ধারাবাহিক উপন্যাস // কবি আসছে // ফারুক আহমেদ // পর্ব নয়

  • শোন, তোমার কাছ থেকে জাতি কোনোমতেই নন্দনতত্ত্ব শিখবে না, শিখবে চামবাজ তত্ত্ব।
    পিয়াল অবাক হয়, স্যার ফোন করে দেয়ার পর ইয়াকুব আলী ওর সঙ্গে এমন ব্যবহার করল। এ অবিশ্বাস, লোকটা নন্দতত্ত্ব করতে করতে মাথাটা নষ্ট করে ফেলেছে। এবার বোধহয় চেয়ারে টান পড়বে। স্যার ব্যাপারটা জেনে খুব সহজভাবে নিবেন বলে মনে হয় না।

জহির
জহিরকে কবি অর্পা তাবাসসুম ডেকেছে। বলেছে, আজ ছুটির দিন, কিন্তু তোমার ভাইয়া গেছে চট্টগ্রাম, তুমি আজ রাতে আমার সঙ্গে খাবে। ঠিকানাটাও ইনবক্স করেছে।
এ ঘটনা দুপুরের। এরপর থেকে জহির কী করবে ভেবে পায় না। শুধু বার বার কবি অর্পা তাবাসসুম নামটা মুখে চলে আসছে।
সে সন্ধ্যায়ই বেরিয়ে পড়ে। তার মাথায় নানা চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। সে কি কিছু নিয়ে যাবে? নিয়ে গেলে কী রকম হবে উপহার? এসব ভেবে ভেবে চলে আসে কবি অর্পা তাবাসসুম-এর বাসার কাছাকাছি। মনে হয় রাতের দাওয়াত, একটু আগে গেলে ক্ষতি কী? পকেট থেকে ফোন বের করে জহির।
অর্পা তাবাসসুমকে ফোন দিয়ে দেখে, ফোন বন্ধ। এ তো হওয়ার কথা না। সে আবারও চেষ্টা করে, এবারও একই, ফোন বন্ধ।
সে অবশ্য এতে আশাহত না। বরং এক পা এক পা করে বাসার ঠিকানা খুঁজতে থাকে।
বাসাটা সে পেয়েও যায় মিনিট দশেক হাঁটার পর। অ্যাপার্টমেন্ট, চকচকে চেহারা। একটা দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। একবার ভাবে সরাসরি গিয়ে দারোয়ানকে বলবে, অর্পা তাবাসসুমের বাসায় যাব। কিন্তু ঠিক সাহসে কুলায় না। ফলে সে অপেক্ষা করতে থাকে। হেঁটে হেঁটে গলির মাথার দিকে আগায়। এভাবে যখন ৮টা বাজে, তখন সে আবারও ফোন দেয়। কিন্তু এবারও একই ব্যাপার, সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এবার তার মনে দ্বিধা জাগে, মনে হয় কোনো একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ফেসবুকে ঢুকে কিন্তু পেয়ে যায় তাবাসসুমকে।

  • হ্যালো আপু, আপনি কোথায়?
    সিন দেখাচ্ছে, কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। জহির আবারও লিখে, আপু আমি আপনার বাসার সামনে, আপনি কোথায়?
    এবার উত্তর আসে, ও সরি জহির। আমি একটা জরুরি পারিবারিক কাজে বাবার বাসায় এসেছি। তোমাকে জানানোও সম্ভব হয়নি।
    জহির এবার ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কী করবে। বলে, আমি তাহলে অপেক্ষা করছি, আপনি আসেন।
  • না না, আমি আজ ফিরতে পারব কি-না জানি না। সরি ভাইয়া, আরেকদিন।
    জহির আরো কিছু লিখতে যায়। কিন্তু দেখে তাবাসসুম অফলাইন হয়ে গেছে। ফলে সে রাতে ক্ষোভে গলির মাথার দিকে হাঁটতে থাকে।
    গলির মাথায় হেঁটে এসে, তার আর বাসায় যেতে ইচ্ছা করে না। ফলে সে গলির এ মাথা, ও মাথা করে অনেকটা সময় পার করে দেয়। শেষে যখন চলে যাওয়ার জন্য রওনা করে, তখনই চোখে পড়ে একটা রিকশা গলিতে ঢুকছে। রিকশাটা দেখে অর্পা তাবাসসুমকে ঠিক চিনতে পারে। কিন্তু পাশের লোকটা কে, তার চিনতে অসুবিধা হয়। মাথায় ক্যাপ পড়ে থাকা লোকটা কি তার হাজব্যান্ড, সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। যদি হাজব্যান্ড হয়, তাহলে জহিরকে নিয়ে যে খেলাটা খেলেছে, তার অর্থ কী? সে একটু সরে গিয়ে দাঁড়ায়, যাতে রিকশা থেকে দেখা না যায়। কিন্তু সে দেখতে পারে।
    রিকশাটা খুব কাছ দিয়েই চলে গেল জহিরের। তাবাসসুম খুব হাসছে, পাশের লোকটা কি কি যেন বলছে। লোকটা বোধহয় খুব রসিক। এমন রসিক পুরুষে বোধহয় অর্পা আনন্দ পায়। কাছাকাছি এলে জহির চমকে ওঠে, ও মাই গড, এ তো কাব্য কাশেম, শালা ক্যাপ পড়েছে কেন?

পিয়াল-জহির-মেহেদি
ভয়ংকররকম মেজাজ খারাপ নিয়ে জহির বাসায় ফিরে। তার মনে হয় এসব কবিতা-টবিতা তাকে দিয়ে হবে না। কবিতা হলেও ঠিকঠাক মতো প্লেস করা তার সম্ভব হবে না। কিন্তু বাসায় ঢুকে দেখা গেল একটা আনন্দ আনন্দ ভাব।
মেহেদি হাতে করে একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসে বলল, ভাই নেন মিষ্টি খান।
মিষ্টির প্যাকেট দেখে মেজাজ ওর আরো খারাপ হলো, মেহেদি বলল, কীসের মিষ্টি, তুই বাবা হয়েছিস নাকি?

  • কি যে বলেন ভাই। বিয়ে না করে কেমনে কী?
  • বলা যায় না, তোকে কোনো বিশ্বাস নাই। বলে জহির হেসে ওঠে।
    ততক্ষণে নিজের রুমে ঢুকলে জহিরকে দেখে পিয়াল এসে জড়িয়ে ধরে, দোস্ত, আমার তো একটা চাকুরি হয়ে গেছে।
  • কীভাবে, কোথায়? জহির খুব অবাক।
    পিয়াল হাসে, কিছু বলে না। বলে, ইয়াকুব আলী স্যারের অফিসে।
  • নন্দনতত্ত্ব?
    পিয়াল মুচকি হেসে হাঁটা দেয় কিচেনের দিকে। বলে, দোস্ত, চল খাই, খুব ক্ষুধা লাগছে। আজকে রাতে রান্না হয়নি। তোমাদের জন্য বিরানি নিয়া আসছি।

দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে খাবারের টেবিলে। পিয়ালের নিয়ে আসা বিরিয়ানি খেতে খেতে যখন জহির অর্পা তাবাসসুমের ঘটনাটা ভোলার চেষ্টা করছে, সে মুহূর্তে মোমেন মেহেদি বলল, ভাই আমার একটা ছোট্ট খবর আছে।
পিয়াল বলে, কী খবর?

  • আমি একটা ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করছি আগামী মাস থেকে, পার্টটাইম। তবে ৬ মাস পরে কনফার্ম করবে।
    জহির বলে, কোন ইউনিভার্সিাটি?
  • এই তো টপ টাচ এশিয়া, বনানী ক্যাম্পাসে ভাই।
    জহির আর কোনো কথা বলে না, চুপচাপ বিরিয়ানি শেষ করে উঠে পড়ে।

জহির
ল্যাপটপে বসে চ্যাটলিস্ট দেখে। অর্পা তাবাসসুম নাই। কাব্য কাশেম কি আজ রাতের জন্যই অর্পা তাবাসসুমে ডেরা করেছে? এসব মাথা থেকে সে ফেলে দিতে চায়। চ্যাট লিস্টে পম্পা নামে একটা মেয়েকে প্রতিদিন দেখছে। ওর সঙ্গে শাহবাগে পরিচয় হয়, কবিতা পাঠের আসরে। মেয়েটা কবি মৃদুল সীমান্তর পরিচিত। যেদিন পরিচয় হয়, অনেকক্ষণ আড্ডা হয়েছিল। তারপর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেও চ্যাট আর হয়নি। আজ জহির তার দিকে নজর দেয়।

  • এই যে পম্পা, কী খবর কেমন আছেন?
  • জি কবি, এতদিনে মনে পড়ল।
  • মনে পড়ে প্রতিদিন, খুঁজিও। কিন্তু পাই না।
  • তা-ই নাকি, কী সৌভাগ্য, একজন কবি আমাকে মনে করেছে।
  • হুম মনে শুধু, ডাকলে তো ঠিক হাজিরও হব।
  • তা-ই নাকি।
  • হুম, কাল কি সময় হবে?
  • হবে, কখন?
  • বিকালে।
  • ওকে, পাঁচটায় ধানমন্ডি লেকে?
  • ধানমন্ডি!
  • কোন অসুবিধা
  • না না ঠিক আছে।

পম্পা : একটি জহির ঘটনা
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় পম্পা একা। একাই। কোন রাতে যে মিথিলা ফিরে আসবে? এখন, এই সন্ধ্যায় হালকা নীল দেয়াল পম্পাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, আর ছড়ানো ছিটানো কিছু আসবাব। পম্পা জানালার পর্দা টেনে দেয়। জানালার বাইরে লাল ইটের দেয়াল দেখা যায়। চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরে পড়ছে। এ সময় চুল না ভেজালেও পারতো। বিরক্ত লাগে। জানালার কাছে গিয়ে লাল ইটের কারুকার্যে চোখ রেখে আবার ফিরে আসে।
পম্পা রিমোর্ট টেনে নেয়। তখন বিছানায় রাখা মোবাইল বেজে ওঠে। সে উঠে গিয়ে স্ক্রিনে চোখ রাখে। এনামুল। ফোনটা যেখানে ছিল, সেখানেই রেখে সে রিমোর্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারে না। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মোবাইল আবার বেজে ওঠে।

  • হ্যালো।
  • হ্যালো। ফোন দিয়েছিলাম।
  • কখন। টের পাইনি তো। ও, বাথরুমে ছিলাম। কথাগুলো পম্পা একটানা বলে যায়।
  • শোনো, বের হও…
  • এখন? কী বলো, অনেক ক্লান্ত।
  • আসো, আসো।
  • আজ না প্লিজ। কেন তোমার কোনো কাজ নাই? পম্পার স্বর একটা সরু পথ বেয়ে চলে যায়।
    কিন্তু অন্য দিক থেকে আর কোনো কথা শোনা যায় না। পম্পা আরও দু-তিনবার হ্যালো, হ্যালো করে মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে মারে।
    একা-ই লাগছে। সে রুমের এমাথা-ওমাথা পায়চারি করে, কয়েকবার। তারপর দ্রুত পোশাক বদলিয়ে নেয়। পোশাক বদলিয়ে পম্পা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। বেরিয়ে অবশ্য ভেবে পায় না কোথায় যাবে।
    একবার মনে হয়…। না। সে মনে মনে ঠিক করে নেয় মেট্রোতে যাবে। কিছু পছন্দ হলে কিনে নিবে, অন্যথায় একটু ঘুরে ফিরে তো আসা যাবে?
    পম্পা রিকশায় উঠতে উঠতে মিথিলাকে ফোন দেয়।
  • হ্যালো মিথিলা, কোথায় তুমি?
    উত্তরে মিথিলা গরগর করে বলে যায় আর বলো না, এখনো অফিসে আটকা আছি, ফিরতে মনে হয় দশটা বাজবে।
    আচ্ছা বলে পম্পা ফোনটা কেটে দেয়।
    রিকশা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে একটানা মার্কেটের সামনে চলে আসে। শুধু পম্পা বাতাসে তার চুল খেলে যাচ্ছে, তা টের পায়। সন্ধ্যায় লুকিয়ে থাকা এই বাতাসের চুল নাড়িয়ে দেওয়া তো মন্দ লাগছিল না। কিন্তু রিকশাটা এত দ্রুত চলে আসলো যে, পম্পার মনে হলো সে কুরপাড় থেকে বড়বাজার এল। কোথাও এক মিনিটের জন্যও আটকাতে হলো না।
    মার্কেটে ঢুকে পম্পা একটা একটা করে দোকান ঘুরে বেড়ায়। একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তিনতলা। ‘আপা আসেন’, ‘এই যে আপা’ ইত্যাদি শব্দই সঙ্গে কোনো ছেলে না থাকলে দোকানদারগুলো এমনভাবে উচ্চারণ করে যেন আহ্বান করছে। পম্পা মনে মনে হাসে খচ্চরগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের অভিব্যক্তি দেখে নেয়।
    যে ছেলেটার সঙ্গে নিচতলায় বেশ কয়েকবার দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে, ওই ছেলেটাকে তিনতলায় দেখতে…
Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস// কবি আসছে // ফারুক আহমেদ// পর্ব আটধারাবাহিক উপন্যাস//কবি আসছে// ফারুক আহমেদ//পর্ব দশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *