উপন্যাস

উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব দশ

রুম্পা ফেরে সন্ধ্যের আগে আগে। প্রথমেই অনেক সময় নিয়ে গােছল সেরে নেয় সে। তারপর নিজের ঘরের দরােজা আটকে চুপচাপ শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ। যা ঘটে গেছে, তা নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চায় না। কিন্তু চিন্তা এড়াতেও পারে না সে। জামানকে কষে গাল দেয় বার কয়েক। তাতে বরং রাগ তার বেড়ে যায়। তিনটে ফোন এ বাড়িতে। কাছেরটা নিজের ঘরে নিয়ে এসে খামােখাই একে-ওকে ফোন করে। কিন্তু তাতে মন ভালাে হয় না তার। শেষে যা সে প্রায় কোনােদিনই করেনি, তাই করে। উঠে মার কাছে যায়। এ বাড়িতে রান্না তদারকি না করলেও চলে। অভিজ্ঞ বাবুর্চী আছে। সে খুব ভালাে জানে, এ বাড়ির কে কি পছন্দ করে এবং আইটেম গুলােকে কি করে সুস্বাদু করা যায়। তবু মা’র দু’বেলা খোঁজ না নিলে চলে না। রুম্পা যখন তার কাছে যায় তখন সে বাবুচীকে ডেকে বােঝাচ্ছে। খুব মন দিয়ে শােনে রুম্পা। নিজেও একটা আইটেম যােগ করে দেয়। রুম্পাকে এ সময় তার ঘরে দেখে মা খুব অবাক। হাসি হাসি মুখে তাকায় সে মেয়ের দিকে– ‘কিরে, কিছু বলবি?”না মা’ –রুম্পা মাথা নাড়ে— ‘ভাল লাগছে না তাই এলাম।”শরীর – টরীর খারাপ করেনি তাে?”আহ মা, ভালাে লাগছে না বললেই তুমি এমন করতে আর কর। এজন্যেই তােমাকে আমার একটুও ভালাে লাগে না। বলি, ভালাে না লাগা মানেই কি শরীর খারাপ? মন খারাপ লাগতে পারে না?’মা হাসে— ‘হ্যা, তাও পারে বৈকি। কি হয়েছে তাের বল দেখি।”তুমিই আন্দাজ করো না।’ মা তা পারে না— ‘কি করে করি। তােরা কি আমাকে কখনাে কিছু বলিস যে বুঝবাে তােদের কখন কি হয়।’ একটু হাসে রুপা, ঠিকই তাে বলেছে মা— ‘না মা বলে— ‘তেমন কিছু হয়নি, তােমাকে আজও করতে হবে না কি হয়েছে। এই একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ‘ভালাে, তাই যেন হয়। এখন আয়, একটু বােস দেখি আমার পাশে। প্রথম সন্তান তার, সে তাে সবসময়ই এই এতোটুকুন। পাশে রুম্পাকে বসিয়ে তার মনে হয় তেইশ বছর আগের কথা। তখন অবস্থা তাদের ভালাে না। শিশু মেয়েটির যা যা প্রয়ােজন তার অনেক কিছুই কেনা হত না। আর মেয়েটিও জেদি ছিল বটে। একবার কাঁদতে আরম্ভ করলে তাকে থামানাে ছিল মুশকিল। সে কত রকমে ভােলানাের চেষ্টা করতাে ছােট রুম্পাকে। ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোণ ভিজে যায়। সেই দিনগুলােই কি ভালাে ছিল না? অন্ততঃ ছেলেমেয়েগুলাে তাে ছিল কাছের, খুব কাছের। এক সময় তাকে ছাড়া বুঝতােই না কিছু। অথচ এখন দেখ তিনটে ছেলেমেয়েই কত দূরে দূরে। তাদের কারাে নাগালই সে পায় না। কেউ তাে বাসায়ই থাকে না তেমন। তাদের কার কি এত কাজ বােঝে না সে। চোখের দু’কোণ মুছে নিতে গিয়ে দেখে রুম্পা তাকিয়ে আছে তার দিকে। ‘তা মা, তােমার শরীর খারাপ নাকি এখন?’ রুম্পা মুচকি হেসে জানতে চায়। ‘কে বললে?’ ‘ঐ যে কাঁদছো। পেটে ব্যথা হচ্ছে বুঝি খুব?’ ‘ধ্যাৎ । নানা রকম কান্না আছে বুঝেছিস?’ রুম্পা মাথা নেড়ে জানায়, বুঝেছে। কিন্তু মার পাশে বেশিক্ষণ বসা হয় না তার। একটু পরই সে টের পায় কথা ফুরিয়েছে। নিজেরই তার আশ্চর্য লাগে। এই পাঁচ মিনিটেই মার সঙ্গে সব কথা শেষ। ‘গরম লাগছে মা’ — সে বলে— ‘ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি।’‘যা।’ মা আদর করে তার গালে হাত বুলােয়। সেখান থেকে প্রায় পালিয়েই আসে রুম্পা। দ্রুত পায়ে ছাদে পৌঁছায়। বাতাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটু কাঁদে সে। তারপর দেওয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকে বহুদূর। আজ একটু জলদি জলদিই ফিরলাে ইস্তিয়াক। মাহমুদের রুম থেকে বেরিয়ে বহু জায়গায় ঘুরেছে সে। রেল স্টেশন, স্টীমার আর লঞ্চ ঘাট, পার্ক কিছু সে বাদ দেয়নি। সময় কাটানাের আর কোনাে উপায় জানা নেই তার। এক হয় — বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাটা সময়। কিন্তু সেখানেও সমস্যা, সে কিছু বললেই তারা চ্যাচায়, ‘আহ ইস্তি, অমন ভারী ভারী কথা বলিস নাতাে।’ তাছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে আসলে তার সময় কাটে না। হয় সিনেমা, নয়তাে মেয়ে মানুষের শরীরের নতুন অভিজ্ঞতা কিংবা নতুন কোনাে নেশা — এই তো। এভাবে কত আর কাটে সময়। তার চেয়ে ঢের ভালাে মানুষ দেখে বেড়ানাে। মজা লাগে তার। একটি মানুষও আরেকটির মত নয়। আজ অবশ্য মানুষ দেখায় মন ছিল না তার। মাহমুদ চাচার ওখান থেকে বেরােনাের পর থেকেই ভার হয়ে আছে মন। এমন কেন হয় সে বুঝতে পারে না। এমন তাে হওয়ার কথা নয়। বরং চাচার ওখান থেকে বেরিয়ে মন ফ্রেশ থাকা উচিত ছিল। চাচার কাছ থেকে জানা যাবে অনেক কিছু—এই ভেবে হালকা হয়ে উড়ে বেড়ানাের কথা তার। কিন্তু এর উল্টোটাই ঘটেছে। একবার তাে তার মনে হয়েছে বাসায়ই ফিরবে না। এরকম মাঝে মাঝেই মনে হয় তার। মনে হয়, কি হবে বাসায় ফিরে। বাসা নয়, যেন খোয়াড়ে ফিরে যাওয়া। আজ প্রায় মনস্থির করে ফেলেছিল সে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে, বাসায় না ফিরেই বা কি হবে। এমন কি কোনাে বিশাল পরিবর্তন ঘটবে তাতে। না, ঘটবে না। শম্পা একটু চিন্তিত আর মা কেঁদে কেটে আকুল হবে। এইত, তবে কেন খামােখা না ফেরা আর মাকে কাঁদানো। মা’র কথা মনে হলে একটু ম্লান হাসে সে। মা’কে বড় ভাল লাগে— এই কথাটাই জানানাে হয়নি কোনাে দিন। তবে জানে সে, জানানাের প্রয়ােজন নেই, মা এমনিই জানে। শুধু একটা ব্যাপারে তার বড় বিরক্তি, মা বড় বেশি বেশি আগলে রাখতে চায় তাকে। চায় ঘরেই কাটাক সে বেশি সময়, এ সময়ে সে একটু ছেলেকে আদর – যত্ন করার সুযােগ পায় তবে। তাই কি হয়? বাড়ি ফিরতে ফিরতে ইস্তিয়াক হেসেছে। এখন মা একটার জায়গায় দুটো প্রশ্ন করলে শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে, সে ঝামেলা মনে করে। তবু মা’কে বড় অললা লাগে তার মা কী অসহায়। বাড়ি ফিরে ড্রইংরুমে সে বসে প্রথমে। টিভিতে খবর হচ্ছে। হােক। সে ওঠে। তারপর কি করবে ভেবে পায় না। একবার ভাবে শম্পার সঙ্গে কাটাবে সময়। কিন্তু একটু ভেবে সে চিন্তা বাতিল করে দেয়। শম্পাটা বড় বাকোয়াজ। একবার মুখ খুললে মাথার পােকা বের করে তবে ছাড়ে। তবে একটা কিছু নিয়ে এখনই ব্যস্ত হয়ে পড়া উচিত। নইলে তাকে ফাঁকা দেখে মা এসে পাশে বসলে ওঠানাে মুশকিল হবে। অন্ততঃ এ মুহূর্তে মা’র আদরে-সােহগে আর অবিরাম কুশল জিজ্ঞাসায় অতিষ্ঠ হওয়ার কোনাে ইচ্ছে নেই তার। তাছাড়া মার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা চালান খুব মুশকিল। সে তাে একটু পর বলার মতাে কোনাে কথাই খুজে পায় না। শেষে সে নিজের ঘরে গিয়ে কতক্ষণ সটান শুয়ে থাকে। কতক্ষণ রবিশঙ্কর শোনে। কতক্ষণ র্যাকের বইগুলাে উল্টে-পাল্টে দেখে। এক সময় বুঝে যায় এভাবে কাটবে না সময়। টেবিলের ড্রয়ার খোলে সে। দুটো ট্যাবলেট বের করে স্ট্রিপ ছিঁড়ে এক ঢোকে পানির সঙ্গে দুটোই চালান করে দেয় ভেতরে। ‘আই ফোর সুইট ড্রীমস্, —জানালায় দাঁড়িয়ে সে মৃদু হাসে। বিশেষ কোনাে কারণ না থাকলে এগারােটার দিকে শুয়ে পড়ে শম্পা। আজ সে জেগে আছে। সেই ট্যাবলেট সরানাের পর থেকে একবারও সে ঘর থেকে বের হয়নি। মাঝখানে অবশ্য একবার তাকে বের হতেই হয়েছে। সেটা রাতের খাবার সারার সময়ে। নিজের ঘরে ব’সে সে সবই টের পেয়েছে কখন ফিরলাে রুম্পা, কখন ইস্তিয়াক, কখন বাবা। বেশ অবাক হয়েছে সে। কি ব্যাপার, সবাই এমন সুবােধ ছেলে হয়ে গেল। নটা বাজতে না বাজতেই সবাই ঘরে! রুম্পারটা অলরাইট, কিন্তু ইস্তিয়াক আর বাবা কখলে এত আর্লি ফের না। বাবাকে খুব খুশি খুশি মনে হয়েছে। সে যাক, দশটার মধ্যে খাবার পর্ব চুকেছে। সবাই ছিল টেবিলে, তবু ইস্তিয়াক আসেনি। কেন, সেটা সে কিছুন আন্দাজ করতে পারে। মা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে গেছে। ইস্তিয়াক ‘এখন খাব না’ ছাড়া কিছুই বলেনি। শেষে মা তার খাবার টেবিলে চাপা দিয়ে রেখেছে। এমন অবশ্য মাঝে মধ্যেই হয়। ইস্তিয়াক মাঝ রাতে কিংবা আরাে পরে উঠে খায়। শম্পা খেয়ে এসে কতক্ষণ চেয়ারে বসে পা নাচায়। ইস্তিয়াকের ঘর থেকে আনা ‘অ্যাওয়ারনেস’ নামে এক ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোয় কতক্ষণ?কিছুই বােঝে না, ইপ্তি যে কী পড়ে এসব। সে ‘অ্যাওয়ারনেস’ ছুঁড়ে ফেলে দু পাতা হ্যারল্ড রবিন্স, তিন পাতা সিডনী শেলডন পড়ে। ভালাে লাগে না। শেষে খাটের নিচ পড়ে থাকা ব্যাগাটেলিটা তুলে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করে। কিন্তু একবারও ভালাে স্কোর তুলতে পারে না। ‘ধ্যাৎ তেরি’, বলে সেটাও রেখে দেয় সে। ঘড়ি দেখে বারবার। রাত বাড়লে ঘরের দরােজা খুলে এদিক-ওদিক তাকায়। আধঘন্টা আগে ‘শম্পা ঘুমিয়েছিস’ বলে মা দরোজায় ডেকে গেছে। শম্পা জবাব দেয়নি। এখন দরােজা খুলে সে দেখে সারা বাড়ি নিশ্চুপ। মৃদু হাসে সে ঠোঁট টিপে। পা টিপে গিয়ে আবার ঘর থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে আসে। পানি এক গ্লাস রােজ রাতেই এনে রাখে সে। আজ তাড়াহুড়োয় এ কাজটিই করা হয়নি। ঘরে ফিরে দরােজা বন্ধ করে দেয়। পানির গ্লাস আর ট্যাবলেটটা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। পুরােটা খাবে না সে। ডােজ সম্পর্কে কোনাে ধারণাই নেই তার। শেষে না, কি কেলেঙ্কারী বাঁধে, বাড়ির সবাই জেনে যাবে। জানলে, শম্পা ভাবে, জানলে অসুবিধে নেই। তবে নিজের কিছুর সঙ্গে বাড়ির কাউকে জড়ানাের কোনাে ইচ্ছে নেই তার। সে স্টীপ ছিঁড়ে সাবধানে দুভাগ করে ট্যাবলেট। এক ঢােক পানির সঙ্গে অর্ধেকটা গিলে ফেলে ড্রেসিং টেবিলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। সে ভেবেছিল, মুহূর্তের মধ্যে হয়তো দারুণ কিছু একটা ঘটে যাবে। কিন্তু না, শরীর যথাযথ, সে একটু নিরাশই হয়। বাকী অর্ধেকও খেয়ে ফেলবে কি-না ভাবে। কিন্তু স্প্রীপের ওপর লেখা মিলিগ্রামের পরিমাণ দেখে ইচ্ছেটা সে বাতিল করে দেয়। বাকী অর্ধেক স্ট্রীটে জড়িয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। পা একটু কাঁপে নাকি? নাহ, মনের ভুল। সে টেবিলের বইয়ের ফাঁকে মােড়কটা রাখে। আবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসে। সময় যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই ঘটছে না কেন। সে আয়নার খুব সামনে গিয়ে চোখ দেখে, মুখ দেখে। না, কোনাে পরিবর্তন নেই। নিজেকে চিনতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধে হচ্ছে না। কি আর করা, তার রাগ হয় নিজের ওপর, ইস্তিয়াকের ওপর। সে উঠে পুরাে ঘরে ঘুরতে আরম্ভ করে। একসময় টের পায়, এতেও কোনাে লাভ নেই, খামােখাই ক্লান্তি বাড়ানাে শুধু। খাটের ওপর সে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতাে অনেকক্ষণ বসে থাকে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব নয়উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব এগারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *