ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব ষোল
- সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা// প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস //এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা//পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব তিন
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট // নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট // নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক// উপন্যাস // এক্সপেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব সাত
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব নয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব দশ
- ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব একাদশ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব বারো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব তেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব চৌদ্দ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব পনেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব ষোল
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব সতেরো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। আঠারো পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। শেষ পর্ব
উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এডলফ হিটলারের গড়ে তোলা ইহুদি নির্যাতন ক্যাম্পের সেই সময়টাতে ফিরে যাওয়া যাক। গ্যাস চেম্বারে বন্দীদের পুরে দেওয়ার প্রধান কর্মকর্তা জোসেফ মেঙ্গেলে নামের এক পাগলা ডাক্তার অসউইজ বন্দী শিবিরে ইহুদি নারী-পুরুষ-শিশুদের উপর নানা রকমের, বিভৎস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করত। জেনেটিক পরীক্ষায় বিপুল আগ্রহ ছিল আগে থেকেই, অসউইজ বন্দী শিবিরের দায়িত্ব পাওয়ার পর আগ্রহটা বিকৃতিতে পরিণত হয়, হাতের কাছে সহজলোভ্য ইহুদি সিল মারা মানুষের দল পেয়ে তাদের উপর শুরু করে যা তা পরীক্ষা। জমজ শিশুর চোখের রং এক রকমের। বিষাক্ত পানীয় একজনকে খাওয়ানো হ’ল, দেখা হ’ত এই একজনের চোখের রং পাল্টে যায় কি না। মায়ের পেটে ভ্রুনের বৃদ্ধি কিরকম হচ্ছে, জানার জন্য গর্ভবতী নারীর পেট চিরে দেখা তো কোন ব্যাপারই ছিল না। একজনের শরীরের হাড় আরেকজনের শরীরে লাগানো যায় কি? অজ্ঞান না করেই শরীর থেকে হাড় বের করে আনার বিভৎসতা ছিল স্বাভাবিক।
এরকম বর্ণনা খুব বেশি না দেওয়াই ভাল।
হিটলারের পতনের পর কি হ’ল সেই জোসেফ মেঙ্গেলের?
লাল বাহিনী আসার খবর পেয়েই উধাও হয়ে গেল জোসেফ মেঙ্গেলে। আর্জেন্টিনা হয়ে প্যারাগুয়ে-ব্রাজিলে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ব্রাজিলের সমুদ্র পাড়ে নাকি জোসেফ মেঙ্গেলের ডুবে মরা লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। ভুয়া নামে কবরস্থ হয় জোসেফ মেঙ্গেলে-র। এ নিয়েও রহস্য আছে।
ইহুদি হত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করতে ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা হন্যে হয়ে খুঁজছিল জোসেফ মেঙ্গেলেকে। নাৎসি সমর্থক ওলফগাং গেরহার্ড তাকে ব্রাজিলে পালিয়ে আসতে সাহায্য করে, সেখানে পিটার হসবেসলার নামে খামার বাড়িও বানিয়ে নেয় লোকটা। এরপরও ভয় তো ছিল মনে, কখন না ধরা পড়ে যায়! ১৯৭২ সালের পর থেকে জোসেফ মেঙ্গেলের স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। হাই ব্লাড প্রেসার ছিল, কানেও ইনফেকশন ধরা পড়ল। কানের সমস্যাতেই লোকটা নাকি শরীরের নিয়ন্ত্রন রাখতে পারত না। ব্রাজিলের সমুদ্র পাড়ের শহর বার্তিওগাতে গিয়েছিল পুরনো বন্ধু ওলফ্রাম আর রিসেলোত্তে বোসের্ট-এর সাথে দেখা করতে। সমুদ্রে নেমেছিল সাঁতার কাটতে, পানিতেই স্ট্রোক করে এবং ডুবে যায়। লাশটা যখন খুঁজে পাওয়া গেল, তখন লাশের পকেটে ছিল একটি ভিজিটিং কার্ড। ওলফগাং গেরহার্ড নাম লেখা সেই ভিজিটিং কার্ডে। ওলফগাং গেরহার্ড নামেই সমাধিস্থ হ’ল জোসেফ মেঙ্গেলে-র।
অন্য নামে কবরে থাকতে জোসেফ মেঙ্গেলের কষ্ট হয়েছিল বলে মনে হয় না। ছদ্মনাম তো তার কতই ছিল। কিন্তু জোসেফ মেঙ্গেলে রহস্যের শেষ তো হ’ল না তবুও। পৃথিবীর নানান জায়গায় মেঙ্গেলেকে নিজের চোখে দেখতে পাওয়া মানুষের খোঁজ পাওয়া যেতে লাগল। আসলে মেঙ্গেলের মৃত্যুর আগে থেকেই মেঙ্গেলেকে নানান জায়গায় দেখতে পাওয়ার গুজব মুখরোচক ছিল মানুষের কাছে। গ্রিক দ্বীপ কিথনোসে নাকি তাকে দেখা গেছে ১৯৬০ সালেই, এর পরের বছর কায়রোতে, ১৯৭১-এ স্পেনে, ১৯৭৮-এ প্যারাগুয়েতে। ১৯৭৯-তে মৃত্যু হ’ল, অথচ এর তিন বছর পরও জোসেফ মেঙ্গেলেকে জীবিত ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার ঘোষিত হ’ল ১ লাখ ডলার, মৃত্যুর ছয় বছর পরও মেঙ্গেলে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, এমন জোরালো দাবী অটুট রইল। ১৯৮৫তে গনআদালত গঠিত হ’ল জেরুজালেমে, সেখানে দোষী সাব্যস্ত হ’ল জোসেফ মেঙ্গেলে, গণআদালতে উপস্থিত ছিলেন মেঙ্গেলের নিষ্ঠুর গবেষণার শিকার শতাধিক মানুষ।
এর পর পরই, ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পূর্ব জার্মানী সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ল জোসেফ মেঙ্গেলের সন্ধানে। জীবিত থাকলে জীবিতই চাই, মরে গেলে হাড্ডিগুড্ডি।
৩১ মে ১৯৮৫। পূর্ব জার্মানের প্রসিকিউটর অফিসে এসে পৌঁছাল একটি সাংকেতিক ভাষায় লেখা বই আর অনেকগুলো চিঠি। পুলিশ হ্যান্স সেডলমেয়ার নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পেয়েছে এগুলো। হ্যান্স সেডলমেয়ার মেঙ্গেলের দীর্ঘ দিনের বন্ধু, মেঙ্গেলের পারিবারিক খামারের সেলস ম্যানেজার।
চোখ কপালে উঠতেই বাধ্য। সাংকেতিক ভাষার বইটার পাঠোদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এক দল। আরেক দল চিঠিগুলো নিয়ে নাওয়া-ঘুম ছেড়ে দিল। চিঠিগুলো কী যে অদ্ভুত! জোসেফ মেঙ্গেলে লিখেছে জোসেফ মেঙ্গেলকে। আরো কিছু চিঠি আছে যা অন্যরা লিখেছে জোসেফ মেঙ্গেলেকে, তবে জোসেফ মেঙ্গেলে টু জোসেফ মেঙ্গেলে এবং জোসেফ মেঙ্গেলে ফ্রম জোসেফ মেঙ্গেলে ভাবনায় ফেলে দিল। এসব কিছুর কাছে জোসেফ মেঙ্গেলের মৃত্যুর স্বীকারোক্তিও ছিল, যে বন্ধুদের কাছে বেড়াতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল, তাদের একজন রিসেলোত্তে বোসের্ট সেটি দিয়েছিল সেডলমেয়ারকে।
রিসেলোত্তে বোসের্ট-কে গ্রেফতার করা হ’ল। তার মুখ থেকেই জানতে হবে কি ঘটেছিল জোসেফ মেঙ্গেলের। রিমান্ডে স্বীকার করল বোসের্ট, কবরটি দেখিয়ে দিল। ১৯৮৫ সালের ৬ জুন তারিখে কবর খুঁড়ে হাড্ডিগুড্ডি তুলে নিল কর্তৃপক্ষ। এগুলো জোসেফ মেঙ্গেলের কি না, তা পরীক্ষার জন্য পাঠানোও হ’ল। জোসেফ মেঙ্গেলের ছেলে রলফ মেঙ্গেল একটি বক্তব্য দিল, সেখানে বলা হ’ল, হাড্ডিগুড্ডিগুলো তার বাবা জোসেফ মেঙ্গেলেরই, কিন্তু বাবা জোসেফ নির্দোষ, সম্পূর্ণ নির্দোষ, কেবল দায়িত্বপালন করেছিল, কোন অপরাধ করেনি।
সন্দেহাতীতভাবে দেহাবশেষ জোসেফ মেঙ্গেলের, এটা প্রমাণ করতে নাকি সময় লেগেছিল আরও। ১৯৯২ সালে ডিএনএ টেস্ট করে ভেরিফাই করা হয় জোসেফ মেঙ্গেলেকে। পরিবারের দাবির মুখে দেহাবশেষ আর পূর্ব জার্মানীতে পাঠানো হয়নি, সাও পাওলো ইনস্টিটিউটের ফরেনসিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে সংরক্ষিত রাখা হ’ল।
‘বয়েস ফ্রম ব্রাজিল’ নামে একটি হলিউডি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে জোসেফ মেঙ্গেলেকে নিয়ে, যেখানে স্বয়ং রোমান হলিডে খ্যাত বিখ্যাত অভিনেতা গ্রেগরি পেক অভিনয় করেছিলেন নরপিশাচটার চরিত্রে। ছবিতে দেখা যায়, জোসেফ মেঙ্গেলে হিটলারের ক্লোন সরবরাহ করেছিল ব্রাজিলের একটি ক্লিনিকে।
জোসেফ মেঙ্গেলে-এর চিঠি আর ডায়েরির যে কি হ’ল তা জানা যায়নি। ততদিনে পৃথিবী আসলে নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে। মিত্রশক্তির শত্রু হিসেবে ইতিহাস তাকে চিনলেও গোপন ইতিহাসে ঘটে গেল অন্য রকমের ঘটনা। বিশ্ব-অর্থনীতিকে হাতের মুঠোয় নিতে চাইলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশ শতকের মানুষ। যে জোসেফ মেঙ্গেলে ছিল শত্রু, অথবা যারা ছিল জোসেফ মেঙ্গেলে-এর শত্রু, তারা জোসেফ মেঙ্গেলে-এর কাজকে ভালবাসতে শুরু করে দিল। এই এদের পরিচয় রাশিয়ান-আমেরিকান-ইজরায়েলি-ইরানিয়ান-এশিয়ান নয়, এরা আসলে নতুন পৃথিবী গড়তে চাইছে নিজেদের মতো করে। এদের বিকৃতি জোসেফ মেঙ্গেলে-এর বিকৃতির সাথে তুলনীয়। এদের গড়ে তোলা পৃথিবীর নাম জোসেফ মেঙ্গেলেজ ওয়ার্ল্ড।
এই ওয়ার্ল্ড গড়ে তোলার নেতৃত্ব দিল কে?
জোসেফ মেঙ্গেলে নিজেই।
পানিতে ডুবে মরা, হাড্ডিগুড্ডি খুঁজে বের করার কাহিনী চমৎকারভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল জোসেফ মেঙ্গেলে-র বন্ধুরা। যখন এই কাহিনীতে বিভ্রান্তি জমা হচ্ছিল, তখন সাও পাওলো ইনস্টিটিউটের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের সাহায্য সবিশেষ কাজে লেগেছে। ডিএনএ টেস্টের ফলাফল দিয়ে জোসেফ মেঙ্গেলে-কে মাটিচাপা দেওয়া গেল, কেননা এই ইনস্টিটিউটে সক্রিয় ছিল জোসেফ মেঙ্গেলেজ ওয়ার্ল্ড-এর সমর্থক-সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। দেহাবশেষও এখানেই সংরক্ষিত, কাজেই এ বিষয়কে থামিয়ে দেওয়া গেল সহজেই। কার না কার দেহাবশেষ, এ নিয়ে আর কখনো প্রশ্ন উঠবে না বলে ধারণা করা যায়।
মানুষের জেনেটিক গঠন নিয়ে তার মত ভাল আর কে জানত? এখনোই বা আর কে জানে? জোসেফ মেঙ্গেলে নিজের উপরেই পরীক্ষা করেছিল অনেক। আর তাই শরীরের বয়স বাড়িয়ে ফেললেও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে জোসেফ মেঙ্গেলে। এখনো। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ জন্মেছিল কিন্তু! বয়স তাই একশ’র উপরে হলেও বাস্কেটবল খেলতে মোটেও সমস্যা হয় না। একা একাই থ্রো করে বল। কেননা, লুকিয়ে থাকার আনন্দে জোসেফ মেঙ্গেলে লুকিয়েই থাকতে চায়। তাকে কেউ দেখে না। তার ক্লোন করা গাদা গাদা জোসেফ মেঙ্গেলে-রাও না। ওরা কেবল তার নির্দেশ পায়। কাঁচের দেয়ালের ডিসপ্লে-তে ফুটে ওঠা নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে ওরা। কাজ না করা, কাজ করবে কি করবে না, এসব ভাবার অভ্যেস ওদের একদমই নেই। ক্লোন করার পর কোষের জেনেটিক পরিবর্তন ঘটানো তো খুব সহজ কাজ, যে পরিবর্তন কখনোই পরিবর্তনের কথা বলবে না। বলতেই পারবে না।