উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// আট

পঞ্চপিত 
।।আট ।।

জনমানবহীন মহাকালের মৃত নক্ষত্রের মতো প্রাণশূন্য এই গ্রামে রাত নামে। আর তখনই অজাগতিক প্রাণের পুনর্জাগরণ ঘটে। প্রাচীন দেহাতীত আত্মারা পলাশির পলাতক। বিগতকালের মানুষ তারা। ওদের স্মরণে আছে তারা যে প্রাচীন রাঢ় ভূমির সন্তান। আত্মরক্ষার্থে কেবল সমতটেও আগমন। তারা এটাও জানে তাদের গ্রামত্যাগী উত্তরপুরুষেরা বরেন্দ্রভূমির দিকে চলে গেছে। পরিত্যক্ত গ্রামে ওরা ফিরে আসুক এমন প্রত্যাশা তাদের। কেননা দেহাতীত হয়েও তারা ভুলতে পারে না প্রচুর বারিপাতের এই দেশকে। সমুদ্রবাতাসে তুলে আনা বৃষ্টি তাদের দান করেছে শস্য। মলয় পর্বতের মলয় বাতাস এনেছে বসন্ত। আজও তাদের স্মরণে আছে প্রচুর জলের কারণে কি চমৎকার গজিয়ে উঠত ধানের গাছ। গোধূলিতে গরুগুলো গোয়ালে ফিরলে সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে যেত তারা। নারীরা পুরুষের দিকে কামদৃষ্টি ফেলে চুলে মাখতো তিলের তৈল। পঞ্চপিতার এই সমতটভূমি যারা পরিত্যাগ করেছে তাদের জন্য তারা শোক করে।

এই জলা-জঙ্গলের ভূমিকে কারা শস্যক্ষেত্রে পরিণত করেছিল? তারা নয় কি? কাদের জন্য? উত্তরপুরুষের জন্য। প্রাচীন আত্মাগণ শত শত বৎসর পূর্বের পলাশির পলায়ন বিষয়ে সপ্তকা–রামায়ণ ফেঁদে বসে। এই নব্য আবাসনে এসেই তারা পঞ্চপিতার দর্শন পেয়েছিল। তাই তারা এখন পলাতক উত্তরপুরুষদের জন্য অজাগতিক কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই কান্না শব্দশূন্য এবং অশ্রুহীন। কষ্টসাধ্য রাত ঘনিয়ে এলে প্রাচীন আত্মাগণ দৃশ্যান্তরে চলে যায়।

এবার একাত্তরের গণকবর থেকে জেগে ওঠে নিহতগণ। ওরা সংখ্যায় ছিল একচল্লিশজন। মৃত্যু তাদের গণনাকারী। বৃদ্ধ, যুবক, নারী এবং শিশু। আসলে একচল্লিশটি চলন্ত সজীব কংকাল, হাঁড়ের খাঁচা। ওরা অপেক্ষায় ছিল কখন একাদশির চাঁদ আকাশে উঁকি দেয়। আসলে চাঁদ ছিল মেঘের আড়ালে। দিবসটি ছিল পহেলা মে। শ্রমজীবী মানুষের প্রিয় দিবস। এক সময় মেঘ অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন ঝলমল করে একাদশির বিস্ময়কর উৎপল-চাঁদ। ঠিক ফুটন্ত পদ্ম। এমন বিস্ময়ের চাঁদ আর কবে দেখেছে ওরা?

গাঁয়ের প্রথম যে মুক্তিযোদ্ধা বাইশ বছরের তাজা যুবক, যাকে ব্যায়নেটের খোঁচায় হত্যা করে অন্য চল্লিশ জন নিহতের সঙ্গে গণকবরে পুঁতে দেয়া হয়, সে নিহত প্রৌঢ় অধ্যাপকে সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রণিপাত করে বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করে, ‘স্যার, দুনিয়ায় জীবদ্দশায় আপনি কখনও ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করবেন না, সেই কারণে পাকিস্তানি সেপাইরা আপনাকে ব্রাস ফায়ার করে হত্যা করে। কাফের শব্দটি বারবার উচ্চারণ করে দুশমনেরা আপনার লাশ গণকবরে নিক্ষেপ করে। যে ঈশ্বরের কারণে আপনাকে হত্যা করা হয়, সেই ঈশ্বরের সঙ্গে মৃত্যুর পর পরলোকেও কি সাক্ষাৎ ঘটেনি?’

অধ্যাপকের কংকাল তখন দুলে ওঠে। হাড়ে হাড়ে ঘর্ষণের শব্দ হয়। তার মাথার খুলির দু’পাটি দাঁতে এমনই শব্দ তৈরি হয় যে, মনে হয় স্টেনগান থেকে ব্রাস ফায়ার হচ্ছে। অধ্যাপকের কংকাল মুক্তিযোদ্ধারা কংকালকে উত্তর দেয়, ‘মৃত্যুর পর আমার দৃষ্টিশক্তি এমন মহাশক্তি অর্জন করে যে, আমি মহাশূন্যের বিগ ব্যাং, অন্ধকার মহাগহ্বর ছাড়িয়েও কোটি কোটি সৌরম-ল দেখতে পাই। কিন্তু কোথাও তোমাদের ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাইনি, তুমি নিজে কি পেয়েছ?’

মুক্তিযোদ্ধার কংকাল নিরুত্তর। কিন্তু আচমকা কারও কান্নার শব্দ হয়। নারীকণ্ঠ। কে কাঁদে? সেই ধর্ষিতা নারীÑ যে ছিল গর্ভবতী। সৈনিকের ধর্ষণের পর তার গর্ভ চিরে ভ্রƒণটিকে বের করে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুন করে গর্ভধারিণীকেও হত্যা করে। গণকবরের কংকালেরা দেখতে পায় একটি নারী কংকাল, কোলে তার ভ্রƒণকংকাল। একজন কৃষক-কংকাল জানতে চায়, ‘তুমি কাঁদছ কেন? জান না মৃত্যুর পর নারী-কংকালের কান্না নিষিদ্ধ?’

‘পরকালেও নারীদের কি পুরুষের ধর্ষণ থেকে মুক্তি নেই?’ নারী কংকাল জানতে চায়।

নিরুত্তর সবাই। ঠিক তখনই তেপান্তরের দিক থেকে কংকাল-সভায় সবচেয়ে সম্মানিত কংকাল ব্রহ্মকংকাল এসে হাজির। মন্দিরে পূজা করার সময় গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। ব্রাহ্মণ-বর্ণের বলেই সে বর্ণশ্রেষ্ঠ। কংকাল-জীবনেও তাই। অপরাপর কংকালেরা তাকে প্রণিপাত করে। এবার সে ধীবর কংকালকে ডেকে বলে, ‘শোন মেছোভূত, আর্যব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাস্ত্র তোকে মানতে হবে এই পরকালেও, ভুলে যাসনি মৃত্যুর পরও তুই অন্ত্যজ জাতি, মৎস্য সংগ্রহ আর আহার আজ থেকে নিষিদ্ধ এই মৃতদের জাগতে।’

ঠিক তখনই পঁচিশে মার্চের রাতে যে শিল্পপতিকে হত্যা করা হয় তার কংকাল তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে কংকাল-সভায় উপস্থিত হয়। কংকাল শিল্পপতি গুরুগম্ভীর গলায় সমবেত কংকালদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘তোমরা শোন, শ্রমিকদের জন্য ইহকালে যে বিধান, পরকালেও তাই, এই পরকালে আন্দোলন নিষিদ্ধ, কোনো দাবি নয়, কেবল আনুগত্য, অন্যথায় কংকালকে পরিণত করা হবে পিশাচে, শ্মশানে মড়া খেয়ে তবেই বাঁচতে হবে।’

এবার কংকালদের প্রেত নিঃশ্বাস পড়ে। জোরে বাতাস বইতে থাকে। সেই বাতাস কংকালের মুণ্ডে আছড়ে পড়লে চোখ আর মুখের ছিদ্রপথে প্রেত-বাঁশির শব্দ তোলে। কংকালেরা তা-ব মৃত্যু শুরু করে দেয়। তখনই এই প্রাণশূন্য গ্রামে চাঁদের আলো আরও ঘন হয়ে নামে। দূরকাছের গাছগাছালির ফাঁকে আগুনে পোড়া বাড়িগুলোর শূন্য ভিটায় প্রেতের আলো জ্বলে ওঠে। নীল আলো। কংকালদের নৃত্যও শেষ হয়। এক পলকে অদৃশ্য হয়ে যায় কংকালরা।

আকাশের চাঁদ হেলে যাচ্ছে। জোনাক কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যায়। চারদিক স্তব্ধতা। আরও পরে নিশ্চল স্তব্ধতা ভাঙে। আকাশ থেকে নেমে আসে এমন এক অজাগতিক শব্দ, যার মধ্যে তরঙ্গ নেই। এই তরঙ্গহীন অজাগতিক শব্দের দুনিয়ায় হঠাৎ আবির্ভাব ঘটে দশটি ছায়ামূর্তির। ওদের ছায়া আছে কিন্তু অশরীরী। জন-মানবশূন্য এই বধ্যভূমিতে এরা কারা? ওরা কি জৈন তীর্থঙ্কর? হ্যাঁ, তারা। বহু শতাব্দী পেছনে ফেলে বিগতকালের এই তীর্থঙ্করদের দলটি অজাগতিক রূপ নিয়ে পরিব্রাজনে বেরিয়েছেন। তাম্রলিপ্তি, পুন্ড্রবর্ধন, রাঢ়ভূমি পেরিয়ে সমতটের বরেন্দ্রভূমি পরিভ্রমণ করেছেন। করতোয়া, আত্রাই, মহানন্দা, তিস্তা তীরবর্তী গ্রামগুলো ঘুরে ও কোথাও জৈনদের খুঁজে পাননি তারা। জৈনরা দেশান্তর কিংবা ধর্মান্তর?

কোথায় গেল জৈনরা? এরা কি কোনো দৈব বিপাক প্লাবন কিংবা মহামারীতে নিঃশেষ হয়ে গেল? প্রাচীন প্রেতাত্মারা সাক্ষ্য দেয় যে, কৃচ্ছ্রসাধনের এই ধর্ম তাদের কাছে আত্মনিগ্রহ ভিন্ন অন্য অর্থ ছিল না। জীব হত্যা নিষিদ্ধ, কীট-পতঙ্গ-কেঁচো হত্যাও মহাপাপ। শস্যভূমি কর্ষণের ফলে যে পতঙ্গ বা কেঁচো নিহত হয় তাও পাপ। তা হলে শস্য ফলবে কি করে? গৃহে খাদ্য থাকলেও অর্ধাহার বিধান। কংকালসার দেহ কি সুখ-প্রশান্তি দান করে? তাই তারা পূর্ব-পুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে কেউ পুতুল পূজক, কেউবা ইরান-তুরান-আরবের পিরের ধর্ম গ্রহণ করেছে।

এসব সাক্ষ্য তীর্থঙ্করদের অশরীরী ছায়ামূর্তিকে ভেঙে খান খান করে দেয়। ওরা দমকা বাতাসের শব্দের মতো হাহাকার করে ওঠে। তখন তারা তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের জন মহাশোকে পতিত হয়। ঠিক তখনই একাদশির চাঁদ ডুবে যায়। রাতের শেষ প্রহরের আঁধার নামে। জনশূন্য বধ্যভূমির এই মৃত্যুর দেশে ছায়ামূর্তির ভগ্নাংশগণ অদৃশ্য হয়ে যায়।

রাত পোহায়। রোদের আলো চুষে নেয় গণহত্যার লাশের গন্ধ। গণকবরের ভেতর তিনটি গুহাপথ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছড়ানো ছিটানো কাঁচা মাটির উপর শেয়াল কিংবা হিংস্র মাংসাশী সরীসৃপের তীক্ষ্ণনখযুক্ত পদচিহ্ন। দলা দলা মাটি আলে বাসী জমাট রক্তে তৈরি মণ্ড। নির্বিকার উড়ে যায় কাকেরা। মাংসাশী হলেও গণহত্যার দিনে মাংসের এই প্রাচুর্যের সুসময়ে ওরা অনাহার ব্রত পালন করছে।

গণকবরের তৃতীয় গুহা মুখে একটি হাত দেখা যায়। হাতের মাংস খুবল নেয়া হয়েছে। অর্ধমুষ্টিবদ্ধ আঙ্গুল। দুপুরের এই বধ্যভূমির গ্রামে রোদ দোল খায় গাছের পাতায়। ওই তেপান্তরের মাঠে রোদের মরীচিকার খেলা চলে। মরীচিকার ভেতর পা ফেলে কে যেন একজন আসছে গণকবরের দিকে। কেউ জলভ্রমে পড়েনি তো? মনে হয় কে যেন পরনের ধুতি কাপড় হঁটু অবধি তোলা, ফতুয়া গায়ে, কাঁধে গাদা বন্দুক তুলে জলভ্রমের মরীচিকার জলভেঙে এগিয়ে আসছে।

গণকবরের ভেতর মৃত্যু নিদ্রায় যারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে, মৃত্যুর পূর্বে যার আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল তারা তাদের কাছেই আসছেন তিনি। তার শ্বেত বসনের উপর অলৌকিক আলো ঝলমল করে। অথচ সেই বসন থেকে উঠে আসা ঘ্রাণে মৃত্যুর গন্ধ। গণকবরের পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। তার দৃষ্টি কবরের তিনটি সুড়ঙ্গের অন্ধকারে গড়িয়ে পড়ে। মাংস খুবলে খাওয়া যার হাতটি সুড়ঙ্গ পথে বেরিয়ে আছে, কবরে আবৃত তার লাশটি তিনি দেখতে চান। কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ হয় না। কবরে মৃত্যু ঘুমে আচ্ছন্নদের উদ্দেশ্যে এবার তিনি আপন পরিচয় দান করেন, ‘আমি চট্টগ্রামের সূর্যসেন, যাকে তোমরা জানতে মাস্টারদা নামে, আমি তোমাদের একথা জানাতে এসেছি যে, ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমার যেমনি পুনরুত্থান ঘটেছে একাত্তরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য, ঠিক তেমনি এই গণকবরের অন্ধকার থেকে তোমাদের আত্মার পুনর্জাগরণ ঘটবে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার ভেতর। পুনর্জারণের সময় সমাগত, তোমরা জেগে ওঠ।’

ঠিক তখনই একটি অতি উজ্জ্বল আলোর বৃত্ত নেমে আসে গণকবরের উপর। ভূকম্পনের মতো বিশাল কবরটি কেঁপে ওঠে। অজাগতিক সূর্যসেন হাঁটতে থাকেন। তার শরীর তেপান্তরের অগ্নিময় সূর্যালোকের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়। আলোর পর্দাটি তারপর দুলতে থাকে। দোলায়মান পর্দা থেকে ঝরে পড়ে অজস্র আলোর কণা।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// ছয়ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// নয় >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *