উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। তৃতীয় পর্ব

চেনা-জানা মহলে বিডির তাই খুব খাতির। বন্ধুরা তাকে ব্লাক ডায়মন্ড বা সংক্ষেপে বিডি বলে। আসল নামটা তার প্রায় চাপা পড়ে গেছে।

তা তার শরীরের গাঁথুনী একটু শক্ত হলে ব্লাক ডায়মন্ড নামটা যথাযথ হত! ডায়মন্ড তার শরীরের মত এমন নরম নয়। সে বেশ চকচকে কলো। শরীরে বড় বেশী মেদ, একটু থলথলে। যখন-তখন ঘামে, আর একটা বড় রুমাল, যটো সবসময় হাতেই থাকে, সেটা দিয়ে ঘাম মোছে। পোশাক আশাকের ব্যাপারেও তার খুব একটা মনোযোগ নেই। কিংবা সে হয়তো বুঝে গেছে, যে পোশাকেই সে গায়ে চাপাক না কেন, তার এই মোটা থলথলে শরীর এটা মানাবে না। লেটেষ্ট কাট-ছাট দূরের কথা, সাধারণ স্যুট পরতেও তাকে কদাচিত দেখা যায়। অভ্যেসের মধ্যে আঙ্গুলে আংটি পরা। বাঁ- হাতের পাঁচ আঙ্গুলের চারটিতে চারটে আংটি। পাথরগুলো দামি। সে বলে পাথরের দ্রব্য গুণ আছে, চমৎকার কাজ দিচ্ছে। দ্রব্য গুণের ব্যাপারটায় সে নিশ্চিত। ইনলে এত খরচ করে পাথর গুলো সে কিনতো না। হ্যাঁ, অদৃস্টেবিডি বিশ্বাস করে বৈকি। সে যাক বিডির জন্য অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে উঠে। একটু বিরক্তও হয়। বিডি কি অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে? কিন্ত তার কাজটা আরও জরুরি জানে সে। অবশ্য এও ঠিক, কাজ তো গুছিয়েই এনেছে বিডি। সপ্তাহ খানিক আগে জানিয়েছে, চমৎকার এগোচ্ছে সবকিছু। আজ পাকিস্তান থেকে আসবে আবদুল্লাহ সাঈদ। কন্ট্রাক্টার অগ্রগতির খবর নেবে। অন্য একটা ডিলও হবে। সমস্যা হচ্ছে, একা একা কখনো কখনো, কোনো কারণ নেই, সে নার্ভাস হয়ে পড়ে। বিডি পাশে থাকে বড় নিশ্চিত থাকা যায়। সবকিছু সে চমৎকার সামাল দেয়। বিডি এল ঘন্টাখানেক পর। বড় রুমাল টা মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢোকে। সে রুমের বাহিরে লাল বাতিটার সুইচ টিপে কটমট করে তাকায়- ‘এতক্ষণে তোর সময় হলো?’ বিডি হাত নেড়ে তাকে উড়িয়ে দেয়— ‘চুপ চুপ, আজ অনেক কাজ করেছি।’ ‘এই খবরটার জন্য তোর দেরিতে অসাসা মাফ করে দিলাম’—সে হাসে—দে এখন কাজ কতটা এগিয়েছে ইনফরমেশন দে।’ বিডি হাত তুলে তাকে থামায়—‘পরে বলছি। এখন তোর কাছে কি আছে বের কর। সেই ভোর ভেলা থেকে উপোশ দিচ্ছি আর খুব ধকলও গেছে। ’ সে ব্লাক ডগের একটা বতল বের করে। পানীয়ের প্রতি বিডি’র খুব আসক্তি। ‘একটা ঘোরের মধ্যে না থাকলে আমাকে দিয়ে কিছু হয় না’—সে যেখানে-সেখানে প্রায়ই বলে।সে টানতেও পারে বটে। যখন-তখন বোতলের ছিপি খুলে দিলেই হয়। কোনো বিশষে ব্রান্ডের প্রতি তার ফ্যাসিনেশন নেই। বোতলে বিদেশী ছাপ থাকলেই চলে। ব্লাক ডগের বোতল দেখে উল্লাসিত হয়ে ওঠে। ‘দারুণ দারুণ। ইয়াহিয়া খানের প্রিয় পানীয় এটা। অন্য কোনো ব্রান্ড হলে নাকি ব্যাটার চলতো না। দে, আজ দেখি কালা কুত্তা টেনে একটু ইয়াহিয়া খান হওয়া যায় কিনা।’ ফ্রিজ খুলে সে বরফ বের করতে করতে বলে—‘তুই যে কোনদিন গনপিটুনী খাবি।’ ‘কেন কেন?’
‘তুই সবসময় পাকিস্তান র্মাকা কথা বলে বেড়াস, যেথখানে-সেখানে, পাবলিক সেন্টিমেন্ট বুঝিস না।’ ‘অ্যা’- বিডি মুখ বাঁকায় —‘তোর পাবলিক সেন্টিমেন্টের ইয়ে করি।’ ‘তা না হয় করলি, এদেশের প্রতি তোর মিনিমাম কৃতজ্ঞ অন্তত থাকা উচিত।’
‘কোন?’
‘দেশটা স্বাধীন না হলে কি করতি বলতো? ক্যান্টনমেন্টে কাঁচামাল সাপ্লাই দিয়ে তো আর জীবন পার করতে পারছি না। এ অবস্থায় পৌঁছাতেও পারছি না।’ খ্যা খ্যা করে হাসে বিডি—‘খুব যে আমার কথা বললি, তুই-তুই কি করতি?’ ‘আমি গ্রেটফুল অনেস্ট। চেঞ্জটা না হলে দোস্ত কিছু হোত না। সেভেন্টি ওয়ানে যাই হোক না কেন, আমি এখন র্হাডকোর বাংলাদেশী।

এক পেগ শেষ হয়েছে বিডির, সে আরটি ডালতে ডালতে বলে—‘ট্টু, ঠিক বলেছিস দোস্ত, তোর মতো আমিও এখন র্হাডকোর বাংলাদেশী। সিরিয়াস।’
‘হাসছিস কেন তবে, হাসিস না।’
‘কই দোস্ত, হাসছি না। আমর মুখটাই অমন।’
‘না, তুই হাসছিস।’
‘অলরাইট হাসছি। কিন্তু হাসি পেলে আর কি করবো! মদ খেলেই যে আমার হাসি পায়।’
‘বেশ। তোর হাসিড়কান্না নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। এখন বল কাজের কদ্দুর হল’
এক ঢোকে দ্বিতীয় পেগটা নির্জলা শেষ ক’রে বিডি। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে—‘চলে,যেতে যেতে বলছি।’

কে জানতো এমন হবে! ঐ ছেলের সঙ্গে নিজেকে জড়ায় রুম্পা। এখন প্রবলেম অ্যাটুক। রুম্পা প্রথমে খুব চোটপাট করেছিল। ভেবেছিল ওতেই হয়ে যাবে। তা ছেলে এমন ঠান্ডা চোখ তুলে তাকালো যে রুম্পার আর কথা জোগালো না। তবে সে হাল ছেড়ে দেয়ার মেয়ে নয়। দেখবে, সেও দেখবে। তবু একটু খচখচ করে। এ ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। মিটিয়ে ফেলতে পারলেও গোপন একটা হয়তো থেকেই যাবে, সে জানবে না।

নিজের চেহারা সম্পর্কে খুব স্বচ্ছ ধারণা আছে তার। রাস্তার বুড়ো লোকগুলো পর্যন্ত তাকিয়ে আছে। আর ছোকড়াগুলোর মাথা নিশ্চয় চক্কর খায়, সে জানে। নিজকে তুলে ধরতেও সে জানে। এসব সে দিনে দিনে আয়ত্ত করেছে। চমৎকার একটা আর্ট, তার মনে হয়, শরীর ঠিক রাখা এবং তা দিয়ে একটির পর একটি বিজয় সম্পন্ন করা। সে পেরেছেও বটে। এক এক করে হিসেব করলে অনেক হবে। সবার নাম ঠিকানা লিখতে গেলে একটা দু’নম্বর খাতা ফুরোবে। সে সবই ছিল একচেটিয়া বিজয়। ফাঁক-ফোকরহীন, বিজিতদের হেলাফেলায় ছুঁড়ে ফেলার পরও বিপদের আশঙ্কা থাকতো না। পছন্দের ব্যাপারে খুব একটা ভাবতো না সে। একটু ড্যাশিং আর কর্কশ টাইপের হলেই হত।
এবারের ছেলেটার দিকে সে যখন ঝুঁকলো, বন্ধুরা যারা টের পেল, বারণ করলো। ছেলেটা ভালো নয়। প্রয়োজন পড়লে কোমরে হাত রেখে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়াতে পারে। তার দলের বাকী ছেলেগুলোও এরকম। বন্ধুরা বললো —-‘বুঝেসুঝে……বাড়াবাড়ি করিস না। ছেলে একটা ডাকাত।’ এসব শুনতে শুনতে তার আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল। আহা, এরকম একটা ছেলেই তো তার দরকার। আগে দু’ একটা মাস্তান গোছের ছোকড়ার সঙ্গে তার সময় কাটেনি তা নয়। তবে এ ছেলে বোধহয় আরেক কাঠি সরস। ভাবে–সাবে তার তাই মনে হয়েছিল। হ্যাঁ, ঠিক এরকম একটা ছেলে দরকার ক’দিনের জন্য। কম তো দেখা হল বা; লাজুক, গোবেচারা, রংবাজ, আধা-রংবাজ, অতি৷ ভদ্র—এ ধরনের অনেককে চেনা হয়েছে তার। এখন একজন ডেয়ারিং ফুল রংবাজ না হলে দু’নম্বর খাতাটা পূর্ণ হবে না। তা, ব্যাপারটা খুব চার্মিং হবে ভেবে সে আটকে গেল। এখন বেরোবার পথ পাওয়া ভার।
তবে ব্যাপারটা চার্মিং ছিল বটে। ছেলে খুব স্ট্রেটকাট, ফরোয়ার্ড। দারুণ আপার–কাট ঝাড়তে পারে, চমৎকার তুড়ি বাজাতে পারে, যখন-তখন শরীরে হাত রাখতে পারে। রুম্পার ভালোই লাগছিল। পুরুষ মানুষ তো এরকমই হবে। তবে ছেলের ডিমান্ড খুবই হাই, একদম শেষ পর্যন্ত যেতে চায়। সে ব্যাপারে রুম্পা’র আপত্তি নেই। তবে সে জানে রংবাজ ছেলেদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যাওয়া নিরাপদ নয়। ব্যাপারটা চাপা থাকে না। ওসব ব্যাপারে মুখচোরা, লাজুক ছেলেরা নিরাপদ। কক্ষণো কাউকে বলবে না। সে নিজেকে সরিয়ে আনবে ভাবছিল ইদানীং। সে ফাঁক ফোকর খুঁজছিল, একটা যুতসই উপায়ের কথা ভাবছিল। এ সময় বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল। ছেলে বিদেশেই সেটেলড। এখন একটু জলদি জলদি ছোকড়ার সঙ্গে লেন-দেন চুকিয়ে ফেলা দরকার। কিন্তু সে নিজেকে সরিয়ে আনতে গিয়ে টের পেল দড়ি তার হাতে নেই। দড়ির সবটুকু ছেলেটার হাতে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব- ০২ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চার >>

One thought on “ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। তৃতীয় পর্ব

  • Nusrat Sultana

    দারুণ। প্রতিটি পর্ব পড়ছি।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *