ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব আট
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব দুই
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তিন
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চার
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পাঁচ পর্ব
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব আট
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব নয়
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। দশ পর্ব
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব এগারো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। বারো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তেরো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চৌদ্দ
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। শেষ পর্ব
তৃতীয় পর্ব: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর ফেসবুক
অনেক দিন ধরে জয়িতার মাথায় একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে যখন চোখে দেখত তখন ফেসবুক ব্যবহার করত। এখন পারে না। এমনটি ভাবতে গেলেই তার কান্না পায়। নীরবে কাঁদে। সড়ক দুর্ঘটনায় জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেল। দুর্ঘটনায় মারা গেল মা। ফিরে এলো না ছোট ভাইটিও। আর সে হারাল দৃষ্টিশক্তি।
এখন সকাল দশটা। জয়িতা ড্রয়িং রুমে এসে বসে। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। ফেসবুকে কত বন্ধু ছিল! এখন কারো সঙ্গে চ্যাটিং করতে পারে না। আজ সেসব বন্ধুরা স্মৃতির পাতা থেকে মুছেও যাচ্ছে। কত সুন্দর সুন্দর ছবি দেখা যেত। কত কথা! একেকজন বন্ধু যেন গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসত। এখন সবই ফাঁকা। অনেক দিন আগে আতিকনকে পাসওয়ার্ড দিয়ে জয়িতা বলেছিল, খালা আপনি দেখেন তো কেউ আমাকে খোঁজ করে কিনা।
আতিকন ফেসবুক একাউন্ট খুলে দেখেছে। অনেক বন্ধু ইনবক্সে জানতে চেয়েছে, জয়িতা তোমাকে অনেকদিন ফেসবুকে দেখছি না কেন? তুমি কোথায়?
একজন লিখেছে, জয়িতা তোমাকে খুব মিস করছি। ফেসবুক জানি টাইম কিলার। কিন্তু মাঝে মাঝে ঢুঁ মেরো। তোমার স্ট্যাটাস দেখতে না পেয়ে খুব ভাবছি।
একজন লিখেছে, তোমার সুন্দর সুন্দর ভাবনার লেখাগুলো আর দেখি না। জয়িতা তুমি কোথায় আছো?
এই লেখাটি যখন আতিকন পড়েছিল তখন জয়িতার চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়েছিল। জয়িতার কান্না দেখে আতিকন বলেছিল, মা, তুমি বলো তোমার ভাবনার কথাগুলো, আমি লিখিয়া দিব।
জয়িতা বলেছিল, না খালা। থাক। যে পৃথিবী আমার জন্য অন্ধকার হয়ে গেছে সে পৃথিবীতে আমি আর থাকতে চাই না। জয়িতার বুক ভেঙে কান্না আসে। সে আতিকনের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরিয়ে কেঁদেছিল সেদিন।
আজকে সেদিনের স্মৃতি মনে পড়াতে জয়িতার কান্না আসে। তবে শব্দ করে কাঁদে না। পাছে বাবা জেনে যায়। বাবাকে সে কষ্ট দিতে চায় না। চোখ টিপে টিপে কাঁদে। আস্তে আস্তে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। গ্রিল ধরে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে। বাসার সামনে বিদ্যুতের তারে বসা কয়েকটি কাক কা কা কা করছে। পাশের বকুলগাছের ডালে অনেক পাখি। পাখিদের কলকাকলি বেশ ভালো লাগে। চোখের পানি ওড়না দিয়ে মুছে। ঝিরঝিরে বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। এই সময় বাবা এসে ঘরে ঢোকে। বাবার পায়ের আওয়াজ পেয়ে জয়িতা চোখের পানি মুছে ফেলে। সে বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কিছু নিয়ে ভাবছে। গভীর ভাবনা। আসলে সে মনের কষ্ট বাবাকে বুঝতে দেয় না। বাবা কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, মা, কী করছ?
কিছু করছি না।
কী ভাবছ?
কিছু ভাবছি না।
আজকে কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে তোমার?
না। ইচ্ছে করছে না। আমি আজকে বাসাতেই থাকব।
চলো আজকে তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে ঘুরতে যাই।
না বাবা। আজকে ঘুরতে ইচ্ছে করছে না।
আজ ছুটির দিন বাসায় বসে থেকে কী করবে?
অনেক কাজ আমার। জানো বাবা, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। চমৎকার আইডিয়া।
বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী আইডিয়া, মা?
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ফেসবুক তৈরি করব।
তার মানে?
তার মানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যাতে ফেসবুক ব্যবহার করতে সেরকম একটা পদ্ধতির উদ্ভাবন করা।
কী করে সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব। সহজ। তুমি বিজ্ঞানী কান্টিবান্টিকে বাসায় আনার ব্যবস্থা করো।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের গাড়িটি বানানোর পর বাবার মনে অনেক আনন্দ। জার্মানি, আমেরিকার কয়েকটি অফার এসেছে গাড়ির টেকনোলজি বিক্রি করার জন্য। এখন দরদাম চলছে। নিউইয়র্ক টাইমসে জয়িতা আর কান্টিবান্টির ছবিসহ গাড়ির মডেলের ছবি ছাপা হয়েছে। সারা পৃথিবীতে এখন অনেক বিজ্ঞানীর মধ্যে এই গাড়ি নিয়ে আলোচনা চলছে। যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার পর বাবার আনন্দ উপচে পড়ছে। জয়িতার প্রতি তাঁর আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গেছে হাজারগুণ।
জয়িতার কথা শুনে নতুন ধারণা পেয়ে আনন্দে বাবার লাফাতে ইচ্ছে করছে। বাবা ড্রাইভারকে ফোন করে বলে, বিজ্ঞানী কান্টিবান্টিকে এক ঘণ্টার মধ্যে পাকড়াও করে বাসায় নিয়ে এসো।
বাবার কথা শুনে জয়িতা হাসে। এতো বড় একজন বিজ্ঞানীকে পাকড়াও করে আনতে হয়।
ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ছোটে। বিজ্ঞানী কান্টিবান্টিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেসের দরজায় বিরাট তালা। ড্রাইভার ফোন করে, বিজ্ঞানী সাব, আফনে কোনহানে?
আমি পুরান ঢাকায়। হাজির বিরিয়ানি খেতে এসেছি।
আফনে ওইহানে থাহেন। আপনাকে পাকড়াও করতে হবে।
কেন? আমাকে পাকড়াও করতে হবে কেন?
কারণ, সাহেবের হুকুম। ড্রাইভার ফোন কেটে দিয়েই গাড়ি হাঁকায়। এদিকে কান্টিবান্টি বাড়তি কাজের চাপ মনে করে সে বিরিয়ানি খাওয়া রেখেই পালায়। রিকশা নিয়ে গুলিস্তানের দিকে যায়। এই সময় ড্রাইভার বিপরীত দিক থেকে আসছিল। কান্টিবান্টিকে দেখে গাড়ি পার্ক করেই কান্টিবান্টির রিকশা আটকায়। এই বিজ্ঞানী নামেন।
কেন? নামব কেন?
সাহেবের হুকুম।
আপনি না হাজির বিরানি খাইতে গেছেন। এইহানে কী করেন? মিছা কথা কন?
না। মিছা কথা কই না। আমি ফোন পেয়ে পালাচ্ছিলাম।
তাইলে নামেন। আপনাকে পাকড়াও করার জন্য সাহেব বললেন।
ড্রাইভার কান্টিবান্টির হাত ধরে টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে তোলে। তারপর দরজা আটকাতে আটকাতে বলল, একদম নড়বেন না। সীট বেল্ট বাঁধেন।
কান্টিবান্টি সিট বেল্ট বাঁধে চুপ করে বসে। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সময় ড্রাইভারকে বলল, সকাল থেকে কিছু খাইনি। এখন প্রায় দুপুর। কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে?
ড্রাইভার বলল, না করা যাবে না। বাসায় গিয়ে খাবেন।
গাড়ি ছুটছে বাসার দিকে।
ড্রয়িং রুমে বসে আছে জয়িতা। বসে আছে জয়িতার বাবা। কান্টিবান্টির পরনে লাল প্যান্ট। গায়ে গোলাপি টিশার্ট। মাথায় চার্লি চ্যাপলির ক্যাপ। চোখে কালো গগলস। পোশাক দেখে জয়িতার বাবার পেটের ভিতরে হাসির ঢেউ খেলতে শুরু করে। অনেক কষ্টে নিজেকে কোনোক্রমে সামলান। তারপর বলেন, বসো কান্টিবান্টি। জয়িতার কথা মতো তোমাকে একটি কাজ করে দিতে হবে।
কী কাজ করে দিতে হবে?
তা তুমি জয়িতার কাছ থেকে শুনো। কথাটি বলে জয়িতা অন্যরুমে চলে যান। গতরাতে দ্য ভিঞ্চি কোড বইটি পড়ছিলেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেটির পাতা নাড়াচাড়া করছেন। একটা বই লিখতে লেখকের ভাবনা, তার ওপর কত লেখাপড়া করতে হয়। পৃথিবীতে লেখকরা কত অবদান রাখছে। অথচ হাতে গোনা কিছু লেখক ছাড়া প্রায় সব লেখকই অবহেলিত। তিনি ভিঞ্চি কোডের লেখক ড্যান ব্রাউনের জীবনী আবার পড়েন। গতরাতেও পড়েছিলেন। লেখকের ছবিটি দেখেন খুঁটিয়ে খুুঁটিয়ে। বেশ ভালো লাগে। কাশেম পাটোয়ারীর একটি অভ্যাস হলো, বইটি পড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাইলাইটার দিয়ে দাগান। অনেক ভাবেন, তিনিও কখনও লিখবেন। বইয়ের আলোচনা-সমালোচনা লিখবেন, কিন্তু তা আর হয় না। এতো বড়ো শিল্পপতি হলে কী আর লেখার সময় পাওয়া যায়? তাই লেখা আর হয় না। ভাবনা পর্যন্তই থেমে থাকে।
আতিকন চা নিয়ে আসে। সে আতিকনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, বুয়া, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়াতে পারো?
কান্টিবান্টির কথা শুনে আতিকন রেগে আগুন। সে বলল, এই বিজ্ঞানী, শুনো। আমি তোমাকে কতবার বারণ করেছি আমাকে সম্মান করে কথা বলতে। তোমার অভ্যাস ঠিক হয়নি কেন? তুমি মনে করো না এই বাসায় কাজ করি বলে আমাকে তুমি করে ডাকবে। আমাকে আপনি করে ডাকবে। আজকেই শেষবারের মতো বলে দিলাম।
কান্টিবান্টি এই ধমক আগেও একবার কক্সবাজার খেয়েছে। কিন্তু আজকে সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল তাই মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল। তাছাড়া তার ভাষাগত সমস্যা আছে যা আতিকন জানে না। এটা একপ্রকার বিপদ ছাড়া আর কিছু না। তবু রক্ষে যে, জয়িতার কাছে কিছুদিন ভাষা শিখে আগের চেয়ে অনেক ভালো করছে। তবে এখনও কিছু ভুলভাল হয়ে যায়।
কান্টিবান্টি ঢোক গিলে বলল, ঠিক আছে, খালা। আর ভুল হবে না। আমি বিজ্ঞানী মানুষ তো, এসব আলতুফালতু বিষয় মাথায় থাকে না।
কী বললে, এসব বুঝি আলতুফালতু কথা? ভালোভাবে কথা বলা, মানুষকে সম্মান করা বুঝি আলতুফালতু হইল? মুখ সাবধান করে কথা বলবে।