উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব দুই

উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

জয়িতার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন বাবা। দিনের আলো শেষ হয়ে গেছে। সন্ধ্যা খুলে দিয়েছে অন্ধকারের ডালা। কিন্তু বাবার মনে একটি কথাই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করে সম্ভব? কী করে সম্ভব?
শহরের পথবাতি জ্বলে ওঠেছে। বাবা বললেন, চলো মা ঘরে।
বাবার হাত ধরে এগিয়ে জয়িতা ঘরে ফিরে আসে।
রুমে গিয়ে বসে ব্রেইল বের করে স্কুলের পড়া তৈরি করতে বসে যায়।

কাশেম পাটোয়ারী শিল্পপতি। তাই বড় ধরনের চিন্তা করতে কোনো সমস্যা নেই। জয়িতার জন্য প্রয়োজন হলে তার সমস্ত শিল্পকারখানা বিক্রি করে দিবেন তবু মেয়ের ইচ্ছেকে পূরণ করবেন। টেবিলের উপর অনেক জরুরি ফাইল পড়ে আছে। তিনি সেদিকে তাকাচ্ছেন না। একাউন্ট্যান্ট দুবার চেক বই নিয়ে ফিরে গেছেন, চেকে সাইন করতেও তার মন চাইছে না। তার ভাবনাটা আস্তে আস্তে জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ে কোম্পানির এক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের কথা। লোকটাকে সবাই পাগল ডাকে। ঢিলেঢালা জামাকাপড়। লাল প্যান্ট পরে। গোলাপি ঢিলেঢালা শার্ট। মাথায় ইংরেজদের হ্যাট পরে। সব সময় কালো চশমা চোখে। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। শুধু কাজ আর পড়া ছাড়া জীবনে কিছু শিখেনি। কারো সঙ্গে কথাও ঠিকভাবে বলতে পারে না। তার নাম কান্টিবান্টি। বলে রাখা ভালো যে, এই নামটা অফিসের লোকজন দিয়েছে। তার প্রকৃত নাম জানলেও কেউ তা বলে না।
কাশেম পাটোয়ারী পিয়নকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, পাগল কান্টিবান্টিকে ধরে নিয়ে এসো।
পিয়ন দৌড়ে গেল নিচতলায়। সে কিছু না বলেই পাঁজাকোলে করে কান্টিবান্টিকে নিয়ে এলো কাশেম সাহেবের রুমে। স্যার এই যে পাগলকে আনলাম।
কান্টিবান্টি ভয়ে কাচুমাচু। কাশেম পাটোয়ারীকে দেখে বলল, লোকটা আমাকে কোলে নিল কেন? আমি কি শিশু?
কাশেম পাটোয়ারী কান্টিবান্টির শিশুর মতো সরল মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে আমার বাসায় যাবে।
আমি তোমার বাসায় যাবে কেন?
পিয়ন কান্টিবান্টিকে ধমক দিয়ে বলল, এই স্যারকে তুমি করে বলছেন কেন?
কিন্তু কাশেম পাটোয়ারী হাসলেন। তিনি পিয়নকে থামালেন। বললেন, ওকে ওর মতই কথা বলতে দাও।
কান্টিবান্টি ভয়ে ভয়ে পিয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে ধমক দাও কেন?
কান্টিবান্টির কথা শুনে পিয়ন আর কাশেম পাটোয়ারী আবার হাসেন।
কাশেম পাটোয়ারী বললেন, ঠিক আছে। চলো। আমার বাসায় চলো।
আপনার বাসায় গেলে অফিসের কাজ করবে কে? তুমি করবেন?
আরে বোকা। আমার সঙ্গে চলো। তোমার কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি অন্য কাজ করবে।
তা হবে না। তোমার বাসায় যাবে না। আমার অনেক কাজ হাতে। আপনি তোমার বাসায় যাও।

পিয়ন পিছন দিক থেকে ধরে নিয়ে এলো।
কান্টিবান্টি পিয়নকে দেখিয়ে বলল, এই লোকটা অল্প অল্প খারাপ আছে।
কাশেম পাটোয়ারী বললেন, তুমি চলো আমার সঙ্গে। তোমাকে একটা জটিল কাজ করতে হবে। তুমি ছাড়া এই কাজ আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়।
কাশেম পাটোয়ারী কান্টিবান্টিকে নিয়ে চলে এলেন বাসায়। জয়িতাও বাসায় ছিল।
ড্রয়িংরুমে কান্টিবান্টিকে বসিয়ে বাবা ডাকলেন, জয়িতা, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।
জয়িতা আস্তে আস্তে এসে তার নির্ধারিত সোফায় বসে। কাশেম পাটোয়ারী বিজ্ঞানীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ও হলো বিজ্ঞানী কান্টিবান্টি। গাড়ি বানানোর আইডিয়াটা তুমি ওর সঙ্গে শেয়ার করো। আমার মনে হয় এই কাজটি ও করতে পারবে। অসম্ভব প্রতিভাবান কম্পিউটার বিজ্ঞানী।
কান্টিবান্টি তুমি এখন থেকে আমার বাসায় থাকবে। আর আমার মেয়ে জয়িতার সঙ্গে কথা বলে একটা আইডিয়া ডেভেলপ করে নতুন একটা গাড়ি বানানো চেষ্টা করবে। পারবে তো?
কান্টিবান্টি খুব অবাক হলে বলল, তাহলে অফিসের কাজ কে করবে? তুমি করবেন? আমার বেতন কে দেবে?
কাশেম পাটোয়ারী হাসেন। জয়িতাও হাসতে শুরু করে। এমন উল্টাপাল্টা কথার মানুষ জীবনেও দেখেনি। শুনেও নি। তাছাড়া একজন কোম্পানির মালিক যিনি তাকে চাকরি দিয়েছেন তাকে বলে কিনা বেতন কে দেবে? এমন রামবুদ্ধু কোথায় পাওয়া যায়। এই লোক কি তাহলে কাজটি পারবে। আবার ভাবে বেশি মেধাবীরা অনেক সময় কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। হয়তো এমনও হতে পারে। জয়িতা বুদ্ধিমতি মেয়ে তাই সঠিক ধারণাটি করতেই পারে।

কাশেম সাহেব অফিসে চলে গেলে জয়িতার সামনে বসে কান্টিবান্টি বলল, আপনি আমাকে ডেকেছো কেন?
জয়িতা বলল, আমার তো মনে হচ্ছে আপনাকে আগে আমার ভাষা শেখাতে হবে। তারপর কাজ।
ভাষা শেখাতে হবে কেন? আমি কি ভাষা জানি না? কাজের কথা বলেন।
আমি তো চোখে দেখি না, এটা কি বুঝতে পেরেছেন?
চোখে দেখেন না? না বুঝতে পারিনি। তুমি চোখে দেখতে পারেন না কেন? এটা তো ভয়ানক ভালো ঘটনা। চোখে দেখতে পাওয়াই খুব বিপদ।
বিপদ কেন? আর ভয়ানক ভালো ঘটনা কীভাবে হয়?
চোখে দেখতে পেলে সমাজের নানা খারাপ জিনিস দেখতে হয়। তাহলে সেটা ভালো হলো?
আপনি যদি চোখে দেখতে না পেতেন তাহলে কী ভালো হতো?
তা হতো না। আমি পড়তে পারত না।
তাহলে? চোখে দেখি না সেটা ভালো হলো কীভাবে?
ওহ, আচ্ছা। চোখে না দেখতে পাওয়া তাহলে ভালো নন। আচ্ছা, এখন আপনি কী করবা?
লোকটির অদ্ভুত ভাষা শুনে জয়িতা মনে মনে হাসে। আবার ভাবে, এই লোকটিই পারবে। এসব লোক দারুণ কাজের হয়। শুধু কাজটি বুঝিয়ে দিতে পারলেই হয়। জয়িতার যখন দৃষ্টিশক্তি ছিল তখন এক আদিবাসীকে দেখেছে খুব কাজের মানুষ ছিল। শুধু কাজটি বুঝিয়ে দিতে পারলেই নিখুঁত পারফরমেন্স।
জয়িতা একটু স্থির হয়ে শান্তভাবে বলল, আমার মাথায় একটা ধারণা এসেছে। আমি তো চোখে দেখতে পারি না। কিন্তু আমার গাড়ি চালাতে খুব ইচ্ছে করে। এখন আমি ভাবছি এমন একটি গাড়ি বানাতে হবে যাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরাও চালাতে পারে।
এরকম গাড়ি বানানো সম্ভব নন। পৃথিবীতে এমন কোনো গাড়ি এখনও তৈরি হননি। যদি সম্ভব হতো তাহলে বিজ্ঞানীরা আগেই বানিয়ে ফেলত।
সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব হবে।
আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। ভেবে উত্তর দিবেন। না ভেবে হুটহাট উত্তর দিবেন না। বুঝেছেন?
জি বুঝেচেন। তুমি কী প্রশ্ন করবেন দিবেন?
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যে ক্রিকেট খেলতে পারে সেটা জানেন।
না, জানি না।
পারে। এবার একটু অনুমান করে বলুন তো কীভাবে সম্ভব?
কান্টিবান্টি চিন্তা করে বলে, সম্ভব। মনে হয় ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার ও শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে খেলতে পারে।
হ্যাঁ। আপনি সত্যি বুদ্ধিমান। আমার ধারণাটি হলো শব্দ তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সির ওপর নির্ভর করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের গাড়ি বানানো সম্ভব। আপনার কী মনে হয়, সম্ভব হবে?

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। প্রথম পর্বধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব তিন >>

One thought on “ধারাবাহিক উপন্যাস।। আলোর পথিক।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী।। পর্ব দুই

  • নাহিদ হাসান মিশুক

    অপেক্ষায়….

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *