সায়েন্স ফিকশন

ধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব বারো

এর ঠিক দু’দিন পর নিজের বাড়ির লিফটে জবুথবু হয়ে মরে ছিলেন ড. বেঞ্জামিন। হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন বিজ্ঞানী। অত্যধিক মদ্যপানের প্রমাণ পাওয়া গেছে তার রক্তে, পত্রিকায় কেবল এভাবেই এল তথ্যটা। বেচারার গবেষণার সফট-হার্ড কপির অনেক কিছুই কোন্ ফাঁকে কে সরিয়ে নিল, নাকি তিনি নিজেই হারিয়ে ফেলেছিলেন, তা-ও জানা হ’ল না। কেউ জানতে চাইল না বলাটাই সঙ্গত হবে এ ক্ষেত্রে।
রেসাস বানরদের ধরে ধরে খাঁচায় পুরে ফেলার কোন খবরও ছাপা হ’ল না। কেবল জানা গেল, মাল্টিপল স্কেলরোসিস, হৃৎরোগ এমনকি মেরুদন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সমস্যা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুকোষ, রক্তকোষ কিংবা হৃৎকোষ তৈরি হয়ে গেল বলে। স্টেম সেল থেকে আস্ত রক্তশিরা তৈরি হয়ে গেছে, ইঁদুরের শরীরে বসিয়ে দেখা গেছে দিব্যি কাজ করছে, কিডনি আর হৃৎরোগের জন্য এ এক মহা আনন্দের সংবাদ।
মানুষ, বনমানুষ এবং বানরদের সম্পর্ক বিবর্তনের হিসেবে খুব কাছাকাছি বলে শ্যেণ চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ল এরাই। রেসাস বানর, বনমানুষের মতো মানুষের নারী প্রজাতিটিও পড়ে গেল খুব বিপদে। রক্তশিরা তৈরির জন্য নাকি ১০ মিলিয়ন স্টেম সেল তৈরি করতে হয়েছিল, যা ০.০৫ ইঞ্চি ব্যাসের একটি মাত্র টিউবেই রাখা গেছে! মানুষের এত এত রক্ত পাওয়া মুশকিল বলে শুকরের কাছে হাত পাতা হয়েছে, এর রক্ত নাকি মানুষের রক্তের সাথে অনেক মেলে।
কী আর করা! কেবল মাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নাকি বছরে ১ মিলিয়ন রক্ত-সংবহনতান্ত্রিক বাইপাস গ্রাফট করা হয়।
জীবনে মৃত্যুর খোঁজ মেলে তো!
সাকি মানে কি, জান তুমি?
সাকি ভাবী সত্যি সত্যিই এগিয়ে এলেন, একেবারে গা ঘেঁষে বসলেন। আরিফ দিব্যি টের পাচ্ছে, সাকি ভাবির শরীরের উষ্ণতা। জ্বর জ্বর হলে যেমন হয়। এতকাল এসব কিছুই টের পাওয়া হয়নি, কেননা আরিফ এর আগে কখনোই সাকি ভাবীর পায়ের কাছে বসে কাতর কণ্ঠে বলেনি, আমার খুব কষ্ট। ভাবী আর সব মেয়েদের মতই পুরুষের কষ্টের কথা শুনে কোমল হয়েছেন। আরিফের হাত ধরে বসিয়ে দিলেন সোফায়। আরিফ এতকাল তাকে কেবলি ভাবী ডাকত, কেননা রেজওয়ান ভাইয়ের স্ত্রী ওর ভাবীই হ’ন। আজ আরিফ ডেকেছে সাকি ভাবী বলে। রেজওয়ান ভাই বহু বার স্ত্রীকে ডাকতে গিয়ে সাকি বলে ডেকেছেন, আরিফ বহু বার শুনেছে। কিন্তু সাকি ভাবী তাজ্জব হলেন, আরিফ তার নাম জানে দেখে। আরিফ খোলাসা করেনি, বলেনি কিভাবে জেনেছে নামটা। কি দরকার?
সাকি নামের অর্থ কি? আরিফ জানে না। ওর আকষ্ঠ তৃষ্ণা কেবল মাত্র সাকি ভাবীর উষ্ণতা টের পায়, নাম কেন আর কোন কিছুরই অর্থ-টর্থ ওর ভেতরে কৌতুহল জাগাতে পারে না। মদ না খেয়েও মদাক্রান্ত তরুনের মত জড়ানো কণ্ঠে আরিফ বলে, আপনি হচ্ছেন বিশ্বব্রক্ষান্ড। আমি এক ধূলি কণা। আপনাকে জানতে চাওয়ার আকাঙ্খা আমার কত দিনের। সত্যি বলছি, আপনি এক বিস্ময়।
আচ্ছা! সাকি ভাবী কিশোরীর মত প্রগলভ হাসি দিয়ে ভ্রুঁ নাচিয়ে বলেন, বউ ভেগে গেছে বলে এতকাল পরে আকাঙ্খা পূরণের চান্স পেলে, তাই না? সাকি ভাবীর শরীর ভেঙ্গে পড়ছে হাসির ধাক্কায়। হাতে ধরা চায়ের কাপের চা উছলে পড়ে শাড়িতে। আরিফ চায়ের কাপসহ ভাবীর হাতটা নিজের দুই হাতে ধরে আবারো বলে, আমার খুব কষ্ট। বউ নেই যার, তার তো কষ্ট থাকার কথা না। জানো তো, ভাগ্যবানের বউ মরে। অভাগার মরে গরু! গরু মরলে কাঁদতে হয়, বউ মরলে কভি নেহি। রেজওয়ান ভাই রবীন্দ্র সঙ্গীত গান। তার সুযোগ্য স্ত্রী করেন আবৃত্তি। গান আর আবৃত্তির নিয়মিত আসর বসে এই বাসায়। সোহা চলে যাওয়ার পর রেজওয়ান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল, তা-ও বহু দিন পর। য়্যুনিভার্সিটির বড় ভাই, এখন বিরাট ব্যবসায়ী। সোহার সাথে বিয়ের আগে রেজওয়ান ভাই আর সাকি ভাবীর বাসায় ও আসত, একটা চাকরির জন্য রেজওয়ান ভাইকে অনুরোধ করতে আসত। রেজওয়ান ভাইয়ের সুপারিশ নিয়ে চাকরি হ’ল, সোহার সাথে বিয়ে হ’ল, আরিফের আর সময় করে আসা হয়নি এ দিকে। তাই তো, এই এখন গান আর আবৃত্তির আসরের নিয়মিত শ্রোতা হয়েছে বলে সাকি ভাবী বহু বার তির্যক বাক্য হেনে আরিফকে আহত করতে চেয়েছে। আরিফ আহত হয়নি, অভিমানের ভান দেখিয়েছে। সোহা চলে যাওয়ার পর ওর এখন আর কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। সাকি ভাবীর তীর্থে পৌঁছানোর কোন কারণহীন যাত্রা ওকে আসরের দিন ছাড়াও হঠাৎ হঠাৎ এ বাসায় চলে আসতে প্রলুব্ধ করে। রেজওয়ান ভাই যখন থাকেন না, আরিফ অফিস ফাঁকি দিয়ে চলে আসে সাকি ভাবীর কাছে, এর কোন জবাব ওর কাছে নেই। সাকি ভাবী নিজেও ব্যস্ত কম না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে বলে নিজে এখন সমাজ সেবায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে আরিফ এসে দেখে সাকি ভাবী বাসায় নেই। পরে যে দিন আবার এসে সাকি ভাবীকে পেয়ে যায়, তখন কাতর কণ্ঠে বলে, সেদিন ছিলেন না। সাকি ভাবী হাসেন। ছোট বাচ্চারা মিথ্যে বলে ধরা পড়লে যে রকম হাসে মায়েরা, এ সে রকম হাসি। এক দিন জানতে চেয়েছিল, কেন আস?
আরিফ মাথা নিচু করে ছিল। ও কোন্ বাক্য দিয়ে বোঝাবে, ও কেন আসে?
আমার কাছে কেন আস?
আরিফ সেটাও জানে না স্পষ্ট করে। মরুদ্যানের খোঁজে ও কবে থেকে মরীচিকার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। সাকি ভাবী সেরকমই এক মরীচিকা। এরকম আরো মরীচিকা আছে আরিফের, অনেকগুলোকে ও একা যখন থাকে, তখনো মনে করতে চায় না। শিমুলের কিশোরী মেয়েটাকে ও বিভ্রান্ত করেছিল। বাপের নামের সাথে মেলানো নাম-শিমু। আরিফকে আঙ্কেল বলে ডাকত। আরিফ দিব্যি সেই মেয়েটাকে পতঙ্গ বানিয়ে ছেড়েছিল। শিমু যখন মরীয়া কণ্ঠে বলল, আমি তোমার কাছে চলে আসব, তখন আরিফের ভয় লেগে গেল। শিমুল ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। শিমুর সাথে ফেইসবুকে বন্ধত্ব করা, দিনের পর দিন চ্যাট করা, নানান কথা বলতে বলতে অবুঝ মেয়েটাকে পটিয়ে ফেলার ঘটনা শিমুল কেন মানবে? আরিফ কিভাবে বোঝাবে, ও আসলে শিমুকে যা বলেছে, তা শিমুর জন্য বলা নয়। ও দোলাকে যা বলত, সোহাকে যা বলত, সেসব কথা বলার তৃষ্ণা থেকে ওসব বলেছে। শিমুলের ভয় বুকে বাসা বাঁধার পর বাস্তবে ফিরেছিল আরিফ। শিমুকে আগের মত ‘মা’ ডেকেছে, বলেছে যা হয়ে গেছে তার পুরোটাই ভুল। শিমু ভুল করে আরিফের বলা কথাগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করেছে, এরকম যুক্তি দেখিয়ে মেয়েটাকে যদি বাস্তবে ফেরানো যায়। একবারে কি হয়? কিশোরী বয়সের আবেগ তো আরো তীব্র। শিমু ওর বাপকে বলে দেয় আরিফের বদমায়েশির কথা। শিমুল আরিফকে পেটাতে এসেছিল। ওর স্কুল জীবনের বন্ধু শিমুল, কেমন অচেনা দৃষ্টিতে ওকে পুড়িয়ে কাবাব করতে চেয়েছিল। আরিফ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, সোহা চলে যাওয়ার পর ও আসলে পাগল হয়ে গেছে। সুস্থ মানুষ কি এরকম করতে পারে? বন্ধুর মেয়ে, শিমুলের মেয়ে তো ওরও মেয়ে। শিমুল আরিফের মুখে থুতু ছিটিয়ে প্রবল ঘৃণায় মুখটা বেঁকিয়ে বলেছিল, তোর মুখ যেন আর না দেখতে হয় আমাকে।
কেন মরীচিকাগুলোর পেছনে ছোটে আরিফ? পাড়ার মসজিদের হুজুরের সাথে কথা বলতে গিয়ে এক দিন পাপ স্বীকারের ভঙ্গিতে অকপটে স্বীকার করেছিল ওসব। হুজুর ওকে তাবলিগ জামাতে শরীক হওয়ার বুদ্ধি দিল। ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকলে শয়তানের খপ্পর থেকে বাঁচা যাবে। আরিফ কিছুই করেনি। শেষ ঔষুধ হিসেবে রেখেছে ধার্মিক হওয়াকে। সাকি ভাবীর সাথে এক দুপুরে উন্মত্ত হতে চেয়েছিল আরিফ। কাতর মিনতির মতো ওর অর্ঘ্য সাকি ভাবীর পায়ের তলায় রাখার জন্য ও ভিখেরি হয়ে গেল। সেই দিন সাকি ভাবী খুব গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, আরিফ! তুমি আর এসো না।
কেন আসব না? রেজওয়ান ভাই কিছুই জানবেন না। আমি খুব সাবধানে থাকব।
আমি থাকব না। রেজওয়ানকে লুকিয়ে তোমার সাথে থাকব কেন আমি?
কেন?
কি এমন নতুন স্বাদ তুমি দেবে, যা আমি আগে পাইনি?
আরিফ বিজ্ঞাপনের ভাষায় নিজেকে জাহির করতে থাকে। ও দেবে নতুন স্বাদ, যা আগে কেউ কখনো দিতে পারেনি, রেজওয়ান ভাইও নয়।
সাকি ভাবী আবারো হা হা করে হাসেন। কেবলি সেক্স! শোন আরিফ, যখন বয়স কম ছিল, এই ধর টিনএজ বয়সটায় সেক্স নিয়ে রোমাঞ্চ হ’ত বৈকি। আস্তে আস্তে পৃথিবীর দিনরাত আমাকে ভেতরে প্রশ্ন জাগিয়েছে, কেবলি কি সেক্স? পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসে মানিক বন্দোপাধ্যায় কুসুমকে কেবলি সেক্স নিয়ে তাড়িত হতে দেখে শশী ডাক্তারকে দিয়ে বলিয়েছেন, তোমার মন নাই কুসুম?
আরিফ এসব কিছুই বুঝতে চায় না। ও সাকি ভাবীর হাত চেপে ধরে গোঙাতে থাকে। ওর বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে, শারীরিক কামনার প্রকাশে পুড়ন্ত শরীরটা কুঁকড়ে উঠলেও বুকের গভীরে টের পায়, শরীর জাগেনি, কেবলি জেগে ওঠার ভান করে শান্তি খুঁজছে।
তোমার মন নাই আরিফ?
আরিফ থমকে যায়। সাকি ভাবী শশী ডাক্তার হয়ে জানতে চাইছেন, আরিফের মন আছে কি নেই?
আছে?
আরিফ কিছু বলতে পারে না। ওর খসখসে চোখের পর্দায় ফুটে ওঠে না কোন গভীরতা। সাকি ভাবী ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন, সেক্স তো একই প্রক্রিয়ার একটু এদিক সেদিক। কেউ এদিক দিয়ে শুরু করে তো আর কেউ শুরু করে ওদিক দিয়ে। মনের তার যদি না বাজে, তাহলে সেক্স যে শরীরের খেলা হয়েও হয় না। ও খেলায় আনন্দ নেই যে!
সাকি ভাবী আরিফের চুলে হাত বুলিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলেন, তুমি কতটুকু কি দেবে, তা বুঝতে আমার খুব দেরি হলে কি চলে আরিফ?
না ভাবী। এভাবে ফিরিয়ে দেবেন না।
আই এম নট ইন্টারস্টেড।
কেন? কেন? কেন?
একচুয়ালি, য়্যু আর নট মাই টাইপ।
নই?
না।
কে তবে আপনার সেই মনমতো টাইপ?
জীবনানন্দ দাশ।
সাকি ভাবী ভরদুপুরে সোফায় হেলান দিয়ে সামনের সাদা দেয়ালে চোখ গেঁথে দিয়ে আওড়াতে থাকেন জীবনানন্দকে। একদিন ম্লান হেসে আমি/ তোমার মতন এক মহিলার কাছে/ যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে/ অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে/
শুনেছি কিণœরকণ্ঠ দেবদারু গাছে,/ দেখেছি অমৃতসূর্য আছে।
এরপর? আরিফের গলায় আটকে যাওয়া বাষ্প শব্দটাকে প্রশ্নের আকারে বের হতে দেয় না।
সাকি ভাবী বলে গেলেন, সব চেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালো,/ তুমিও সময় স্থির নয়,/ আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে/ দেখেছে সে তোমার বলয়।
এরপর? এরপর কি সাকি ভাবী?
এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন/ তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো;/ সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার ব’লে…
সাকি ভাবীর চোখের পানি গাল গড়িয়ে বুকে এসে পড়ে টপটপ করে। তিনি ভাঙ্গা গলায় ফুঁপিয়ে উঠে বলেন, সুদর্শনা! তুমি আজ মৃত!
আরিফ নিজেও জানে, সুদর্শনারা আজ মৃত। কিন্তু কেন? এমন তো কথা ছিল না। নাকি ছিল?

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব একাদশধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব তেরো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *