ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব ছয়

ইস্তিয়াক বোঝে না সমস্যাটা কোথায় হল। সে মাথা নাড়ে হ্যাঁ, পড়ে। ‘কিন্তু কেন, কি হয়েছে’—- সে জানতে চায়।
সামান্য হাসে মাহমুদ— মগজ ধােলাই কি ক’রে হচ্ছে তাের সেটাই জানলাম।’ একটু ক্ষ্যাপে ইস্তিয়াক— ‘মগজ ধােলাই কেন হবে? আমি কি ভুল বললাম! ভালো থাকা কি মানুষের নিজের দায়িত্ব না? হ্যাঁ —শান্ত গলায় বলে মাহমুদ — ‘তবে ঠিক তখনই যখন ভালো থাকার প্রয়ােজনীয় সব উপকরণ মানুষ পাবে হাতের কাছে, কিংবা প্রয়ােজনে এ উপার্জন করতে পারবে। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় তা তো সম্ভব না।’
ইণ্ডিয়াক তখনই জিজ্ঞেস করে— ‘কেন, কেন সম্ভব না?’ সে অনেক কথা। তুই বুঝবি না। আমার বলার মুড নেই, মাহমুদ এড়িয়ে যায়। ‘বেশ, তুমি তাহলে বল বাবার ওপর তােমার কেন এত রাগ?’ মাহমুস কথা বলে না। একটা সিগারেট ধরিয়ে খবরের কাগজটা টেনে নেয়। ইণ্ডিয়াক অল্প অল্প হাসে — ‘আমি কিছুটা জানি। তুমি মুক্তিযােদ্ধা ছিলে… মাহমুদ খবরের কাগজটা সরিয়ে রাখে — এটা কোনাে ব্যাপার নয়।’ আর বাবা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। তোমাদের বিপক্ষে।,
একটু থমকায় মাহমুদ, পর মুহূর্তে সহজ গলায় বলে — এটাও পুরনাে খবর। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবাই উঠে গেল তরতর করে। আর তুমি যুদ্ধ করে, দেশ স্বাধীন করেও পড়ে থাকলে কিংবা আরাে নীচে নামলে। আর এ জন্যই বাবার ওপর তােমার রাগ। মাহমুদ খবরের কাগজটা টেনে নেয়, আবার সরিয়ে রাখে। কাঁপছে সে, ইণ্ডিয়াকের দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয় ইণ্ডিয়াক, ‘তুই এখন যা। এই মুহূর্তে যা।’ বেরিয়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না ইস্তিয়াকের মধ্যে। সে প্রাণ খুলে অনেকক্ষণ ধরে হাসে— ‘ইজি , ইজি, তুমি একটু সহজ হওতাে চাচা। খুব বেশি রেগে গেছ তুমি। আমি শুধু তােমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যেই ও কথাটা বললাম। আমি নিজেও তা বিশ্বাস করি না। তুমি অনেক বড় মানুষ। মাহমুদ সিগারেট গুজে দেয় অ্যাশটেতে। পর মুহূর্তে সে কাঁপা হাতে আরেকটি ধরায়— ‘কি প্রতিক্রিয়া দেখতে চাস তুই?’ ‘দেখলাম তুমি রাগ কি – না। সে দিন একটা লেখায় পড়লাম মুক্তিযােদ্ধারা নাকি এখন রাগতেও ভুলে গেছে।’ সিগারেট ধরে রাখে মাহমুদ, টানে না। সে তাকিয়ে আছে ঘরের দেয়ালের দিকে। সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই সে জিজ্ঞেস করে—
‘লিখেছে এই কথা — মুক্তিযােদ্ধারা। এখন রাগতেও ভুলে গেছে?’
‘হ্যা, লিখেছে। ‘মাহমুদ হঠাৎ অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠে তখনই চুপ করে যায়।
‘খুব কি ভুল লিখেছে?’

মাহমুদ ইস্তিয়াকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে, একটু হাসে সে – ‘তুই এবার ভার্সিটিতে ভর্তি হলি, না?’
‘হা হলাম।’ তবে কবে বের হব তা জানতে চেয়াে না। কেউ জানে না।
‘কেউ জানে না’ — মাহমুদ আবার হেসে ওঠে।
‘না ‘ — ইস্তিয়াক গম্ভীর গলায় বলে— ‘কারাে কোনাে মাথা ব্যথা হয়েছে বলেও মনে হয় না। অথচ সংশ্লিষ্ট সবার গলাবাজি শুনলে মনে হয় এ জন্যে তাদের রাতের পর রাত ঘুম হচ্ছে না। সব জায়গায় শুধু বিপরীত অবস্থা… ‘তাই বুঝি হাসির রেশ রয়েই গেছে মাহমুদের ঠোটে।’ তাইতাে। অন্যান্য জায়গাও তুমি দেখ না কেন ! …… বাবা গ্রামের কথা শুনতে পারে না, অথচ প্রায় আমাদের বাসায় গ্রাম থেকে অদ্ভুত ধরনের লােকজন আসে। এরা নাকি আত্মীয়, বাইরে সেটা অবশ্য বলা নিষেধ, যদিও বাবা ওদের সঙ্গে গ্রাম্য স্যাঙ্গুয়েজেই কথা বলে। এদিকে আমাদের কিন্তু বাসায় ইরেজীতে কথা বলার নির্দেশ বাবা দিয়েছিলেন এক সময়। বাবা মসজিদ উন্নয়নে প্রচুর টাকা দেয়, বাসায় হার্ড বু ফিল্ম দেখে। আমি রুম্পা আর শম্পা দেশের কথা ভাবি মাঝে মাঝে, ভিখারি দেখলেই আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মানুষ কেন ভিখারী হবে …।
মাহমুদ হাত তুলে ইণ্ডিয়াককে থামায় — ‘এগুলাে এমন কোনাে বিষয় নয়রে ছেলে। এর চেয়ে অনেক বড় অসংগতি আছে, অনেক অনেক বড় বড় বিপরীত ঘটনা ঘটছে অহরহ। তুই চোখ – কান খােলা রাখলে সবই বুঝতে পারবি। তবে মানুষ কেন ভিখরী হবে — এটা একটা ভাইটাল প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর জানা হয়ে গেলে আর বাকী থাকবে না কিছু, তাের প্রায় সবই জানা হয়ে যাবে।’
ইস্তিয়াক বসে পা দোলায়। কোনাে তাড়া নেই তার। কোথাও যাওয়ারও নেই। বন্ধুদের কারাে সঙ্গে সে আজ দেখা করবে না।
মাহমুদ উশখুশ করে— ‘কিরে, এখানেই সারা দিন কাটাবি বলে মনে হচ্ছে?’
ইস্তিয়াক এ প্রশ্নের ধার দিয়েও যায় না। পা দেলানাে থামিয়ে সােজা মাহমুদের চোখের দিকে তাকায়— ‘চাচা, তুমি না জানতে চেয়েছিলে কেন আসি তােমার কাছে? তা বােধ হয় চেয়েছিলাম এক সময়। তা আসিস — এটা আর এমন কি ব্যাপার। ‘না শােন, আমি আসি তােমাকে আমার খুব ভালাে লাগে। মাহমুদ হাসে। ‘আর আসি, কারণ আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই।’ ‘একী বলিস তুই ছোড়া, এ বয়সে তাের যাওয়ার জায়গা নেই…!
ইস্তিয়াক সে কথা শােনে কি শােনে না—
‘তুমি আমার একটা কথা রাখবে, চাচা?’
মাহমুদ চমকায়, ছেলেটির গলা এত করুণ কেন!
কষ্ট করে একটু হাসে সে—কি কথা শুনেই দেখি, তার পর তো রাখার কথা। ইস্তিয়াক কাতর গলায় বলে— ‘যখন মুক্তিযুদ্ধ হল তখন আমি খুব ছােট, কিন্তু বুঝি না। তারপর দিন গেল। ক্লাস ওয়ানে যখন পড়ি তখন একটা ছেলে আমাকে গাল দিয়েছিল ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে, বহুদিন আগের কথা, কথাটার অর্থ জানতাম না,

কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে। বাবাকে এসে বলেছিলাম, বাবা ‘দাত কিড়মিড় করেছিল, একটু আর কিছু না!’
একটু থামে ইস্তিয়াক, সামান্য হাসে সে— ‘আমি তখন ভেবেছিলাম সারা জীবন বােধহয় এই গাল গুনতে হবে। কিন্তু না, তারপর কেউ আর কোনাে দিন আমাকে ও কথা বলেনি। হয়তো আড়ালে বলেছে, কিং সামনে নয়। দিন যতই যাচ্ছিল আমি বুঝতে পারছিলাম অবস্থা বদলাচ্ছে, ক্লাস ওয়ানে আমি ‘রাকারের বাচ্চা’ গাল শুনেছিলাম, তখন বাবা শুধু দাত কিড়মিড় করেছিল, বুঝতে পারছিলাম পরে যখন ঐ গালি কেউ নিত আমাকে তবে বাবা দাত কিড়মিড় করত না, বাবা মারত্মক একটা কিছু করতো…। এগুলো বাইরে বাইরে ভাসা ভাসা বুঝতে পারছিলাম মাহমুদ চাচা। কিন্তু
ভেতরটা তাে বুঝতে পারছিলাম না। ঐ অল্প বয়সে কিই বা বােঝা যায়। তারপর এই যে। তােমার আর বাবা’র ব্যাপারটা…….
‘আমার আর তাের বাবার আবার কি ব্যাপার?’ ইস্তিয়াক ম্লান হাসে— তুমি সিরিয়াসলী নিচ্ছো না চাচা। এই যে, দেশের জন্য যুদ্ধ করলে তুমি কিছু পেলে না, কেউ তােমাকে মনে রাখলাে না। আর বাবাকে দেখ, তােমাদের বিপক্ষে কাজ করেও সে এখন কোথায়, হিজ পাওয়ারফুল নাউ, রিয়েল পাওয়ারফুল। এসব কি করে হল? আমি এর মধ্যেই বেড়ে উঠেছি, কিন্তু আমি তাে বুঝতে পারিনি, এখন হঠাৎ করেই যেন দেখছি বিরাট পার্থক্য এক ঘটে গেছে …… তুমি আমাকে বলবে চাচা।’
‘কি বলবাে, কি শুনতে চাস তুই?’
‘কি করে বেড়ে উঠলাম আমরা, কোন অবস্থায় কি প্রক্রিয়ায়।’
‘কেন জানতে চাস?’
ছটফট করে ইস্তিয়াক— কেন জানতে চাইবে না— কোন কোন অবস্থায় কিভাবে বেড়ে উঠেছি আমরা…। অবস্থান চাচা, আমি বলছি, নিজের অবস্থান জানা না থাকলে। মানুষের আর কি থাকে, বল? আমাদের জানতে হবে না কোথায় আছি আমরা?
মাহমুদ হাসে— ‘তুই তাে খুব সিরিয়াস সিরিয়াস কথা শিখেছিস।’
‘তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ। আর কে বলবে বল। আর কার কাছে যাব? কেউ তাে নেই।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে মাহমুদ— এসব তাে বন্ধুদের সঙ্গে ডিসকাস করেও জানার চেষ্টা করতে পারিস।
‘বন্ধু, ফু – ইস্তিয়াক অদ্ভুত ভাবে হাসে—
‘ওদের বললে ওরা বলবে ফাক – অফ,
ওরা বললে বললে …. তুমি বলবে না?
মাহমুদ চেয়ারে ফেরে, সিগারেট ধরায়, গভীর গলায় বলে—
বলব, তবে শর্ত আছে একটা।
‘কি শর্ত? আমি রাজী যে কোনাে শর্তে।’
‘আমি বলবাে, কিন্তু তােকে ধারণ করতে হবে।’
‘আমি রাজী। ধারণ করার জন্যই তাে জানা।’
‘বেশ, তবে বলব একদিন।’

‘কবে? তুমি নিদিষ্ট করে জানাও।’
একটু ভাবে মাহমুদ— ‘আমি কাল গ্রামে যাচ্ছি। দু’তিন দিন পর আবার আসতে হবে। এবার কাজটা হলো না। তখন।’
‘থাস্কু চাচা- ইণ্ডিয়াক মাহমুদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়— থ্যাঙ্কস আ লট।’
‘তবে ওঠ এখন, আমার একটু কাজে বেরােতে হবে।’
‘কিন্তু আমার যে আরেকটা কথা ছিল।’
‘বলে ফেল।’
মুক্তিযুদ্ধের কথা আমাকে একদিন বলবে? তুমি নাকি খুব বীর যােদ্ধা ছিলো। এক বইয়ে পড়েছি বাজিতপুর অপারেশনের কথা, তােমার নাম আছে ওখানে, অনেকবার। তােমার পায়ে নাকি ওখানেই গুলি লেগেছিল। ……. তুমি বলবে আমাকে মুক্তিযুদ্ধের কথা?’
মাহমুদের মুখে গভীর ছায়া পড়ে, পাশাপাশি একটু হাসিও খেলে যায় তার মুখে—
‘তাের বয়স কত রে ছেলে?’ বলে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দাঁড়ায় ইস্তিয়াকের সামনে। ইস্তিয়াক হকচকিয়ে যায়— ‘কেন …. উনিশ হয়ে গেছে, এইতাে প্রায় বিশ। বােধহয়।’
‘বুড়াে খোকা তুই? বিশ বছর বয়সেও কেউ গল্প শুনতে চায়?’
‘গল্প’
মাহমুদের হাসি কান্নার মতাে শােনায়— ‘গল্প নয় তাে কিরে? মুক্তিযুদ্ধ — এসবতাে এখন গল্পই রে।’
ইস্তিয়াক তাকিয়ে থাকে মাহমুদের দিকে, তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে সে হেসে ওঠে— ‘হ্যা।’ তুমি ঠিকই বলেছাে, গল্পই বােধহয়। এখন যে ভাবে সবাই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, গল্প— যেন একদা এক দেশে এক রাজা ছিল ……
‘তবে? তাহলে আর কি তুই শুনতে চাস?’
‘আমি’- ইস্তিয়াক ঠোঁট টিপে হাসে— ‘আমি খুব স্বপ্ন দেখতে ভালােবাসি। গল্প শুনতেও তাই খারাপ লাগবে না। প্রায় ভুলে যাওয়া কোনাে সত্য, —যা এখন গল্পের মতাে এবং কোন স্বপ্ন— এ দুইত প্রায় একই ব্যাপার। তাই না, কি বল তুমি?

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব পাঁচধারাবাহিক উপন্যাস।। পাথর সময়।। মঈনুল আহসান সাবের।। পর্ব সাত >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *