কিশোর উপন্যাস

কিশোর উপন্যাস ।। কিডন্যাপ হলো চার গোয়েন্দা ।। শামস সাইদ ।। নবম পর্ব

বোকার মতো তাকিয়ে আছে নিলয়। তার মাথা অচল গাড়ি। কিছুই ভাবতে পারছে না। সামি বলল, রেজা স্যারের কাছে যাই। আমার মনে হয় ওরা এসেছে। স্যারকে জানানো উচিত।
তুই শিওর ওরা এসেছে? জানতে চাইল অয়ন।
মনে তো হচ্ছে। কতটা শিওর তা বলতে পারব না। স্যারকে এখনই জানাতে হবে।

অয়নও ভাবল তাই। তাদের শঙ্কার কথা স্যারকে জানানো উচিত। ক্লাস থেকে বের হবে অয়ন। পা রাখল দরজায়। কিন্তু বের হতে পারল না। কয়েক পা পেছনে সরে এলো। তার পেছনে নিলয়, আবির আর সামি। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে চারজন মানুষ। কালো কাপড়ে মুখ বাঁধা। চেহারা দেখা যাচ্ছে না। হাতের দিকে তাকাল অয়ন। অস্ত্রও আছে। ভয় পেয়ে গেল। ওরা কারা? এখানে কেন এসেছে? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সামি যা বলেছে তাই ঠিক। ওই কালো গাড়িটা ওরা নিয়ে এসেছে।

তাদের তুলে নেবে। অয়নের মনে পড়ল বাবার কথা। বাবার ভয়টা একটুও অমূলক ছিল না। ঠিকই বলেছিল। তখন গা করেনি। ভাবনা শেষ হয়নি অয়নের। ক্লাসের ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। খপকরে একজন ধরে ফেলল অয়নের হাত। নিলয়, সামি আর আবির একটু পেছনে সরে গেল। অন্যরাও ভয় পেয়ে গেল। এক কোণে চেপে দাঁড়াল। একজন গম্ভীর কণ্ঠে বলল, তোমাদের ভয় নেই। ওদের নিতে এসেছি। ওদের সাথে হিসাব আছে। অন্য তিনজন নিলয়, সামি আর আবিরকে ধরল।

নিজেদের মুক্ত করতে অনেকক্ষণ চেষ্টা করল অয়ন। কিন্তু পারল না। সামি প্রায় ছুটে গিয়েছিল। সামনে দাঁড়ান আর একজন জোরে থাপ্পড় মারল। ঠাস করে শব্দ হলো। ভ্যাবাচ্যাকা দিয়ে পড়ে গেল সামি। পালাতে পারল না কেউ। সব চেষ্টাই বিফলে গেল।

একজন কালো কাপড় দিয়ে ফটাফট বেঁধে ফেলল চোখ-মুখ। বাঁধল হাত। এরপর কাঁধে তুলে নিল। বীরদর্পে বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। স্কুলের মাঠ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তখন আর একটা বোম ফাটাল। সব অন্ধকার হয়ে গেল। সামনে যাওয়ার সাহস পেল না কেউ। পুরো স্কুলজুড়ে পিনপতন নীরবতা। একজন মানুষও দেখা যাচ্ছে না। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে পড়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা সেই কালো গাড়িটায় তুলে ফেলল ওদের।

শুইয়ে দিল ঠাসাঠাসি করে সিটের সামনে ফাঁকা জায়গায়। অয়নদের গায়ের ওপর পা রেখে বসল ওরা। গাড়িটা চলে গেল। সব শব্দ হারিয়ে গেছে। তারপর বেরিয়ে এলেন শিক্ষকরা। বারান্দায় দাঁড়াল ছাত্ররা। সবার মনে ভয় ও আতঙ্ক। ইংরেজি স্যার এলেন ক্লাস সেভেনে। জানতে চাইলেন কী হয়েছিল?

সামনে এলো ডানা। পুরা ঘটনা বলে গেল গল্পের মতো। রেজা স্যার তখনো জানেন না এই কাহিনি। ওয়াশরুমে ছিলেন। শুনছেন বিকট শব্দ। কিসের শব্দ বুঝতে পারেননি। তারপর থেমে গেল সব। আবার সরব হয়ে উঠেছে। হইচই পড়ে গেছে। হঠাৎ কী হলো। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন। বুঝতে পারলেন কিছু

একটা ঘটেছে স্কুলে। সবাই ছুটছে। বারান্দায় দাঁড়াতেই সামনে পড়লেন ধর্ম শিক্ষক। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে?
সবাই ছুটছে কেন?
অস্থির কণ্ঠে ধর্ম শিক্ষক বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার! কোথায় ছিলেন আপনি?
কী হয়েছে?
স্কুলে হামলা করেছে সন্ত্রাসীরা। ক্লাস সেভেন থেকে চারজন ছাত্রকে তুলে নিয়েছে। কমান্ডো স্টাইলে। বোমা ফাটিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে। ওদের সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস ছিল না কারো। বীরদর্পে হেঁটে গেছে। কেঁপে উঠল রেজা স্যারের বুক। মুহূর্তেই জমে গেলেন। কথা বলতে পারছেন না। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, অস্ত্র নিয়ে এসেছিল?
হ্যাঁ, অস্ত্র ছিল ওদের হাতে। মুখ ছিল বাঁধা। চিনতে পারেনি কেউ। গাড়ি নিয়ে এসেছিল। কালো গাড়ি। যেটা থামানো ছিল স্কুলের সামনে।

আকস্মিক এই ঘটনা শুনে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন রেজা স্যার। ক্লাস সেভেন থেকে তুলে নিয়েছে, তার মানে ওরা চারজন। এই ভয়ের কথাই বলেছিল অয়ন। ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী করবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। ফোন করলেন ওসি কুতুবউদ্দিনকে। অসম্ভব অস্থির কণ্ঠে জানালেন, খারাপ সংবাদ আছে অফিসার। সুন্দ্রাকাঠি আসতে হবে একবার। খারাপ খবর! কী হয়েছে মাস্টার? বলুন। একটু ব্যস্ত আছি। এখন আসতে পারব না। আসতে হবে অফিসার। কোনো কথা শুনতে চাই না। স্কুলে হামলা হয়েছে। আমার চার ছাত্রকে তুলে নিয়েছে। তারপরও আসবেন না আপনি? কণ্ঠটা ধরা ছিল রেজা স্যারের।

কখন তুলে নিল?

বেলা এগারোটার দিকে। বোমা ফাটিয়ে পুরো স্কুলে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল ওরা। কেউ দাঁড়াতে পারেনি সামনে।
কী বলছেন। কারা করল এই হামলা? আতঙ্কিত গলা অফিসারের।
আমার মনে হচ্ছে ওদের কাজ অফিসার। কালো গাড়ি নিয়ে এসেছিল। মুখ বাঁধা ছিল। কেউ চিনতে পারেনি। তবে সন্দেহ হচ্ছে ওরা। অন্য কেউ সাহস দেখাবে না। আপনি আসেন। যেভাবে হোক ওদের উদ্ধার করতে হবে।
চিন্তা করবেন না মাস্টার। আসছি আমি। পালাতে দেব না ওদের।
রেজা স্যারের অঙ্কের মাথা থেমে গেছে হঠাৎ।

কোনোভাবেই ওটাকে চালু করতে পারছেন না। থম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছুটে যাওয়ার কথা ক্লাস সেভেনে। কিন্তু যেতে পারছেন না। অনেক্ষণ পরে মনো হলো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন! চালু হলো তার মাথা। ক্লাস সেভেনে গেলেন।

দেখলেন ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আছে ওরা। হিংস্র জানোয়ারের থাবা পড়েছিল তা ওদের মুখে স্পষ্ট। তাকে দেখে কেঁদে উঠল কয়েকজন। ডানা বলল, ওদের নিয়ে গেছে স্যার।
সবাইকে শান্ত হতে বললেন রেজা স্যার। তোমরা কান্নাকাটি করো না। ভয়ও পেও না। ওদের কিছু করতে পারবে না। পুলিশ ফোন করেছি। ওসি সাহেব এসে পড়বেন। ওদের উদ্ধার করব আমরা। এরপর জানতে চাইলেন ঘটনা।

আবারও সামনে এলো ডানা। বলতে শুরু করল ঘটনা। আমরা কিছু বুঝতে পারিনি স্যার। যা ঘটেছে চোখের পলকে। ইংরেজি স্যার চলে গেলেন। খানিক পরেই বিকট শব্দ। সবাই চমকে উঠল। এত জোরে শব্দ আগে শুনিনি। ভয় পেয়ে গেলাম। কোথায় বোমা ফাটল? খানিক পরে আবার একটা শব্দ। সেটাও বিকট আওয়াজ তুলল। অয়ন, আবির, নিলয় আর সামি হয়তো কিছু বুঝতে পারছিল। ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল ওরা। সম্ভবত আপনার কাছে যেতে চাচ্ছিল। তখনই দরজায় দাঁড়াল চারজন মানুষ। ওদের হাতে পিস্তল। ভয়ে কয়েক পা পেছনে সরে

দাঁড়াল অয়ন। বড় হয়ে গেল ওদের চোখ। ক্লাস থেকে বের হওয়ার পথ নেই। এক কোণায় জড়ো হলাম আমরা। ওদের চারজনকে ধরে ফেলল। অয়ন, আবির চেষ্টা করছিল ছুটে যেতে। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করল। পারল না। সামি প্রায় ছুটে গিয়েছিল। একজন ওর কানের ওপর থাপ্পড় মারল। ঘুরে পড়ে গেল। এরপর চোখ মুখ বাঁধল। নিয়ে গেল কাঁধে করে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, কেউ সাহস করেনি ওদের সামনে দাঁড়াতে। আটকাতেও চায়নি। ভয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। বীরদর্পে হেঁটে গেল ওরা। গাড়িতে তুলে অয়নদের নিয়ে গেল। আমরা তাকিয়ে ছিলাম স্যার। অসহায়ের দৃষ্টিতে। আমাদের কিছু করার ছিল না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন রেজা স্যার। সবাই তাকিয়ে আছে স্যারের মুখের দিকে। এতটা অসহায় কিংবা মন খারাপ আগে দেখেনি কেউ। যেদিন স্যারকে পুলিশ ধরেছিল সেদিনও এতটা মন খারাপ ছিল না। স্যার ভেঙে পড়লেন অনেকটা। অনেকক্ষণ পরে মাথা তুললেন। তাকালেন ডানার দিকে। জানতে চাইলেন, ওরা কিছু বলেছিল?

রিয়াদ বলল, হ্যাঁ স্যার, ওরা বলেছিল─ তোমরা ভয় পেও না।

ওদের সাথে হিসাব আছে। তাই নিয়ে যাচ্ছি।

স্যার আর কিছু বললেন না। বুঝতে পারলেন হিসাব কোনটা। ওরা সহজে হার মানবে না। বড় খেলা শুরু করতে যাচ্ছে। গাড়িটা কোন দিকে গেছে?

ডানা বলল, বাহুবলের দিকে গেছে। অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। সোজা পথে যাবে না। ওরা খুব চালাক।

সেটা ঠিক বলছ। স্কুল থেকে তুলে নিয়েছে। তার মানে ওদের হাত লম্বা। দুর্বল ভাবা যাবে না। তোমরা শান্ত হও। চিন্তা করো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওসি সাহেব এসে পড়বেন।

আচ্ছা ওই গাড়ির নম্বরটা কেউ দেখেছিলে?

গাড়ির নম্বরপ্লেট ছিল না স্যার। ওটা টুকে রাখতে চেয়েছিলাম। বলল ডানা।

ক্লাস সেভেন থেকে বের হলেন রেজা স্যার। পুরো স্কুলজুড়ে আতঙ্ক। ভয়ে কাঁপছে শিক্ষার্থীরা। তাদের সাহস জোগালেন। ভয় পাবে না তোমরা। পুলিশে ফোন করেছি। এখনই চলে আসবে। ওদের খুঁজে বের করবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তবু কেউ ভরসা পায় না। স্যারদের কাছে না বলেই বাড়ির পথ ধরল। আবার কোন বিপদ হয়। আসতে পারে ওরা। রেজা স্যার গেলেন শিক্ষকদের কক্ষে। সেখানে আলোচনা চলছে এসব নিয়ে। সবাই তীর ঘুরাচ্ছে তার দিকে। আপনার জন্য হয়েছে এসব। স্কুলে বোমা ফাটিয়েছে। ছাত্রদের তুলে নিয়েছে। কী হবে এখন? সামনে পরীক্ষা। ছাত্ররা ভয়ে কাঁপছে। এই আতঙ্ক নিয়ে পারবে না ওরা স্কুলে আসতে। পরীক্ষার আসনে বসতে।

ইংরেজি স্যার বললেন, ওই পর্যন্ত ঠিক ছিল। আপনাকে জেল থেকে বের করেছিল ওরা। কিডন্যাপ করেননি আপনি, মুক্তি পেয়েছেন। সত্যটা সামনে এসেছিল। তারপর লেখাপড়ায় মন দিতে বলতেন ওদের। তা না করে খুললেন গোয়েন্দা স্কুল। ওদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। লেখাপড়া রেখে ওসব নিয়েই পড়ে রইল।

এখন কী হলো? অভিভাবকদের কী জবাব দেবেন? সেটা ভাবেন। যদি ওদের না পাওয়া যায় তার দায় আপনাকে নিতে হবে। তাছাড়া স্কুলের পরিবেশটাও নষ্ট করলেন। সুন্দ্রাকাঠি স্কুল এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন রেজা স্যার। একটা কথারও উত্তর ছিল না তার মুখে। মাথা নিচু করে বসে রইলেন। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তার জন্যই বিপদে পড়েছে ওরা। এটা অস্বীকার করতে পারবেন না। মেনে নিতেই হবে।

বিজ্ঞান স্যার ফজলুল হক বললেন, এখন কী করবেন, কিছু ভাবছেন?

আমাদের কিছু করার নেই। বিষয়টা পুলিশের। ওসি সাহেবকে ফোন করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বেন উনি,

দেখি কী বলেন।

ধর্ম স্যার বলতে চাচ্ছিলেন, করার নেই কেন বলছেন!

আপনাকে তো মুক্ত করল ওরা। ওদের খুঁজে বের করেন আপনি।

কিন্তু বলতে পারলেন না।

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস ।। কিডন্যাপ হলো চার গোয়েন্দা ।। শামস সাইদ ।। অষ্টম পর্বকিশোর উপন্যাস।। কিডন্যাপ হলো চার গোয়েন্দা।। শামস সাইদ।। দশ পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *