ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব সাত
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব দুই
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তিন
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চার
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পাঁচ পর্ব
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব আট
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব নয়
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। দশ পর্ব
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব এগারো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। বারো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তেরো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চৌদ্দ
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। শেষ পর্ব
আতিকন জয়িতার হাত ধরে পানিতে নামে। জয়িতা সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে থাকে, যদিও সে দেখতে পায় না। সন্ধ্যার অন্ধকার আস্তে আস্তে ঘনিয়ে আসে। সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় শুধু। জয়িতা আস্তে আস্তে বলে, খালা।
বলো।
এখন কী অন্ধকার?
হুম। অন্ধকার।
এই অন্ধকারই আমার সারা জীবন ঘিরে রেখেছে, তাই না খালা?
আতিকনের বুক ভেঙে কান্না আসে। মুখে আঁচল গুঁজে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। জয়িতা বুঝতে পারে আতিকনের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। তাই সে অন্য প্রসঙ্গ এনে আতিকনের মনের কষ্ট দূর করতে চেষ্টা করে। জয়িতা বলল, খালা জানেন, অন্ধকার আসলে মানুষকে ঢেকে দিতে পারে না। তাই না?
হুম। যদি পারিত তাহা হইলে তুমি এতোদূর কীভাবে আসিয়াছ? চলো, রুমে যাই মা।
খালা, তুমি আমার হাত ছেড়ে দিয়ো না।
না, রে মা আমার। তোমার হাত ছেড়ে দিব না। আসো আমার সঙ্গে।
খালা, রাতে ঝাউবন হোটেলে খেতে যাব। ওখানে আমরা খেতাম, তাই না। মনে আছে খালা? আপনিও তো আসতেন।
হুম। ওখানেই খাব। ছুরি মাছের শুঁকটির ভর্তা। আর গরুর গোসতের ভুনা। রূপচান্দা ফ্রাই। সব খাবো। আসো আমার সঙ্গে। আতিকনের চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ে।
রাতে ওরা ঝাউবন হোটেলে খেয়ে ফিরে আসে হোটেলে।
রাতে বাবার সঙ্গে জয়িতার কথা হয়। অনেক কথা।
সারা দিনের ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়েই মনে হয় ঘুমে বিভোর হয়। জয়িতা ঘুমিয়ে পড়ে। মাকে স্বপ্নে দেখে। বাবাকে স্বপ্নে দেখে।
টেকনাফ যাত্রায় ছিনতাইকারীর কবলে
রাতে ভালো ঘুম হয়েছে সবার। সকালে খুব ভালো নাশতাও হয়েছে। তিনজনের মনই ফুরফুরে। আনন্দে উচ্ছ্বাসিত। এখন টেকনাফ যাবে। সেখান থেকে দিনে দিনে ফিরে আসবে। তারপর রাতটি কক্সবাজার থেকে পরদিন ঢাকায় যাবে। ঢাকায় দিনে দিনে যাতে পৌঁছানো যায় সেজন্য গাড়িটি চালাবে কান্টিবান্টি। ফেরার পথে জয়িতা গাড়িটি চালাবে না। এমনই সব ঠিকঠাক করা হয়েছে। ঢাকা থেকে গাড়ি কোন দিকে যাচ্ছে তা মনিটর করা হচ্ছে। কিন্তু আজকে সবকিছুই কিছু গোলমাল দেখা দিয়েছে।
জয়িতার বাবা আজকে গাড়িটি মনিটর করতে বসেনি। তিনি একটি জরুরি কাজে অফিসে গেছেন। আর গাড়ি মনিটর করার জন্য অন্য একজন লোককে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু এই লোক যে রেড ওয়ার্ল্ডের লোক তা তিনি বুঝতে পারেন নি।
রাতেই গাড়ি থেকে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) খুলে নিয়ে গেছে রেড ওয়ার্ল্ডের লোকজন। গভীর রাতে সেটি চুরি করা হয়েছে। এখন বলতে গেলে, ঢাকা থেকে গাড়ির কোনো হদিস করতে পারবে না।
গাড়িটি চলছে টেকনাফের দিকে। যেখান থেকে গাড়িটি মোড় নিল সেখানে থেকেই মোড় নেয়ার কথা। কিন্তু বিরোধ বাঁধল কান্টিবান্টিকে নিয়ে। কান্টিবান্টিকে বুঝানো হয়েছিল রাস্তাটি ভাঙা থাকাতে বিকল্প রাস্তা দিয়ে গাড়িটিকে নিয়ে যেতে হবে। হায় কপাল! কান্টিবান্টি ভাবতে ভাবতেই গাড়িটি ঢুকে গেল এক বিরাট বনের মাঝখানে। পথের ওপর একটা গাছ আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। গাড়িটি অটোমেটিকভাবেই থেমে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ডাকাত এসে কান্টিবান্টি আর আতিকনকে ধরে চোখ বেঁধে ফেলল।
ডাকাতগুলো বলল, ওই মেয়েটা তো অন্ধ। ওকে আর চোখ বাঁধব কী? ওরা হো হো হো করে হাসে।
ডাকাতেরা ওদের নিয়ে গহিন বনে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে। তবে জয়িতাকে তারা বাঁধে নি। ওদের ধারণা জয়িতা যেহেতু চোখে দেখে না তাই ওকে নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। কোনো জায়গায় থাকলেই হলো। একটা গাছ আর জয়িতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
ডাকাতরা চারজন। এদের মধ্যে একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারও আছে। তারা খুব আনন্দের সঙ্গে গাড়ির পাশে মুরগির ভুনা আর পরোটা খাচ্ছে। তারা পরিকল্পনা করেছে খেয়ে দেয়ে গাড়ির ইঞ্জিন খুলে নিয়ে এখান থেকে পালাবে।
জয়িতার কাছে একটা মাইক্রো মোবাইল ফোন ছিল যা ডাকাতদের জানা ছিল না। জয়িতার এই ফোনটি তার বাবা বিশেষভাবে তৈরি করিয়েছেন জাপানের একটি বিশেষ ফোন কোম্পানির কারিগরি সহযোগিতায়। এটি খুব কম দামি হাতঘড়ির মতো দেখা যায়। জয়িতার হাতে এটি ছিল। এই ঘড়ি কাম মোবাইল ফোন কাম ক্যামেরা অর্থাৎ একের ভিতর তিন যন্ত্রটিকে দেখলে যে কেউ ভাববে এটি একশ বা দুইশ টাকার একটা হাত ঘড়ি। ঘড়িতে দুটি চাবি। একটিতে চাপ দিলেই জয়িতার বাবার মোবাইল ফোনের সঙ্গে কানেক্ট হয় এবং দ্বিতীয়টিতে চাপ দিলে এতে টেন ম্যাগাফিক্সেলের ক্যামেরা চালু হয়ে যায়।
জয়িতা বুঝতে পেরেছে ডাকারা বেশ দূরে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ঘড়ির চাবি ঘুরিয়ে দিল। বাবা
উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, মা, তোমার কী হয়েছে?
জয়িতা বলল, আমাদের ডাকাতে ধরেছে। তুমি তাড়াতাড়ি কিছু করো বাবা। ওরা মনে হয় গাড়ির ইঞ্জিনটি নিয়ে যেতে এসেছে।
ঘড়ির চাবিটিতে চাপ দিয়ে জয়িতা এমনভাবে হাতটা উঁচিয়ে রাখল মনে হবে হাতে ব্যথা হয়েছে তাই হাতটি একটু টান দিচ্ছে। আসলে জয়িতা অনুমান করছে যদি কোনোভাবে ওদের ছবি ধরে রাখা যায় তাহলে পরে ওদের খোঁজ করা যাবে।
জয়িতার বাবা টেলিফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সহযোগিতা চাইলেন। পুলিশ কর্তৃপক্ষ সঙ্গে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, রামু প্রত্যেকটি থানায় খবর দিয়ে দিলেন।
জয়িতার বাবার টাকার অভাব নেই। তাই তিনিও একটি হেলিকপ্টার ভাড়া করে সঙ্গে সঙ্গে টেকনাফের দিকে ছুটলেন। আগে মেয়েকে বাঁচাতে হবে, তারপর অন্য কথা। তিনি র্যাবের সহযোগিতা চাইলেন। র্যাবের পক্ষ থেকে কয়েকজন সদস্য দেয়া হলো। তারা সশস্ত্র অবস্থায় হেলিকপ্টারে চড়লেন। হেলিকপ্টার ছুটছে টেকনাফের দিকে।
মুহূর্তের মধ্যেই গাড়িটি শনাক্ত করা হয় এবং চারদিক থেকে আসা পুলিশ বাহিনীকে দেখে হাইজ্যাকাররা জঙ্গলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ জয়িতাদের উদ্ধার করে। কিন্তু গাড়ি হাইজ্যাকারদের ধরতে পারে নি। জয়িতার বাবার হেলিকপ্টারও একটি ফাঁকা জায়গায় ততক্ষণে ল্যান্ড করে। মেয়েকে সুস্থ দেখে তিনি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। হাইজ্যাকাররা গাড়ির কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।
পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা জঙ্গলের ভিতর অনেক জায়গায় অনুসন্ধান করেছে কিন্তু তাদের নাগাল পায়নি। নাগাল না পাওয়ার অবশ্যই কারণ ছিল। ওই জঙ্গলের ভিতর একটি সুড়ঙ্গ আছে। ওরা সেই সুড়ঙ্গের ভিতর ঢুকে উপরটা লতাপাতা দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিয়েছিল সেখানে মানুষ ঢুকতে পারে এমন ধারণা পুলিশ বা র্যাবের সদস্যদের ধারণার বাইরে ছিল।
কাশেম পাটোয়ারী সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি পুলিশ সদস্যদের চা-নাশতা খাওয়ার জন্য বিশ হাজার টাকা দেন। র্যাবের সদস্যদের অবশ্য দেননি। তাদের ঢাকায় এসে পুরস্কৃত করবেন বলে ভেবে রেখেছেন।
আতিকন আর কান্টিবান্টিকেও কাশেম পাটোয়ারী জিজ্ঞেস করেন, শরীর-মন ঠিক আছে কিনা। তারা দুজনই সাহসের সঙ্গে বলল, সব ঠিক আছে। আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
এবার বিপদসংকুল জঙ্গল থেকে বিদায়ের পালা। কাশেম পাটোয়ারী জয়িতাকে বললেন, তুমি কি গাড়ি চালিয়ে যাবে? নাকি হেলিকপ্টারে যাবে?
জয়িতা বলল, তুমি যা বলো বাবা। একটা বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম।
বাবার চোখে পানি। তবে তা জয়িতাকে বুঝতে দেননি তিনি। তিনি শান্তভাবে বললেন, তোমার অভিযান তো সফলই হয়েছে। চলো আমার সঙ্গে হেলিকপ্টারে। কান্টিবান্টি দুজন পুলিশ সদস্য নিয়ে গাড়িটি চালিয়ে ঢাকায় আসুক। আর আতিকনও আমাদের সঙ্গে হেলিকপ্টারে যাবে। চলো মা। তুমি আমার জান।
জয়িতা আর কোনো কথা বলেনি। জয়িতাও জানে তার বাবা কতটা দুঃখী। হেলিকপ্টারে জয়িতা আর আতিকনকে নিয়ে কাশেম পাটোয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন।
ডাকাতদল মনে করেছিল তারা নিরাপদে পালিয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জয়িতার ক্যামেরায় ওদের ছবি থাকাতে আর পালানোর পথ পায়নি। তার মানে পরদিন পুলিশ হেড কোয়ার্টের গিয়ে জয়িতা ও কাশেম পাটোয়ারী জয়িতার ক্যামেরার সব ছবি জমা দেন এবং কেস করেন। ছবি দেখে পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তার দ্রুত অ্যাকশনে চলে যান এবং পরের দিনই তাদের ধরে থানায় হাজির করেন।
দেশের মানুষ অবাক হলো এই দেখে যে, রেড ওয়ার্ল্ডের মালিকও সেই হাইজ্যাকারদের দলে ছিল।
সেদিনই বিজ্ঞানী কান্টিবান্টি গাড়ি নিয়ে ফিরে আসে। গাড়িটি গ্যারেজে রাখা হয়। কান্টিবান্টি বাসার ভিতরে গিয়ে ঢোকে। সবার চোখেই আনন্দ।
আতিকন বলল, আজকে আমি অনেক মজাদার খাবার রান্না করিয়াছি। সবার একসঙ্গে খাইতে হইবে। কান্টিবান্টি তুমিও খাইয়া যাইবা।
রাতে খাবারের আয়োজন। বিরাট আয়োজন। অনেক পদের রান্না হয়েছে। সব দেশীয় খাবার। তিনজন টেবিলে বসেছে। আতিকন খাবার পরিবেশন করছে।
খেতে খেতে জয়িতা বলল, কান্টিবান্টির ভাষা ঠিক করতে হবে। বাংলা ভাষায় এমন জঘন্য করে বললে আমার খুব রাগ হয়।
কাশেম পাটোয়ারী হাসেন।
আতিকনও হাসে। আতিকন বলল, ঠিক কথা।
জয়িতা বলল, আপনার সাধুভাষার কথাও শুনতে ভালো লাগে না। আপনারা দুজনই আমার কাছে ভাষা শিখবেন।
আতিকন হাসতে হাসতে বলল, আমি চলিত ভাষাও জানি। তবে আমি সাধু রীতিতে অভ্যস্ত।
কান্টিবান্টি বিনা শর্তে রাজি হয়ে যায়। সে বলল, আমি অবশ্যই ভাষা শিখতে চাই। আপনি শিখাবেন।
পরদিন থেকে কান্টিবান্টিকে প্রতিদিন জয়িতার কাছে আসতে হতো। ভাষা শেখার কৌশলটাও সুন্দর। তারা তিনজন বাড়ির লনে বসে কথা বলত। জয়িতা শুধু ভুলটা সংশোধন করে দিত। কান্টিবান্টি খুব মেধাবী হওয়াতে খুব ভাষা শিখতে বেশি দিন লাগে নি।