উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।।পর্ব বারো
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব- ০২
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। তৃতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।।পর্ব বারো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের ।। পর্ব ষোল
বারো
তবে জনগণ জানে পুত্রে ব্যাপার— কেন লড়াই, কিসের জন্যে লড়াই, কার বিরুদ্ধে লড়াই। তবে ঐ পুরনাে কথাই— হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার দিন ফুরিয়েছে। এ্যাকশন, একশনের ভেতর দিয়েই জনগণকে সচেতন করে তােলা যাবে, তাদের কাছাকাছি পৌছানাে যাবে। সে সজোরে মাথা নাড়ে, নাে, নেভার,— কিন্তু উত্তেজনায় আর কি বলবে ভেবে পায় না। এ্যাকশন, ডাইরেক্ট এ্যাকশন। সে ভেবে পায় না কোনােরকম প্রিপারেশন ছাড়াই। এই লােকগুলাে কোথায় পাবে। পুরাে অর্গানাইজেশন এখনাে নড়বড়ে, কাজ-কর্মের কোনাে ধরাবাধা নিয়ম নেই, যােগাযােগ ব্যবস্থা ভালাে না— এরপরও এ্যাকশন। জনগন সঙ্গে না থাকলে বন্দুকের নল কোনাে কাজে লাগে না। আর হাতে তৈরী দুটো খেলনা পটকা ফুটিয়ে, পাইপগানের গুলি ছুঁড়ে সমাজ ব্যবস্থা বদলানাে যায় না। যখন ধর-পাকড় আরম্ভ হবে, তখন? কতজন যাবে আন্ডার গ্রাউণ্ডে। বাকীরা টপাটপ ধরা পড়বে, পুরো ব্যাপারটা তখন বুজুস বৈ আর কিছুই দাঁড়াবে না। কিন্তু অতােগুলাে পােক ওদিকে, সে এদিকে একা। তবু হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে না, বলে— ‘আমি জনগণের কথা আরেকবার ভেবে দেখতে বলছি। যেন কিছুই হবে না এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে হারুন… সুপ্রীম কাউন্সিল ভেবে দেখেছে, জোনাল হেডরাও, আপাতত এই জোনের দায়িত্ব আমার, আমিও ভেবেছি।’ ‘ধরা যাক রেজিস্ট্যান্সের প্রয়ােজন পড়লাে, ব্যারিকেড তৈরির ক্ষমতাও কি’ এটা প্রসেসর ব্যাপার, লড়াই তীব্রতর হলে একেক প্রক্রিয়ায় ক্রমশই বৃদ্ধি পায় ব্যারিকেডের সংখ্যা। এদের বােঝননা যাবে না, সে নিজের অজান্তেই মাথা নড়ে। হয়তাে স্রেফ এ্যাডভেঞ্চারিজম, হয়তাে অতিমাত্রায় ইমােশনাল। খুব তড়িঘড়ি হাতের মুঠোয় পেতে চায় সবকিছু। আগামী সপ্তাহেই বড় একটা এ্যাকশন, সে বিন্দুমাত্র সায় পায় না, সব কিছু আনঅর্গানাইজড, আর প্রতিরােধ ক্ষমতা, তা ছেলে খেলা ধরনের। সে মৃদু মাথা নাড়ে। সুপ্রীম কাউন্সিলের সঙ্গে একবার খুলে-মেলে কথা বলতে চায়, সে জানায়, তারপর শান্ত গলায় বলে— ‘প্রতিরােধ কমরেড, আমি আমাদের আমাদের আছে।’ প্রতিরােধ ক্ষমতার কথা বলছিলাম।’ ব্যস, ঘটনার এখানেই শেষ। এরপরে যেটুকু আছে সেটুকু বড় নির্মম। আজ এত বছর পরও তার চিন্তা ভাবনা এতটুকু বদলায়নি। হারুনের সঙ্গে সে সময় যা যা কথা হয়েছিল তা আজও সে বিশ্বাস করে। সেই ঠিক ছিল সে বিষয়ে সে নিশ্চিত। তবে ভুল কার ছিল? অতগুলাে অভিজ্ঞ লােক নিয়ে গড়া সুপ্রীম কাউন্সিলের? ভুল কার ছিল? তত্ত্বের? ভুল কার ছিল? হারুনের মতাে কিছু প্রভাবশালী নেতার? না, সে জানে না। বহু চেষ্টা করেছে তুলের আসল কারণ নিদিষ্ট করার। কিন্তু এত দিনেও তা হয়ে উঠেনি।
যে গান শুধু মনে হয়, বিপ্লবের অন্য সময় এবং দেশের ইতিহাস, ভূগােল জ্ঞান অপরিহার্য। ছিল না, সে মাথা নাড়ে, এ সময় সব কিছুই ছিল না। কোনাে প্রতিরােধ ক্ষমতাই ছিল না। না পার্টির না তার। তাই পাটি কয়েকটি মাত্র ধাক্কা দেবার পরই এখান হয়ে গেল। অবশ্য তারও আগে তাকে ছাড়তে হল প্রিয় শহর। হারুন তার পেছনে লেগেছিল, পাটিও হয়তাে খারাপ কোনাে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার ব্যাপারে। সে শহরে থাকা নিরাপদ মনে করেনি। ভয় পেয়েছিল সে। ভয়ে শহর পুরােপুরি ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছিল। পাটি অবশ্য ইচ্ছে করলে গ্রাম পর্যন্ত সহজেই আসতে পারতাে তার পেছনে পেছনে। আসেনি কেন তা সে জানে না। প্রিয় শহর ছেড়ে চলে আসার সময় তার কষ্ট হয়েছিল খুব। কিন্তু গ্রামে আসার কয়েকদিন পরই তার মনে হয়েছে— এই তাে ভালাে হল। শহরে আসলে নির্দিষ্ট করে কিছুই করা হয়নি তার। এখন এটা তখন সেটা করে দিন কেটেছে। গ্রামে একটু থিতু হয়ে বসার সুযােগ ছিল। আজ একযুগের বেশি সময় পর সে টের পায়— গ্রামে থিতু হয়ে বসা হয়নি তার। বেশ তাে চলছে তার ছােটখাট পােলট্রি ফার্ম। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। একই গ্রামে কয়েকঘর পরই বাস করে রফিক আখন্দ। আখন্দ ’৭১ সালে পাকিস্তানীদের দালালী করেছে। শান্তি কমিটির মেম্বার ছিল। অবশ্য ৭২-এর শেষ থেকেই সে জোর গলায় বলতে আরম্ভ করছে— ঠিকই করেছে সে। সে না থাকলে পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে টিত এ গ্রাম। সে যা করেছে তা গ্রাম আর গ্রামবাসীদের বাঁচানাের জন্যেই করেছে। এমন কথাই শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। সুতরাং ‘৭১ -এর রফিক আখন্দ চেয়ারম্যান, দু’তিন বছরের মধ্যে আবার সেই চেয়ারম্যান। লােকটা আপাদমস্তক অসৎ, চোর। কিন্তু একটা গুণ— যেচে লাগতে আসে না। এলে মাহমুদ হয়তাে গ্রামেই থাকতে পারতাে না। রফিক আখন্দের এ্যান্টি-পাটিও আছে। মাহমুদ তাদের নব প্রজন্মের তরুণ বলে ডাকে। তাদের কোনাে আদর্শ নেই, এরা কিছু ভাবে না, এরা কিছু দেখে না, এরা কিছু জানে না। শহরের সঙ্গে এদের ভালাে সম্পর্ক, টুকটাক ব্যবসা। এরা একজোট হয়ে কোনাে কোনাে বছর রফিক আখন্দকে সরিয়ে নিজেদের কাউকে চেয়ারম্যান বানায়। পরের বছর হয়তাে সুক্ষ্ম কোনাে কৌশলে আবার রফিক আখন্দ ফিরে আসে। মাহমুদ গ্রামে আসার পর থেকে এরকমই চলছে। আর ইদানীং মনে হয় এর বাইরে নতুন কিছু ঘটার কোনাে সম্ভাবনা নেই। বাইরে ক্রমশ ভাের হচ্ছে। সে ঘরের একটা জানালা খুলে দেয়। আবার মনে হয়, হারুনকে সে যা বলেছিল ঠিকই বলেছিল। পেছনের বছরগুলোয় তাতে ঠিক ঠিক প্রমাণ হয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য, ক্ষেত্র বিশেষে অবস্থা ও মানসিকতা এখনাে এতটুকু বদলায়নি। বছর কয়েক আগে গ্রামে একটি ছেলের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল।
সে পার্টির কাজ করে গোপনে আর ঐ সব বড় বড় কথায় খুব বিশ্বাস করে। মাহমুদের সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়। কিন্তু দীর্ঘ আলােচনায়ও সে ছেলেটিকেও একটুও প্রভাবিত করতে পারে নি। একটুও সরিয়ে আনতে পারেনি ছেলেটিকে তার অনড় নির্দিষ্ট বিশ্বাস ও চিন্তা-ভাবনা থেকে। প্রসঙ্গক্রমে সে একদিন বলেছিল— ‘ঠিক আছে, তবে রফিক আখন্দকে সরিয়ে দাও তােমরা।’ ছেলেটা একটু ভেবে বলেছিল— ‘আপাতত তাকে আমরা শ্রেণী শত্রু মনে করছি না।’ শ্রেণী কোথায় বাংলাদেশে, কোথায় তার বিভাজন। কিন্তু ছেলেটি নিজের বিশ্বাস থেকে সরে এসে এতসব বুঝতে চায় না। মাহমুদ অবাক হয়ে বলেছিল— ‘ঠিক আছে, শ্রেণী শলু না, কিন্তু দেশের শত্রু তাে। লােকটা অত্যন্ত অসৎ, ক্ষতিকর— একে কেন। বাচিয়ে রাখছাে?’ ছেলেটা তবু মাথা নেড়েছিল— ‘না, এ মুহূর্তে তাকে সরানাে। অপ্রয়ােজনীয়।’ তবে কাকে সরাবে? ৭১ নিয়ে এদের আলাদা কনসেপ্ট। মাহমুদ তার অনেকটাই অস্বীকার করে না। কিন্তু তাই বলে এতটা নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়ার তাে কোনাে কারণ নেই। অথচ ছেলেটাকে কিছুই বােঝানাে যায় না। একদিন তর্ক করতে গিয়ে সে ছেলে আটকে গিয়েছিল। বলেছিল— ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর এখন নয়, কাল দেব।’ মাহমুদ হেসেছিল— ‘কেন, বই দেখতে হবে? তারপর ছেলেটি মাস দুয়েক আসেনি। মাহমুদ ভয়ে ভয়ে ছিল। ছেলেটাকে ওভাবে চটিয়ে দেয়া নিশ্চয় তার উচিত হয় নি। কিন্তু আর কী করে সে। নিজের ওপরই যে তার চটে যেতে ইচ্ছে করে কিছু হল। নাইদানীং তার ঘন ঘন মনে হয়। কিছু হলে আফতাবকে অবার আখন্দের আশ্রয়ে ফিরে যেতে হত না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে আফতাব ছিল রফিক আখন্দের ডানহাত। তার জন্যে লাঠি ধরতাে ছায়ার মতাে লেগে থাকতাে তার সঙ্গে। কয়েকটি খুন জখমও করেছিল। অথচ ৭১ সালে সেই আফতাব কি অদ্ভুতভাবে বদলে গেল। রফিক আখন্দ যােগ দিল শান্তি-কমিটিতে, আফতাব মুক্তিবাহিনীতে। মাহমুদ তার সঙ্গে একই ফ্রন্টে লড়াই করেনি, কিন্তু আফতাবের বীরত্বের কথা সে শুনেছিল। সেই আফতাব স্বাধীনতার পর গ্রামে ফিরে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে লাগলাে। কিছুই করার নেই তার। এভাবে প্রায় বছর খানেক যাওয়ার পর দেখা গেল আফতাব আবার রফিক আখন্দের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। রফিক আখন্দ যখন পুরনাে আসনে ফিরে আসার চেষ্টা করছে তখন আফতাবই ঝাপিয়ে পড়লে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে। তার একটা আশ্রয় দরকার। মাহমুদ হাসে, বড় বেশী হাসি পায় তার। আফতাবকে আশ্রয় দেয়ার কথা ছিল কাদের? যাদের ছিল তারা পারে নি। পারার কথা নয়। তাদের শ্রেণী-চরিত্র পারার কোনাে। ইঙ্গিত দেয় না। তাদের শ্রেণী অবস্থান থেকে তারা স্বাধীনতা মানে বােঝে ক্ষমতা নিজ হাতে পাওয়া। এখানে দায়িত্ব নেই, ক্ষমতা নিজ হাতে পাওয়ায় নিজস্ব সুবিধা বৃদ্ধির আর আনন্দে মশগুল হওয়ার ব্যবস্থা আছে। মাহমুদ এখন বােঝেনা, অর্ধ-সমাপ্ত কিছুই ভালাে না। অথচ এই অবস্থা যথাযথ ভাবে বিশ্লেষণ ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে তারা, হারুনরা ব্যর্থ হয়েছিল।
অথচ কী সম্ভাবনাটাই না ছিল। শুধু প্রচণ্ড আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেল। মতের অমিল থাকলেও মাহমুদ তাে আজও হারুনদের মতাে লােকদের মহান মনে করে। সে তাে পারেনি দেশের ভালাের জন্যে অকাতরে ঐ ভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। মন খারাপ হয়ে যায় এই সব ভেবে। এদেশের কিছু হবে না, সে মৃদু গলায় বলে কি করে হবে, সেত কয়েকবছর হল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে অবস্থা। গতকাল খুব হঠাৎ করে একটা চমৎকার বিষয় চোখে পড়েছে তার। রাজনীতি আর ক্ষমতা যেন আমগাছের মততা, মৌসুমী ফল হঠাৎ হঠাৎ সিজন বুঝে বেগ আসে। নেতারা পাবলিককে চড়িয়ে দেয় আমগাছে। আম, অর্থাৎ ক্ষমতা দখলের জন্যে। কিন্তু এখন অফ-সিজনে আম খাওয়ার হয়তাে তেমন ইচ্ছে নেই তাদের। তাই যেই দেখে, পাবলিক আম পেড়ে ফেলেছে প্রায়, তাদের নামিয়ে আনে। গাছে ওঠা আর নামার প্রক্রিয়ায় কিছু পাবলিক মারাও যায়। তাতে কি, এই ধাক্কা ধাক্কিতে যে দুএকটা আম পড়ে তা দু একটা বাড়তি সুবিধা, তা নেতারাই খায়, মিলেমিশে। মাহমুদ হাে হাে করে হাসে। ভাবে— এটা বলতে হবে ইস্তিয়াককে। ছেলেটা এ ধরনের কথা শুনে খুশী হয়। আড়মােড়া ভাঙে মাহমুদ। আজ তার দুপুরে ট্রেন ধরে ঢাকা যাওয়ার কথা।