উপন্যাস

উপন্যাস।। অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। শেষ-পর্ব

আলী আসগর স্যার এসব করবেন না। করতেই পারবেন না।

কি করবেন তাহলে?

কি করবেন? হাসে জাহাঙ্গীর, বিশ্রী তরল হাসি-তিনি মেয়েটির পায়ের উপর লুটিয়ে পড়বেন, বলবেন-তুমি আমার মা, আমার জননী। আমাকে ধর্ষণ করো না, আমাকে বাঁচাও, আমার এতোদিনের সযত্নে রক্ষিত পুরুষ সতীত্ব রক্ষা করো-

এইবার হাসির প্রচণ্ড এক বোমা ফাটল রুমে। অধ্যাপক টুনটুনি পাখি আর কার্নিশে থাকতে পারলেন না। অসহ্য যন্ত্রণায় ডানা মেললেন আকাশে, আগেই ক্লান্ত ছিলেন, বেশি দূর যেতে পারলেরন না, কলেজ কম্পাউন্ডে একটি ভাঙা বিল্ডিংয়ের পেছনে দেয়ালের উপর বসলেন। মনে হচ্ছে নিজেকে, তপ্ত চুলোয় ঝলসানো একটি অরুচিকর রুটি তিনি, সমস্ত শরীরটা ঝলসে যাচ্ছে। শরীরের সমস্ত মিহি পালক পুড়ে পুড়ে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে যাচ্ছে। আহ! কী কুৎসিত জীবন-বিশাল এই পৃথিবীতে যেখানে এখন সাড়ে ছয়শত কোটি মানুষের বসবাস-তার মধ্যে কি কেউ তাঁর পক্ষে নেই? না স্ত্রী-না ভাই, না কলিগ, না অন্য কোনো মানুষ অথবা প্রাণী-ব্যার্থ জীবন বহন করে চলেছেন দিনের পর দিন।অধ্যাপক টুনটুনির ইচ্ছ হয়- নদীতে ঝাঁপ দেয়া যাবে না। ঝাঁপ দেয়া যায় কিন্তু ডুবে মরা যায় না। পানির উপর ভেসে থাকতে হবে। দুঃখের মধ্যে মুখে হাসি আসে- আত্মহত্যা করার জন্যও শারীরিক ক্ষমতা ও ওজন দরকার।

আলী আহসান ঢাকা শহরের হাসপাতাল-হাসপাতালের মর্গ-থানা হাজত খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত বিধস্ত হয়ে বাসায় ফেরে দুপুরের পরে। বাসায় এসে দেখতে পায় ড্রয়িংরুমে বসে আছে শ্যামপুর থানার দারোগা-ইনচার্জ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সঙ্গে কয়েকজন কনস্টেবলও। ড্রয়িংরুমে বসা সবাই। বাসার আশপাশে থেকেও কিছু লোক এসেছে, ড্রয়িংরুম, বারান্দা-সামান্য উঠোনে মানুষের কৌত’হলী সমাবেশ। বাড়িতে ঢুকে হতচকিত হলে দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় আহসান। সে ড্রয়িংরুমে ঢোকার সঙেগ সঙ্গে আবদুল ভূঁইয়া উঠে দাঁড়ায়, হাত বাড়ায় আহসানের দিকে, আহসানও হ্যান্ডশেক করে তাকায়।

আপনার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছি-বলে আবদুল ভূঁইয়া।

কেন? বাবার কোনো সংবাদ পেয়েছেন?

না।

তাহলে?

আমরা আপনার মাকে গ্রেফতার করতে এসেছি- দারোগা হাতের কালো কুঁচকুঁচে তৈলাক্ত লাঠি নাচায়।

কি বললেন? আহসান বিশ্বাস করতে পারছে না দারোগার কথা।

আমরা আপনার মাকে গ্রেফতার করতে এসেছি-দারোগা পুনরায় বলে।

কিন্তু কেন?

বসুন-আবদুল ভূঁইয়া নিজেও বসে, সামনের চেয়ারে বসে আহসান তাকায় দারোগার দিকে-ব্যাপারটা আপনাকে খুলেই বলি- আপনারা থানা থেকে আসার পর সরেজমিনে তদন্তে নামি, এরই মধ্যে আমাদের কাছে কয়েকটি টেলিফোন আসে-যেসব টেলিফোন থেকে বলা হয়েছে-অধ্যাপক আলী আসগরকে খুন করেছে আপনার মা এবং খুন করে লাশ কোথাও লুকিয়ে রেখেছে-

দেখুন দারোগা ভূঁইয়া, আমার ধারণা আপনার কোথাও কোনো মারাত্মক ভুল হয়েছে।

কি রকম ভুল? দারোগা জানতে চায়।

হ্যাঁ এটা ঠিক, আমি, আপনাকে বলে এসেছিলাম আমার মা বাবার ওপর বিরক্ত ছিলেন, খব বকাঝকা করতেন ঠিকই-কিন্তু একজন মানুষ, যে ব্যক্তি আবার তার স্বামী, তিনি তাকে কেন খুন করবেন?

প্রশ্নটা তো আমারও-দারোগা দ্বিধাগ্রস্থভাবে কথা বলে, কিন্তু আপনার মায়ের সঙ্গে কথা বললে-সে কুব সহজেই স্বীকার করেছে।

কি স্বীকার করেছে?

আপনার মায়ের সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ কথা হয়েছে-

কি কথা হয়েছে?

অধ্যাপক আলী আসগর সম্পর্কে। আপনার মা স্বীকার করেছেন-

কি স্বীকার করেছেন?

তিনি খুন করিয়েছেন।

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আলী আহসান শ্যামপুর থানার সেকেন্ড অফিসার আব্দুল ভূঁইয়ার দিকে।

সেকেন্ড অফিসার মৃদু হাসে- বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে মেনে নিতে, কিন্তু ঘটনাটা সত্যি।

কিন্তু কেন? খানিকটা হতবিহল চিত্তে উত্তেজিত হয় আলী আগসান।

উত্তেজিত হবেন, বসুন। বুঝি আপনার মানসিক কষ্ট কিন্তু এখন কি করব বলুন।

আমার মা কি সরাসরি খুনের কথা স্বীকার করেছেন! বসতে বসতে জানতে চায় আহসান।

না আপনার মা সরাসরি খুন করেনি।

তাহলে? কাকে দিয়ে খুন করিয়ছে? এত সাহস কোথায় পেলেন মা।

সাহসের কথা বলতে পারব না, তবে খুনি হিসেবে নাম বলেছে আপনাদের প্রতিবেশী সাঈদ হোসেন দেলোয়ারের।

আলী আহসান বিপন্ন বিষ্ময়ে হতবাক-মুখ দিয়ে কথা সরছে না। চারপাশে লোকজনের কোলাহল বাড়ছে। বাড়ছে নানা শব্দও। আহসানের মনে হচ্ছে সে জীবিত নেই। সে মৃত। সে যা শুনছে, ভুল শুনছে। অথবা তার সামনে এখন কোনো নাটক রেকর্ডিং হচ্ছে-

আমরা সাঈদ হোসেন দেলোয়ারকেও গ্রেফতার করতে হিয়েছিলাম, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি-দারোগা আবদুল জানায় আহসানকে।

কিছু বললেন? নিজের ভেতরে ফিরে আসে আলী আহসান।

হ্যাঁ, আমরা আপনার মায়ের স্টেটমেন্ট অনুযায়ী আপনাদের প্রতিবেশী দেলোয়ারকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিলাম কিন্তু সে বাসায় নেই। তাছাড়া ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে-সেকেন্ড অফিসার পুরোটা না বলে থেমে যায়।

কি রকম গোলমাল?

দেলোয়ারের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক ভালো। লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছি-দুই ফ্যামিলির মধ্যে আসা-যাওয়া আছে। আপনার বাবা এবং দেলোয়ারের সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। সেই লোক কেন খুন করতে যাবে-

ঠিক আছে, খন না হয় করেছে, কিংবা করিয়েছে, লাশটা কোথায়?

সে প্রশ্নও করেছি- উত্তরে বলেছেন যাদের দ্বারা খুন করিয়েছেন, লাশ তারা কোথায় রেখেছে জানেন না তিনি।

যে খুন করেনি- সে লাশ কোথায় জানবে কি করে?

কিন্তু আপনার মা তো স্বীকার করেছেন-

দেখুন অফিসার, আপনাকে একটা কথা বীল, যে মানুষ অতীতের কৃত অপরাধ ভোগে জর্জারিত, সে উল্টা পাল্টা এরকম অনেক কিছুই বলতে পারে-কারণ আমি যেমন আমার বাবাকে চিনি, তেমন চিনি মাকওে। সারাজীবনের কৃত অপরাধসমূহ হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পেয়েছেন মা এবং তার মধ্যে একটা কিছূ করে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবার একটা ত’ব্র আকুলতার সৃষ্টি হয়, আমার মায়ের মধ্যে সেই তীব্র আকুলতা এসেছে। আপনাকে তো সেদিন অফিসে বসে বলেছিই- মা বাবার সম্পর্কের ব্যাপারটা। আমার মনে হয়- বাবা কোথাও লুকিয়ে আছেন তিনি মানা যাননি কিংবা তাকে কেউ মেরেও ফেলেনি।

তাহলে আমরা কি করব? জানতে চায় আবদুল ভূঁইয়া।

অপেক্ষা। আপাতত অপেক্ষা ছাড়া কোনো বিকল্প দেখছি না এই ক্রিটিকাল মুহূর্তে। তারপর যদি মনে হয় আমার বাবার কোনো অনিষ্ঠকারী আমার মা- কিংবা প্রতিবেশী কেউ অবশ্যই তাকে ইনের কাছে সমর্পণ করব, আপনাকে ডেকে পাঠাব আমি নিজেই।

দারোগ কাম ইনচার্জ কিছুটা সময় ভাবে- ঠিক আছে, আমরাও আমাদরে লাইনে খুঁজতে চেষ্টা করি। আ হ্যাঁ আগামী তিন চানদিনের মধ্যে আপনার বাবার ছবিসহ নিখোঁজ সংবাদ পক্রিকায় ছাপার ব্যবস্থা করছি।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

আচ্ছা আসি-দারোগা আবদুল ভূঁইয়া চলে যায় দলবলসহ। চারপাশে জমা কৌতুহলী লোকজনও চলে যায়। যেতে যেতে লোকগুলেঅ শূন্যে অযাচিত অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। ভেতরে ঢোকে আলী আহসান। ডাইনিং টেবিলে আয়েশ করে ভাত খাচ্ছে মৌলি মুরগীর মাংস দিয়ে। পাশের বিছানায় শুয়ে আছেন মাকসুদা বেগম।

মুখের ভাত শেষ করে মৌলি-সারাদিন কোথায় থাকিস তুই?

কেন কি হয়েছে?

মা গতকাল থেকে ভাত খায়নি।

আলী আহসান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মৌলির দিকে-কি আশ্চর্য মেয়ে মৌলি! বাবা দু’দিন বাসায় ফেরেনি, মা না খেয়ে আছে-অথচ ও নির্বিকার। একবার জিজ্ঞেসও করছে না। বাসায় পুলিশ আসছে- ও সারাদিন নানা জায়গায় ঘুরে ক্লান্ত শরীরে এসেছে, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় গিয়ে কৌশলে ওর বাবার উপস্থিতি জানার চেস্টা করেছে। যদিও সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ। তবুর চেষ্টাটা তো করেছে, করে চলেছে। অথচ মৌলি?

হাসে আহসান- মা না খেয়ে থাক- তুই তো খেয়েছিস!

হঠাৎ মৌলির মনে হল- তার গলায় একটা ভয়ংকর কাঁটা বিঁধেছে-গলায় স্বর চলে না। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। অথচ চারপাশে বাতাসের সমুদ্র, সেই সমুদ্রে বাতাসের স্পর্শ পাচ্ছে না মৌলি। মৌলিরা আসলে ডুব-সাঁতার খেলে তো!

কলেজের দেঢয়ালের সঙ্গেই বেশকিছু বুনো ঝোপ-জঙ্গল।

জীবনের প্রতি গভীর বিতৃষ্ণায় যখন অধ্যাপক টুনটুনি কাতর ঠিক তখন কয়েকজন ছাত্র আসে সেখানে। তারা প্রথমে প্যান্টের জীপার খুলে প্রসাব করতে দাঁড়েিয় যায়-বুনো ঘাসের উপর। পকেট থেকে বের করে সিগারেটের প্যাকেট, মুখে একেকজন একেকটা সিগারেট দিয়ে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একজন ছাত্র হঠাৎ বলে ওঠে-খবর শুনেছিস সান্টু?

কি?

আমাদের আলী আসগর স্যারকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

বলিস কি?

হ্যাঁ, লাইব্রেরিতে শুনলাম স্যারের আলোচনা করছে-

খুব খারাপ খবর-একজন ছাত্র মন্তব্য করে- জয়পুরহাট কলেজের সবচেয়ে ভালো শিক্ষক তিনি। আর যা পড়ান না-বাড়ি গিয়ে পড়তে হয় না আর।

কিন্তু জাহাঙ্গীর স্যার তো আজেবাজে কথঅ বলছে-মন্তব্য করে অন্য আর একজন ছাত্র। ক্ষেপে ওঠে প্রথম ছেলেঠি-ও তো একটা বদমাইশ আর লুচ্চা।ক্লাসে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে কুকুরের মতো। আর জানিস জাহাঙ্গীর স্যারের বৌ চলে গেছে?

কেন? সবাই উৎসুক হয়।

স্যারের বাসায় থেকে নাকি তার শালি কলেজে পড়ত, ঐ যে বেসরকারী মহিলা কলেজ, সেখানে। হঠাৎ এক সকালে স্যারের বৌ দেখে-তার স্বামী তার ছোটবোনকে আদর করছে-

তারপড়?

চিল্লাচিলি­-ঝগড়া-মারামারি কত কী! শালি তো চলে গেছেই, কয়েকদিন পনে বৌও চলে যায়।

আসেনি?

অনেকদিন খবর নেয়া হয় না- আমাদের পাড়ায়ই তো বাসা-ছোটবেলা থেকে দেখছি। এলাকায় বদনাম আছে তার বিরুদ্ধে। স্যারের বাপ নাকি যুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সঙ্গে ছিল। যারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তাদের বাড়িঘর লুট তরেছে সে।

ওয়াক থু-একটা ছেলে বমির ভাব দেখায়-আসলেই তো লোকটা খচ্চরের পোলা থচ্চর। কিন্তু আসগর স্যারের খবরটা নেয়া দরকার-

সত্যি বলেছিস-প্রথম ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়-এমন ভালো একজন স্যারের খোঁজ-খবর নেয়া দরকার, চল প্রিন্সিপালের কাছে যাই-

চল-

ছাত্ররা সিগারেট টানা শেষ করে দেয়াল অতিক্রম করে চলে যায়। ওদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন অধ্যাপক টুনটুনি। নিজের অজান্তে দু’ চোখে পানির ধারা নামে। কিছুক্ষণ আগের ধারণা আমূল পাল্টে যায় তাঁর- না পৃথিবীটা খুব সুন্দর। আমাদের বয়সী মানুষগুলো হয়তো জ্বরাগ্রস্ত, অন্ধ, বধির, পরশ্রীকাতর, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম-এইসব ছেলেরা সাহসী, মেধাবী। এরা পারবে এ পুরোনো সমাজ পাল্টে নতুন আর একটচা সমাজ তৈরী করতে- এক অপার প্রশান্তিতে দগ্ধ মনটা শান্ত হয়ে আসে তাঁর। আসলে মানুষের জীবন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অন্ধকারের মধ্যেই আলোর আগ্রাসন-ভাবেন অধ্যাপক আলী আসগর অথবা অধ্যাপক টুনটুনি।

বিকেল গড়িয়ে গেছে, সন্দ্য নেমে আসছে।

পাখি হিসেবে কেবল আজকের রাতটুকুই থাকতে হবে তাঁকে।

আগামী সকালে আবার ফিরেন যাবেন তিনি বোধিবৃক্ষের তরায়, তাবাসে বাতাসে বাজবে সুমধুর ঘুঙুরধ্বনি, তিনি আবার মানুষ হয়ে যাবেন। অধ্যাপক টুনটুনির মধ্যে এক বিরলণ অনুভবের নৃত্য শুরু হয়েছে। বিশাল পৃথিধবীতে একমাত্র তিনিউ পাখি এবং মানুষ হবার অসাধারণ অভিজ্ঞতার অধিকারী। ক’টা দিন কী আবেগ, ইত্তেজনায়, অভিজ্ঞতায় কাটল-বলে শেষ করা যাবে না। তিনি ভাবছেন-মানুষ হওয়ার পরে গোটা অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখবেন। লোকে নানাভাবে তাঁকে হেনস্তা করতে চাইবে- কিন্তু অভিজ্ঞতাটা তো বিনিময় করতে পারবেন। এটাই বা কম কিসে!

তার হাসি পায় স্ত্রী সন্তানেরা নাকি তাকে খুঁজছে? কি হবে খুঁজে! সংসারের যে মমত্ব, যে দৃঢ় বাঁধন সেটা ছিঁড়ে গেছে। লাটাই থেকে ঠিঁড়ে যাওয়া বা ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো তিনি এখন অনেকটা স্বাধীন, সার্বভৌম। তিনি এখন আর সংসারের প্রতি দায় কিংবা টার অনুভব করেন না। নিজের প্রতিও এক ধরনের সূত্র অবজেলা অনুভব করেন। ছিন্নমূল মানুষ হিসেবে জীবন শুরু করে সংসার নামক কারখানা পর্যন্ত গড়লেন-কিন্তু সংসার তাকে কি দিয়েছে? বরং সংসার কারখানায় জীবনের সব উপার্জন, সব সুন্দর উৎসর্গ করেছেন। বিনিময়ে যা পেয়েছেন-না, তিনি আর কিছু চান না, কারো কাছে তাঁর কিচু আর চাইবার নেই। কেবল একজন সাদঅরণ মানুষ হয়ে, অগণিত ছাত্র-যারা পৃথিবীর সুনাগরিক হবে তাদের প্রিয় শিক্ষক হয়ে থাকতে চান। মানুষ হয়ে এইটুকুই তাঁর প্রার্থনা এখন।

তিনি উড়তে আরম্ভ করলেন। গন্তব্য ঢাকা। সন্ধ্যা অতিক্রম করেছে অনেক আগে। মানুষ আসলে সংসার ছেড়ে দিতে চাইলেও সংসার তাকে ছাড়ঝে নসা। সংসার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। দেখতে উচ্ছে করছে কেমন আছে মাকসুদা বেগ, আর আদরের সন্তানেরা! মৌলির প্রতি তাঁর এক ধরনের স্নেহ আছে- আলী আহসান এটা নিয়ে ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার বলেছে-বাবা, তুমি আপুকে বেশি ভালোবাসো।

তাই নাকি? তিনি হাসতেন।

হ্যাঁ।

কে বলল তোকে?

আমি বলছি।

কই না তো। যখন যা আনি দুই ভাই-বোনের জন্য সমান আনি। মৌলির জন্য বেশি তো আনি না।

বাবা-ওটা সংখ্যার ব্যাপার। আর ভালবাসার ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম- বোঝা যায়, সংখ্যার পরিমাপে পার্থক্য করা যায় না।

তুই এত বুঝিস?

বুঝব না? আমি না তোমার ছেলে!

আলী আহসানকে নিজের মানস প্রতিম হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন-ঘরে জমা করা রাজ্যের বই পাঠ করতে ঘোড়ার পিঠে ঘুরে বেড়ায় শূন্য লাটিমের মতো। ঘোর মানুষকে বিভ্রান্ত করে, টালমাটাল করে।

অধ্রাপক টুনটুনি পাখি হয়ে উড়ছেন। পাখি হয়ে শেষবারের মতো যান্ত্রিক ঢাকা শরীরটা একবার উঁচু থেকে দেখতে চান।

সন্ধ্যায় মায়ের বড় ভাই এসে অযতা কিছু অপ্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে গেল- বিরক্ত আলী আহসান। এসব অর্থহীন কথার কোনো মানে হয় না। মা নির্বিকার। আগাগোড়আশ্চর্য নির্বিকার রূপ ধারণ করলেন কীভাবে? আলী আহসান এতদিন সংসারে থেকেও ছিল না, হঠাৎ পিতার রহস্যময় অন্তর্ধানে সে সংসারের ভেতরে ঘুরে দাঁড়ায় কিন্তু মুশকিল হল মাকসুদা বেগড়কে নিয়ে। কোনো কিছু খায় না। চুপচাপ শুয়ে থাকেন। পাথরের মতো চোখথদুটো নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। কোনোভাবেই খাওয়ানো যাচ্ছে না। জোন করে খাওয়ালে বমি করেন। মাত্র তিনটে দিনের জণ্যে মানুষের কি অনিয়ন্ত্রিত পরির্বতন-মাকে না দেখলে বিশ্বাস করত না আলী আহসান।

তার নিজের থেবর এসেছে বিপুল পরির্বতন সে-নিজে যেদিন শুনল বাবা বাসায় ফেরেনি-কোথায় গেছে কেউ জানে না-মনে হল বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা ছিটকে বেরিয়ে আসছে, হাসতে হাসতে। নিজেকে নিঃসঙ্গ এক শিয়ালের শাবক মনে হয়েছে। যার সবি আছে-তবুও কিছু নেই। বাবা জিনিসটা আসলে অনেক বড়। অনেক মহৎ। শালঅ-জগৎ সংসারে মােিক নিয়ে অনেক গল্প, কবিাতা-গান-উপন্যাস হয়েছে, বাবাকে নিয়ে তেমন কিছু হয়েছে বলে মনে পড়ে না তার।

বাবা প্রায়ই বাড়ি থাকেন না, বাংলাদেশে, নানা প্রান্তরে কলেজে পড়ান, সেখানেই থাকেন, মাঝে মাঝে বাড়ি আসেন, দু’দিন পাঁচদিন থাকেন-আবার চলে যান। কিন্তু কখনও ফিরে আসবে না- এই মর্মমূলটানা কথা মনে আসেনি।

মনে পগে বাবার প্রতি কত অবিচার করেছে সে। কথা শোনেনি। মায়ের তালে তাল মিলিয়ে অনেক সময় অমার্জিত ব্যবহার করেছে-বাবা কিচ্ছু বলেননি। অসহায়ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখঝেন। তিনি নিশ্চয়ই জানতেন-আমাদের এইরকম এক কাল বা সময় আসবে, যখন আমি, আমরা বুঝতে পারব বাবা তখন অনেক দূরের খেয়ায়-অস্থির হওয়ায় পাঁয়চারি করতে করতে বিছানায় শুয়ে পড়ে আলী আহসান।

রাতে এসে নিজের বাড়ির ছাড়ে নামের অধ্যাপক টুনটুনি।

আসার সময় দেখে এসেছেন নিঝুম ঢাকা, ঘুমন্ত ঢাকা। আসলে রাতের গভীর প্রহরে ঢাকা শহর নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে। হঠাৎ তাঁর জীবনের সমস্ত দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস ক্লেদ মুছে যায়। কেমন এক অসীম ভালোলাগায় মনটা আচ্ছন্ন তাঁর। সামান্য জীবনে এত নাটক-এত বেদনা আর ভালো লাগে না। সেই যে পুরোনো একটা গান আছে না-যা পেয়েছি তা যেন গারায় না…। কাল দুপুরে সংসারে ফিরে আসবেন তিনি-স্বামী, পিদা,শিক্ষক হিসেবে। একজন মানুষকে বয়সের সীমানায় কতভাবে কত ঢংয়ে রূপান্তরিত হতে হয়! তিনি ছাদ থেকে বারান্দায় এলেন, জানালা দিয়ে তাকালেন আলী আহসানের কক্ষে। আলী আহসান বিড়ালের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ভাবলেন তিনি- শৈশবে কতবার বিছানায় প্রসাব করেছে আহসান! জামাকাপড় ভিজিয়ে দিয়েছে। সেই ছেলে বড় হয়েছে- তিনি গেলের তার বা তাদের রুমে। মাকসুদা আলুথালুভাবে ঘুমিয়ে আছে। কাপড় এলোমেলো-মোমরেরউপরে পেটিকোট, কাপড়। না, এই অভ্যাসটা গেল না! হঠাৎ বাসায় বা রুমে যদি ছেলে-মেয়ে কেউ ঢোকে-এ অবস্থায় দেখলে কি ভাববে! কিংবা ঢোকে চোর! বেচারা চোর চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য দেখে তার চুরিই করতে পারবে না-হাসেন তিনি।

হঠাৎ শুনতে পেলেন কথার মৃদু শব্দ। চমকে ওঠেন অধ্যাপক টুনটুনি। এত রাতে কে কোথায় হাসে টুংটাং চুড়ির শব্দে? কথা বলে? মাকসুদার ঘরে তো মাকসুদা একা। গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে। তাহলে? কে কোথায়? কেউ কি তাকে উপহাস করছে? নাকি রাতের নীরবতা শব্দ করে?, না, আবার শুনলেন। তাহলে কি আহসানের রুমের জানালায়। না, আহসার আগের মতোই ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। মুখটা হা-ছেলেটার কেমন অসহায় লাগে তাঁর। তাহলে কীসের শব্দ? নিশ্চয় তিনি ভুল শুনেছেন? হাই তুলেছেন-সাবর ঘুম দেখে তারও ঘুম আসছে।

আবর শুনলেন-এবার খিলখিল হাসির মৃদু শব্দ-তিনি উড়ে ঘুরে ঘুরে চলে গেলেন মৌলির কক্ষে। বসলেন জানায়। চোখ রাখলেন ভেতরে- যা দেখলেন, তার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। অবিশ্বাস্য চোখে তিনি দেখতে পেলেন মৌলির বিছানায়, মৌলির গলাধরে শুয়ে আছে সাঈদ হোসেন দেলোয়ার। মৌলিও গভরি আবেগে দু’হাতে বেষ্টন করে ধরেছেছ তাঁকে।

দু’জনে চোখে চোখ রেখে হাসছে, ফিসফিস কথা বলছে। ঠোটে ঠোঁট রেখে চুষছে। দু’জনেই আদিম-

না, আর দেখলেন না। দেখতে পারলে না অধ্যাপক টুনটুনি। তিনি উড়ে গেলেন। কোথায় গেলেন-তিনি নিজেও জানেন না। ঢাকা শহরের আকাশে তিনি অন্ধের মতো চক্রাকারে উড়তে লাগলেন। মানুষ হয়ে তরল বিষ কি করে বুকের মদ্যে পুষবেন? বুকটা খাঁ খাঁ করওেছ, অসহ্য দহনে শরীর মন আত্মা ঝলসে যাচ্ছে। ঘুরতে লাগলেন লাটিমের মতো। উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে একসময় জ্ঞান হানিয়ে তিনি পড়ে গেলেন একটি বাড়ির ছাড়ের পাশে, ময়লার মধ্যে।

কখন এবং কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন তিনি, তিনি জানেন না। তাঁর ঘুম ভাঙে অনেক বেলায় একটি অশ্র“তপূর্ব মায়াবী সুরের কম্পনে। চোখ মেলে তাকালেন, দেখতে পেলেন অজস্র আবর্জনায় পূর্ণ একটি ডাস্টবিনে পড়ে আছেন তিনি। সুর শুনেই তিনি বুছতে পারলেন তাকে ফিরে যেতে হবে সেই বোধিবৃক্ষের তলায়। সময় হয়ে এসেছে। ডাকছে তাকে অলৌকিক ঘুঙুর, ঘুঙুরের হিরন্ময় মায়াবী সুর। তাঁকে আবার মানুষ হতে হবে। কিন্তু তিনি গতরাতে ঢাকার আকাশে চক্রাকারে দিকবিদিক উড়বার সময় ভেবেছেন-তিনি আর মানুষ হবেন না। মানুষ হিসেবে জগ\কে দেখতে ঘৃণা করেন। তার চেয়ে পাখি-এই টুনটুনি পাখি হয়ে থাকা অনেক ভালো। মানুষ হয়ে মানুষের মাঝে থাকতে গেলে-মানুষের কযর্দতা, স্বার্থপরতা, কদাকার র্রূপ দেখতে হবে। তিনি এসব দেখতে চার না।

সারাজীবন, যতদিন বাঁচবেন, টুনটুনি পাখি হয়ে বাঁচবেন। তিনি চান ঐ ঘুঙুরের সুর যেন তাঁর কানে না আসে। সুর কান ভেদ করে মর্মে প্রবেশ করলেই তাকে ছুটে যেতে হবে বোধিবৃক্ষের তলায়। তিনি নষ্ট ময়লা পচা দুর্গন্ধের মধ্যে পুরো গলাটা ঢুকিয়ে দিলেন যাতে তাথিয়া ঘুঙুরের মোহাবিষ্ট অমরলোকের অলৌকিক সুর তাকে শুনতে না হয়। তারপরও রেললাইনের পাশে, রোধিবৃক্ষের তলা থেকে ঘুঙুরের শব্দ, সুরের মায়া ভেসে আসতে লাগল। এবং সেই সুর তাকে মোহাবিষ্ট করে আকাশে তোলে। অধ্যাপক টুনটুনি পাখি তাঁর জীবনের সব শক্তি দিয়ে ঐ সুর প্রতিহত করতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। মানুষের পৃথিবীতে মানুষ হওয়ার জন্য তাকে ফিরে যেতেই হচ্ছে বোধিবৃক্ষের তলায়, ঘুঙুর সুর ও ছন্দের তাছে।

মানুষ হতে হবে পুরনৎবার মানুষের পৃথিবীতে, মানুষ হওয়ার দুঃখে, অপমানে এবং লজ্জায় কাঁদতে কাঁদতে তিনি, অধ্যাপক আলী আসগর অথবা অধ্যাপক টুনটুনি পাখি ফিরে চললেন শোকের বাতাসে ভেসে ভেসে ঘুঙুরের ছায়ায়, বোধিবৃক্ষের তলায় সমান্তরাল রেল লাইনের কাছে।

চারপাশের বাতাসের স্রোতে মানুষ হওয়ার দুঃখ এবং লজ্জাকে ধারণ করে বেজে উঠছে ঘুঙুরের মোহন বিউগল।

Series Navigation<< উপন্যাস।।অধ্যাপক কেন মানুষ হতে চায় না।। মনি হায়দার।। ১২তম-পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *