উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// ছয়

এক পূর্ণিমা রাতে তেপান্তরের মাঠের উপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দিল্লির শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা এবং আজাদ হিন্দ্ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে অশ্বপৃষ্ঠে ছুটতে দেখে নিত্যানন্দ। শীতকাল নয়। তবু তার মনে হয় আসমান আর জমিনের মাঝখানে কুয়াশার ঘন একটি পর্দা ঝুলে আছে। তিনজন অশ্বারোহী নিকটবর্তী হতেই পর্দাটি দু’ভাগ হয়ে যায়। অশ্বারোহীগণ তার ভিতর ঢুকে যাওয়া মাত্র পর্দা জোড়া লেগে যায়। কিন্তু তখনও নিত্যানন্দের কানে অশ্বখুরধ্বনি আছড়ে পড়ছিল। বাতাসে লোবানের গন্ধ।

তাই সে প্রত্যাশা করে প্রাচীন পৃথিবীর জাতিস্মর কাকেশ্বর তার সামনে এসে দাঁড়াক। অথচ কাকেশ্বর কিংবদন্তির ভিতর হারিয়ে গেছে সেই কবে। আজ আর ধরিত্রী দাস, দমনক কিংবা। চণ্ডরবও নেই। কে ব্যাখ্যা দেবে এসব অজাগতিক রহস্যময় দৃশ্যের? দিতে পারত অজানা কোন মুলুক থেকে ফসলের মৌসুমে গ্রামে আসা পটুয়ারা। ওরা তো যাযাবর। হঠাৎই উদয় হয় আবার হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। পটের ছবি দেখিয়ে গান গেয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে শস্যদানা কিংবা পয়সা কুড়িয়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়, কেউ জানে না। ওরাই জানে চেরাগি ফকিরের হদিস। যাযাবর পটুয়ারা।

যেই নারী স্বামীর আগে খাইয়া ঘুম যায়,

সেই নারী সবার আগে নরককুণ্ডে যায়।

যেই নারী যপযপাইয়া পায়ের শব্দে চলে,

সেই নারীর স্বামী মরে নিশি অকালে।

শিব, দুর্গা, লক্ষ্মী ঘর ছাড়ে নারীর পাপে,

সংসার বিনাশ পাগলা শিবের অভিশাপে।

কোন স্বপ্নের কোন অর্থ ফকির তা জানে। কোন দৃশ্যে কোন বিপদের আলমত, তাও জানে ফকির। নিত্যানন্দ কেন বীর যোদ্ধাদের ঘোড়ার পিঠে দেখল, যারা মৃতদের জগতের বাসিন্দা, এর ব্যাখ্যাকার গ্রামে খুঁজে পায় না নিত্যানন্দ। তাই সে আতঙ্কের মধ্যে দু’দিন কাটিয়ে দূর গাঁয়ে চলে যায় চেরাগি ফকিরের খোঁজে। সে জানতে চায় পূর্ণিমা রাতের সেই দৃশ্য তার কোনো দুর্ভাগ্যের ইংগিত কিনা। ভাগ্য ভালো সে খুঁজে পায় ফকিরকে।

চেরাগি ফকির তার পঞ্চশিখার চেরাগ জ্বালিয়ে নিত্যানন্দকে অন্য কথা বলে। সে জানায় অতীতের কোনো মৃত পিরের কথা। সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে সেই পির এই মুলুকে এসেছিলেন আরবের মরু আর পাহাড় পেছনে ফেলে। মৃত্যুর পর সেই পির তার মুরিদের দেখা দিতেন সুরত ধরে। কেউ হয়ত দেখতে পায় তিনি ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়েই নামাজ পড়ছেন, হয়ত দেখল তিনি নিজের কবর-মাজারের পাশে বসে আছেন ইবাদতের ভঙ্গিতে। হাতে তসবি।

হতাশ নিত্যানন্দ বাড়ি ফিরে আসে। পথে সে অচেনা একজনের মুখে শুনতে পায় চেরাগি ফকির জিন সাধক। জিনেরা আদম সুরত ধরে ফকিরের আদেশ পালন করে। চাষের কাজ করে দেয়। মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে এই কারণে যে, উপকার করে একটা পয়সাও হাত পেতে নেন না। জনশ্রুতি এই, চেরাগি ফকিরের ঈমান পরীক্ষার জন্য খোদা তার প্রথম শিশুপুত্রকে দুনিয়া থেকে তুলে নেন। ফকিরের চোখে একফোঁটাও পানি নেই। খোদার ইচ্ছাকে মেনে নেন তিনি।

ইবাদত-বন্দেগিতে মসগুল চেরাগি ফকিরের কুদরতি ক্ষমতার সাক্ষী তার স্ত্রী। একদিন সে হঠাৎ দেখতে পায় ধ্যানমগ্ন ফকিরের জ্বলন্ত চেরাগের পাঁচটি নলের ভেতর থেকে পাঁচজন জিন বেরিয়ে আসছে। ওদের শরীর আগুনের তৈরি।

রাতে ঘুম নামে না নিত্যানন্দের। ছটফট করে। হঠাৎ তার কানে আসে বাইরের অন্ধকারে ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ। বালিশের উপর মাথাটা উঁচু র্ক না, কোথাও কোনো শব্দ নেই। বালিশে মাথা নামাতেই আবার সেই শব্দ। নিত্যানন্দ বিছানায় উঠে বসে। অন্ধকারে হাতড়ে দুয়ার খুলে বাইরে আসে। নিস্তব্ধ রাত। ঝিঁঝি ডাকে। খালের পারে যে জঙ্গল বেত আর ভাঁট ঝোপ সেখানে উড়ন্ত জোনাকি জ্বলছে। হাজার হাজার। কি বিস্ময়। জোনাকিরা গাঙের স্রোত তৈরি করেছে। ঢেউ আর ঢেউ। জলের ঘূর্ণি জোনাকিদের এমন খেলা তো জীবনে আর কখনও দেখেনি। কেউ দেখেছে এমন কথাও শোনেনি।

এটা শোনো প্রেতরহস্য নয়তো? হঠাৎ একটি কালো ডানার পতঙ্গভূক নিশিপক্ষি জোনাকির নদীতে সাঁতার দেয়। পাখির ডানার ঝাপটায় জোনাকির জলঘূর্ণি ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। অদৃশ্য হয়ে যায় জোনাকিরা। বেত আর ভাঁট ঝোপ রাতের ভেজা ঘন রঙে থিক্থিক্ করে। বাড়ির বাইরের কাঠবাদাম গাছের অন্ধকার মগডালে ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ হয়। হয়ত উড়ন্ত পেঁচা নেমে পড়েছে গাছের ডালে। মুখে শিকার করা নির্বিষ সাপ।

তারও তিনদিন বাদে নিত্যানন্দ পুনরায় ছুটে যায় চেরাগি ফকিরের বাড়ি। ফকির তাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে গম্ভীর গলায় বলে : তুই বিধর্মী, কিন্তু নেকবান্দা, তাই আসছে বুধবার সন্ধ্যায় আমার কাছে আসবি। একা কিন্তু। সেদিন মহররমের দিন। সেদিনই আমার পুত্রের ইন্তেকাল ঘটে, হ্যাঁ সেদিনই আসবি। ভুলবি না, একা কিন্তু।’

আলপথ, জলা-জঙ্গল ঘেরা কয়েকটি গ্রামের দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে একটা ঘোরের ভেতর নিত্যানন্দ সন্ধ্যা নামার পূর্বেই চেরাগি ফকিরের আস্তানায় হাজির হয়। ফকিরের মুখ বিষণ্ন। কারবালার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার স্মৃতি তার বুকের ভেতরটা রক্তাক্ত করে। তার উপর ঠিক এই মহররমের দিনেই ফকিরের পুত্র বিয়োগ ঘটে।

‘ফকির, পুত্রের মৃত্যুর কথা কি এখন আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে?’ নিত্যানন্দ খুবই বিনীতস্বরে কথাটা বলে।

‘তা ঠিকই ধরেছিস বাবা, কিন্তু অধিক কষ্ট পাচ্ছি হোসেনের মৃত্যুতে, গোনাহগার সিমার তাকে এই মহররমের দিনেই ফোরাত দরিয়ার তীরে হত্যা করে’, বলতে বলতে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে ফকির। এ যেন এক অর্বাচীনের কান্না।

নিত্যানন্দ নিথর হয়ে পড়ে যেন দাঁড়িয়ে থাকা একটি লাশ। চেরাগি ফকির বুঝতে পারে। নিত্যানন্দকে দাওয়ায় বসতে দিয়ে বেলা ডুবে যাবার অপেক্ষায় থাকার কথা বলে অদৃশ্য হয়ে যায়। নিত্যানন্দ ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলে কান্নার সুরে ফকিরের সুর তুলে জিকির পড়ার মতো শব্দ শুনতে পায়। কোথা থেকে, কোনদিক দিয়ে শব্দগুলো ভেসে আসছে বুঝতে পারছে না। নিত্যানন্দের মনটা কেমন উলটপালট হয়ে যায়। নিহত হোসেন বুঝি তারও কত আপন, হয়ত সেই সব দেবতাদের মতোই একজন, যে তাদের গ্রামের ঘরে ঘরে নিত্য পূজা পায়। তাই সে সেই অজ্ঞাত দেবতাকে চোখ বুঁজে প্রণিপাত করে।

কখন তার সামনে চেরাগি ফকির সটান দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে কতক্ষণ, বুঝতেই পারেনি নিত্যানন্দ। চোখ খুলে সে থতমত খেয়ে যায়। নিশ্চুপ ফকির অপলক তাকে দেখছে। এক সময় অনুচ্চস্বরে বলে, ‘তোর চোখে কি পানি? কারও জন্য শোক করবি না। আমিও অবশ্য, শোক করি, কিন্তু তাতে কবরের ভেতর মানুষের, কষ্ট পায়। আত্মা কষ্ট পায়।’

নিত্যানন্দ চোখ মোছে। বিড়বিড় করে মা বলে তা শোনা যায় না। চেরাগি ফকির খানিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু তার ঠোঁট নড়ে। আসলে তার মনের ভেতর জিকিরের ঘোর তখনও কাটেনি। এই ঘোরের ভেতর ফকির আসমানে চোখ তোলে। তার চোখ বিস্ফারিত। একি আলামত আসমানে? ঘূর্ণায়মান একটি অগ্নিগোলক ছুটে বেড়াচ্ছে আসমানে। কিয়ামত কি ঘনিয়ে আসছে? নূহের কিয়ামতের কথা মনে পড়ে তার। সে একটি কিসতি খোঁজে যার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পায় খোদার নেক বান্দারা। কেবল রক্ষা পায়নি নুহের অবাধ্য এক বেদ্বিন পুত্র।

তারপর একসময় নিত্যানন্দকে পাশে বসিয়ে সেই পূর্ণিমা রাতের অশ্বারোহীদের কথা পাড়ে। এসব দৃশ্যের রহস্যময় দুনিয়ায় প্রবেশ করে ফকির। এর সানে-নজুল কি? নিত্যানন্দ সম্মোহিত হয়। চেরাগি ফকির তাকে এমন এক দুনিয়ার সীমানায় নিয়ে যায় যেখানে নিত্যানন্দ আলো-অন্ধকারের এক গোলক ধাঁধায় পতিত হয়। কেননা দিন সমাগত। রক্তের বান বয়ে যাবে। হাজার হাজার নরকংকাল চারদিকে ছুটে বেড়াবে। তাদের শুকনো হাড়ে হাড়ে সংঘাতের ফলে যে শব্দ হবে তা নর-বলির বাজনার ভয়ংকর শব্দে ওই আসমান আর এই জমিনে কম্পনের সৃষ্টি হবে। গৃহগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মানুষের কাফেলা ছুটবে দিগদিগন্ত, দিগি¦দিক। বিচ্ছিন্ন হবে পরস্পর থেকে। হাজারজনের কাফেলা পরিণত হবে শতজনে। কেউ হবে সঙ্গীহীন, একাকী। সঙ্গীদের রক্ত আর মৃতদেহ মাড়িয়ে ওরা যেখানে পৌঁছবে, এক সে অচেনা দুনিয়া। ওখানেও মৃত্যু ওত পেতে থাকবে।

চেরাগি ফকিরের আস্তানা পেছনে ফেলে নিত্যানন্দ যখন গাঁয়ের উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামে। ঘরের বাইরে জনমনিষ্যির গতাগম্য নেই। সে ভয়ার্ত, কিন্তু দিগ্ভ্রান্ত নয়। মনে হয় চেরাগি ফকির তার পথের সঙ্গী। ওরা পরস্পর কথা বলছে। আসলে নিত্যানন্দ নিজের সঙ্গেই কথা বলছে। তার আরও মনে হয় মাঝপথে তৃতীয় কেউ তাদের সঙ্গী হয়েছে। তৃতীয় ব্যক্তির কণ্ঠস্বর অচেনা। কিন্তু অলৌকিক। এমনি কণ্ঠস্বরের কথা সে গ্রামের কবিয়ালদের মুখে শুনেছে। সেই কথা এ দুনিয়ার নয়, বরং অন্য দুনিয়ার। দৈব। সেই দৈবকণ্ঠই তাকে শোনাচ্ছে, ‘বহু দূরে নগরের আসমানে গভীর রাতে যে আলোর আভা ক’দিন ধরে দেখা যায় তা আসলে গৃহদাহ। নগর জ্বলছে। সেই অগ্নি রেখায় সীমানায় যে বজ্রপাতের শব্দ ওঠে তা দানবের অট্টহাসি। আসমান ফালাফালা হয়ে যায় সেই হাসিতে। হাসির ভাঙা টুকরো হাজার হাজার অগ্নিগোলকের মতো শব্দ নিক্ষেপ করে সব বিচূর্ণ করে দেয়।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব পাঁচধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// আট >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *