ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব ছয়
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব দুই
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তিন
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চার
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পাঁচ পর্ব
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব আট
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব নয়
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। দশ পর্ব
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব এগারো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। বারো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তেরো
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব চৌদ্দ
- কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। শেষ পর্ব
যাতে গোলাপি গাড়িকে সহযোগিতা করে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যদিও বলা হয়েছে তারা যেন কক্সবাজার জেলা ট্র্যাফিক কন্ট্রোল রুমকে জানিয়ে দেয়, কিন্তু এই বার্তাটি তারা ভুলে গেছে এবং কক্সবাজারে সেই বার্তা পৌঁছায়নি।
গাড়ি এগিয়ে চলছে। কান্টিবান্টি পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার সামনের দিকে একবার জয়িতার স্টিয়ারিং আর একবার জয়িতার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কী অদ্ভুত সাহসী মেয়েরে, বাবা। আতিকন হাসছে। খুব সুন্দর লাগছে। আতিকন মাঝে মাঝে নির্দেশনাও দিচ্ছে। ঢাকা শহর পার হয়ে যাত্রা বাড়ি যেতেই ইঞ্জিন থেকে শব্দ ভেসে এলো, আমরা এখন যাত্রাবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি।
আতিকন খুব অবাক হয়ে বলল, জয়িতা, গাড়ি আবার কথাও বলিতে পারে? ইহা কী করিয়া সম্ভব হইল?
জয়িতা বলল, ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব হয় খালা।
যাত্রা বাড়ি পার হওয়ার পর সামনে মোড় থাকলে গাড়ি থেকে সংকেত দেওয়া হয় সামনের দুশ গজ বামে ৩০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে মোড় আছে। গাড়িটি এখন সোজা যাবে। মোড়ের পাশে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে সংকেত দেওয়া হলো ৩০ ডিগ্রি বামে মোড় নাও। মোড়ের পাশে একটা ভাঙা টেম্পু আছে। স্টিয়ারিং হুইল এক ইঞ্চি এন্টি ক্লকওয়েতে ঘুরবে।
গাড়ির এমন নির্দেশনা শুনে আতিকনের হার্টফেল করার অবস্থা। তবে মনে মনে খুব আনন্দিত যে, জয়িতা সুন্দর করে গাড়িটি চালিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির গতি বেগও মোটামুটি খারাপ নয়। ঘণ্টায় ত্রিশ কিলোমিটার।
এ-রকম ভাবেই জয়িতার গাড়িটি চলতে লাগল। পিছন দিকে গাড়ি এলেও সংকেত দেয় আবার সামনের দিক থেকেও গাড়ি এলে সংকেত দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে শব্দ-তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সিতে বুঝিয়ে দেয় অন্য গাড়িগুলোর গতিবেগ কত। কতটুকু দূরত্বে আছে।
গাড়ি চলতে চলতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সামনে গেলে গাড়িটিকে আটকানো হয়। এতো আস্তে আস্তে হাইওয়েতে গাড়ি চলতে পারবে না। গাড়ি ফিরে যেতে হবে।
জয়িতা ঠান্ডা মাথায় বলল, কেন? আস্তে আস্তে যেতে পারবে না এটা কোন ট্র্যাফিক আইনে আছে?
ট্র্যাফিক পুলিশের মাথায় রক্ত ওঠে যায়। একটা পিচ্ছি মেয়ে মুখে মুখে তর্ক করে, এতো বড় সাহস? জয়িতাকে ধমক দিয়ে বলল, এই গাড়ির কাগজপত্র আছে, এই মেয়ে? তোমার তো আঠার বছর হয়নি। তোমার লাইসেন্স আছে? দেখাও দেখি কাগজপত্র।
জয়িতা বলল, এই গাড়ির বিশেষ ছাড়পত্র আছে। আপনাদের মহাপরিদর্শকের বিশেষ ছাড়পত্র।
মহাপরিদর্শকের! লোকটার মাথা কিছুটা ঠান্ডা হয়। তারপর বলল, ম্যাডাম, চা-নাশতা খাওয়ার জন্য কিছু দিলে ভালো হতো না?
আতিকন বলল, এই ব্যাটা পুলিশ। তুমি টাকা চাহিলে আমি তোমার নামে মামলা করিয়া দিব।
আতিকনের কথা শুনে ট্র্যাফিক পুলিশ ঘাবড়ে গেল। তারপর গাড়িটি ছেড়ে দিল।
কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর ইঞ্জিন থেকে কড়া ব্রেক চাপার নির্দেশ আসছে। ইঞ্জিন থেকে ক্যাঁ, ক্যাঁ শব্দ বের হচ্ছে। জয়িতা কান্টিবান্টির দিকে তাকিয়ে বলল, কী সমস্যা হলো?
সমস্যা একটা হয়েছে, বটে। একটা ছাগল সামনে। ছাগলের কোনো ছবি ইঞ্জিনে প্রোগ্রামিং করা হয়নি। এখন কী করব?
হর্ন দাও।
হর্ন দেওয়ার পর অবশ্যই গাড়িতে ব্রেক চাপতে হয়নি। জয়িতা গাড়ি এগিয়ে নিতে পেরেছে। ছাগলটি পাশে দাঁড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছে। জয়িতা হাসতে হাসতে বলল, ছাগলটি বুদ্ধিমান। একটা হর্ণ দিতেই চলে গেছে।
সবার মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। আতিকন মুখে পান গুঁজে গিয়ে বলল, এই মিয়া কান্টিবান্টি, তুমি জানো না, বাংলাদেশের রাস্তায় গরুছাগলকুকুর ভেড়া থাকে। এই সবের ছবি সংযুক্ত করিলে না কেন? শুনো, শুধু খাতাকলমে বিজ্ঞানী হইলে চলিবে না। বিজ্ঞানীদের বাস্তব জ্ঞানও থাকিতে হইবে। বাংলাদেশের গাড়ি চালাইতে হইলে ‘ব’-এর বিপদের কথাটি মনে রাখিতে হইবে। এই ‘ব’-এর বিপদ কী তা কি তুমি জানো?
কান্টিবান্টি বলল, না, জানি না।
তাহা হইলে শুনো। আতিকন সুন্দর করে বর্ণনা করে, ব তে, বকরি, বালক, বালিকা, বলদ, বুড়া, বুড়ি, বাছুর, বাঁদর, বকনা, আর কি জানি কি জানি; আচ্ছা ঢাকায় গিয়ে সব বলিব। তুমি এই সবের ছবিও ইঞ্জিনের প্রোগ্রামিংয়ে যুক্ত করিবে। বুঝিতে পারিলে?
জি, বুঝিতে পারিলাম।
কান্টিবান্টির কপাল থেকে ঘাম বের হচ্ছে। এখনই একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেত পারত। যাহোক, দুর্ঘটনা ঘটেনি।
জয়িতা কান্টিবান্টিকে জিজ্ঞেস করল, সামনে কোনো গাছের ছায়ায় আমরা থামব। চা-নাশতা খাব। খালা আপনি চা-নাশতা রেডি করেন।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছাতে তাদের আর কোনো সমস্যা হয়নি। শুধু মিরসরাইয়ে একটা বৃদ্ধ লোক গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। ব্যথা পায়নি। রাস্তার লোকজন গাড়ি আটকাতে চেয়েছিল। কিন্তু জয়িতা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বলে তারা ছেড়ে দিল। তারা অবাকও হলো। আর উৎসাহও দিল।
চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে জয়িতা গাড়িটি আর চালাতে পারেনি। কারণ, শহরের রাস্তা গুগল ম্যাপ থেকে গাড়িতে সংযোজন করা হয়নি। তাই কান্টিবান্টি হোটেল আকবর পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে যায়।
জয়িতার গাড়িটি ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পরই মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে গাড়িটি মনিটর করছিল কাশেম পাটোয়ারী। সকাল থেকে চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে আর কখনও উত্তেজনা, কখনও কষ্ট আবার কখনও উচ্ছ্বাসে ছিলেন তিনি। হোটেল আকবরে যাওয়ার পর মেয়ের সঙ্গে কথা বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন বাবা।
পরদিন ভোরে রওনা হলো জয়িতার গাড়ি। এতোটা পথ পাড়ি দিয়েও তাদের ক্লান্তি নেই। ক্লান্তি কেন থাকবে? মানুষ যখন আনন্দে থাকে তখন কি আর ক্লান্তি ভর করতে পারে? গাড়িটি আস্তে আস্তে শহর থেকে বের হয়ে কর্ণফুলী নদীর ব্রিজ পার হয়। ব্রিজটি পার হওয়ার সময় জয়িতা অনুভব করে নদী পার হচ্ছে। কারণ, প্রতিটি ব্রীজ পার হওয়ার সময় গাড়ি থেকে একটা সংকেত দেয়া হয়। যেমন, আমরা এখন কর্ণফুলী নদী পার হচ্ছি। কর্ণফুলী সম্পর্কে সামান্য একটু ধারণাও দেওয়া হয়। কোথা থেকে উৎপত্তি, কোথায় শেষ, কত দীর্ঘ, প্রস্থ কত ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হয়। ব্রীজ পার হওয়ার সময় এমন প্রোগ্রামিং করার বিষয়টি জয়িতা কান্টিবান্টিকে বলেনি। এটি কান্টিবান্টির নিজের বুদ্ধিতে করেছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যাওয়ার পথে নদীগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। শুধু নদী নয়, পথে ঐতিহাসিক কোনো জায়গা থাকলে সে সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হয়। এতে লাভও হচ্ছে। ভ্রমণের আনন্দের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় শেখাও হয়ে যাচ্ছে। কান্টিবান্টির বুদ্ধি দেখে জয়িতা মুগ্ধ। অবাক। কর্ণফুলী পার হওয়ার সময় হিম বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেয়। এই বাতাস মনে হয় ঢাকায় পাওয়া যায় না। কোথা থেকে পাওয়া যাবে? ঢাকায় কি আর এমন প্রসারিত জায়গা আছে? মুক্ত বাতাস কীভাবে পাবে?
গাড়িটি রাস্তার ম্যাপ অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ। ঝড়োহাওয়া। ঝড়োহাওয়ার সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে গাড়ির শব্দ তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সীতে বেশ গোলামাল দেখা গেল। গোলমালের কারণে এস আলম পরিবহনের সঙ্গে প্রায় মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে গাড়িটা বেঁচে গেল। সবার আত্মা যেন পানি পেল।
কান্টিবান্টিকে আতিকন ধমক দিয়ে বলল, বাংলাদেশে গাড়ি বানাইবেন এসব খেয়াল রাখিবেন না। আপনি কীসের বিজ্ঞানী হইলেন?
কান্টিবান্টি কোনো কথা বলেনি। তার মন খারাপ হয়ে যায়।
জয়িতা বলল, খালা আপনি রাগ করেন কেন? গাড়িটি নতুন বানানো হয়েছে। এর অনেক দিক এখনও ঠিক করতে হবে। কান্টিবান্টি ঝড়োহাওয়ার মধ্যে আপনি গাড়ি চালান। তারপর ঝড়োহাওয়া কমলে আমি চালাব।
কান্টিবান্টি ড্রাইভারের সীটে বসে আর জয়িতা বসে বাম পাশের সীটে।
গাড়িটি এগিয়ে যায়। এমন সুন্দর গোলাপি গাড়ি দেখে মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আর নানান জনে নানান কথা বলে।
চকরিয়ায় যাওয়ার পর ঝড়োহাওয়া থেমে যায়। বাতাসের গতি স্বাভাবিক হয়। ওরা চকরিয়ায় নেমে চা-নাশতা খেয়ে একটু সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে শুরু করে।
জয়িতাই গাড়ি চালাচ্ছে। পাহাড়ি রাস্তা। উঁচু-নিচু। উঁচু নিচু রাস্তার জন্যও গাড়িতে তেমন কোনো সতর্ক সংকেতের ব্যবস্থা ছিল না। তাই খুব সাবধানে চালাতে হয়েছে। গতি কমিয়ে দশ কিলোমিটারে নিয়ে আসা হয়েছে।
চকরিয়া থেকে কক্সবাজার যেতে বিকেল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম থেকে স্বাভাবিক গাড়িতে বড় জোড় চার ঘণ্টা লাগে, সে জায়গায় জয়িতাদের গাড়িটি কক্সবাজার পৌঁছাতে প্রায় সারা দিন লেগে গেল।
বিকেলে হোটেল হেভেনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু সংবাদিক এসে জয়িতাকে ঘিরে ধরে। জয়িতা তাদের সঙ্গে কথা বলে। সাক্ষাৎকার দেয়।
রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আতিকনের হাত ধরে হেঁটে হেঁটে জয়িতা আর কান্টিবান্টি সমুদ্র সৈকতে গিয়ে দাঁড়ায়। জয়িতা কান পেতে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন শুনে। দুর্ঘটনার আগে প্রতি বছর ওরা এখানে বেড়াতে আসত। তখন মা পাশে থাকত। ভাইটি থাকত। আজকে সেই স্মৃতি মনে হওয়াতে জয়িতার চোখ থেকে পানি পড়ে। বেশ বাতাস। জয়িতার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় বাতাসে। জয়িতা জিজ্ঞেস করে, খালা, এখনই কি সানসেট হবে?
আতিকন বুঝতে পারে জয়িতার কষ্টটা। এর আগে ওরা প্রতি বছর এখানে এসেছে। সানসেট দেখেছে। জয়িতা বাইনোকোলার নিয়ে আসত। আজ সে সানসেট দেখতে পারছে না। আতিকন জড়ানো গলায় বলল, হুম। ওই যে সূর্য ডুবছে।
জয়িতা আতিকনের হাত শক্ত করে ধরে বলে, খালা আমাকে নিয়ে একটু পানিতে নামবেন?