উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের ।। পর্ব ষোল
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। প্রথম পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব- ০২
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। তৃতীয় পর্ব
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চার
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব পাঁচ
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব ছয়
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব সাত
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব আট
- ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।।পর্ব বারো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব তেরো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব চৌদ্দ
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব পনেরো
- উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের ।। পর্ব ষোল
‘তােমার কথা আমার বিশ্বাস হয় না চাচা’ ─ইণ্ডিয়াক সামান্য মাথা নাড়তে নাড়তে ম্লান
বিমর্ষ গলায় বলে।
সে বসেছে বিছানার ওপর দু’পা তুলে মাহমুদ তার সামনে, চেয়ারে ব’সে।
আজ সকাল থেকে তার বাঁ পা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। পা’টা তাে কেটে ফেলারই কথা ছিল।
আহত অবস্থায় তাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখনও জ্ঞান হারায়নি সে।
যদিও আঘাত গুরুতর ছিল, প্রচুর রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে পড়েছিল খুব।
হাসপাতালের বেডে এক ঘােরের মধ্যে পড়েছিল সে। তখন ডাক্তারদের নিজেদের
ভেতরকার কথা থেকেই বুঝেছিল সে, কেটে ফেলতে হবে এ পা। কিন্তু বড় ভাগ্যি তার।
শেষ পর্যন্ত খুব অল্পের জন্যে বেঁচে যায় তার পা। কেটে ফেলতে হয়নি, তবে জন্মের
মতাে ছাপ ফেলে গেছে। এখন এমনিতে কোনাে সমস্যা নেই। খুঁড়িয়ে হাঁটা তাে তার
অভ্যেসই হ’য়ে গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, খুব হঠাৎ করে। তখন পাগল
হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ডাক্তাররা অবশ্য তখনই জানিয়েছিল এ পা ভােগাবে।
ব্যথা প্রচণ্ড হলে কখনাে মনে হয়, গুলিটা পায়ে না লেগে ভাইটাল কোনাে জায়গায়
লাগতে পারতাে। তাহলে এতসব সহ্য করতে হত না। মাস দেড়েক পরই ক্রাচে ভর─
এমন জীবন কখনাে চায়নি সে। হয়তাে বিদেশে গেলে উপকার পাওয়া যেত।
কতজন তাে স্বাধীনতার পর বিদেশী চিকিৎসা পেয়ে দিব্যি সুস্থ হয়ে ফিরে এল।
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক ছিল না, এমন অনেকেও লিষ্টে নাম তুলে সামান্য
সদ্যি-কাশি সারাতে বিদেশ গেছে, সরকারী বদান্যতায়, সে জানে। তার ভাগ্যে এসব
কিছুই জোটেনি।
ব্যথাটা উপেক্ষা করা ছাড়া তাই আর কিছু করার নেই তার। ইস্তিয়াকের স্নান বিমর্ষ
গলা শুনে সে গাঢ় চোখে তাকায়। বড় বেশি নুয়ে পড়েছে ছেলেটা। বড় আবেগ,
বড় বেশী আবেগ। অথচ যুক্তির শাসন নেই কোনাে। এখনাে সংহত হতে শেখেনি।
মাহমুদ সামান্য হাসে। ’বিশ্বাস যে তুই করেছিস, তাতাে বােঝাই যাচ্ছে’ — সে মৃদু
গলায় বলে।
ইস্তিয়াক তখনই সরাসরি তাকায় — ‘কে বললাে তােমাকে?’
’সবকিছু কি বলে দিতে হয়?’ সে আবারও মৃদু হাসে— ’তাের মুখ দেখেই বােঝা
যাচ্ছে তুই আমার সব কথা বিশ্বাস করেছিস।’
সামান্য মাথা নাড়ে কি নাড়ে না ইস্তিয়াক। অদ্ভুত এক হাসি খেলে যায় তার মুখে —
‘হা , আসলে বিশ্বাস করেছি আমি।’
ছেলেটার জন্যে কষ্ট হয় মাহমুদের। কিন্তু কিই – বা করে সে। তার নিজের ক্ষমতাই
তাে সীমাবদ্ধ। ইস্তিয়াককে তার বাবা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই না জানানো —
এটুকু সে অবশ্য পারতাে। কিন্তু ছেলেটা নিজেই এমন চেপে ধরলাে। আর সে শুধু
আজকের ব্যাপার নয়। ছেলেটা অনেক দিন থেকেই জানতে চাচ্ছে এসব।
শুধু কি এ জন্যেই ওকে জানালাম সবকিছু– সে অবশ্য নিজেকেও প্রশ্ন করে দেখেছে।
ভেবেছে, কোনাে রকম হিংসা চরিতার্থ করা হল না তাে। তারপর সন্দেহমুক্ত হয়েছে
সে। না, কোনাে পাপ নেই তার মনে। ইস্তিয়াকের বাবা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গী স্বচ্ছ,
সে জানে। লােকটিকে গত ষােল-সতেরাে বছরে একদিনও সে ব্যক্তিগত শত্রু মনে
করেনি। ব্যক্তিগত শত্রু যে নয়, তার সম্পর্কে তার ছেলেকে জানানাে যায় সত্যি কথা।
তাছাড়া সে মনে করে, প্রতি ছেলেরই সত্যি কথা জানা দরকার পিতা সম্পর্কে। তাতে
নিজ অবস্থান সম্পর্কে অনেক পরিস্কার ধারণা পাবে ছেলে। তাতে মঙ্গল হবে তার। সে
মঙ্গল সামগ্রিক। মাহমুদ ভেতরে ভেতরে স্বস্তি পায়; না, কোন অপরাধ সে করেনি।
ইস্তিয়াক একসময় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কতক্ষণ সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে
থাকে। তারপর অস্থির পায়ে ফিরে আসে ঘরের মাঝখানে। দাঁড়িয়ে থাকে বােকার
মতাে। মাহমুদের দিকে তাকিয়ে একসময় সে ম্লান হাসে।
‘তােমাকে বলেছি চাচা, ক্লাশ ওয়ানে যখন পড়ি তখন এক ছেলে আমাকে
‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গাল দিয়েছিলাে। তখন তাে বুঝিনি কিছুই। বড় হ‘য়ে
বুঝেছি। কিন্তু তাও এতােটা তখনও বুঝি নি। ভাবতাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা
ছিল পাকিস্তানের পক্ষে, ব্যস, এটুকুই। কিন্তু সে যে পাকিস্তানী সােলজারদের জন্যে
মেয়ে জোগাড় করতাে তাতাে কল্পনাও করিনি কোনােদিন। সে যদি সিম্পলী
পাকিস্তানী হত, ভাবতাম আদর্শ। আদর্শের মিল নাও থাকতে পারে দু’জন মানুষের
মধ্যে। তাকে সে জন্যে অপরাধী ভাবতাম না। কিন্তু এখন দেখছি ওসব আদর্শ-ফাদশ
না, তার কোনাে বিশ্বাস নেই; এখন দেখছি, সে ক্রিমিনাল, পাপী।
মাহমুদ সামান্য হাসে— ‘তুই বড়াে বেশী উত্তেজিত হয়ে গেছিস ছেলে। নিজের বা
বাকে কেউ কখনাে ক্রিমিনাল বলে?’
ইস্তিয়াক মাহমুদের সে কথার ধার দিয়েও যায় না। যেন সে ও কথা শােনে- ই নি।
কি এক ঘােরের মধ্যে সে বলে — ’তাহলে শম্পা ঠিকই বলছিল। বুঝেছ চাচা, শম্পা
আজ সকালেই আমাকে বলছিল ….।’
’কি বলছিল?
’কি বলছিল?’ –ইস্তিয়াক সামান্যক্ষণ কিছু বলে না। সে এসে মাহমুদের সামনে বসে। মুখ
খােলে এবং প্রথম থেকে সব কিছু খুলে বলে।
মাহমুদ চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। যেন কিছুই হয়নি, যেন নতুন কিছুই সে শোনে নি,
এমন ভঙ্গিতে বসে থাকতে চায়। পারে না। এক সময় ধীরে ধীরে সে মাথা নাড়ে — ‘হতে
পারে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।….. হ্যাঁ, হতে পারে, তাের বাবা হয়তাে এখনাে সত্যি
সত্যিই ঐ কাজই করে যাচ্ছে।’
’তবে’ ইস্তিয়াক অস্থির গলায় জানতে চায়।
’তবে কি?’ — মাহমুদ চোখ তুলে তাকায় ইস্তিয়াকের দিকে।
ইস্তিয়াক সে মুহূর্তে কোনাে কথা খুঁজে পায় না। কি বলে সে, আসলেও তাে, তবে কি?
তবু ‘তাই ব’লে… ‘ সে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়।
মাহমুদ চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এসে তার পিঠ চাপড়ে দেয় — ‘এতটা উত্তেজিত
হওয়ার কিছু হয়নিরে। আমরা শুধু অনুমানের কথা বলছি। অমন তাে নাও হতে পারে।’
‘চাচা, তুমি বাবাকে চেন না, সে সব পারে’ –ইস্তিয়াকের গলা ছটফটে শােনায়।
মাহমুদ হাসে, ইস্তিয়াক চেনাচ্ছে তাকে। ’হয়তাে, কিন্তু আমরা ঠিক ঠিক কিছুই জানি
না, হয়তাে ওসব ভুল ধারণা আমাদের’ — সে শান্ত গলায় বলে।
‘কিন্তু যদি সত্যি সত্যিই হয়, তখন?‘
’বারে ছেলে, সত্যি সত্যিই যে হচ্ছে সেটা আমরা বুঝবাে কি করে?‘
’ধর, কোন না কোনাে ভাবে বুঝে গেলাম।’
যদি সত্যি সত্যিই বুঝে গেলাম? পায়ের ব্যথাটা হঠাৎ প্রচণ্ড হয়ে ওঠে।মাহমুদ দাঁতে দাঁত
পিষে তা সামাল দেয়ার চেষ্টা করে— ’তা হলেও আমাদের কিছু করার নেই।’
’কি বলছাে তুমি? কিছু করার নেই আমাদের?
’না, নেই’ — ছোট করে শক্ত গলায় বলে মাহমুদ।
’কেন নেই।’
মাহমুদ একটু হাসে— ’তুই বল দেখি কি করা যায়।’
ইস্তিয়াক এমনভাবে মুখ খােলে যেন অনেক কিছুই বললে সে, কিন্তু পরমুহূহে সে মাথা
ঝাকায়– ’আমিই যদি জানতাম তবে আর তোমাকে জিজ্ঞেস করছি কেন?’
হাসিটা মিলিয়ে যায় মাহমুদের — ’আমি তাে বললাম, কিছু করার নেই। আমার নেই,
তােরও নেই।’
’কেন নেই?’ ইস্তিয়াককে রাগী ও একরোখা দেখায়।
মাহমুদ ইস্তিয়াকের সামনে এসে দাঁড়ায় — ‘সেটা তাে তুই জানিস। জানিস না?
তবে আর আমাকে কেন খামোখা জিজ্ঞেস করছিস?’
ইস্তিয়াক একটু ভাবে— ’আমি? না, আমি জানি না ।… জানলামই বা, আমি
তােমার মতামতটা শুনতে চাই।’
’কি শুনবি তুই’ — মাহমুদ ফিসফিস করে বলে— ’কিভাবে হবে……..?
’হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি সেটাই বলাে।‘
’চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে হবে তােকে?’ মাহমুদ রেগে যায়।
’হ্যাঁ, তাই দেখাও।’
মাহমুদ কতক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে ইস্তিয়ানের দিকে। তারপর ক্লান্ত গলায়
বলে — ’এখন না, পরে’
’না এখন।’
’না, পরে’ —মাহমুদের ক্লান্ত গলায় বলে, চেয়ারে বসে সে উদাসীন চোখে তাকিয়ে
থাকে অন্যদিকে।
ইস্তিয়াক যখন সকালের পর পর এল তখনও মাহমুদ জানতাে না এদিকে এগোবে
কথাবার্তা। অবশ্য ইস্তিয়াক গতবার এমন আভাসই দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে যে এমন
চেপে ধরবে তাতাে মাহমুদ জানতাে না। যদি জানতাে তবে ওসব কথার ধার
দিয়েও যেত না সে। কিন্তু ইস্তিয়াকের জেদাজেদিতে কথা না বলেও পারা যায় না। সে না
না করেছে। কিন্তু প্রথম থেকেই ইস্তিয়াকের ঐ এক কথা— ’তুমিই তাে বলেছিলে
মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে।’
কিন্তু মাহমুদ ভেতর-বাহির থেকে সাড়া পায়নি কোনাে। তারা মুক্তিযােদ্ধা ছিল, ব্যস,
এইটুকুই। এর বেশি আর কিছু বলার নেই এখন। এটুকু বলাই তাে এখন কখনাে কখনাে
কঠিন ব্যাপার। এর ওপর আবার মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ! না। সে আগের মতাে ছােট করে
বলে দিয়েছিল, — ’না, ওসব বলার কিছু নয়।’
‘তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ। তুমি সব সময় আমাকে এড়িয়ে যেতে চাও। আমার বাবা সে
সময়ে কি ছিল না ছিল সে জন্যে ……….।’
সে কঠিন ভাবে মাথা নেড়েছে— ’না, ওসব কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে এখন
আমার ক্লান্তি লাগে।’
ইস্তিয়াক হেসেছে — ’তাই কি কখনো হয়?’
’হয়, আমার হয়। আর এক সময় কি হয়েছে না হয়েয়ছে, কি করেছে মুক্তিযোদ্ধারা সে
সব আর টেনে-হেচঁরে আনার কোনো প্রয়োজন এখন আছে ব’লে আমি মনে করি না।’
’কেন মনে করো না, একটু বল।’ ’যা কিছু অর্থহীন, তাই আমি অপ্রয়োজনীয় মনে করি।
ইস্তিয়াক তবু বাড়াবাড়ি করলে সে কঠিন গলায় জানিয়ে দিয়েছে, ’আমার গল্প শােনা
নাের কোনাে ইচ্ছে নেই ইস্তিয়াক?’ ‘তবে তাকে কে পুরো এড়াতে পারে নি। কি যে
ছেলে, ‘ধমক খাওয়ার পরও ঝুলে থাকে। ‘তবে অন্য কিছু বল ’─ইস্তিয়াক গাে ধ’রো
নাছোড়বান্দা ব’সেই থেকেছে। ‘কি বলবো?’ ‘সেদিন বলেছিলে আমরা কি ভাবে বেড়ে
উঠেছি সেটা জানাবে, সব কিছু কেমন বদলে গেল যে প্রক্রিয়ায়, সেই প্রক্রিয়ার কথা
জানাবে। ‘সে তাে অনেক লম্বা কথা। এখন হবে না। আর আমি বলছি ইস্তিয়াক ওসব
জেনে এখন কোনাে লাভ নেই।’ ‘সে আমি বুঝবাে। অন্তত নিজের অবস্থানটা তাে
আমি জানবো।’
‘তাহলে তাের বাবাকে দিয়ে আরম্ভ করতে হয়। এই উদাহরণটা টানলেই তুই সব কিছু
ভালাে বুঝবি। কিন্তু সেটা কি উচিত হবে?’ ‘তাই কর। কে তােমাকে বারণ করেছে।
আমি তাে সে কথাই জানতে চাই সবার আগে। সূতরাং কেন উচিত হবে না?‘ সামান্য
মাথা নেড়েছে মাহমুদ — ‘শুনে কষ্ট পাবি। সব সত্য সব সময় ভালো লাগে না।‘ অদ্ভুত
ভাবে হেসেছে ইস্তিয়াক─ ‘না, কষ্ট আমি পাব না। যাকে আমি খারাপ লােক হিসেবে
জানি, তার সম্বন্ধে নতুন কিছু শুনলে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।‘ মাহমুদ বলতে আরম্ভ
করেছিল।
বলেছিল যতটা বলা যায়, যতটা ইস্তিয়াকের প্রয়োজন। এখন এই অবস্থা। তবে এমন
চুপচাপ অর্থহীন ব’সে থাকতে তার ভালাে লাগে না। ‘ইস্তিয়াক, তুই এখন বাড়ি যা’ —
সে এক সময় বলে — ‘আমি একা থাকবাে।’ ইস্তিয়াক সে কথা শােনে ব‘লে মনে হয়
না। সে মৃদু গলায় বলে— ‘কিন্তু এমন তাে হতে পারে না যে কোনাে পথই থাকবে না।
আমি তাে এটা ভালাে করেই জানি যে যত কঠিন আর বন্ধ হােক না কেন চারপাশ,
বেরােবার একটা না একটা পথ থাকবেই।….. একটা ওয়ে আউট থাকেই।’ হ্যাঁ, তাতে
ঠিক। মাহমুদ সেটা নিজেও ভালো করে জানে। কিন্তু ইদানীং মাঝে মাঝে তার সত্যিই
মনে হয়, বেরোবার পথ বোধহয় আসলেও নেই। আর যদিও তা থেকে থাকে, তা খুঁজে
বের ক‘রে ব্যবহার করা বড় কঠিন কাজ। তবে খুঁজে বের করার প্রশ্ন ওঠ না, মাহমুদ
জানে, পথ একটিই এবং কি─ তা সে জানে। সে জানে, অর্ধ-সমাপ্ত কিছুই ভালো না, সব
কিছুরই সমাপ্তি প্রয়োজন। কিন্তু ঐ যে কথা – সমাপ্তির
যে পথ, সে বড় কঠিন কাজ। আর ক্লান্তি এখন, কি যে ক্লান্তি। সুতরাং খামােখা কেন
ওসব ভেবে ভেবে চিণ্ডিত আর ব্যতিব্যস্ত হওয়া। তার চেয়ে ঢের ভালাে এরকম বিচ্ছিন্ন
থেকে জীবন যে ভাবে যাচ্ছে সে ভাবে কাটিয়ে দেয়া।
মনে মনে ম্লান হাসে সে; হ্যা, এই তাে, এভাবেই কেটে যাবে। ‘ইণ্ডিয়াক, যা তো তুই’ — সে
আবার এক সময় বলে— ’আমি একটু বিশ্রাম নেব।’
ইস্তিয়াকের সুশ্রী মুখের ওপর কি এক গভীর ছায়া পড়েছে। তাকে এখন দেখেই বােকা যায়
সে খুব অতিমানী, একরােখা আর অবুঝ। সে তাকিয়েই থাকে মাহমুদের দিকে।
ব্যথাটা থেকেই গেছে। মাহমুদ দাঁতে দাঁত পিষে পড়ে থাকে। এবং এক সময় ইস্তিয়াকের
ওপর ক্ষেপে যায় — ’কে, কে তােকে ওসব কথা ওঠাতে বলেছিল?…..
এখন কেন তুই বসে আছিস? খামােখা।… কেন তুই যাচ্ছিস না?’
ইস্তিয়াক এবার আরাে গ্যাট হয়ে বসে। অনেকক্ষণ পর একটুকরাে হাসি খেলে তার মুখে—
’আমি বুঝতে পারছি — অন্য কারাে ওপর তােমার এই ক্ষেপে যাওয়ার কথা, পারছে না;
তারা তােমার নাগালের বাইরে। তাই আমার ওপর ক্ষেপে যাচ্ছ তুমি। কারাে কারাে
ওপর তােমার তাে ক্ষেপতে হয়। আর আমি তােমার নাগালের মধ্যে। ……. এসবের
কোনাে মানে হয়?’
’হয় না, আমিই তাে বলি, কোনাে কিছুরই কোনাে মানে হয় না।….. কিন্তু তুই-ই তাে
ওঠালি। তুই-ই তাে এসব অর্থহীন ফালতু কথা ওঠালি।’
’কিন্তু সে জন্যে তাে তুমি রাগ করনি। আমি তাে বুঝতে পারছি তােমার রাগের কারণ
অন্য।’
‘বুঝেছিস ভালাে করেছিস। তারপরও কেন বসে আছিস? এখন চলে যা তুই।’ ইস্তিয়াক
সামান্য ইতস্তত করে— ’বারবার চলে যেতে বলছে। চলেই বােধ হয় যাওয়া উচিত। কিন্তু
তুমি যে ওয়ে─আউটের কথা বললে না। আমি জানি তুমি তা জান।‘
’জানি? বেশ, জানি আমি’ —মাহমুদ সামান্য হসে— ’কিন্তু তােকে তা বলে কি হবে?’
ইস্তিয়াক অবাক হয়ে যায়— ’কেন, আমি কি করেছি। আমাকে বলবে না কেন।’
মাহমুদের মুখে সামান্য হাসিটা থেকেই গেছে — ’কিছুই করিসনি তুই। তুই ভালাে ছেলে
ইস্তিয়াক। কিন্তু তুই পারবি না। আমি জানি, তােকে দিয়ে হবে না। তুই হয়তাে এ
মুহূর্তে সত্যিই খুব সিরিয়াস। কিন্তু এ সিরিয়াসনেস তোর থাকবে না। দু’দিন পর তুই সব
ভুলে যাবি। হয়ত আটকা পড়ে যাবি কোথাও কিংবা ক্লান্ত হয়ে পড়বি। তুই পারবি না
ইস্তিয়াক। এ কাজ তাের নয়।’
’তবে কার? কার, সে কথা বল।’ মাহমুদ মাথা নাড়ে— ’তা তাে ঠিক জানি না। কিন্তু
তাের যে হবে না, এটুকু বুঝি।’ ইস্তিয়াক সবেগে মাথা নাড়ে –’না, কক্ষনাে না। তুমি
আমাকে ভুল বুঝেছো। তুমি আমাকে আণ্ডার-এস্টিমেট করেছে। আমার সবকিছু
ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করে।