ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব এক
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব তিন
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা// হরিপদ দত্ত // পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// নয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // পঞ্চপিতা // হরিপদ দত্ত // পর্ব// দশ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব এগার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব বার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।।পর্ব -তের
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব চৌদ্দ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব -পনেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব ষোল
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পঞ্চপিতা।। হরিপদ দত্ত।। পর্ব সাত
॥ পাঁচ ॥
চারপাশে ছড়িয়ে আছে কে অলৌকিক মায়াজাল। নানা বৃক্ষশোভিত দেশ। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ আর শব্দের মতো পঞ্চগুণের মাদক রূপে রূপে অপরূপ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার মতো মায়াবতী পঞ্চনদী। সবুজ-পেলব পঞ্চপল্লব ছাওয়া আম্র, অশ্বত্থ, বট, পাকুড় আর যজ্ঞডুমুর গাছের আদিগন্তবন। অশ্বত্থ, বট, বিল্ব, আমলকী আর অশোক বৃক্ষের শীতল ছায়ার পঞ্চবটী। ধান্য, মুগ, মাষ, যব, তিল-সর্ষপের মতো পঞ্চশস্যের ভূমির বন্ধন যে বড় রহস্যের। এই জটিল বন্ধন যে আচ্ছেদ্য পলাশির অভিশপ্ত, পরাজিত, পলাতক জনগোষ্ঠীর মুক্তির যে গোলকধাঁধায় ডুবন্ত। মানুষগুলো বাস করে এক রূপকথার জগতে। দেবী কালীর বরাভয়ও তাদের চিত্তের দুর্বলতা দূর করতে পারে না। দিন গিয়ে রাত এলে ফসলের ক্ষেত, তেপান্তরের মাঠ, গাছ-গাছালি, বিল-ঝিল নদী-নালা দেবী কালীর গাত্র বর্ণের মতোই ঘন অন্ধকার মানুষ সমেত দুনিয়াটা গ্রাস করে। নিশাচর পাখি, পতঙ্গ আর পশুর সঙ্গে প্রেতাত্মার মৃত্যু শীতল ডাক শোনা যায়। আর যখন জোনাক পড়ে তখন স্তব্ধ নির্জনতা অন্য জগতের ইঙ্গিত দিয়ে যায়। বৃক্ষ অরণ্যের ছায়া বাতাসে দোলা খেলে অশরীরী আত্মা যেন ভয় দেখায়। সবুজ কচি ফসলে পূর্ণ ভূমিতে দিনের আলোয় যারা মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রার্থনার ভঙ্গিতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারাই রাত নামলে সেই সবুজ রংকে ভূতের কালো শরীর ভেবে ভয়ে থিরথির করে। এত আতঙ্ক আসে কেন?
আজ তারা বিগত দিনের এক সাহসী পুরুষের কথা স্মরণ করে। দীর্ঘকায় কালো বর্ণ মানুষটিকে তারা দেখেনি, আয়নায় বাঁধানো তার বিবর্ণ ছবি দেখেছে। নীলকণ্ঠ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইংরেজের সৈনিক। তার হারানো মেডেলের রহস্য আজও এই তল্লাটের মানুষ ভুলতে পারেনি। লোকে বলে ভৌতিক মেডেল। মনিপুরের যুদ্ধে যে বাহিনী নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীকে হারিয়েছিল, সেই বাহিনীতে ছিল নীলকণ্ঠ। এ বিজয় কি নীলকণ্ঠের বিজয়? এ পরাজয় কি নেতাজীর পরাজয়?
নীলকণ্ঠের প্রপুত্র বা ছেলের ঘরের নাতি গৌরবের সঙ্গেই যুদ্ধ কাহিনি বর্ণনা করে। জাপানি যুদ্ধ-বিমানের কথা এভাবেই সে বর্ণনা করে যে, মনে হয় পৃথিবীতে জীবিত সেই তার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। নীলকণ্ঠের যোগ দেবার কথা ছিল নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ সে শুনেছিল সুভাষ বসুর সেই আহ্বান- ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি দেব তোমাদের স্বাধীনতা।’ আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাপতি কর্নেল শাহ নেওয়াজ খাঁ’র যুদ্ধের ডাকও শুনেছিল সে। কিন্তু কানে শুনলেও মর্মে প্রবেশ করেনি সেই ডাক। সে ইংরেজ বাহিনীতে যোগ দেয় নেতাজির বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। এ যে রাজার প্রতি প্রজার ধর্ম। আত্মপ্রতারকের রাজভক্তি।
নীলকণ্ঠের প্রপুত্র বিজয়ীর মতো হাত তুলে উচ্চস্বরে বলে, আমার ঠাকুর্দা আজাদ হিন্দের একজন আহত সৈন্যকে বুকে তিনবার গুলি করেছিল, তারপর পাথর দিয়ে মাথা গুড়িয়ে দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল, জান? গুলি খেয়েও ওই ব্যাটা বলছিল ‘ভারত মাতা কি জয়!’
শ্রোতাগণ বহু বৎসর ধরে শুনে আসা পুরাতন কাহিনির ভেতর রূপকথা খুঁজতে থাকে। বয়ান শেষে নামে নীরবতা। সেই নীরবতা ভাঙে ধরিত্রী দাসের প্রপুত্র নিত্যানন্দ। তার কাহিনি বর্ণনার ঢং অনেকটা ঠিক কবিয়ালদের মতো। সুর তোলা। ‘আমার পিতামহ ধরিত্রী দাস গত হয়েছেন বহু বৎসর আগে। আমরা বংশ-পরম্পরায় তার বর্ণিত কাকেশ্বরের জন্ম-জন্মান্তরের গল্প ধানের গোলার মতো অন্তরে সঞ্চিত রেখেছি। সেই পলাশির যুদ্ধ, নবাব সিরাজ, সিপাহি যুদ্ধ আর সিপাইদহের কাহিনিও ভুলিনি আমরা। এ স্মৃতি আমাদের অক্ষয়।’
নীলকণ্ঠের প্রপুত্রকে হঠাৎ ধমকে দিয়ে নিত্যানন্দ দাবি করে নীলকণ্ঠ ছিল বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান। কেননা সে স্বাধীনতাযোদ্ধাকে হত্যা করেছে ইংরেজের ক্রীতদাস হয়ে। মৃত মিরজাফরের আত্মাই পুনর্জন্ম নিয়েছে নীলকণ্ঠ নামে। ইংরেজের দান সেই কলঙ্কিত মেডেল সে কারণেই প্রেতাত্মার ভর করে রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এ দৃশ্য বড় রহস্যের।
পঙ্গু অবস্থায় দীর্ঘবছর বিছানার পড়ে থেকে শেষে মৃত্যু ঘটে। নীলকণ্ঠের মৃতদেহের বালিশের তলায় পাওয়া যায় মেডেলটি। পুত্র-কন্নারা জানতো মেডেল রক্ষিত আছে কাঠের সিন্দুকের লক্ষ্মীর গোপন ভাণ্ডারে। সেই খুদে ভাণ্ডারে সিঁদুর লাগানো মহারানি ভিক্টোরিয়ার মুখাঙ্কিত একটি রূপোর টাকা। টাকা তো নয়, যেন রূপের ভগবান।
কাকেশ্বরের যাদুবিদ্যার প্রাচীন দুনিয়া কোথায় যে হারিয়ে গেল। যদি পুনর্জীবন হতো তার তবে নিত্যানন্দ খোঁজ পেতো সেই তামার মেডেলটির। তবে কি নীলকণ্ঠের প্রেতাত্মা ভর করেছে তাতে? না হলে কেন রহস্যের খেলা খেলছে? নীলকণ্ঠের মৃত্যুর পর একরাতে তার পুত্রটি মিথ্যা স্বপ্ন দেখেছিল? নীলকণ্ঠ তার পুত্রকে স্বপ্নে আদেশ করছে যেন ইংরেজের দান মেডেলটিকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করা হয়। পুত্র এতে পিতার আদেশ মতো সেই মেডেলকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করতে কখনও ভুল করেনি। কিন্তু যেদিন এক ছদ্মবেশী প্রত্ন-চোরাকারবারী এসে লাখ টাকার বিনিময়ে তা তার হাতে তুলে দেয়ার লোভ দেখায়, লোকটি পিতৃস্মৃতি ভুলে যায়। নির্ধারিত দিন লোকটি ফিরে এলে সিন্দুক খুলে অবাক হয়ে যায় নীলকণ্ঠের পুত্র। মেডেলটি অদৃশ্য। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এ তো ভৌতিক মেডেল।
জানাজানি হলে চারদিকে রটে যায় যে, নীলকণ্ঠের মেডেল যক্ষের ধন হয়ে গেছে। তাকে পাহারা দেয় কালনাগিনী। কিন্তু হঠাৎ এক সন্ধ্যায় নীলকণ্ঠের পুত্রবধূ ধূপ-প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে দেখতে পায় মেডেলটি ঝুলছে তার মৃত শ্বশুরের আয়নায় বাঁধানো বিবর্ণ ছবিতে। ভয় আর উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে নীলকণ্ঠের পুত্রবধূ। এ ঘর ও ঘর থেকে বৌ-ঝিয়েরা ছুটে এলে নীলকণ্ঠের পুত্রবধূ যা দাবি করে তা অসত্য প্রমাণিত হয়। কোথাও মেডেলটি নেই। তারপর থেকে কেউ আর কোনোদিন মেডেলটির হদিস পায়নি। ওরা বুঝতে পারে না এ কোন নির্মম ছলনা।
এক আলোজ্বলা অমাবস্যা রাতে আধঘুম আধ জাগরণে নীলকণ্ঠের প্রপুত্র দেখতে পায় তার মৃত পিতামহের ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকেছে। কি যেন খুঁজছে। ছায়ায় তৈরি মুখ হলেও প্রপুত্র পিতামহকে চিনতে পারে। লোকটি এবার সে ছাতনা-পড়া ঘোলাটে পুরানো ছবিটার সামনে দাঁড়ায়। ইংরেজ সৈনিকের পোশাক পরা ছবি। ইংরেজ রাজত্ব রক্ষার বিশ্বাসী গোলাপ। স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীর হত্যাকারী।
প্রপুত্র স্পষ্ট শুনছে ফিসফিস করে ছায়ামূর্তটি বলছে, ‘কোথায় আমার মেডেল? কোথায় যুদ্ধ পুরস্কার?’ হ্যাঁ। সে তার পিতার মুখ থেকে শুনেছে তার ঠাকুর্দার মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে চিতায় উঠিয়ে মুখাগ্নি করা মাত্র লাশটি ওঠে বসে চিতার উপর এবং চিৎকার করে বলে-‘যুদ্ধের মেডেল কোথায় আমার?’
আজ প্রপুত্রের মনে হয় ইংরেজের দান মেডেলটি প্রেত শক্তি অর্জন করেছে। তাই সে মাঝে মধ্যে তার মৃত মালিককে খুঁজতে আসে এই বাড়িতে। খুঁজে না পেয়ে ঘরঘর পায়চারি করে বেড়ায়। হয় তো যুদ্ধের কথা মনে পড়ে মেডেলটির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মনিপুর সেক্টর। আজাদ হিন্দ বাহিনী। ইংরেজ বাহিনী। কি ভয়ংকর যুদ্ধ। ইংরেজ রাজত্ব রক্ষার্থে যে যুদ্ধে জীবনদান করতে পারলে মানবজন্মের পূর্ণ সার্থকতা আসে, সেই যে যুদ্ধ। একবারও কি মেডেলটির মনে পড়ে না সেই যুদ্ধছিল নীলকণ্ঠের জন্য পরাধীন মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ? বেঈমানের যুদ্ধ? কলঙ্কিত পাপপঙ্কিল এক বিজয়। মানুষগুলোর ঘোর কাটে না মেডেলটিকে নিয়ে। ওদের ঘোর সেদিনই ভাঙে যেদিন শুনতে পায় প্রপুত্র তার ঠাকুর্দার চিতা থেকে তুলে আনা দেহাবশেষ কপালের একখ- হাড় পবিত্র নদী গঙ্গায় বিসর্জনের জন্য খুঁজতে গিয়ে পুরানো টিনের সুটকেসটি খুলে ফেলে। ভয় আর উত্তেজনায় শরীর কেঁপে ওঠে তার। ঘামতে থাকে। চিত্তবিকল ঘটতে থাকে।
প্রপুত্রের কাঁপতে থাকা হাতে ওঠে আসে নীলকণ্ঠের কপালের হাড়। এ যেন যাদুকরের হাতে স্থির হয়ে থাকা আত্মঘাতী মানুষের মাথায় খুলি। কপালের হাড়টি সে খুঁজে পায় নীলকণ্ঠের খাকি রং-এর জীর্ণ সেনাউর্দির ভাঁজের ভেতর। পিতা জীবিত থাকলে নিশ্চয়ই জানতে পারতো কখন কি জন্য টিনের সুটকেসে উর্দির সঙ্গে কপালের হাড়টি রাখা হয়েছে। মৃত্যুরপূর্বে পিতাকে সে আক্ষেপ করতে শুনেছে যে, ঠাকুর্দার হাড়টি গঙ্গার বিসর্জন করা গেল না। আরও শুনেছে সিপাই পিতার স্মৃতির একটি উর্দির কথা।
গভীর রাতে খোলা জানালার ভিতর দিয়ে গড়িয়ে পড়া জোছনার আলোর প্রপুত্র দেখতে পায়, নীলকণ্ঠের কপালের হাড়টি মাকড়সার মতো পিলপিল করে খাড়া মাটির দেয়াল বেয়ে উঠা-নামা করছে। সেনাউর্দিটি শূন্যে ঝুলে হেল-দোল করছে। সত্যি সে ভয় পেয়ে যায়। একি তার ঠাকুর্দার প্রেতাত্মার কাজ? তার মৃত ঠাকুর্দার আত্মা কি অতৃপ্ত কামনা নিয়ে এই ঘরে বন্দি হয়ে আছে? স্বর্গে কিংবা নরকে কোথায় স্থান পায়নি?
এই রহস্যের কথা জানাজানি হলে গ্রামবাসী এই সিদ্ধান্তে আসে যে, মৃত্যুর পর নীলকণ্ঠের যে প্রেতজীবনের শুরু তা থেকে কখনও মুক্তি ঘটবে না। তার মৃত আত্মা পাপাত্মায় পতিত হয়েছে। কেননা সে স্বদেশের স্বাধীনতা যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। গ্রামবাসীর এই বিশ্বাস প্রপুত্রের মনে মৃত নীলকণ্ঠের প্রতি ঘৃণা তৈরি করে। দাউদাউ জ্বলে ঘৃণার আগুন।
‘নীলকণ্ঠের বংশধর, তোর শরীরে যে পলাশি যুদ্ধের মিরজাফর আর মনিপুরের যুদ্ধের আজাদ হিন্দ বাহিনীর দুজন ইংরেজ বাহিনীর বিশ্বাসঘাতকের রক্ত মিশে আছে,’ সমস্বরে গ্রামবাসী এ কথা বললে প্রপুত্র কেঁদে ফেলে। প্রেতের কান্নার মতো।
‘আমি আমার পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই’, গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে এমনি কাতরতা প্রকাশ করলেও তারা নিরুত্তর।