উপন্যাস

উপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব বারো

গভীর রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না পার্থের। বিক্ষিত চিন্তা ক্রমাগত ঊর্ণনাভে জড়িয়ে যাচ্ছে। জট খুলছে না। কোনো কিছুর সঙ্গে মেলানো যায় না। প্রত্যেক বিষয়, জীবন-চৈতন্য-বোধ সম্পূর্ণ আলাদা। পূর্বাপর নিজকে নিয়ে ভাবে পার্থ। বিপুল পৃথিবীকে নিয়ে ভেবে লাভ কী? নিঃস্তরঙ্গ এ মধ্যবিত্ত জীবনে ভাবনার জগত কতটুকু! হঠাৎ করে কবি কাতিল সিপাই-এর একটি শের মনে পড়ে, ‘কেয়া দেখা আউর না দেখা, এ দিল তো তেরা হোগেয়া। আউর সোঁজতে সোঁজতে রাতকা সাবেরা হোগেয়া।’ তাই তো রাত কী ভোর হয়ে গেল! ক’টা বাজে। একবার ঘড়ির দিকে তাকায়। একটা পঞ্চাশ। জানালার পর্দা টেনে হোটেলের ঊনিশ তলা থেকে রাতের সিঙ্গাপুরের দিকে চোখ রাখে। কী জীবন্ত এ শহর। মনে হচ্ছে যেন এখনই উৎসব শুরু হবে। জোনাক পোকার মেলা বসেছে। একাত্তরে মাকড়াই ফ্রন্টে এ রকম জোনাকীর আলো দেখেছিলো। যুদ্ধদিনের সতর্ক মুহূর্তে সেই আশ্চর্য রাতের কথা অনেকবার মনে পড়েছে ওর। অসম্ভব সুন্দর ভালোলাগায় একাকার দুর্লভ মুহূর্তের ঘোর। জানালায় দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল আলোয় কষ্টকেই লালন করছে পার্থ। হঠাৎ মনে হলো, জুডির কথা রিনিকে জানানো উচিত। রিনি খুব অবাক হবে। শুধু মিমি বার বার রিনিকে বলবে, ‘পাপার সেই মেম কি করেছে মা?’
রিনি এক সময় প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বলবে, ‘তোমার পাপা মেম বিয়ে করেছে।’

আবার মিমি বলতে থাকবে, ‘পাপা, মেম বিয়ে করেছে। পাপা মেম বিয়ে করেছে।’

মনটা ভালো হয়ে যায় পার্থের। বুকটা ভরে ওঠে। মা’র কথা মনে পড়ে। কী সরল মহিলা? যেদিন প্রথম জুডিকে দেখে, অনেকটা নাক সিটকানোর মতো করে বলে, ‘অয় পার্থ, মেমটা বেশরম!’
‘না মা। ওদের পোশাক এ রকম। তোমার শাড়ির মতোন।’
পরবর্তীতে জুডির সঙ্গে মা’র বেশি ভাব হয়েছিলো। মা’র ধারণায়, জুডি-মনিকার মতোন মেয়ে এ জগতে জন্মগ্রহণ করেনি। মা’র ধারণা অমূলক নয়। পার্থের সঙ্গে মিল আছে। আশ্চর্য সুন্দর শুদ্ধতায় মনিকা-জুডিকে নিয়ে ওদের যে ঘর-গেরস্থালি তাতে বসবাস করে সুখী এক মানব প্রজাতি। তাদের ধ্যানমগ্নতায় শুধু দূরতম দেশের বাসিন্দা দুই নারীর অনন্ত বিস্তার।
মা’র ধারণা, ওরা মানুষের জন্য এত পরিশ্রম করে, এ জন্য খোদাতায়ালা ওদেরকে বেহেশতে নেবেন। আহ! এক সময় পার্থের চোখ জল ভরে ওঠে। মধ্যরাত বিদীর্ণ নানা কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে ইনানী বাড়ি গ্রামের এক কিশোরের সকরুণ ক্রন্দন। হোটেলের মিহিন আলোয় ঘেরা রুমটিতে এখন সহস্র পার্থ হেঁটে যায়। ঘুরাঘুরি করে। কথামালায় গুঞ্জন তোলে।
‘এই ছেলে, তুই পার্থ না?’
‘হ্যা।’
‘তোর চোখে পিঁচুটি ছিলো।’
‘হ্যা’।
‘তুই আমাকে চিনিস?’
‘চিনি। মঞ্জু মাসী কীর্তণ গাইতেন।’
‘এখন গাই না। সন্ন্যাাস নিয়েছি। বৈষ্ণবী রাধা কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে কাটাই শত বছর।’
‘আহ। কতদূর!’
‘সহস্র জনম।’
‘আমার জনম একটা।’
‘জানি। মেনে নিয়েছি।’
রুম জুড়ে ছায়াবাজি। রঙের রশ্মি চারদিকে উপড়ে পরছে। পার্থ রুম জুড়ে পায়চারী

করে। জানালায় তাকিয়ে রাতের আকাশ দেখে। দূরে স্বাতি’ নক্ষত্রের মুখ মিটমিট করে তাকায়। কোথায় যেন পাড়ধসের শব্দ হয়। যেন ছলাৎ ছলাৎ অবিরল শব্দে ধেয়ে আসছে পদ্মার জল। পার্থ দূরাগত এক কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। বোধের বারান্দায় নিঃশব্দ এক ছায়া এসে দাঁড়ায়। প্রথমে পার্থ ওকে চিনতে পারে না। আবছায়া। হৃদয় আঁতকে ওঠে। এ রকম এক মুখচ্ছবির জন্য অন্তর তৃষ্ণার্ত। বহুদিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক রাজা। তার ছিল এক কন্যা। কন্যার ভারি অহংকার। তবে মুখমণ্ডল ছিলো অনুরাগে সিক্ত। কোমল হলুদাভ রশ্মি ছড়াতো তার অবয়ব জুড়ে। তার অহংকারে অবজ্ঞা ছিলো না, ছিলো আকর্ষন। একদিন নিশ্চিন্তপুরের বুড়া বাবার মেলা থেকে ফেরার পথে কন্যা আবিষ্কার করে রাজ্যের সবচেয়ে নিরীহ যুবকের দৃষ্টির প্রখর অনুরাগ। পাখিরা গাহিয়া উঠিল গান। নদীতে লাগল জোয়ার। পরাণ থামিল আপনা-আপনি। তারপর আর দেখা হলো না। হিমালয় থেকে তুষার ঝড়ে বয়ে আনা সেই সব খণ্ড বরফ অনেক আগেই গলে মহাকালে মিশে গেছে। কন্যা জানে না। তরুণ যুবার কাছে জেগে আছে অনিন্দ্য এক সুন্দর নারীর মুখ।
‘মনে পড়ে?’
‘পড়ে।’
‘ভুলে গেলে ক্যানে?’
‘সাহস হয়নি।’
‘জুলেখা বাদশাহ’র মেয়ে তার ভারি অহংকার।’
‘কতেকটা। মূলত সময়।’
‘আমি মনে রেখেছি।’
‘আমি অকৃতজ্ঞ।’
‘ধন্যবাদ।’
‘আজ তোমাকে বাদশা বেগমের মতোন লাগছে।’
‘আগে আরো সুন্দর ছিলাম। তখন আমরা পরস্পরের চোখ দেখেছিলাম।’
‘আমি যুদ্ধকে গ্রহণ করেছি।’
‘যার যেথা ঘর।’
‘কতকাল…। রিনিকে বলবো, সিঙ্গাপুরে ইনানী বাড়ির কুসুমের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।’
‘রিনিকে মনে রাখলে?’
‘ও আমাকে বহন করে।’
মাথায় যন্ত্রণা হতে থাকে পার্থের। কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি অনুভব করে। বারবার তলে কেটে যায়। জোড়া লাগে। কেটে যায়।
রুমের লাইট জ্বালিয়ে এক গ্যাস পানি খায়। তৃষ্ণায় খাক হয়ে আছে গলা। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। আবার জানালায় মুখ রেখে রাতের পৃথিবীর দিকে তাকায়। মনে হয় অনেক পুরোনো হয়ে গেছে পৃথিবী। নক্ষত্রের ভাজে ভাজে মানুষের সহ¯্র হাহাকার। এর ভার বহন করার যোগ্যতা অনেক আগেই হারিয়েছে বসুন্ধরা। বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা।
‘আচ্ছা পার্থ, যুদ্ধক্ষেত্রে ওই রাইফেল বহন করতে কেমনে?’
‘কেন?’
‘আমার ধারণা তোমার হাতে কোনো অস্ত্র ছিলো না।’
‘ছিলো। তখন ভার বহন করবার শক্তি ছিলো। এখনও আছে।’
‘বিশ্বাস করি না। তোমার হৃদয় অতোটা কঠিন নয়।’
‘দিলের পরীক্ষা তো আমি দেইনি।’
‘দিয়েছো। গ্রহণ করার শক্তি কোথায়।’
‘ভীরু।’
‘অপবাদ দিও না।’
মুচকি হাসে পার্থ।
মেয়েটির মুখের দিকে তাকায়। মনিকা রীভ। পিল পিল চোখের আড়ালে যে পৃথিবী, তা কেবল প্রেমময় মুগ্ধ দূরতম শূন্যতা।
আহ্! একবার কাতরোক্তি করে পার্থ। আবার যুদ্ধক্ষত তেতিয়ে ওঠে। কী কষ্টকর মনুষ্য জীবন। আবার মনে হয় রিনিকে জানানো হলো না, ‘জুডিকে আমি পেয়েছি।’
হোটেলের রাইটিং পেডে আঁকিবুকি করে কতক্ষণ। টুকটাক স্কেচ আঁকে। যার কোনো অর্থ নেই। অথবা অর্থ আছে। ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত তিনটে। মাথা ঝিমঝিম করে।

মীরামার হোটেল
১ আগস্ট ১৯৯২

প্রিয় রিনি,
এখন শেষ রাতের প্রহর। ঘড়িতে রাত তিনটে। আগামীকাল সকাল দশটায় আমার সিউলগামী কানেকটিং ফ্লাইট। এ হোটেলের ঊনিশ তলায় আমার অবস্থান। এ অবস্থান থেকে সিঙ্গাপুরের সিংহভাগ দেখা যায়। এত রাতে তোমাকে লেখার কারণ, ঘুম আসছে না আমার। প্রথমত পরিচিত পরিবেশ নেই। জায়গা বদল হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জুডিকে আমি এখানে পেয়েছিলাম। তৃতীয়ত, আমি অত্যন্ত স্মৃতি পরিব্রাজক। ইত্যাকার কারণগুলো ঘুমহীনতার জন্য দায়ী।
অনেকগুলো মুখের সমাবেশ আমার অস্তিত্ব অসহায় এক ত্রিকালদর্শী বটবিরিক্ষি বানিয়ে দিয়েছে। শুধু ছায়ার নিচে গুটিয়ে নিয়েছি। এখন কোনো পথিক যদি জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’ আমার উত্তর, ‘জগতের সব স্বপ্নভঙ্গের দায়ভার নিয়েছি।’
আজ তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, আমি কি সত্যিকার অর্থে কোনোরূপ দায়িত্ববান মানুষ?’ আমি জানি, তুমি এক বাক্যে বলে ওঠবে, ‘তোমার কোনো দায়িত্ব আছে নাকি?’
আমিও মেনে নেবো এই রায়। জুডিকে বলেছি, রিনির কাছে আমি পোষমানা ময়না। অবুঝ। দায়ভার নেই। ঠিক বলেছি না?
কিন্তু আজ চন্দ্রাহত বালকের মতো দূর দিগন্তে দৌঁড়ে যাচ্ছি। চারদিকে স্বপ্নাচ্ছন্ন ঘোর। ঘোরের মধ্যে ফেনিল ঊষা। একটু পর ভোর ওঠে আসবে। আমিও তড়িঘড়ি করে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে যাবো। হঠাৎ আমার এ রকম হলো কেন, বলতো। বাসর রাতে তোমাকে আমার দায়ভার তুলে দিয়েছিলাম। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মিমির অস্তিত্ব। যা আমাকে-তোমাকে কেবলি নিকটে নিয়ে গেছে।
তোমাকে চুপি চুপি একটা কথা লিখি, মিমি কিন্তু তোমার চেয়ে আমাকেই বেশি ভালোবাসে। তুমি হয়তো উন্নাসিক উত্তর দেবে, বাসতে পারে তাতে আমার কি?’
তাতে আমিও খুশি হবো।

আমাদের আকাশ তো এখন এক হয়ে গেছে। এখন জুডির কথা লিখি। এয়ারপোর্টেই জুডির সঙ্গে দেখা। কেমন অবাক না! আমি সত্য আনন্দিত হয়েছি। চার বছরের কন্যা তাতশি সঙ্গে রয়েছে। জুডি আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছে। অথবা আমি

জুডিকে। এ দু’দিন সিঙ্গাপুরে আমাকে জুডির তত্ত্বাবধানে থাকতে হলো। ভাব হলো তাতশির সঙ্গে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার যে, তাতশিকে জুডি একটি মাত্র বাংলা শব্দ শিখিয়েছে। তাতশি আমাকে ‘যুদ্ধপাখি’ বলে ডাকতো।
মনিকার কথা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক বলেছে। জুডির ধারণা, মনিকা আমার প্রেমে পড়েছিলো। আমি বলেছি, পরতে পারে। আমি মনিকাকে এভাবে ভেবে দেখিনি। মাকে নিয়ে জুডির আচরণ ছিলো শিশুসুলভ। আমার হঠাৎ করে একটি ধারণার জন্ম নেয়, মা, বিদেশী দুই নারীর ভালোবাসা পেয়েছে নিখাঁদভাবে। জুডি সিঙ্গাপুরে ছুটি কাটাতে এসেছে, থাকবে আরো চৌদ্দ দিন। একসপ্তাহ পর জুডির স্বামী মি. এ্যাটকিনশন আসবে ম্যালিনা থেকে। ওরাই ভালো। এ দু’দিন আমি জুডির অতিথি ছিলাম। জুডির আচরণ ছিলো, আমি এখনও হাসপাতালে ওর রোগী হিসেবে রয়ে গেছি। ওর চিন্তায় বাংলাদেশ, শেখ মুজিব, মুক্তিযোদ্ধা। আমার মা’র ছায়া প্রকট ভাবে বহমান। আমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেললাম কেন। এ প্রশ্ন জুডির। আমি জবাব দিতে পারিনি। অপ্রস্তুত মনে হয়েছে।
মনিকা, জুডিকে জিজ্ঞেস করেছে, পার্থের সঙ্গে রিনির সম্পর্ক কেমন? মনিকার সীমাহীন কৌত‚হল। ওরা ওদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করছে। জুডির ধারণা, নিজস্ব পুরুষের ব্যাপারে পৃথিবীর যে কোনো নারী স্বার্থপর হয়। এক্ষেত্রে আমি তোমাকে ব্যতিক্রম বলে চিহ্নিত করেছি। জুডির ধারণা রিনি অসাধারণ। গর্বে আমার বুক ভরে গেছে।
হোটেলে পৌঁছে দিতে এসে জুডি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এ জীবনে আবার কি কখনও দেখা হবে?’
আমি বলেছি, ‘দেশমাতৃকার জন্য আমার কিছু পুন্নি আছে, তার বদৌলতে হতে পারে।’ সবকিছু কেমন কাকতলীয়।
আর আমি সেই স্বপ্ন সাগরের মধ্যে আছি বলে রাত ভোর হয়ে গেল আমার। আর দু’ঘন্টার মধ্যে এ স্থান ত্যাগ করবো।
প্রবহমান এ জীবন। জীবনানন্দ দাস ভালো বলেছেন, ‘স্বপ্ন নয়, সত্য নয় এক বোধ কাজ করে মাথার ভেতরে।’
তোমাদের শুভ কামনায়
যুদ্ধপাখি, সিঙ্গাপুর ১৯৯২
ঈষৎ কুয়াশার মধ্যে ভোর ওঠে আসে। সমুদ্রের জাহাজগুলোর আলো মৃত নক্ষত্রের মতো আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে। একটু পর আধ ভাঙা সূর্য উঠতে শুরু করবে।
চিঠিটা খামে ভরে পার্থ নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। দশটায় ওর সিউলগামী ফ্লাইট।

Series Navigation<< উপন্যাস// কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে// আলমগীর রেজা চৌধুরী // পর্ব এগারোউপন্যাস // কালপুরুষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে // আলমগীর রেজা চৌধুরী// শেষ অধ্যায় >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *