ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব সাত

।।পর্ব সাত।।

খেলিছে এ বিশ্বলয়ে
দুরকমের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে আশফাক। স্পার্ম সেল উৎপাদন তো বটেই, এ নিয়ে গবেষণা বন্ধ করার জন্য আইন পাশ করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে অনেক সংগঠন। আইন করে গর্ভপাত কিংবা মানব ক্লোন নিষিদ্ধ করা নিয়ে যেমন আন্দোলন হচ্ছে, তেমনি ডাইমেনশন পেয়ে গেল এই বিষয়টিও। ওদিকে নারীবাদী সংগঠনগুলো অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে, এই আবিষ্কার মানুষের সভ্যতাকে নতুন আলোকময় দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
শেফিল্ড য়্যুনিভার্সিটির সেন্টার ফর স্টেম সেল বায়োলজি-র রিসার্চার হ্যারি মুর ড. করিম নায়েরনিয়ার টিমের অন্যতম রিসার্চ ফেলো। ডরমেটরিতে আশফাকের পাশের রুমে থাকেন স্বাস্থ্যবান সম্পূর্ণ চুলবর্জিত গোলগাল মাথার অধিকারী এই বিজ্ঞানী। আশফাকের সাথে মিল একটাই, দুজনেই বিয়ে করেনি। হ্যারি মুর যৌনতার ব্যাপারে দারুন বৈচিত্রে বিশ্বাসী। মুড যখন যেমন, তখন তেমন তার স্বাদ নেওয়া। তাই কখনো সমকামী, কখনো গার্লফ্রেন্ড একটা কিংবা একাধিকের সাথে যা তা এনজয় করা হ্যারির নাকি শখ। অথচ কাজের সময় চেনা যাবে না, এমনই আত্মমগ্ন, এমনি তুখোড়, আশফাক এমনটি আর দেখেনি।
এক রাত্রে সেই হ্যারিই টোকা দেয় আশফাকের বন্ধ দরজায়। আশফাক নিজের শরীরে উত্তাপ টের পায় না, পুরো জীবনটায় এই টের সে পেয়েছে খুবই কম, হাতে গোণা কয়েকবার। শুধু একদিন, এক দুপুরে গোসল সেরে আসা লরাকে দেখে, লরার সাথে আবোল তাবোল বকতে বকতে আশফাক পাখির পালক হয়ে গিয়েছিল।
আশফাক ঘুম জড়ানো কণ্ঠে প্রশ্ন করে, হু’জ দেয়ার?
এ্যাশফাক!
খুব মৃদু গলা হ্যারির। সব সময় আশফাককে মজা করে শুধু ফাক বলে ডাকে, এখন পুরো নামটা উচ্চারণ করছে। আশফাক সচকিত হয়ে যায়। মতলব কি ব্যাটার? আজ রাতে কোন সঙ্গী জোটেনি বুঝি?
এ্যাশফাক! আই হ্যাভ আ ডিফরেন্ট থিংকিং। ক্যান উই শেয়ার?
এই কণ্ঠ দিনের বেলার হ্যারির। কাজে ব্যস্ত থাকা, মাথা খাটাতে থাকা হ্যারি এভাবেই ভারি কণ্ঠে আস্তে আস্তে কথা বলে। মাথায় কোন আইডিয়া এসেছে নিশ্চয়। আশফাক লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। দরজা খুলে দেখে, হ্যারির হাতে ধরা বেয়ারের ক্যান, ঠোঁটের কোণায় না ধরানো একটা তরতাজা সিগার আর ওর চোখে দুর্ভাবনা। দরজায় দাঁড়িয়েই থাকে, ভেতরে ঢোকে না। আশফাকও কেন যেন ওকে ভেতরে ডাকতে পারে না।
হ্যারি ঘুমপাড়ানি গানের মতো বলতে থাকে, ইঁদুরের স্টেম সেল থেকে স্পার্ম তৈরি করা গেছে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই রকম সাকসেস জুটবে, তা কিন্তু এখনো বলা যাচ্ছে না।
কি বলা যাচ্ছে না?
এই স্পার্ম সেল নারীর এগ সেলকে নিষিক্ত করতে পারবে কি না। অথবা স্টেম সেল থেকে পাওয়া এগ সেল নিষিক্ত হবে কি না। ধর, ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ (In vitro fertilisation (IVF) চিকিৎসায় পাওয়া ডোনারের স্পার্ম সেল নারীর এগ সেলের সাথে মেলানো হ’ল। কিন্তু কাজ হ’ল না।
তাহলে আর কি? এসব বাদ দিয়ে ঘুমোতে যাও।
ওর কথা মনে হয় শুনতে পায়নি হ্যারি। বিড়বিড় করে বলল, এরকম গবেষণা সত্যিই সফল করা কঠিন।
এক সময় হয়তো কঠিন হবে না।
হয়তো এমন কঠিন কিছু ঘটে গেল—
তুমি কি বলতে এসেছিলে?
এইটাই। আমার মাথায় এই চিন্তাটা এল। যদি সত্যি সত্যি ভয়ংকর কিছু ঘটে যায়? আই হ্যাভ আ ডিফরেন্ট থিংকিং। আনফরচুনেটলি দিজ স্টেম সেল ম্যানিপুলেশন্স ক্যান লিড টু পারমানেন্ট জেনেটিক চেঞ্জেস হুইচ উড মেইক দেম আনসেফ টু য়্যুজ স্পেশিয়ালি এ্যাজ আ পটেনশিয়াল স্পার্ম অর এগ।
এরকম ভয় হওয়াটা স্বাভাবিক। স্টেম সেল থেকে স্পার্ম বানাতে শুরু করলে মানুষ প্রজাতির যদি সত্যিই স্থায়ী জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে যায়? যদি তারা আর স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান উৎপাদনক্ষম স্পার্ম আর এগ তৈরি করতে না পারে? তবে অন্য আর সব বিজ্ঞানীদের মতই সম্ভাবনার উত্তেজনায় আশফাক নিজেও ব্যর্থতা নিয়ে ভাবতে চায় না। মানুষের চলমান বংশগতিতে ভয়ংকর কোন পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে কি না, তা নিয়েও ভাবেনি। এ যেন এক দৌড়ে নেমেছে বিজ্ঞানীরা। সাফল্যের সোনার হরিণ যার হাতে ধরা দেবে, সে-ই যে ভবিষ্যতের রাজা। এখন আশংকার কথা বলা মানে দৌড় থেকে ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে বেরিয়ে যাওয়া। হ্যারি মুর কি সেরকম কোন বিপদে পড়তে চায়?
এ্যাশফাক, চীনা শূকর-ছানাগুলোর কথা ভেবে দ্যাখ একবার। ফিসফিস করে বলল হ্যারি। আশফাক বুঝল হ্যারি কি বিষয়ে ভেবে দেখতে বলছে।
দক্ষিণ চীনে জন্ম নিয়েছে দশটি শূকর-ছানা।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে এই ছানাগুলোর গা থেকে ঠিকরে পড়ে সবজেটে আলো। মা শূকরের ডিম্বানুতে জেলি ফিশের ডিএনএ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হ’ল একই রকম। প্রাণীদের বংশগতির চলমান ধারা মানুষ কি স্বৈরতান্ত্রিক ভাবে পাল্টে দিতে পারে? শূকর সমাজ কি দাবি তুলেছিল এরকম আলোকিত ছানাপোনার জন্য? মানুষ হয়েছে বলে কি মানুষ যা তা করবে?
বল এ্যাশফাক, এই দশটা ছানা যখন বড় হবে, শূকর-সমাজ মেনে নেবে এদের?
এই প্রশ্নটা লরাও করেছিল। হ্যারির সাথে রাতের আলাপের পুরোটা স্কাইপে-তে লরাকে বলেছিল আশফাক। লরা থমথমে মুখে প্রশ্ন করেছিল, প্রাণীদেরও কিন্তু সমাজ-টমাজ মেনে চলতে হয়। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের সেই কুৎসিত হাঁসের ছানার গল্পটা মনে নেই? অন্য রকম দেখতে হাঁসের ছানাটিকে শেষ মেষ চলে আসতে হয়। শূকর ছানাদের কি হবে?
লরার প্রশ্নের জবাবে আশফাক হাসে। বলে, ওরা নতুন সমাজ তৈরি করবে, দেখে নিও। এবং এই সমাজ-ই হবে উন্নত, শক্তিশালী, শূকর-সমাজের প্রভাবশালী শূকর।
কীভাবে?
ভেবে দেখ, অন্ধকারেও ওদের খাবার খুঁজতে কষ্ট হবে না। ওদের দেখে আলোহীন শূকররা ঈর্ষান্বিত হবে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে গালমন্দ করবে, কেন তাদেরকে বঞ্চিত করা হ’ল। দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
কী দরকার অন্ধকারে খাবার খুঁজতে যাওয়ার? সৃষ্টিকর্তা ওদেরকে দিনের বেলায় খাবার খুঁজতে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে অভাব তো রাখেননি। খোদার উপর খোদকারীর কোন দরকার কি ছিল? এ্যাশ, আমার এসব ভাল লাগছে না।
ভাল লাগাও, প্রিয়তমা। কেননা, সামনের দিন এরকমই রঙ্গিন।
মানে?
আলোময় শূকরদের সাথে আলোময় এবং আলোহীন শূকরদের মিলনে যে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হবে, তারা নিশ্চয়ই পুরনো জেনুইন শূকরদের থেকে আলাদা হবে। বল, হবে না?
জানি, তুমি কি বলতে চাইছ। এক সময় বংশগতির ধারাটাই হবে আলোর মশালধারী শূকরদের আয়ত্তে। হয়তো, আলোহীন শূকররা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এক সময় সবাই অবাক হবে, শূকরদের গায়ে আলো না থাকাটাই যেন অবাক হবার মত ঘটনা। তারপরও বলছি, এসব আমার ভাল লাগছে না।
বল, ভয় লাগছে।
লাগছে।
স্কাইপে-তে আশফাকের মুখোমুখি ছিল লরা। ওভাবেই দেখল, দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আশফাক। বলছে, ভয় লাগলে এস আমার কাছে। আমার দু’বাহুর মাঝখানে। আমি তোমার ভয় দূর করে দেব।
রাগ লাগছিল লরার। মাঝ রাত্তিরে এসব আদিখ্যেতা ভাল লাগার কিছু নয়। তা-ও যদি সত্যিকারের আদিখ্যেতা হত! ও খুব ভাল করেই জানে, আশফাকের এ আরেক নতুন নাটুকেপনা। মাথা ঠান্ডা করার কায়দা। সারা দিন ঐ মাথাটার উপর ধকল তো কম যায় না! ঝামেলা লরারও যাচ্ছে। একটা ট্রেনিং প্রোগ্রাম-এর প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওকে। নিঃসন্তান দম্পতিদের চিকিৎসা করেই কূল পায় না, এর মাঝে আবার তরুন-তরুনীদের লেখাপড়া শেখানো! আজকাল অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে ও। কেন, বুঝতে পারছে। আসলে, বয়স বেড়েছে।
আশফাকও বলল সে রকম। বয়স বাড়ছে। তাই সব কিছুতে ভয় পাও। শূকর-জেলি ফিশের এক্সপেরিমেন্ট দেখে আঁতকে উঠলে! জান, হাওয়াই য়্যুনিভার্সিটিতে প্রজনন-বিজ্ঞানীদের একই রকম গবেষণা চলছিল। তারা তো বলছে, মানুষের জিনগত বৈকল্য রুখতে কাজে দেবে এই বুদ্ধি। যেমন ধর, হেমোফিলিয়া। এই রোগিদের রক্তে দরকার রক্ত-মোড়ানো এনজাইম। কারখানায় এরকম এনজাইম তৈরি করতে কি রকম খরচ পড়বে, আন্দাজ করতে পারছ। কিন্তু, প্রাণীর শরীরে এভাবে দিব্যি এরকম এনজাইম তৈরি করা সম্ভব। অনেক কম খরচে পাওয়া যাবে তখন। এরকম আশ্বাস কে দিয়েছেন, জান? হাওয়াই য়্যুনিভার্সিটির গবেষক, বিজ্ঞানী স্টেফান মইসিয়াদি।
লরা ভাবছিল, প্রাণী অধিকার নিয়ে হাউকাউকারীদের কথা।
মানুষকে নিয়ে ভাবছে মানুষ। হেমোফিলিয়ার রোগিদের তো উপকার হবে।
হবে।
আর এরকম ঘটনা কেবল মাত্র শূকরের ভাগ্যে ঘটেনি। এর আগে তুরস্কে খরগোশ তৈরি হয়েছে। একই রকম ভেড়াও জন্ম নিয়েছে বলে শুনেছি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরা এদের স্বজাতির সমান আয়ু পাচ্ছে, স্বভাবও একই রকম। আলো ছড়ানো শূকর ছানাগুলো এদের বাপ-দাদাদের মত কাদা ঘাঁটে। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে। অন্ধকারে ভয় পায়। আর কি চাও?
কিছু না।
না চাইলে তো হবে না। মানুষ বুঝতে পেরেছে, তার শারীরিক নকশায় ত্রুটি আছে। অদম্য মনের মানুষ শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করার চেষ্টায় আবিষ্কারের নেশায় ছুটেছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মরা মানুষের শরীর কেটে কংকাল আঁকার ঘটনাকে অস্বাভাকি বলতে চাইলেও এর প্রয়োজন যে ছিল, তা কি তুমি অস্বীকার করতে পারবে?
তা পারব না। কিন্তু…
যেমন ধর, ঐ খবরটা। যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমেন্সে ভোটাভুটি হয়ে অনুমোদন পেল সন্তানের একাধিক পিতা-মাতা থাকার বৈধতা। দুই নারী ও এক পুরুষের ডিএনএ নিয়ে সন্তান জন্মদান করতে পারলে অনেক শিশু মাইটোকন্ড্রিয়া ত্রুটিজনিত মরণ ব্যাধির হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। মায়ের কাছ থেকে সন্তানের শরীরে জটিল জিনগত রোগের বিস্তার ঠেকাতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা দুই মায়ের প্রস্তাব করেছিলেন, যদিও ধর্মীয় নেতারা তোমার মতই গেল গেল রব তুলে ফেলল।
লরা চুপ থাকে। কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না ওর। আশফাক ওকে এক মায়ের ছবি দেখাল। যে কোন বাঙালি মায়ের মতই হাউমাউ করে কাঁদছেন এক ব্রিটিশ মা। তার নাম শ্যারন বারনারদি। বেচারির সাত সন্তানই মাইটোকন্ড্রিয়ার ত্রুটিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সবশেষ মারা গেছে এডওয়ার্ড, ছেলেটার বয়স হয়েছিল ২১!
ক্যারন না কেঁদে কী করবে! ওর সন্তানদের মরতে হয়েছে যে কেবল মাত্র ওরই কারণে। মায়ের শরীরের ত্রুটিজনিত মাইট্রোকন্ড্রিয়া গর্ভে থাকার সময়ই সন্তানের শরীরে ঠাঁই নিয়েছিল। যদি আইনটা আগেই পাশ হ’ত, শ্যারন এবং ওর স্বামীর ডিএনএর সঙ্গে সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়ার অধিকারী আরেক নারীর শরীর থেকে ডিএনএ নিয়ে সন্তান জন্ম দিতে পারত, তাহলে শ্যারন হয়তো একক মায়ের কৃতিত্ব নিতে পারত না, তবে সন্তানগুলো তো বেঁচে থাকত।
একক মা!
ডিএনএ যিনি দিলেন, সেই দাতা মায়ের ডিএনএর মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পাবে সন্তান, বাকিটুকু কিন্তু মূল মায়ের। এটুকু মেনে নিতে পারা উচিত, কেননা এইটুকুনের জন্যই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতে থাকা ত্রুটির সমাপ্তি ঘটবে।

থ্রি-পারসনস বেবি।
লরা, যদি প্রয়োজন হয়, মাল্টিপল পারসনস বেবি হওয়া উচিত। এত সম্ভাবনাময় মানুষ কেন সাামন্য জীনগত ত্রুটির জন্য সব সম্ভাবনাকে দুই হাতে উজাড় করে দেখতে পারবে না? মানুষ-শক্তির অপচয় আর মেনে নেওয়া যায় না।
প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে লরা। শ্যারনের মতো মায়ের প্রসঙ্গ তুলে ঢালাওভাবে এসব কান্ডকে মেনে নিতে যদি বল, তবে বলব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং করছ। মানুষের ইচ্ছেমত জীনগত পরিবর্তন মেনে নেওয়া যায় না।
আশফাক তর্ক করতে আগ্রহী ছিল। লরা ছিল না। আশফাক কিছু বলতে শুরু করেছিল, লরা ওকে শেষ করতে না দিয়েই জানতে চায়, তুমি ফিরবে কবে?
আশফাক লরার মুখটা খুঁটিয়ে দেখে। কোন সম্ভাবনা খুঁড়ে বের করতে চাইছে কি? গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে, তুমি আমার পথ চেয়ে আছ? অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছ, আমার জন্য?
লরা ভেংচি কাটে। কি আমার রাজপুত্তুর! তার জন্য আবার অপেক্ষা!
ঠিক আছে, তাহলে আর কি, ফিরব না। কেন ফিরব? কার জন্য ফিরব? কার কাছে ফিরব? কে আছে আমার? কেউ নেই!
সংযোগ কেটে দিয়েছিল আশফাক। ও কি নিদারুন অভিমানে এরকম করল? লরার মনটা খারাপ হতে চাচ্ছিল, কিন্তু লরারই মন এইসা ধমকে মনের খারাপত্ব উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু কি যে হয়েছে, এই রাত্রে ঘুম আসছিল না কিছুতেই। লরার মন ভাবতে চায় না ঘুম না আসার কারণ। বয়স হয়েছে, ঘুম কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, এটাই লরার সাফ জবাব।
আশফাককে মেইল করল অগত্যা। তুমি ফিরলে আর কেউ না হোক, সোহা বেচারি খুশি হবে। সোহা তোমার ঘরের প্রতিটি কোণায় যতেœর ছাপ দারুন মমতায় বিলিয়ে দিচ্ছে। তুমি ফিরে এসব দেখ আর অবাক হও, প্লিইজ।
এই মেইলের জবাব আসেনি। লরা ইনবক্সে খামাখা চোখ বোলায়। আশফাকের কিছু না পেয়ে খুব যে হতাশ হয়, তা-ও না। তবে, প্রত্যাশা যে আছে, এটা ওর মন টের পায়। তখন ধমকায় মনকে। হু ইজ আশফাক? ওর সহপাঠী। ব্যস, এর বেশি কি? এসব বদারিং সহ্য করতে হবে কেন? ওর কত কাজ!
ওদিকে, আশফাকও কাজের ভেতরে ডুবে আছে বলা যায়। ও দিব্যি দেখতে পাচ্ছে, নতুন পৃথিবীর জন্ম হচ্ছে। সেই পৃথিবীতে যারা থাকবে, তাদের কোন কিছুই অপরিবর্তিত থাকছে না। ইঁদুর-গিনিপিগ-শূকর-ভেড়া-হাতি থেকে শুরু করে বনের রাজা সিংহ পর্যন্ত রূপ নিচ্ছে নতুন করে। বিজ্ঞানীরা ছোট বাচ্চাদের মত খেলায় মেতে গেছেন। ইচ্ছেমত প্রাণীর জন্ম দিচ্ছেন। এখনো পর্যন্ত, যা ঘটছে তা গোপনেই ঘটছে। নিরবে এগিয়ে যাচ্ছে পুরনো পৃথিবীর পুরনো প্রাণীদেরকে বিলুপ্ত করে দেবার কাজটা। করছে কিন্তু পুরনো পৃথিবীর পুরনো মানুষ-ই। নিজেকে ধ্বংসের খেলায় নেমেছে মানুষ। এই খেলার আনন্দ ছুঁয়ে দিচ্ছে আশফাককেও। কি হবে সব একই রকম রেখে? এই যে পাল্টে ফেলার খেলা চলছে, তাতে অপরাধবোধ নেই আশফাকের, তার বেশির ভাগ সহকর্মীর। হ্যারি মুরের মত কেউ কেউ মাঝে মাঝে উদাস হচ্ছেন বটে, তবে এই খেলায় থেমে থাকছেন না তারাও।
এ-ই হয়তো হওয়ার ছিল। স্বাভাবিক সৃষ্টির খেলায় ক্লান্ত প্রকৃতি হয়তো মানুষের হাত দিয়ে খেলছে সৃষ্টির নতুন নতুন খেলা। আর এই খেলায় পক্ষপাত কি চলছে? নইলে গবেষণার ফলাফলে কেন দেখা যাবে, পুরুষের শরীর থেকে পাওয়া স্টেম সেল-এর চাইতে নারীর শরীর থেকে পাওয়া স্টেম সেল গুণগত মানে বেশি উৎকর্ষ?
নারী ইঁদুরের পেশি থেকে পাওয়া স্টেম সেল টিস্যু তৈরিতে বেশি কার্যকর, জানা গেল সম্প্রতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫,০০০ কিশোরের শরীরে পাওয়া বংশগত রোগ ডুচেনে মাসকুলার ডাইস্ট্রোফি-র জীবানু ঢোকানো হয়েছিল বেশ কিছু ইঁদুরের শরীরে। এই রোগের ফলে শরীরে ডাইস্ট্রোফিন নামের প্রোটিনের ঘাটতি হয়, আর এই প্রোটিনটি মাংসপেশীর কোষ গঠন করে। ডাইস্ট্রোফিনের সংখ্যা কমতে থাকে, এর জায়গা নিতে থাকে চর্বি, হৃৎপিন্ড এবং ডায়াফ্রামের টিস্যু সরিয়ে চর্বি জমতে জমতে হৃৎপিন্ড বিকল হয়ে কিংবা শ্বাসকষ্ট হয়ে মারা যায় রোগী। আমেরিকান কিশোরদের একটা অংশ ৫ বছর বয়সে এই অসুখে আক্রান্ত বলে সনাক্ত হয়, হুইলচেয়ারে জীবন কাটিয়ে মাত্র ২৫ হতে না হতে মারা যায়।
সব ক’টা ইঁদুরের শরীরেই স্টেম সেল ঢুকানো হ’ল, যাতে ডাইস্ট্রোফিনসমৃদ্ধ টিস্যু তৈরি হয়। খুব ভাল কাজ হ’ল কয়েকটিতে, দেখা গেল এই কয়েকটি এসেছে নারী ইঁদুরের শরীর থেকে।
স্টেম সেলের লিঙ্গভিত্তিক এরকম পার্থক্য বুঝতে পেরে বিজ্ঞানীরাও রোমাঞ্চিত। আমজনতা কি পারবে রোমাঞ্চিত হতে? কীভাবে পারবে? বাজারে মান যার বেশি, তারই তো চল থাকবে। পুরুষের স্টেম সেলের মান ভাল না হলে তো বাদ পড়ে যাবে পুরুষের স্টেম সেল, শেষ পর্যন্ত নারীর কাছেই হাত পাততে হবে। চিরকাল নারীর কাছে হাত পেতেও নারীকে স্বীকৃতি না দেওয়া পুরুষ কিন্তু এইবার বুঝবে কত ধানে কত চাল। বাজার অর্থনীতির জ্ঞান এখন মাইক্রো লেভেলের নারীর মাগজেও ঢুকে গেছে। ফেল কড়ি নাও স্টেম সেল নীতি বজায় রাখতে পারে এ যুগের নারী। কেবলমাত্র ভালবাসা বিষয়ক মনোদৈহিক বাকোয়াজবাজি করে নারীকে এক দু’বার বোকা বানানো যেতে পারে, প্রতিবার নয়। সমানে সমানে লড়াই শুরু হ’ল বটে।
তাই কি?
লড়্ইা যে শুরু হয়েছে, অথবা এই লড়াইয়ের প্ল্যাটফর্ম অনেক পুরনো, সেটা কি নারীকূল বুঝতে পেরেছে আজো?
লড়্ইা শুরু হলেও এই লড়াইয়ে লড়বে কে? নারী? যে নিজেই টেন পায়নি লড়াই শুরু হয়েছে, সে আবার লড়বে কি?
নারীর নির্লিপ্ততা বা বোকামির কারণেই একদা শক্তিশালী নারী হেরে বসেে আছে সব দিক দিয়ে। এর ক্ষতি কি কেবলি নারীর? মানবসভ্যতাকে নারী আর পুরুষে বিভাজিত করার হঠকারি নীতি মানবসভ্যতাকেই ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। মানবসভ্যতার সত্যিকারের বিকাশের স্বার্থে নারীকে লড়তে হবে, নারীর পাশে লড়তে হবে পুরুষকেও। সম্ভাবনার সত্যিকারের ফলাফল তখনি হয়তো ধরা দেবে মানুষের হাতে, যে মানুষ নারী নয়, পুরুষও নয়, শুধুই মানুষ।
এতসব ভাবনা আশফাককে জড়িয়ে রাখে, লরাকে বলা হয়ে ওঠে না। কী আশ্চর্য, লরাও এভাবেই ভাবে তবে আশফাকের সাথে মিলিয়ে দেখার সুযোগ মেলে না। ব্যাপারটা এমন, খুব কম মানুষ বুঝবে এই আলোচনার রস। আশফাক আর লরার মতো তো সবাই নয়।
আশফাক আর লরা এর পরও এক হতে পারে না। এও এক আশ্চর্যের বিষয় বটে। কে যে খেলে মানব-মানবীর মন নিয়ে, সে খেলায় এক রান দরকার হলেও ছক্কা মারতে গিয়ে কেন আউট হতে হয়, ব্যাটসম্যান সব সময় নিজেও জানে না কার্যকারণ। আর তাই বিষণ্ন বাতাসে দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে দিয়ে বলতে হয়, সব কিছু কি মানুষের হাতে? আরো গভীরে বসবাস যাদের, তারা হাহাকার ছড়িয়ে বলে ওঠে, কিছু কি আছে মানুষের হাতে? মানুষের হাত দিয়ে কে যে খেলিয়ে নিচ্ছে কি! বিবর্তনের এই চরম ক্লাইমেক্সে কে যে মানুষকে দিয়েই পূর্ণ করে নিচ্ছে পরবর্তী ধাপের ছক, বুঝতে পারা যায়নি এখনো।
কখনো বুঝতে পারা যাবে বলে কি আশা করা যায়?
কে জানে!

Series Navigation<< ধারাবাহিক// উপন্যাস // এক্সপেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব ছয়ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব আট >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *