শিউল মনজুর এর কবিতা

বৃষ্টিসমগ্র থেকে


বৃষ্টিসমগ্র থেকে নেমে এলো ঝড়ো হাওয়া; খুলে গেলো দরোজা জানালা ও বৃষ্টিজলের ছলছলানি কলকলানি এবং টাপুরটুপুর থেকে বন্ধু লাইব্রেরীর নতুন পাঠকেরা এঁকে নিলো বনবনানী ক্যানভাসে তোমার মুখ। কদমের আবেগ ও সৌন্দর্য পাঠে মগ্নহলো পাঠশালার পাখিরাও, কৈশোরপর্বতো মাত্র শুরু। বৃষ্টিসমগ্র উল্টাতে উল্টাতে নদীও মুখর; তরঙ্গে তরঙ্গে খুলে গেলো শাড়িরভাঁজ, গহনার ব্যঞ্জনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলামাঠে বর্ষাপ্রেমিকেরাও পাহাড়ীঢলে ছুটে আসা বন্যার জলে পুটি ও টেংরা ধরতে গিয়ে ক্লান্ত হলে কেউ কেউ অভিজ্ঞতা অর্জনে তৃপ্ত হয়ে ফিরে গেলো হলের করিডোরে, জিমে অথবা দুপুরের ডাইনিং হলে। অবশ্য বৃষ্টিসমগ্র পাঠ অভিজ্ঞতায় বিধ্বস্তনিবাসের যুদ্ধক্লান্ত সৈনিকেরাও এমনদিনে ছুটি নিয়ে বাজার থেকে খুঁজে আনে কচিমোরগ, ডিম ও সুগন্ধিচাল। সাথে ডালতো থাকেই। জানা গেছে এমনসময় শিল্পপতিরাও বেশিদামে রূপালি ইলিশ সংগ্রহকরণে ব্যাংক চেকে অগ্রিম স্বাক্ষর করে রন্ধনশালায় নিজেদেরকে ব্যস্তরাখেন। কলেজ বিদ্যালয়ের নতুন বন্ধু অথবা বান্ধবীরা জানে কিনা জানিনা, রবিঠাকুর একজন পাক্কা বৃষ্টিপ্রেমিক ছিলেন; বৃষ্টিসমগ্র থেকে রবিঠাকুরের গান ও কবিতা নিয়ে আবারো আলোচনা হতে পারে তোমার বাড়িতে সন্ধ্যায়, তবে টিনের চালে রিমঝিম শব্দটার সাথে খিচুড়ির ঘ্রাণটা যদি থাকে মন্দ হয় না…

সোনালি জলের ঢেউ নিয়ে সারাদিন পাগলামি


লিখলাম একটা কবিতা- কবিতা মানে নদী, নদী মানে তিলোত্তমা জলের ঢেউ, সোনালি জলের ঢেউ নিয়ে সারাদিন পাগলামি। লিখলাম একটা কবিতা- কবিতা মানে ঝর্ণা, ঝর্ণা মানে রূপালি জলের ছলছল চলচল জীবন, জীবনের  প্রাণময় গতি।
লিখলাম একটা কবিতা- কবিতা মানে সমুদ্র, সমুদ্র মানে আকাশছোঁয়া অন্তহীন ক্যানভাস, ক্যানভাসে আঁকা ফেনায়িত শুভ্র জলের ক্রীড়া।লিখলাম একটা কবিতা- কবিতা মানে মেঘ, মেঘমানে সুনীল আকাশে মেঘের মেলা, মেঘে মেঘে গুড়গুড় শব্দের খেলা, টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম সুমধুর গানের বাদলভেলা।
লিখলাম একটা কবিতা- কবিতা মানে পাখি, পাখি মানে নানারঙের গুচ্ছগুচ্ছ পাখি, পাখির ছন্দময় সুখ, ছন্দময় উড়াউড়ি, ছন্দময় ঘুরাঘুরি।
লিখলাম একটা কবিতা- কবিতা মানে শব্দ। হাজার হাজার শব্দ, শব্দের সমষ্টি, শব্দের ধ্বনিময় চিত্র, শাদা জমিনে শব্দের ছুটাছুটি।
লিখলাম একটা কবিতা- কবিতা মানে কলম। কলম মানে মুষ্টিবদ্ধ আঙ্গুল, উদ্যত সাহস, অগ্নিময় বিপ্লবের হাত।
লিখলাম একটা কবিতা- কবিতা মানে গ্রাম। গ্রাম মানে মেঠোপথ, শিশির ¯স্নিগ্ধ ঘাসের আঙিনা, মউমউ পাকাধানের ঘ্রাণ, প্রান্তরে বোশেখের  মেলা, বর্ষায় কাঁদাজলে মাখামাখি, দীঘিজলে লাফালাফি আর নদীজলে থইথই শ্যামল জীবনের স্বর্গময়বাসস্থান।
লিখলাম একটা কবিতা-কবিতা মানে সৃষ্টিকর্তা। মহান প্রভু। দয়াময় প্রভুর কাছে প্রাণখোলে কেঁদে কেঁদে মোনাজাত।
লিখলাম একটা কবিতা-কবিতা মানে স্বপ্ন। স্বপ্ন মানে জীবন। জীবন মানে আশার বাতি। আশার বাতি জ¦ালিয়ে জীবনের ক্যানভাসে স্বপ্নের আঁকাআঁকি।
লিখলাম একটা কবিতা-কবিতা মানে এই যে তুমি। তুমি মানে এই যে আমি। তুমিআমি-আমিতুমি ভালবাসাবাসি আর দিন শেষে ডাল-ভাতের সংসার নিয়ে ঝগড়াঝাটি।
লিখলাম একটা কবিতা-কবিতা মানে দেশ। দেশ মানে প্রিয় বাংলাদেশ। বাংলাভাষার দেশ। রক্তেরাঙা একাত্তরের দেশ। লাল সবুজের পতাকার দেশ।

মায়াবিনী


তোমার জন্ম কোথায় ? কখন কিভাবে এলে –
উহান থেকেই কি তোমার তুফান যাত্রা শুরু – জলে স্থলে সর্বত্র জমিদারী প্রতাপে, দখল করে নিচ্ছো- ছুটে যাচ্ছো লন্ডন, রোম, মাদ্রিদ, প্যারিস, লিসবন, ফ্রাঙ্কফুট, মিউনিখ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো নিউইয়র্ক থেকে টরন্টো এবং দিল্লী থেকে ঢাকা হয়ে অতঃপর বিশ^ময়।
নামে তো মনে হয় তুমি স্ত্রীলিঙ্গ -তবে, এখনো তুমি রহস্যময়ী, মনে হয় দুর্দান্ত কোনো এক জেদী যুবতী। দেখতে কী তুমি জেলিফিস্ এর মতো, নাকী রূপবতী রূপসী পদ্মা মেঘনা যমুনার মতো দূরন্ত তরুণী- তরুণীগুলি যেমন নিমিষেই জলের গভীরে বিলীন করে দেয় এক জনপদ থেকে আরেক জনপদ!
তোমার রঙ কি ; হলুদ, নীল নাকী শাদা কালো , তোমার কি সৌরভ আছে, তুমি কি বৃত্তাকার ; ফুটবল কিংবা ক্রিকেট বলের মতো , নাকী চর্তুভুজী তোমার কি পা আছে; তুমি নাকী মৎস্য বিতান হয়ে আজ পথে পথে গণপরিবহনে জলে স্টিমারে আকাশে জাহাজে ঘুরে বেড়াও! 
তোমার নাকী পাখাও আছে ; হাওয়ার ভেতরে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াও -তুমি নাস্তিক নাকী আস্তিক, সাম্যবাদী নাকী বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিজ্ঞানী নাকি বুদ্ধিজীবি, লেখক নাকি সাংবাদিক অথবা পেন্টাগণের গোয়েন্দা, নাকী প্রতিদিনের টম ও এন্ড জেরী; দাওয়াত ছাড়াই মসজিদে গির্জায় প্যাগোডায়, চার্চে মন্দিরে তীর্থযাত্রায়, বিদ্যালয়ে পাঠশালায়, সভা মঞ্চে, এমন কি বিবাহের বাসরঘরেও তুমি প্রবেশ করো অবলীলায়।
জেনেছি, দৃষ্টিগোচরযোগ্য নও; স্লো মোশনে গোপনে করো হন্তারক কাজ ভেন্টিলেটরেও বাঁচানো যায় না প্রাণ, এতো এতো প্রাণ নিয়ে তোমার কি লাভ – আচ্ছা, তুমি কি তাহলে পাশের বাড়ির রহস্যময়ী সুন্দরী বরুণার মতো যার তলদেশ খুঁজতে যেয়ে জলতরঙ্গে ঝাঁপদেয় প্রতিদিন নতুন নতুন যুবক নাকী তুমি হলিউড বলিউড এর রূপালি পর্দার ছিপছিপে সুপারহিট নায়িকা নাকী দৈত্য দানবের মতো অদৃশ্য এক দানবী; তোমার ভয়ে বিশ^বাসী লকডাউনে অথবা হোম কোয়ারেণ্টাইনে আতঙ্কে নিদ্রাহীন যাপন করছে দিন। তুমি কী তাহলে মায়াহীন মায়াবিনি অদৃশ্য ঘাতকিনী উহান থেকে ভুল করে বেরিয়ে পড়া বায়োলজিক্যাল ওয়েপন নাকী হোয়াইট হাউসের আবিষ্কার, চাইনিজ ভাইরাস কখনো বা চাইনিজ কুংফু। কত প্রাণের বিনিময়ে শান্ত হবে – হে রহস্যময়ী, তোমার ত্রাসে বেদনাদগ্ধ বিধ্বস্ত মিছিলে মিছিলে  শোকাচ্ছন্ন গোটাবিশ্ব অবিরাম কাঁদছে।

একা একা 


জলোজ্যান্ত একটি করোনা লাফিয়ে পড়লো চোখের সামনে, আরেকটি ডানে আরো কয়েকটি বায়ে, পেছনেও লাফিয়ে পড়লো কয়েকটি নিঃশব্দে। তুমি দেখেও দেখলে না, ঘর পেরিয়ে তোমার রাস্তাটা ঘুরে যাচ্ছিলো মেঠোপথ পেরিয়ে নতুন শহরের নতুন সড়কের দিকে, বুঝে নিতে দেরি হলো না একা হয়ে যাচ্ছি এবং একা একা পুলসেরাতের উপর দাঁড়িয়ে এই গোধূলি সন্ধ্যায় অন্ধচোখে মক্কা ও মদিনার দিকে তাকিয়ে রইলাম…

সুরমা মধুমতি চিত্রা


অনেকেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে…ডানে বায়ে লতাপাতার মতো ঝুঁকে পড়ে… কখনো বা ঝর্ণার মতো আছড়ে পড়ার ভঙ্গিমায় তাপমাত্রা ছড়িয়ে দিয়ে যায়…অথচ বর্ষার রূপসী সুরমা মধুমতি চিত্রার ঢেউ কাঁপানো অথবা পাহাড়ী ঝর্ণার কলস্বর যে মনোজগতের আঙ্গিনা জুড়ে আজও কম্পিত হয়…এ রকম কিছুই চোখে পড়ে না…।
সকাল দুপুর আর বিকেলের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ক্যানভাসে প্রতিদিন উড়ে যেতে দেখি অযুত সারস… ভয়ানক প্রক্রিয়ায় ঝরে পড়ছে তাদের গুচ্ছ পালক…অথচ, এই বুকের কোমল ক্যানভাসে শুধুই কাঁপন তুলছে, রূপসী সুরমা মধুমতি চিত্রার ঢেউ…!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *