কিশোর উপন্যাস ।। কিডন্যাপ হলো চার গোয়েন্দা ।। শামস সাইদ ।। প্রথম পর্ব


বিস্ফোরণের মতই খবরটা দিল বাবা। তখন সন্ধ্যা। তারও আগে গাঢ় হয়ে নেমেছে অন্ধকার। আকাশে ঘন মেঘ। বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি। ভেজা বাতাস উড়ছে এলোমেলো। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন বাবা। কিছুটা ভিজে। তখনো অস্থিরতা কমেনি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গলার সবটুকু জোর দিয়ে ডাকলেন অয়নকে। একশ্বাসে অনেকগুলো ডাক দিয়ে থামলেন।

অন্যঘরে টিভি দেখছিল অয়ন। ‘নাট বল্টুর কান্ডকারখানা’। দারোগাবাবুকে কেমন করে বোকা বানিয়ে হাসছে ওরা। তা দেখে শব্দ করে হেসে উঠল সে। তখনই বাবার ডাক। রিমোট হাতে ছুটে এলো সামনের ঘরে। রান্নাঘরে পাকোরা বানাচ্ছিলেন মা। এই ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালেন। এমন করে ডাকছেন কেন অয়নের বাবা! অস্থির হয়ে তিনিও ছুটে এলেন। বাবার সামনে দাঁড়াল অয়ন। বুঝতে পারল আগুন জ্বলছে বাবার মেজাজে। মুখের দিকে তাকিয়ে নামিয়ে নিল চোখ। বাবার মুখ বেশ গম্ভীর। রাগে অস্বাভাবিক ওঠানামা করছে চোখের পাতা। ভাবছিল তার জন্য কিছু নিয়ে এসেছে। কিন্তু মুখ বলছে অন্য কথা। কিছু আনলে হাসি মুখে তুলে দিত হাতে। এতটা কর্কশ কণ্ঠে ডাকত না। অয়ন ছুটে যেতে চায় টিভির ঘরে। কিন্তু পারছে না। বেজায় ক্ষেপে যাবে বাবা। চুলের মুঠি ধরে মেরেও দিতে পারে রয়েল সাইজের এক থাপ্পড়। নিরুপায় দাঁড়িয়ে রইল তাই।

কিছুক্ষণ পরে চিন্তিত মুখে বাবা বললেন, খুব বেশি সাহস দেখিয়েছিস অয়ন। এতটা সাহস দেখানো ভালো না। কী হয় বলা যাচ্ছে না। খুব খারাপ কিছু হবে। কাঁটা দিচ্ছে আমার শরীর। যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। বাবার কথা শুনে বাজ পড়ল অয়নের মাথায়। কোথায় সাহস দেখিয়েছে সে! খুঁজে পাচ্ছে না। কিছু বুঝতেও পারছে না। বাড়ি থেকে তো বের হয়নি আজ। স্কুল থেকে ফিরে গোপাল ভাঁড়ের সঙ্গে ছিল। এখন নাট বল্টুর দুষ্টুমি দেখছে। তাই সাহস করে জানতে চাইল, কী হয়েছে বাবা? কোথায় সাহস দেখালাম? বাড়ি থেকে তো বের হইনি।

দুশ্চিন্তায় জড়িয়ে গিয়ে কথা বলতে পারছেন না বাবা। থরথর করে কাঁপছেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, একটা কালো গাড়ি ঢুকেছে আমাদের গ্রামে। চারজন মানুষ ছিল ওই গাড়িতে। মুখোশ পরা। কেউ চিনতে পারেনি। অস্ত্রও ছিল হয়তো। খালি হাতে আসেনি ওরা। কালো গাড়ি, অচেনা মানুষ! আসতেই পারে। তাতে সাহসের কী করেছে সে। কিছু বুঝতে পারছে না। তালগোল পাকিয়ে গেছে। না ভয়ে ভুলভাল বকছে বাবা। হয়তো মাথা ঠিক নেই। তবে কিছু একটা হয়েছে। নাহয় এতটা ভয় পেত না। বড্ড ভয় পেয়েছে, মুখ দেখেই বোঝা যা”েছ। খানিক পরে বলল, কালো গাড়ি এসেছে বুঝলাম, তা আমি কী করেছি? আজ তো বাজারেও যাইনি। বাড়িতেই ছিলাম সারা বিকেল। তাছাড়া কালো গাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক কী?

গাড়িটা কঙ্কাল বাড়ির দিকে গেছে। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন বাবা। এবার সামন্য সরে দাঁড়াল অয়ন। কঙ্কাল বাড়ির দিকে গেছে! চোখ তার কপালে। ঠোঁট কামড়ে খুঁজছে রহস্যের গন্ধ। বাবা বললেন, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে। মুহূর্তেই সব উধাও। কোথাও একজন মানুষ নেই। ভয়ে শুকিয়ে গেছে মুখ। টপাটপ বন্ধ হয়ে গেল দোকানের ঝাপ। যেখানে যে পারছে লুকিয়ে পড়েছে। তা কেন? ওরা তো বাজারে নামেনি। কাউকে কিছু বলেনি। কঙ্কাল বাড়িতে যাবে সেটাই বা শিওর হলে কীভাবে তোমরা? সবটাই ছিল অনুমান।

চড়াও হলো বাবার গলা। অনুমান না। আমাকে বুঝাতে আসিস না অয়ন। অনেক বুঝি। শুধু শুধু আসেনি ওরা। প্রতিশোধ নেবে। কাউকে ছাড়বে না। যাকে সামনে পাবে তাকেই মারবে। ওদের ব্যবসা নষ্ট করেছিস তোরা। তা মেনে নিয়ে মুখ বুজে থাকবে না। কুকুরের মতো কামড় বসাবে। তাই এসেছে। অয়ন বলতে চাচ্ছিল কি”ছু করতে পারবে না। অযাথা চিন্তা করছ তুমি। ওদের বিষদাঁত ভেঙে দেব। আমাদের চিনতে পারেনি। বোল্লার মতো হুল ফুটিয়ে দেব। পাগল হয়ে দৌড়াবে। পরনে কাপড় থাকবে না। কিন্তু বলল না। বাবার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। এসব মানবে না। আরও উত্তেজিত হয়ে উঠবে। হাই পাওয়ারের ধমক দেবে। তার সামনে স্থির থাকতে পারবে না সে। হাত চেপ্টা করে থাপ্পড়ও বসিয়ে দিতে পারে গালে। পাঁচ আঙুলের ছবি এঁকে যাবে। মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা যেন বুঝতে পারে সে ভয় পেয়েছে। নাহয় চিন্তা করছে। বিষয়টা হালকা করে দেখছে না। তাহলে সাহস জোগাবে। পাশে দাঁড়াবে। অভয় দিয়ে বলবে, চিন্তা করিস না। বিষয়টা আমি দেখছি। কিন্তু মনে তার অন্য কথা। ওরা এসেছে ভালো হয়েছে। ওসি সাহেবকে ফোন করবে এখন। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবেন ওদের। তখন বুঝবে খেলাটা কোথা থেকে শুরু হয়েছে।

বাবা বললেন, সাবধানে থাকিস অয়ন। বেশি সাহস দেখাইস না। তাহলে সবাই মরব। কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না ওরা। অয়ন কিছু বলল না। মাথাও তুলল না। ভাবছে, তারা মরবে না। মারবে। সময় হলে দেখতে পারবে বাবা। কারা মরে, কারা বাঁচে। কিছুক্ষণ ভেবে বাবা বললেন, তোদের ছেড়ে দেবে না ওরা। সাপের লেজে পা দিয়েছিস। সাপের মাথায় পাড়া দিতে হয়। লেজে না। লেজ খারাপ। ছোবল দেয়ার চেষ্টা করবে এখন। মাথা অন্যদিকে ঘুরাল অয়ন। বাবার কথা একেবারে ফেলে দেয়ার নয়। তাদের খাতির করবে না ওরা সেটা সত্য। সুযোগ পেলে আঘাত করবে। তবু বাবাকে অভয় দিল। মাথা তুলে সাহসী কণ্ঠে বলল, তুমি চিন্তা করো না বাবা। কিচ্ছু করতে পারবে না। শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। যমের দুয়ারে দাঁড়িয়েছে ওরা।

এ কথা শুনে বিগড়ে গেল বাবার মেজাজ। চোখ রক্তবর্ণ। শুনছ ছেলের কথা! ওরা সাহস পাবে না। গাড়ি থেকে নামেনি, তাতেই বাজারের মানুষ ভয়ে অ¯ি’র। ও বলছে সাহস পাবে না। কী করে বুঝলি সাহস পাবে না? যারা এসব করে তাদের হাত কত লম্বা জানিস? ওদের সাহস মাপা যায় না। কবর থেকে লাশ তুলে নেয়া মুখের কথা না। অনেক সাহস লাগে। সেই লাশ আবার কঙ্কাল বানিয়ে ফেলে। তারপরও অয়ন বলছে ভয় পাওয়ার কিছু নেই বাবা। ওরা মৃত মানুষের সাথে পারে। জীবিত মানুষকে ঠিকই ভয় পায়। তাছাড়া আমাদের সাথে পুলিশ আছে। ওদের ছাড়ব না।

তা”িছল্যের সুরে মুখ বাকিয়ে বাবা বললেন, পুলিশ। ওদের কিচ্ছু করতে পারবে না পুলিশ। কঙ্কাল বানিয়ে ফেলবে। পারলে এত দিন ধরল না কেন? দিনের পর দিন এসব করে যা”েছ। পুলিশের অজানা ছিল? মোটেই না। নিশ্চয়ই জানত। তবে সাহস পায়নি হানা দিতে। সাপের গর্তে হাত দিয়েছিস তোরা। শুধু হাত দিসনি। টেনে বের করেছিস। তাই বাধ্য হয়ে এসেছিল পুলিশ। সারাক্ষণ তোদের পাহারা দেবে না। এটা মনে রাখিস। বাবা এসব বললেও অয়ন ভাবছে অন্য কথা। ওদের শিক্ষা দেবে সে। যেন এ পথে ভুল করেও পা না রাখে। বাবার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, তা গাড়িটা ফিরে গেছে? না কঙ্কাল বাড়িতে আছে?

অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রুক্ষ স্বরে বাবা বললেন, জানি না। এসব দেখে বাজারে দাঁড়াইনি। যদি জানতে পারে অয়নের বাবা আমি, তাহলে রক্ষা হবে না। তুলে নিয়ে যাবে। মারবে না। জ্যান্ত কঙ্কাল বানিয়ে ফেলবে। বাবাকে দেখলেও চিনতে পারবি না। মৃদু হাসল অয়ন। বুঝতে পারল বাবার ভয় একটুও কমেনি। বাবা এতটা ভীতু জানত না। তাকে তো কড়া সাইজের মার দেয়। তখন কে বুঝবে বাবার সাহস নেই। বাবাকে সাহস জোগাল। খামোখা ভয় পা”ছ তুমি! তোমাকে কেন তুলে নিবে?

বাবার রাগ আরও বাড়ল। দেখেছ, কেমন করে হাসছে ছেলে। ভয় পাব না! কে না ভয় পাবে? তুলে নিয়ে যাবে ওরা। ফেরার স্বপ্নও দেখা যাবে না। ঘুমাতে দেবে না। স্বপ্ন দেখব কীভাবে? কঙ্কাল বানিয়ে ফেলবে। তারপর বেঁচে দিবে। ঝুলব মেডিকেলের কোনো ছাত্রের কক্ষের দেয়ালে। এসব শুনে নিথর হয়ে গেলেন মা। তার ভেতর প্রাণ নেই। একটা কথাও বলেননি। থ হয়ে তাকিয়ে আছেন। খুব চিন্তা হচ্ছে তার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অয়নের সামনে বড় বিপদ। এই শঙ্কা মাকে আরও বেশি দুর্বল করে দিল। রেজা স্যারকে মুক্ত করেছে ওই পর্যন্ত ঠিক ছিল। তারপর কেন ওসব কঙ্কাল উদ্ধারে গেল। ছেলেটাকে ফেরাতেই পারলেন না। এখন কী হবে। ওরা ধরে নিয়ে গেলে ফিরতে পারবে অয়ন? পারবে না। মেরে ফেলবে। মায়ের চোখে জল। শব্দ করেই কেঁদে উঠলেন হঠাৎ।

রাগের স্বরে বাবা বললেন, এখন কাঁদছ কেন? তখন ছেলেকে আটকাও নাই। একটুও শাসন করো নাই। ভালো কাজ করছে ছেলে। যখন তুলে নেবে তখন বুঝবে ভালো না খারাপ। দেখ ছেলের মুখ, দেখে রেখো। খুব বেশি দিন দেখতে পারবা না। অযাথাই মাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে বাবা। এটা ঠিক না। ওরা কিচ্ছু করতে পারবে না, বললাম তো। ওসি সাহেবকে এখনই ফোন করব। পুলিশ চলে আসবে। ওদের ধরে নিয়ে যাবে। তারপর দেখা যাবে কে কাকে কঙ্কাল বানায়।

হাত তুললেন বাবা। এবার একটু থাম। আর মাতুব্বরি করিস না। বিপদ ডেকে বাড়ি পর্যন্ত আনিস না। পথেঘাটে যা করেছিস ওখানেই শেষ কর। শান্তিতে থাকতেদে। কী দরকার পড়েছে পুলিশকে জানানোর। ওরা যা করতে এসেছে করুক। খুব বেশি কথা বলছিস আজকাল অয়ন। কথা বেশি বলা ভালো না। বিপদ আসে কথায়। মানুষ বলে না, কথা যদি রৌপ্য হয়, চুপ থাকা স্বর্ণ। একটু চুপ থাকতে শেখ। চুপ থাকার মূল্যটা বোঝ। তাহলে কথা বলা বন্ধ করে দেব?

শোনো ছেলের কথা। বন্ধ করতে বলেছি! বলছি একটু কম বলবি। বুঝেশুনে বলবি। যার যা ইচ্ছে তা করুক। এসবে তোর নাক গলানো দরকার আছে? লেখাপড়া করবি, খেলাধুলা কর। এসব বড়দের কাজ। তোরা কেন নাক গলিয়েছিস। বিপদে পড়লে কে রক্ষা করবে?
ওদের ভয় পাচ্ছে তুমি? ভয় পেলে আরও বেশি চেপে বসবে। তখন লাশ না, জীবিত মানুষ ধরে নিয়ে কঙ্কাল বানিয়ে ফেলবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। তা নাহলে জীবিত আর মৃতের পার্থক্য থাকে না। রাখ তোর ন্যায়-অন্যায়। ভয় পাব না। ওরা মানুষ না। যম। জীবন ধরে টানাটানি করবে। বাজারের ওপর দিয়ে গাড়িটা যে গতিতে গেল, ধুলোয় সবার চোখ অন্ধ হওয়ার উপক্রম। মনে হচ্ছে পিষে মারবে গাড়ির নিচে ফেলে। কারো তোয়াক্কা করল না। খুব ভাগ্য, গাড়ি থেকে নামেনি। নামলে রক্ষা ছিল না।

কিছুক্ষণ থেমে আবার মুখ খুললেন বাবা। একটা কথা বলি অয়ন, গোয়েন্দাগিরি ছাড়, লেখাপড়া কর। স্কুল আর বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে পারবি না। স্কুলেও একা যাবি না। সতর্ক থাকিস। ভয় হচ্ছে আমার। ওরা কিছু একটা ঘটাবে। অয়নের মাথায় অন্য ভাবনা চেপেছে। ওরা হয়তো প্ল্যান করেই এসেছে। কিছু একটা করবে। নতুন করে কঙ্কাল বানাবে আবার! সেটা করতে দেবে না। যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে। বসে থাকলে চলবে না। যত শক্তি নিয়ে আসুক ওরা অপরাধী। ওদেরও ভয় আছে। আবার তাড়া করতে হবে ওদের।

Series Navigationকিশোর উপন্যাস ।। কিডন্যাপ হলো চার গোয়েন্দা ।। শামস সাইদ ।। দ্বিতীয় পর্ব >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *