উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব সাত

॥ সাত ॥

পঞ্চপিতা পিতৃভূমির পিলসুজগুলো একে একে নিভে যায়। অনাদিকালের অন্ধকারে মানুষগুলো পতঙ্গের মতো যেন গুহা নিবাসে অদৃশ্য হয়ে যায়। গ্রামে ফিরে নিত্যানন্দ তাদেরকে কি যাদুকরের মতো সম্মোহিত করেছে? ওরা অজানা, অদেখা, সমাগত কোনো ভয়ংকর পরিস্থিতির কাছে কি আত্মসমর্পিত হতে রাতের অন্ধকারে নিঃসাড় হয়ে গেলো? পলাশির পলায়নের স্মৃতি ওদের ভয়ার্ত করেছে? দিবারাত্রি দীর্ঘপদ যাত্রা, পথিমধ্যে দুস্যদের আক্রমণ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, নির্ঘুম কি তাদের বুকের ভেতর সাহসের বীজ অংকুরিত করেনি? মনে হয় পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যাবিধৌত দেশে এসে পললভূমিতে স্বল্পশ্রমে অধিক স্থূল জন্মাতে গিয়ে আলস্যদোষে তন্দ্রালু হয়ে পড়েছে? তাই কি তারা শস্যভূমি কর্ষণ এবং বীজ বপনের সমার্থক মনে করে নারী সম্ভোগ আর সন্তান বীজ বপনের বিষয়টি? আত্মশক্তি অর্জনের সাধনা পরিত্যাগ করে তারা দেবী কালীর কাছে ভিক্ষার পাত্র নিয়ে দাঁড়ায় কেন শক্তি লাভের জন্য? ওদের কি শক্ত হৃৎপিণ্ড নেই? একদিকে ভয় আতঙ্ক, অন্যদিকে অনিদ্রায় ছটফট করে রাত নিঃশেষ করে দেয় নিত্যানন্দ। গাঁয়ে যে গুজব রটিয়ে গেছে কেবা কারা, শহর জ্বালিয়ে দিয়ে নরমুণ্ডে গেন্ডুয়া খেলতে খেলতে পাকিস্তানি পাঞ্জাবি সেপাইরা গ্রামের দিকে ছুটে আসছে, একি তবে সত্যে পরিণত হবে? বাঙালিরা পাকিস্তান ভাঙতে চায়, এ সত্য যেমনি আজ তাদের কাছে গোলকধাঁধা বলে মনে হচ্ছে, হিন্দুস্থান ভেঙে পাকিস্তান তৈরির সময়ও একই গোলকধাঁধায় পড়েছিল পলাশির পলাতকেরা। ওরা তো পঞ্চপিতা, পরমেশ্বরের সন্তান। কেঁচোর মতো মাটিতে জন্মে মাটির অন্ধকার নিরাপদ আয়েই জীবন কাটাতে চায়। মাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে কেঁচো যেমনি বাঁচতে পারে না তেমনি পলল মাটির এই শস্যভূমি বিচ্ছিন্ন হলে ওরা হারিয়ে ফেলবে অস্তিত্ব। মাটির এই মায়াজাল বড় জটিল, বড় রহস্যময়।

অথচ নিত্যানন্দ শুনেছে ইংরেজেরা শস্যভূমি চাষ ছাড়াও দিব্যি বেঁচে থাকে। তারা সাতসমুদ্দুর পেরিয়ে এ দেশে এসেছিল বণিক হয়ে। হয়ে গেছে রাজা। ওরা রেলগাড়ি বানিয়েছে, বানিয়েছে জাহাজ, নিজেদের দেশ পেছনে ফেলে, শস্যভূমি পরিত্যাগ করে পলাশির আম্রকাননে যুদ্ধ করেছে। শস্যভূমির মায়া ওরা কোন যাদুশক্তিতে পরিত্যাগ করেছিল? উত্তুঙ্গ সমুদ্র কি মন্ত্র দিয়েছিল কানে?

না, পঞ্চপিতার পঞ্চবর্ণের শক্তি ছিন্ন করার সাহস শক্তি নিত্যানন্দের নাই। এই মাটির মায়া যে রহস্যে ঘেরা। কিন্তু নগর ছেড়ে যদি পাঞ্জাবিরা সত্যি গাঁয়ে হামলে পড়ে তখন তো পালাতেই হবে। গৃহকোণের এই চোখ ছলছল করা মমতা, চিরচেনা বংশ-পরম্পরার ওম নেওয়া এই ফসলের মাটি ফেলে কোথা পালাবে সে? আপন ঘুমের বিছানা ছেড়ে কবে গ্রামান্তরে কোন আত্মীয়ের ঘরে একরাত কাটিয়েছে, মনে পড়ে না তার। কাটালেও আপন চাঁটাইয়ের বিছানার বাইরে হয়ত চোখের পাতা এক হয়নি ক্ষণমুহূর্তের জন্য। কি আত্মহননের অশ্ব মায়া, কি মমতার নিষ্ঠুর যাদুস্পর্শ!

অথচ অলঙ্ঘনীয় ভাগ্য বিপর্যয়ের সেই দিন আসে। গণহত্যার দিন। গৃহদাহের দিন। পলায়নের দিন। প্রাচীন নবী মুসার অনুসারীদের মতো। এ যেন এক ঐশ্বরিক অলঙ্ঘনীয় মন্দভাগ্য। সবই যেন পূর্বনিধারিত। ‘তখন ইস্রায়েল-সন্তানেরা বালক ছাড়া কমবেশ ছয় লক্ষ পদাতিক পুরুষ রাত্রি শেষ হইতে সুক্কোতে যাত্রা করিল। তাহাদের সহিত মিশ্রিত লোকদের মহা-জনতা এবং শেষ ও গো, অতিবিস্তর পশু প্রস্থান করিল। পরে তাহারা মিসর হইতে আনীত ছানা ময়দার তাল দিয়া ভারী শূন্য পিষ্টক প্রস্তুত করিল। কারণ তাহারা মিসর হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছিল। ইস্রায়েল-সন্তানেরা চারিশত ত্রিশ বৎসর কাল মিসরে প্রবাস করিয়াছিল। এই চারিশত ত্রিশ বৎসরের শেষে, ঐদিনে সদাপ্রভু ঈশ্বরের সমস্ত বাহিনী মিসর দেশ হইতে বাহির হইল।… এইরূপে সদাপ্রভু ইস্রায়েল সন্তানদিগকে মিসর দেশ হইতে বাহির করিয়া আনিলেন।… আর মোশি লোকদিগকে কহিলেন, এই দিন স্মরণে রাখিও, যেদিনে তোমরা মিসর হইতে, দাসগৃহ হইতে বহির্গত হইলে।… যে দেশ তোমাদের দিতে সদাপ্রভু ঈশ্বর তোমার পিতৃপুরুষদের কাছে দিব্য করিয়াছিলেন, সেই মুগ্ধমধুপ্রবাহী দেশে তোমাকে আনিবেন।’

‘লোকেরা পলাইয়াছে, মিসর রাজকে এই সংবাদ দেওয়া হইলে, তিনি আপন রথ প্রস্তুত করাইলেন এবং পলাতক লোকদের পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। ফেরাউন যখন নিকটবর্তী হইলেন তখন ইস্রায়েল সন্তানেরা অতিশয় ভীত হইল এবং ক্রন্দন করিল। সদাপ্রভু ঈশ্বর মোশিকে কহিলেন, তুমি আপন ষষ্টি তুলিয়া সমুদ্রের উপরে হস্তবিস্তার কর, সমুদ্রকে দুই ভাগ কর, তাহাতে ইস্রায়েল সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্র মধ্যে প্রবেশ করিবে।’

‘মোশি সমুদ্রের উপরে আপন হস্তবিস্তার করিলেন, তাহাতে সদাপ্রভু ঈশ্বর পূর্বীয় বায়ুদ্বারা সমুদ্রকে সরাইয়া দিলেন ও শুষ্কভূমি করিলেন, তাহাতে জল দুইভাগ হইল। আর ইস্রায়েল-সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্রমধ্যে প্রবেশ করিল, এবং তাহাদের দক্ষিণে ও বামে জল প্রাচীর স্বরূপ হইল। তখন ফেরাউনের সকল অশ্ব ও রথ এবং অশ্বারূঢ়গণ ধাবমান হইয়া সমুদ্রের মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু রাত্রির শেষ প্রহরে সদাপ্রভু ঈশ্বর অগ্নি ও মেঘস্তম্ভে থাকিয়া মিসরিয় সৈন্যদের উপর সমুদ্র ঠেলিয়া দিলেন। তাহাতে ফেরাউনের যে সকল সৈন্য তাহাদের পশ্চাতে সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রইল না। তখন নবি মোশি ও ইস্রায়েল-সন্তানেরা সদাপ্রভু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে গান করিলেন, কেননা তিনি ফেরাউন সৈন্যদর সমুদ্রে নিক্ষেপ করিলেন।’ বাইবেল, ওল্ড টেস্টমেন্ট।

নিষ্ঠুর ফারাউ সৈন্যরা যেমনি নবি মুসার অনুসারীদের দাসত্ব মুক্তির সংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য মিসর থেকে বিতারণের উপায় হিসাবে হত্যা আর বন্দি করার তা-বে মেতে ওঠে, তেমনি পাকিস্তানি সৈন্যরাও পঞ্চপিতা পিতৃভূমির সন্তানদের হত্যা ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজগোখরোর মতো আগুন-ফণা ঊর্ধ্বগামী হয়। অগ্নিবিষ উগরে দেয়। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবার পর এই তারা প্রথম শিখল প্রাণের মায়ার চেয়ে পরম সত্য অন্য কিছু নয়। তারা গৃহত্যাগ করে মায়ের গর্ভনাড়ি ছেঁড়ার মতো। শিশুরাই কেবল নির্বিকার। বোধশূন্য বলে ওরা শোকহীন। যারা সদ্য কিশোর তাদের কারও কারও মনে স্বপ্ন উঁকি দেয় দূরযাত্রার আনন্দে।

পূর্ব-পুরুষের স্মৃতিধারকেরা বিগতকালের কোনো এক যুদ্ধের রূপকথায় অথৈ সাঁতার দেয়। হতে পারে সে যুদ্ধ মহাভারত কিংবা রামায়ণের। কারও স্মৃতি পৃথিবীর বয়ানে মরু কারবালার। কিন্তু শোকের চেয়ে সেই বিশ্বাসকে ওরা আঁকড়ে ধরে যেখানে কল্পিত নরক কিংবা দোজখ, স্বর্গ নয়তো বেহেশত জ্বল জ্বর করে জ্বলে চোখের আয়নায়।

গৃহত্যাগ কিংবা গ্রাম ত্যাগের পূর্বরাত ঘনিয়ে আসে। এমন রাতের অভিজ্ঞতা কারও থাকার কথা নয়। রূপকথায়ও তারা শোনেনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামে না তো মৃত্যুর দেবীর থালে বলি দেয়া ছাগশিশুর খণ্ডিত কালো মু- ঝনঝন শব্দে আকাশ থেকে ঝরে পড়ে। ওরা বিস্মিত হয় নিশিপক্ষিয় অন্ধকার ডানা ঝাপটানোর শব্দে। নির্বোধ শিশু ছাড়া কারও চোখে ঘুমের বিকার নেই। অন্ধকার রাতে সবার চোখ জোনাকির মতো জ্বলে আর নেভে। চিরচেনা মানুষগুলো মুখোমুখি হলে চমকে ওঠে। ওরা ভুলে যায় সেই ঝিলিকমারা চোখ সাপের নয়, বরং প্রিয় মানুষের। কারও মুখে কোনো জিজ্ঞাসা নেই। ওরা বুঝি কোনো কিছুর অস্তিত্বই অনুভব করে না, কেবল যাত্রার পূর্বরাতের আঁধার। এ আঁধার কি দুর্লঙ্ঘ্য? যাত্রাপথ কি চিহ্নহীন আদিম অরণ্য- উত্তর অজ্ঞাত। বিদ্রোহীদের ভাবের আদান প্রদান হয় ভাষার বদলে ইঙ্গিতে। ওরা সত্যি ভাষাহীন ইতরপ্রাণিতে বদলে গেছে। আপন নারীর সঙ্গে দেহমিলনের যে প্রাত্যহিক অভ্যাস কিংবা সন্তান স্নেহের জৈব তাড়না তা কি কেড়ে নিয়েছে এই যাত্রাপর্বের শেষ রাত? মধ্যরাতে ওরা পরস্পর অচেনা হয়ে যায়। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসও হারিয়ে যায়। একে অন্যকে হত্যাকারী বলে ভ্রম হয়। আসলে আতঙ্কে সবাই দৃষ্টিভ্রম আর মতিভ্রম হয়ে যায়।

রাত ফুরিয়ে ছায়াচ্ছন্ন আলো নামে। বাস্তুভিটা পরিত্যাগকারীগণ বিস্ফারিত চোখে প্রভাতের দুনিয়াটা দেখে। ওরা যেন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অপরাধী, যাদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে এগিয়ে আসছে জেলখানার ফাঁসুড়েগণ। ওদের পায়ের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। তাই তারা নির্বিকার, অস্তিত্বহীন। অচেনা অন্য দুনিয়ায় অস্তিত্ব স্তব্ধতার ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে আছে।

ওরা কেবল গণহত্যাই নয়, স্বাধীনতা ঘোষণা, ঘোষকের নাম এবং মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ যে গুজবের মতোই শুনেছে, সে সবও মতিভ্রমে ঘোর আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মানুষগুলো অতীন্দ্রিয় জগতে যেন ভাসমান এবং দোলায়মান। শূন্যে ভাসছে ওরা। সেই শূন্য থেকে নেমে আসার ক্ষমতা অচেনা-অদেখা অশরীরীরা কেউ যেন কেড়ে নিয়েছে। কি ভয়ঙ্কর দুঃসময়। অপার এক দৈব সমুদ্র!

সূর্য ওঠার পূর্ব মুহূর্তে গ্রামের মানুষগুলো বাস্তুভিটা থেকে উঠোনে পা ফেলে। ওরা শ্মশান কিংবা গোরস্থানে লাশ বহনকারীদের মতো নীরব। জীবিতদের চেয়ে মৃতদের শরীরের বোঝা অধিক। তাই তারা নতমস্তক। কিন্তু বাস্তুভিটার বাইরে যে বিস্তীর্ণ শস্যভূমি তার পাশে এলেই আচমকা সমস্বরের আর্তনাদ ওঠে। জন্ম-জীবন-মৃত্যুর এই চিরচেনা দুনিয়া অদৃশ্য।

দুই শতাব্দীকাল পেরিয়ে পলাশির উদ্বাস্তুগণ দ্বিতীয় উদ্বাস্তু ভূমির সন্ধানে আদিগন্ত শস্যভূমি আর দিগন্ত রেখার ওপারে সবুজবৃক্ষের দিগ্বলয়ে দিকে স্থির দৃষ্টি ফেলে ভূমিতে হাঁটু ভেঙে বসে হাত তুলে অন্তিম প্রার্থনায় মগ্ন হয়, ‘হে পঞ্চপিতা পিতৃভূমি পরমেশ্বর, আমরা হতভাগ্য, অভিশপ্ত। তাই তোমাকে পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছি। তুমি আমাদের সন্তানের জন্য দিয়েছিলে নারী, খাদ্যের জন্য ভূমি। সে সব অস্বীকার করে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু পুনরায় আমরা ফিরে আসব। হে পিতা, তুমি আমাদের শক্তি দাও, তুমি আমাদের অস্ত্র দাও, তোমার জন্য বুকের রক্ত দেবার সাহস দাও।’

তারপর সূর্যকে সাক্ষী রেখে ওরা পা ফেলে ওরা ক্রন্দনহীন, কিন্তু চোখে জল। সে জল সূর্য তাপে শুকিয়ে যাবে, এই তাদের বিশ্বাস। তাই দিগন্ত রেখার মতো দীর্ঘ কাফেলা এগিয়ে চলে। ওদের পঞ্চাৎভাগ কেবল দৃশ্যমান।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব ষোল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *