্বীকার করেন। হ্যাঁ, একসময়, একদিন, প্রতিদিন ভালবাসতেন। সেই ভালবাসায় কোনো খাদ ছিল না। তিনি মাকসুদাকে গভীরভাবে, যাকে বলে হৃদয় মন প্রাণ সপে ভালবাসা, তিনি তেমনই ভালবাসতেন। মাকসুদা বেগমের শরীরই ছিল তাঁর জীবনে প্রথম নারীর শরীর। যে শরীরের সৌরভের গন্ধে এক একজন তরুণ নরকেও ঝাঁপ দেয়- না, তার জীবনে কোনো নরকের সন্ধান পাননি তিনি। কেবল জীবনটাকে বহন করেছেন অসহ্য পাথরচাপা বেদনায়। ধূসর শৈশব তাঁর চৈতন্যে কালো চিতাবাঘের মতো হানা দিয়ে তাকে কতবার ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করেছে তার শেষ নেই। সেই রক্তাক্ত শ্যাম্পেন পান করতে করতে রক্তবসনে অসংখ্যবার নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক আলী আসগর।
অনেক অনেক রাত তিনি না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি ঘুমুতে পারতেন না। ঘুমুতে গেলেই চোখের তারাদুটো আদিগন্ত মাঠ হয়ে যেত। সেই মাঠে উড়ে বেড়ায় সাদা কালো রঙিন ঘোড়া, হরিণ, চিতল মাছ, আলতো সবুজ ঘাসফড়িং, বসন্তদিনে উদাস দুপুরে ঘুঘু পাখির ক্লান্ত উড়ে বেড়ানো আর একজন নারীর ছবি।
সেই নারীর কোলে আলী আসগর, ডাক নাম মধু, ছয় বছর পর্যন্ত বেড়ে উঠেছিল। এক মধুর মা, সেই নারী শেফালী বেগম বেশিদিন বাঁচতে পারেনি। মধুর তখন বোঝার বয়স তেমন হয়নি- একদিন দেখতে পায় তার মা উঠোনে তালপাতার হোগলার উপর লম্বালম্বি শুয়ে আছে। পুরোটা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। অসংখ্য মানুষ শেফালী বেগমকে দেখতে আসে, দেখে যাবার সময়ে অবাক মধুর গালে আদর রেখে যায়। মধু বিকেলের দিকে দেখতে পায় তাঁর মাকে নতুন কাপড় পরিয়ে মাথার তুলে কোথায় যেন নিয়ে যায় লোকেরা। মা আর ফিরবে না বুঝেছিল রাতে অন্য বিছানায়, তখন পরীর সঙ্গে ঘুমুতে দেয়া হয়্ অবুঝ মধুর নিজস্ব পৃথিবীটা একেবারে ভেঙে পড়েছিল। লোকমুখে পরে যে শুনেছে- সারারাত সে কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে শেষরাতে, আজানের সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পিতা মাহবুব আলমের সঙ্গে কোনো স্মৃতি তখন পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি মধু। কারণ শেফালি বেগম নিহত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর মধু প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নানীর বাড়িতে নানীর কাছে লালিত পালিত হয়েছে। এবং সে শুনেছে- পিতা মাহবুব আলম সেই যে সন্ধ্যায়, হেরিকেনের আলোয় ঘুমন্ত মধুকে নানীর কাছে হস্তান্তর করেছিল, সেই শেষ দেখা ছিল পিতা ও পুত্রের মধ্যে। কী এক অলঙ্ঘনীয় আর দুর্বোধ্য কারণে মাহবুব আলম এক মুহূর্তের জন্যও মধুকে দেখতে যায়নি, এমনকি কোনো খোঁজ-খবরও নেয়নি। মধু নানাবাড়িতে থেকে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় একবার খবর আসে মধুর পিতা অসুস্থ, দেখতে চায় মধুকে।
না- নির্বিরোধী, অভিমানী মধু গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল।
নানাবাড়ির আত্মীয়-স্বজনেরা অবাক হলেও মধুর এই না কে মেনে নিয়েছিল। ফলে জীবিত পিতার মুখ আর দর্শন করা হয়নি। এই ঘটনার মাস তিনেকের পর আবার খবর আসে মাহবুব মারা গেছে। মধু চাইলে মুখ দেখতে পারে। মধু গিয়েছিল। মাহবুব আলম গ্রামীণ জোতদার, প্রচুর জমিজমার মালিক। প্রথম স্ত্রী রায়হানা বানু দেখতে শুনতেও খারাপ না। তার গর্ভে এসেছে তিনটি ছেলে, দুটি মেয়ে। বাড়বাড়ন্ত সংসার। বড় ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, মেঝো মেয়েকে নিয়ে বিয়ে দিয়েছে, সে ঘরে একটি নাতনী। তারপর হঠাৎ একরাতে গ্রামময় ছড়িয়ে পড়ে মাহবুব আলম দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। খবর মুনে রায়হানা বানু শুরুতে অবিশ্বাস করলেও কয়েকদিন পন ঘটনাটা সত্যি হলে সে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল আমার সাজানো সংসারে যে আসবে তাকে আমি ……. কলিজার ভেতরে থাকা অজানিত প্রতিজ্ঞা সে পূরণ করেছিল দুই ছেলে, এক মেয়ে আর কাজের লোক আক্কাসকে সঙ্গে করে নিঝুম রাতে সতীনকে গলা টিপে মেরে শাড়িতে গলা পেচিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে।
তার আগে মাহবুব আলম গিয়েছিল গ্রামের ছেলে ইমরানের জন্য মেয়ে দেখতে। জোতদার হলে সামাজিক অনেক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে এসব কাজে তাকে প্রায়ই যেতে গত। ইমরান এইচ এস সি পাশ করে স্থানীয় সরকারি স্কুলে মাষ্টারী করছে। মেয়েটিকে দেখে ইমরান, ইমরানের বন্ধুবান্ধব মুগ্ধ। বিয়ের কথা প্রায় পাকা হবে এই সময়ে মাহবুব বাইরে যায় মেয়ের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। আধঘন্টা পর ফিরে এসে মেয়ের বাবা জানায়- সে এই ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে না। ইমরান সবকিছু বুঝতে পারলেও গ্রামীণ জলহাওয়ার মানুষ হয়ে এটাও বুঝতে পেরেছিল- অদ্ভুত এই লড়াইয়ে সে জিততে পারবে না। সুতরাং কষ্ট বুকে চেপে সে নীরব থাকে।
ইমরানের সঙ্গে শেফালি বেগমের বিয়ে ভেঙে যাবার তিন মাসের মাথায় শেফালির বিয়ে হয় মাহবুবের সঙ্গে। মাহবুব অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে, মান অপমান বিদ্রুপ সহ্য করে মেয়ের বয়সী বৌকে নিয়ে বড় বাড়ির পশ্চিম বারান্দায় নতুন করে, নতুন উদ্যমে ঘর বাঁধে। কয়েক মাসের মধ্যে দক্ষিণের পোতায় সুদৃশ্য আর একটি ঘর তোলে একেবারে পৃথক হয়ে যায় মাহবুব আলমআর শেফালি বেগম। সংসার আলো করে আসে মধু। মধুকে ঘিরে শেফালি বেগম বিভোর আগামীর স্বপ্নে। মাহবুব আলম বড় বৌ রায়হানা বানুর ঘরে যায় না, বছরে দুই একবার কথাও বলে না। অবজ্ঞার আগুনে পুড়তে থাকা রায়হানাকে মতামত দেয় সেঝো ছেলে রাহাত, মেজো ছেলে রহিম আর বড় মেয়ে মাহবুবা। চারজনার মিলিত পরামর্শে এক রাতে ঘটে যায় ঘটনাটি- গাছে ঝুলিয়ে দেয়ার জন্য আক্কাসকে নেয়া হয় পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে। রায়হানার বাপের বাড়ি কাছেই। বড় ভাইয়েরা প্রভাবশালী, সুতরাং থানা পুলিশ করারও কোনো সুযোগ ছিল না। মাষ্টার্স পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে গেলে অস্থিচর্মসার বৃদ্ধ আক্কাস কেঁদে কেঁদে বলেছিল শেফালির করুণ মৃত্যু রহস্য। বলতে বলতে কেঁদেছে বৃদ্ধ আক্কাস আর শুনে শুনে পাথর হয়েছে মধু- আসগর আলী।
বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যার আগে মধু পৌঁছেছিল বাপের বাড়ি। সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। কিশোর মধুকে দেখবার জন্য মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে। হেরিকেনের মৃদু ফ্যাকাশে আলোয় মধু মৃত পিতার মুখ দেখেছিল কয়েক মুহূর্ত। আগের ঘরের ভাই এবং বোনেরা অনেক অনুরোধ করেছিল বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্য, যায়নি। চারপাশে তুমুল কান্নার ভেতরও মধুর চোখে এক ফোটা পানিও আসেনি। বার কয়েক ইচ্ছে হয়েছিল রায়হানাকে দেখার। বাড়ির মধ্যে যেতে হবে তাকে দেখতে, কিন্তু ইচ্ছে হয়নি তাই যাওয়া হয়নি। আর না দেখা মুখটিও দেখা হয়নি।
সেই বাড়ির মধ্যে গেছে বিয়ের পর, মাকসুদা বেগমের পরামর্শে। মাকসুদা তাকে বুঝিয়েছিল- তুমি তো জন্মের জন্য দায়ী নও, যারা দায়ী তাদেরকে কেন তোমার নায্য অধিবার, পিতার সহায়-সম্পত্তি বিলিয়ে দেবে? বিয়ের দু’দিন পর আলী আসগরের বুকে মাথা রেখে আদর করতে করতে বলেছিল মাকসুদা যদি প্রয়োজন মনে করো, তোমার জায়গা জমি বিক্রি করে তোমার মায়ের নামে একটা স্কুল করে দাও। চিরকাল গ্রামের মানুষ তোমাকে, তোমার মাকে মনে রাখবে শ্রদ্ধার সঙ্গে।
আহা! কী জবিন! কী অবর্ণনীয় সুখ-তাঁকে দিয়েছিল বিয়ের পর বছর খানেক মাকসুদা। হ্যাঁ-মাকসুদা কথায় হারানো বা ভুলে যাওয়া রাজ্যে গিয়েছিল আলী আসগর। বাপের জমির ভাগ এনে এলাকায় প্রতিষ্টা করেছে শেফালি বেগম উচ্চ বিদ্যালয়। ভঙ্গুর, ক্লেদাক্ত জীবনে দ্বিতীয়বার অসম্ভব সুখ পেয়েছিল মধু-আলী আসগর। আর একবার পেয়েছিল বাসর রাতে, বুকের মধ্যে আস্ত একটা অনিন্দ্যসুন্দর মেয়েকে বুকের মধ্যে পেয়ে। জীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, বেদনা তিলতিল করে বলেছিল মাকসুদাকে। সেই কথা বলা কি কাল হয়েছিল? মাকসুদা বেগম-প্রথম দিকে সহানুভূতির সঙ্গে নিলেও, পরে কি তার মধ্যে কোনো আত্মপ্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়েছিল?
যার বিষক্রিয়ায় আলী আসগর তার চোখের কাঁটা হয়ে উঠছিল? তাহলে নিজের জবিনের বিষাক্ত বিক্রিয়া স্ত্রীর কাছে গোপন রাখাই ভালো? আলী আসগর অনেত ভেবেছেন, অনেক গবেষণা করেছেন- কিন্তু কোনো কূল কিনারা করতে পারেন নি। সংসার জীবনের বয়ে চলা এই দীর্ঘ প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছে ঘুঙুর। হায় ঘুঙুর! জীবনের সব সুষমা দিয়েই তিনি শত অবজ্ঞার পরও ভালোবাসতেন মাকসুদাকে। বারবার ফিরে আসতেন জোয়ারে ভেসে যাওয়া নৌকা ভাটায় যেভাবে ফিরে আসে- সেইভাবে আসতেন মাকসুদার কাছে, সংসারে। অথচ গতরাতে যা কোনো প্রমাণ উপস্থিত করতে পারবেন না ঠিকই কিন্তু যা দেখেছেন- সেই রমণীয় কুৎসিত দৃশ্যাবলি থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না এক মুহূর্তের জন্য। চোখে-মানসিকতায় দৃশ্যটা গেঁথে আছে তক্তার সঙ্গে পেরেক গাঁথার মতো।