ছোটগল্প।। আজকাল খুনিকে চেনা যায় না।। মণীশ রায়

গলার স্বরটা ফ্যাসফ্যাসে নাকি বসে গেছে ? কাশি দেবার সময় রীতিমতো বিদঘুটে শুনাচ্ছে কণ্ঠস্বর।
ডাঃ পাভেল রহমানের একাগ্র দৃষ্টি রাস্তার এই মহিলার উপর। ঘামে ভেজা চিমসানো মুখটা মাটি বরাবর তাক করা। হাঁটুর মালার উপর ঘরের খুঁটির মতন টানটান দুটো হাত দিয়ে দাঁড়ানো। দূর হতে মুখের আদলখানা বুঝা যায় না স্পষ্ট করে । গাড়ির ভেতর বসে তো নয়ই। 
তবু ডাঃ পাভেল ঠিকই চিনে ফেলল মহিলাকে। বয়স এখন নিশ্চয়ই সত্তর ছুঁই-ছুঁই। একহারা গড়নের মিশমিশে কালো মহিলাটি এভাবে হঠাৎ বিষ মিশানো পুকুরের মাছের মতন ওর চোখের সামনে ভেসে উঠবে তা কখনও ভাবেনি সে।
পাভেল তো প্রতিদিনই এরাস্তায় চলাচল করে। ড্রাইভার না থাকলে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসে-যায়। কই, কোনোদিন তো চোখে পড়েনি মহিলাকে ? তাহলে আজ কেন ? কাকতালীয় ? হয়তো বা। দীর্ঘদিন বিস্মৃতির অন্ধকারে পড়ে থাকা অতি পরিচিত মানুষটি হঠাৎ যেভাবে চোখের সামনে ফেইসবুকে ভেসে উঠে স্মৃতির হিল্লোল তোলে মনে, হয়তো সেরকম কিছু একটা ! 
ছাত্রজীবনে ফার্মাসী বিভাগের বন্ধু ফারুক ওকে নিয়ে এসেছিল এই মহিলার কাছে। সেই কড়া তারুণ্যে, যখন প্রবল কৌতূহলের চাপে পড়ে প্রতিটি বিষয় চ্যুইংগাম হয়ে যায়, সেই সময় । হয়তো সেরকম এক মোহ বা টানে পড়েই নিরীহ-গোবেচারা অথচ অসম্ভব মেধাবী পাভেল এসেছিল এই মহিলার কাছে, কে জানে !
ফারুক মুখে বলল, ‘এ্যাইটা আমার বন্ধু। কও দি হাতে কি আছে ?’ হেঁয়ালিভরা কণ্ঠস্বর ওর।
‘হাতে কুস্তা থাহে না রে বান্দির পোলা। থাহে তর কপালে। হাতডা অইলো আয়না।’ আচমকা গালি দিয়ে ওঠে মহিলা। 
‘হেইডাই কও দেহি ?’ এতটুকু না টসকে উত্তর দেয় ফারুক। বোঝা যায় এসবে অভ্যস্ত সে। 
‘আরে ফটকা, আগে ট্যাহা ফ্যালা ?’ বাঁদরের মতন ভেংচি কাটে মহিলা। 
‘বাকি রইলো। আগে কইয়া লও।’ ফারুকের চোখেমুখে হারামি কিসিমের হাসির ঝলক। 
‘বাকির মায়েরেও গুঁতাই না আমি। হুইনা সারলে কেউ আর ট্যাহা দিবার চায় না। সবগুলান পালায়া যায়। আগে ট্যাকা ফ্যালা দিন ? ’ তাড়া দেয় মহিলা।
লজ্জায় পড়ে গেল পাভেল এই বেশরম মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে। অবিরাম কুৎসিত সব শব্দের খই ফুটছে মুখে। এসময় কেন যেন তীব্রভাবে ওর মনে হল আবেগের বশে ফারুকের সাথে এখানে আসাটাই ঠিক হয়নি। একই এলাকার মেধাবী দুই বন্ধু ওরা। চাইলেই ওকে এড়ানো যায় না। এমনি অন্তরঙ্গ ওদের সম্পর্ক।

অনেক বলে কয়ে পাভেলকে এই মহিলার কাছে নিয়ে এসেছে ফারুক । নইলে পাভেল কি জিন্দিগিতেও এদিকে আসে নিজে থেকে ?
অগত্যা কথা না বাড়িয়ে সে দশটি টাকা দিয়ে দিল ফারুকের হাতে। টাকা ভাঙিয়ে সে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর পাঁচটি টাকা মহিলার বাড়ানো হাতে দিয়ে বলল ,‘এইবার কও দি ?’
মহিলা হাইকোর্ট এলাকায় আম্বিয়াবিবি বলে পরিচিত । চলনে-বলনে ঠমক ঝরায়। মাটির নিচে চাপা পড়া ধাতবমুদ্রার মতন পানখাওয়া দাঁতের পাটি। সেই দাঁত মেলে যখন খনখনে গলায় হেসে ওঠে তখন এর প্রতিধ্বনি বাজে সামনের কার্জন হলের চূড়ায় ! কারণ এ এলাকার হলবাসী ছাত্রদের ভেতর সস্তা জ্যোতিষচর্চার কেন্দ্রবিন্দু আম্বিয়া অতি পরচিতি এক নাম। অল্প টাকায় নিজের ভবিষ্যৎ জানার মওকা তখন কে ছাড়ে ? সামনে বিভাগীয় পরীক্ষা, বিসিএস, প্রেম-পরিণয় – কতো কি অজানা রহস্য ওদের সামনে। আম্বিয়ার হাসির গমকের ভেতর যদি সমুদ্র-তলদেশের সেই রহস্যের ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে তাহলে কে না সেই হাসি কান পেতে শুনতে চায় ?
সেরকমই একটা হাসি দিয়ে পাভেলের ডান হাতের বাড়ানো তালুর উপর শিকারি নজর ফেলল আম্বিয়াবিবি। তার আগে পিক ঝাড়ল য়ূ-ক্যালিপটাস গাছের ছাল-ওঠা সফেদ গোড়ায়। গাছের গুঁড়ি লাল-সাদায় একাকার। 
সহসা পাভেলকে চমকে দিয়ে বলে উঠল,‘আরে মদনার পো, তোরে তো খুনি লাগতাছে রে আমার। দেহি আর একবার, হাতডা বাড়া ?’ কথা শুনে পাভেল ওর হাতের তালুটা মহিলার চোখের সামনে খাতার মতন আরও খানিকটা মেলে ধরল।
এবার তীক্ষ্ণভাবে ওর হাতের তালুর সুতোগুলোয় নজর দেবার চেষ্টা করে আম্বিয়া। কাজল ল্যাপটানো দুটো চোখ কুঁচকে যায় বিস্ময়ে ; এবার ওর দিকে নয়, সরাসরি ফারুককে বলে ওঠে,‘ এ্যাইডা কারে ধইরা আনছস রে টেটনা মিঞা ? এইডা তো খুনি। মানুষ মাইরা ফ্যালাইবো যহন-তহন !’ 
‘হে তো আমার ডাক্তার দোস্তো। হের হাতে মানুষ বাঁচবো আবার মরবো। এইডা কী এমুন নতুন কতা কইলা গো আম্বিয়াবিবি ?’ ঢং করে উত্তর দেয় ফারুক।
‘আমি কী জানি ? হাতের তালুত পাইছি, কইলাম।’ বলে একদলা পানের পিক রাস্তায় ফেলে হাইকোর্টের ভেতরে ঢুকে পড়ল পাছা দুলিয়ে। পিছনে ফিরে একবার তাকাল না পর্যন্ত। 
ফেরার পথে ফারুক কইল,‘ মাগির মাথা ঠিক নাই দোস্তো। হাইকের্টের ভিতরে কার লগে কাইজা-ফেসাদ বান্দাইছে কেডা জানে ? চিন্তা করিছ না। মাগির সবই বোগাস। বিরানি খাওয়াইবি দোস্তো? ’ 
‘টাকা নাই।’ বিরক্তিতে ভুরুজোড়া কুঁচকে যায়, মুখ ঘুরিয়ে নেয় পাভেল। 
অগত্যা মুখ চুন করে ফারুক অদৃশ্য হয়ে গেল এফ এইচ হলের রাস্তায় আর পাভেল চলে এল বকশিবাজারে নিজের হলে। কিন্তু পাভেলের মাথা থেকে এরকম ভয়ংকর মন্তব্যের রেশ কিছুতেই কাটছে না। নিরিবিলি হলে শুধু মনে পড়ে আম্বিয়াবিবির কথা। এর প্রভাব মাথার ভেতরে গেড়ে বসতে বেশি সময় লাগে না। 
সহপাঠী সিনথিয়ার সঙ্গে ওর তখন তুমুল প্রেমপর্ব চলছে কলেজ-চত্বরে। এক ফাঁকে ওকেও জিজ্ঞাসা

করে ফেলল,‘আইচ্ছা, আমারে কি খুনির মতন লাগে সিনথি ?’
শুনে সিনথিয়ার হাসি আর থামে না। এমনিতেই মুখভরা ওর অকারণ হাসির ফল্গুধারা উপচে পড়ে সারাক্ষণ, তার উপর ওর একথা ; হাসি যেন থামতেই চায় না ওর । 
বেশ কিছুক্ষণ পর হাসির তুফান থেমে গেলে সিনথিয়া উত্তর দিল,‘ কে খুনি আর কে খুনি নয় সেইটা কি চেহারায় লেখা থাকে পাভেল ? গতকালের লাশটা তাইলে খুব ভাবাইতেছে তোরে, না ? শোন, আমাদের কাছে ওইটা একটা বডি ছাড়া কিছু নয়। ইমোশন মিশাইয়া লাভ নাই।’
‘কোন্ লাশের কতা কইতেছিস তুই ?’
‘আরে, গতকাল আজিজ স্যর না ডিজেকশন ক্লাসে কইলো লাশটা একটা খুনিরও হইতে পারে। ফরিদপুরের চরের দিকে এই বডির মানুষটা ডাকাতি করে বেড়াত বলে স্যার শুনেছে। ভুলে গেলি?’
‘ধ্যাৎ।’ বলে পাভেল ক্যান্টিনে চলে গেল। কিসের মধ্যে কি, পান্তাভাতে গাওয়া ঘি – দাদীর শিলুকটা এসময় মনে পড়ল ওর।
একদিন চুপিচুপি, ফার্মাসীর ফারুককে সঙ্গে নিয়ে নয়, ভয়ডর ঝেড়ে ফেলে নিজেই উপস্থিত হল আম্বিয়াবিবির ডেরার কাছে। ওকে দেখে মহিলা ঝটপট চিনে ফেলল। ভেংচি কেটে বলে উঠল,‘ আবার কি চাছ ? নডি বেডিয়াইতের ধারে বেশি ঘেসিছ না। ফারুইক্যার শরীরে রস বেশি। গোলামের পুতে রস মজাইতে আয়ে। তরও কি এক দুষ ?’ কথা শুনে পাভেল চমকে উঠল। মনে মনে লজ্জাও পেল খানিকটা। ফারুক সম্পর্কে ওর ঝাপসা কিছু আজেবাজে ধারণা থাকলেও অতটা স্পষ্টভাবে ধরা দেয়নি কখনও। তাই একটুক্ষণ থমকে রইল সে। নিজের হলেও সে নানারকম কীর্তি করে বেড়ায় ; ক্ষমতাসীন দলে নাম লিখিয়ে ছোটখাটো মাস্তানি, তোলাবাজি আর ডাইনিং-ক্যান্টিনে ফাউ খেতে সে অভ্যস্ত। অথচ পাভেলের এলাকার ছেলে এই ফারুক । ওর বাবা প্রাইমারি স্কুলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। সে নিজেও মেধাবী। তবু কেন যে এসব করে বেড়ায় – পাভেল বুঝতে পারে না। প্রায়ই ওর কাছ থেকে নানা বাহানা দিয়ে টাকা ধার নেয়। অথচ কখনও ফেরত দেয় না। ফারুকের কারণে ওর ডাক্তার আব্বার কাছে ভুল হিসাব জমা দিতে হয় ওকে। 
মহিলা আবারও চেঁচায়,‘ কিতা অইল ? মুহে কি কলা ঢুকাইয়া রাখছস জমিদারের পো?’
‘আমার খুব ভয় করে যে।’ পাভেলের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে অজানা ত্রাসে।
‘কারে ডরাছ?’
‘নিজেরে! আপনে হাত দেখার পর থেকে নিজেরে শুধু খুনি লাগে। কি করুম, কিছু বুঝি না।’ অসহায় এক আর্তি ফুটে বেরোয় ওর গলা ফুঁড়ে । 
সব শুনে খিকখিক করে এক ধরনের ছিনালি হাসি হাসতেই থাকে আম্বিয়াবিবি,’খিখিখি।‘ 
একসময় হাসি থামিয়ে কোঁচড় থেকে একটা বাসিপঁচা লাল টমেটো বের করে থুতু ছিটায় এর উপর। একটু পর ওর দিকে সেটি বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে,’যা, যা । এইডা লইয়া ভাগ। আম্বিয়া খানকির ছ্যাপ দেওইন্যা টমেটোডা রাইখা দে লগে। সব বালা-মুছিবত দূর অইয়া যাইবো। খিখিখি।’

ফের একইরকম বাঁধভাঙা হাসির ছলকানি। যেন অনেকদিন পর এক নিরীহ-গোবেচারা ভদ্রসন্তানকে নিয়ে ভালোরকম মশকরা করার সুযোগ পেল আম্বিয়া। সেই আনন্দে সে আত্মহারা, হাসি হয়তো সেজন্যে! 
পাভেলকে যারা চেনে অর্থাৎ ওর ধারে-কাছের বন্ধু-বান্ধবীরা, ঠিকই জানে, সে অত্যন্ত নরোম দিলের এক মানুষ। ঠিক ওর মায়ের মতন। সামান্য কথায় চোখ ভিজে যায়, কান্নার বেগ পায় যখন তখন।
কথায় কথায় সিনথিয়া বলে,‘ খোদা বোধ হয় তোরে নারী বানাইতে গিয়া পুরুষ বানাইয়া ফেলাইছে। অত নরম দিল নিয়া তুই ডাক্তারি পড়তে আইছিস ? ভিক্ষুক দেখলে তোর কষ্ট হয়। গরিব রোগী দেখলে খারাপ লাগে। অসহায়, পঙ্গু কাউরে দেখলে পা চলে না। অত নরম মন নিয়ে চলবি কেমনে এদেশে ? বেতন ঘরে নিতেই নিতেই তো সব ফুঁ । খাবি কি ? ’ বলে হাসির হুল্লোড়ে ভেসে যায় দয়িতা। 
হয়তো নতজানু নরম দিলের কারণেই পাভেল সেদিন নোংরা টমেটোটি হাতে তুলে নেয় বিনা দ্বিধায়। শরীর ঘিনঘিন করছে। সঙ্গে গ্লাভস থাকলে ভালো হত। তবু মহিলাকে সে আঘাত করতে চায়নি তখন। রাস্তার ধারের ড্রেনে টমেটোটি ফেলে দিয়ে যথারীতি হলে ফিরে আসে সে। সাবান দিয়ে অনেক্ষণ ধরে হাত ধোওয়ার পর কেন যেন বারবার করে ওর মনে হতে থাকে, ফারুকের সঙ্গে হাইকোর্টের প্রাঙ্গনে না গেলেই বরং ভালো হত ; অন্তত ওর জীবন নিয়ে এক বাজারে মহিলার বানানো এই ভয়ংকর নাটকটি সহ্য করতে হত না ! 
এত বছর পর রহস্যময়ী সেই আম্বিয়াবিবি ফের ওর চোখের সামনে ! একটা দুর্বল বিলবোর্ডের মতন দুপায়ে ভর দিয়ে আনত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন ক্ষমা চাইছে সবার কাছে । অপুষ্ট খ্যাংরাকাঠি দেহকাণ্ডটি ট্রেনের বগির মতন কেঁপে উঠছে খরখরে শুকনো কাশির একটানা ধমকে। নিশ্চয়ই প্রচণ্ড জ্বরও রয়েছে সঙ্গে। কোভিড ১৯ না হয়ে পারেই না ! 
পাভেল গাড়ি থামিয়ে, গাড়ির কাচ নামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে মহিলাকে অভিজ্ঞ ডাক্তারি চোখে পরখ করে দেখতে থাকে। হ্যা, চিনতে কোনো ভুল হয়নি। মায়া হল খুব। চোখের সামনে একদা পরিচিত মানুষটাকে রাস্তার উপর তিলে তিলে মরতে দেখেও এভাবে ফেলে যাবে সে ? বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে অজানা কষ্টে। ওর প্রতি মহিলার নিষ্ঠুর রসিকতার কথা বেমালুম ভুলে যায় সে। 
ড্রাইভিং সীটে সে, কাকে যেন ফোন দিল গম্ভীর গলায়,‘ একজন বয়স্ক অসহায় মহিলা হাইকোর্টের সামনে য়ূ-ক্যালিপটাস গাছের নিচে বেওয়ারিশ পড়ে রয়েছে। কোভিডের পেশেন্ট। এ্যাম্বুলেন্সে দুজনের একটা টীম পাঠিয়ে একে উদ্ধার করুন। ক্রিটিক্যাল অবস্থা, বোধ হয় আইসিইউ লাগবে। বাই।’
ফোনটা রেখে দিল পাভেল। তারপর গাড়ি চালিয়ে শান্তিনগরে নিজের ফ্ল্যাটে চলে এল। রাস্তার পাশে বেশ বড়সড় ফ্ল্যাট ওদের। নভেল করোনার ফলে বুয়া-বাবুর্চির চলাচল একেবারে নিষিদ্ধ। আগাম মাসের বেতন হাতে গুঁজে দিয়ে সিনথিয়া ওদের বলেছে,‘ সরি, আমাদেরও বাঁচতে হবে। করোনা শেষ অইলে তখন এসো। ’ 
সেই থেকে আজ অব্দি ওরা নিজেরাই ম্যানেজ করছে সব। এ সপ্তায় সিনথিয়ার পঙ্গু হাসপাতালে ব্যস্ত শিডিউল ; তাই একদিন পাভেলের কাজ হল ঘরের রান্না-বান্না আর ফ্ল্যাট জুড়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ চালিয়ে যাওয়া। গত সপ্তাহে সিনথিয়াকেও একইভাবে সামাল দিতে হয়েছে সব।

কাজের লোকের এ্যাপ্রন পরে সোজা কিচেনে ঢুকে পড়ল সে। আজকের মেনুটাও সিনথিয়ার, প্রেসক্রিপশন প্যাডে লিখে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে গেছে। ভেজিটেবল একটা ডিশ , ডাল আর মুরগির ভুনা। রান্নার ফাঁকে তিন হাজার স্কোয়ারফিট আয়তনের ফ্ল্যাটের ফ্লোরটি স্যাভলন মিশানো জলে মপিং হবে। একাজে প্রচুর পরিশ্রম। গা থেকে আপনাআপনি ঘাম ঝরে টপটপ করে। ঝিম ধরে এসির নিচে শরীর পেতে বসে থাকতে হয় কিছুক্ষণ। নইলে শরীরের জ্বলুনি থামে না কিছুতেই। 
সাংসারিক এসব কাজ নিয়ে কোনো মানসিক জটিলতা পাভেলের আগেও ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু ফ্ল্যাটে ফিরলেই কেন যেন নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে আজকাল। চোখের সামনে প্রতিটি ঘর ফাঁকা। সিনথিয়ার সাথেও আগের মতন আর জমে না। একই প্রসঙ্গ নিত্যদিন, বারবার । ‘মাকে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে দিও। আমি পরে দিয়ে দেব। এখন নেই ।’ কিংবা ‘সেনজেন দেশে একটা ট্রেনিং আছে। চিঠির অপেক্ষা করছি মিনিস্ট্রি থেকে। গেলে যাইতে পারো নিজের খরচে।’ জাতীয় অতি দরকারি কথাবার্তা । ওদের দামি বিছানাটিও সীমাবদ্ধ কথাবার্তার মতোই নীরস ও ঠাণ্ডা । মাঝে মাঝে পাভেলের মনে হয় ওদের সব কথা, সব হাসি বিয়ের আগেই ফুরিয়ে গেছে। নইলে বিয়ের পর বছর দুয়েক যেতে না যেতেই সব কেমন স্তব্ধ হতে শুরু করেছে কেন ? হাসছে মেপে, কথা বলছে প্রয়োজন মাফিক – এমন কি দাম্পত্য-যৌনতার ভেতরও নেই কোন তরঙ্গস্পন্দন। চিরচেনা গতানুগতিক একই আবেগ কি বহু ব্যবহারে শ্রী-হীন, পরিত্যক্ত ? 
পাভেলের অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও সিনথিয়া সারোগ্যাসি মা হতে চাইছে না। মায়ের কোনো বিকল্প নেই বলে গোঁ ধরে বসে রয়েছে সে। অথচ সময় তো হু-হু করে বয়ে যাচ্ছে। একসময় যেসব গান শুনে ওরা রোমন্টিক হত, সেগুলো এখন আর সাড়া জাগায় না মনে। আগের মতন নিজেদের ভেতর হাসি-তামাশা-খুনসুটি কিছুই আর হচ্ছে না। স্বপ্ন-সাধ কবেই বিদায় নিয়েছে। করোনারকালে প্রকৃতি তার হারানো সৌন্দর্য ফিরে পেলেও ওরা নিজেরা কিছুতেই আর পুরনো অনুভবে ফিরে যেতে পারছে না। 
‘তুই মা হবি কবে সিনথি ? ফাঁকা ঘর দেখতে আর ভাল লাগে না।’ নরোম গলায় শুধায় পাভেল।
‘আমি হব না বলিনি তো ? করোনার ব্যস্ততা কমুক। বেঁচে থাকি। তারপর।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠ ওর। 
‘তুই তো আইভিএফ ছাড়া মা হবি না। বাইরের কোনো ল্যাবের সাথে যোগাযোগ করব ? ’
‘না। এটা মা হবার সময় ?’ ধমকে ওঠে সিনথিয়া। সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চুপ হয়ে যায় পাভেল। কোনো কথা নেই মুখে। 
তবু এই দুঃসহ করোনাকালে পুরনো কোনো অভ্যাসের মতন আবার আড্ডা মারতে শুরু করেছে ওরা । ব্যালকনিতে গিয়ে চায়ের মগ নিয়ে হাসি-হাসি মুখে বসছে। দুজনার ভেতর নানারকম স্বপ্ন বিনিময়ও হচ্ছে। এমনকি বাচ্চা হলে কোন্ ঘরের কি রং হবে তা নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছে এরা। কিন্তু কোথাও আগের মতন আতিশয্য নেই। সব কেমন খরখরে, কাঠখোট্টা, প্রাণহীন। 
তারপরও পাভেল খুব খুশি। সাপের খোলস ছাড়ার মতন ওদেরও কিছু একটা অদলবদলের চেষ্টা চলছে – এসময়ে তা ভেবে সে বেশ উৎফুল্ল। 
সকালে স্ত্রীর জন্য টেবিলে ব্রেকফাস্ট রেখে পাভেল ওর গালে আলতো চুমু খেয়ে বিদায় নেয়। একটা মাইক্রোবাসে করে ওরা কজন সিনিয়র ডাক্তার যাওয়া-আসা করে হাসপাতালে। পাভেলের ঘাড়ে গুরু দায়িত্ব। পুরো কোরোনা ইউনিটটি ওর তত্ত্বাবধানে চলছে। বেশ কজন ভিআইপি রয়েছেন সেখানে। তাদের নিয়েই যত ভয়। বারবার সর্বোচ্চ মহল থেকে টেলিফোন আসছে। সারাক্ষণ বসদের প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত থাকতে হয়, মগজে ভিআইপি রোগীদের আপডেট গুঁজে রাখতে হয় লুকানো পরকিয়ার চিরকুটের মতন। 
মাইক্রোতে বসেই এরকম দুটো ফোন রিসিভ করতে হল পাভেলকে। মোলায়েম গলায় সে রোগীর সমাচার জানায়। বুঝতে দেয় না , ওর অবস্থান এখন গাড়ির ভেতর। 
কোভিড ওয়ার্ডে গিয়ে সবাইকে নিয়ে এক রাউন্ড দেবার পর সে আইসিইউতে ঢোকে। সেখানেই ওর চোখে পড়ে আম্বিয়াবিবি। ভুলেই গিয়েছিল মহিলার কথা ; সামনে পড়ায় ফের মনে পড়ল। ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। বেডটি বেশ উঁচু করে রাখা, যাতে উপুড় হয়ে খানিকটা হলেও বাতাস নিতে পারে ভেতরে। সংকটাপন্ন অবস্থা ; ক্রমে ফুসফুসটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। 
পাভেল এসে সেখানে একটুক্ষণ দাঁড়ায়। মহিলাকে পরখ করে দেখে। শরীরের নড়াচড়া বন্ধ। শুধু শ্বাসনালী দিয়ে যে টিউবটা আমকাটা ছুরির মতন ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সেটি ওর দমটুকু ধরে রেখেছে। কতক্ষণ এরকমভাবে চলবে তা কেউ জানে না । তাছাড়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় চেনা ওষুধগুলো পর্যন্ত কথা বলছে না ওর ভেতর !
জুনিয়র ডাক্তার মুক্তা ওকে জানাল, ‘ ক্রিটিক্যাল অবস্থা দেখে ভেন্টিলেটরে দিয়ে দিয়েছি স্যার। একটাই খালি পড়েছিল।’ রেফারেন্সটা পাভেলের হওয়ায় আম্বিয়াবিবির কপালে এই অগ্রাধিকারটুকু মিলেছে – সেকথাটাই স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে ওর স্বরের ওঠানামায়। 
‘হুম।’ পিপিই মোড়ানো ডাক্তারের মুখ থেকে এটুকুই বেরুল। 
এসময় পাশ থেকে টেকনোলজিস্ট সামিয়া বলে উঠল,‘ স্যার কখন অফ করব ?’
ওর দিকে চমকে ফিরে তাকায় ডাঃ পাভেল রহমান। নভোচারী-গগলসের ভেতর থেকেও দৃষ্টি ওর প্রখর। মুখে কোনো কথা নেই। 
আইসিইউর রাউন্ড শেষ করে দরজার মুখে গিয়ে সহসা সামিয়াকে ইশারায় কাছে ডেকে নিল পাভেল। তারপর ফিসফিস করে বলে উঠল,‘দশ মিনিট পর বন্ধ করে দিও। একটা ভেন্টিলেশন অন্তত খালি রাখতে হবে। ভিআইপিদের চাপ রয়েছে । ওকে ?’
‘ওকে স্যার।’ সামিয়া মাথা নাড়ে। এই অফ-অনের ব্যাপারটা ওর কাছে জীবন-মরণের মতন। অফ করার সময় কেন যেন ওর হাত খুব কাঁপে। রোগীর দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারে না । কেবলি মনে হয় সে অপরাধী ; রোগীকে যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিচ্ছে সে ! ডাক্তার তো নির্দেশ দিয়েই চলে গেলেন। কিন্তু জীবনের উপর জোর করে পর্দা নামানো যে কী নিদারূণ যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা তা কি ডাক্তারসাহেবরা বুঝতে চান ? 
রাউন্ড শেষে পাভেল নিজের রুমে ফিরে আসতেই ফারুকের কথা মনে হল। সে এখন বড় ব্যবসায়ী। বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক। স্বভাব আগের মতোই ; প্রায়ই পরিবার-পরিজনকে ফাঁকি দিয়ে বান্ধবীসহ দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর স্বভাব । একবার আলাস্কা থেকে ফারুকের রিং পেয়েছিল সে ; তখনই বুঝতে পেরেছে জীবন নিয়ে কীরকম এ্যাডভেঞ্চার করার শখ ওর।

মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফারুককে রিং দিতে গিয়েও থেমে যায় সে। মনে হল , যারা বর্তমানে বারূদ জ্বালাতে জানে, অতীতে ফিরে অহেতুক তাদের মুক্তো কুড়ানোর দরকার পড়ে না ! 
পাভেলের ঘড়িতে দশ মিনিট কখন গড়িয়ে গেছে টেরই পায়নি। হয়তো আম্বিয়াবিবি আর নেই। শুকনো পাতার মতন দুর্বল দমটুকু আঁকড়ে ধরে রেখেছে দেহ নামের গাছের কাণ্ডটিকে ; এতক্ষণে নিশ্চয়ই ছিন্নপাতা, উড়ে যাচ্ছে শুন্যে, হয়তো কোনো অচেনা-অজানা লোকের দিকে !
ফিসফিস করে অশরীরী কাকে যেন পাভেল বলে উঠল,‘ তোমার ভুল হইছে আম্বিয়াবিবি। খুনিটা আমি নই, অন্য কেউ । তুমি বুঝতে পারোনি !’
এসময় পাভেলের মনটা তীব্র কষ্টে হু-হু করে ওঠে। নিজের অজান্তে ওর চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *