সায়েন্স ফিকশন

ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব একাদশ

এক্সপেরিমেন্ট ১১ পর্ব 


ভদ্রমহোদয়গণ, আমরা যা করতে চাইছি, তার ভেতর অনৈতিক কিছু আছে বলে কি আপনাদের কারো মনে হচ্ছে?

প্রশ্নটি যিনি করলেন, তিনি বিজ্ঞানী নন। বিজ্ঞান আবিষ্কার নিয়ে ব্যবসা করেন বলে তাকে ব্যবসায়ী বলাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে।

আরথার কোনান ডয়েল, বৃটিশ ধনকুবের, বয়স নব্বই পার হলেও টেনেটুনে সত্তুর বলে মনে হয়।

নিজের নামটা বলার সময় মুচকি হেসে বলেছিলেন, এই নামের কৃতিত্ব পুরোটাই তিনি তার বাবা-মাকে দিতে চান।

শার্লক হোমস-এর স্রষ্টা আরথার কোনান ডয়েল আর নতুন পৃথিবীর স্রষ্টা স্বয়ং এই আরথার কোনান ডয়েল একই ভাবে স্মরণীয় থাকবেন বলে তিনি মনে করেন।

দারুন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আরথার কোনান ডয়েল এক ঘন্টা কথা বলে গেছেন অনর্গল, তার কথা উজ্জীবিত করে তুলেছে সব বিজ্ঞানীকে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছেন, মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলেছেন,

দিস ইজ ইনক্রেডিবল! অসাম!

ইন্ট্রাজেনেটিক সায়েন্স এক্সপ্লোলার কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আরথার কোনান ডয়েল চাইছেন, স্টেম সেল-এর ব্যাপক সরবরাহ।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানুষের ভ্রুণবস্থিত স্টেম সেল উৎপাদনে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করতে হবে এবং তা এখনি।

তবে তার জন্য কেবল মাত্র ভ্রুন তৈরি করাই যথেষ্ট, এই গবেষণা কখনোই কোন জীবন্ত প্রাণ সৃষ্টি করবে না।

কাজেই, অনৈতিক কিছু হবেই না। সামনের সারিতে বসা ড. বেঞ্জামিন হল সহজেই পটে যেতে পারলেন না।

মানুষের ভ্রুন কি মানুষের আদিম অবস্থা নয়?

মানুষের ভ্রুনে কি মানুষের সূচনা ঘটে না?

তবে তার যথেচ্ছ ব্যবহারকে মানুষ মেনে নেবে কেন? মানুষ কেন নিজেকে, নিজের অংশকে গবেষণার উপকরণ করবে? আরথার কোনান ডয়েল ড. বেঞ্জামিনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সোজা। জানতে চাইলেন,

আমরা কি আমাদের মাঝে কোন ধর্মপ্রচারককে চেয়েছি?

আমরা চেয়েছি বিজ্ঞানীকে।

আর য়্যু আ সায়েন্টিটিস্ট? আরথার কোনান ডয়েলের মুখে মৃদু হাসি ফুটল। তিনি ড. বেঞ্জামিনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,

য়্যু আর আ সায়েন্টিটিস্ট।

তা না হলে এখানে আপনি থাকতে পারতেন না। শুনুন, আমি বলছি, ভায়োলেশন অব হিউম্যান ডিগনিটি কোন ভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।

কে এর গ্যারান্টি দেবে,

জনাব? ড. বেঞ্জামিনের প্রশ্ন শুনে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলে উঠলেন আরথার কোনান ডয়েল,

আমি দেব গ্যারান্টি। আমি।

আমার গভর্নমেন্ট। আরথার কোনান ডয়েলের হাতে সরকারি সিলছাপ্পড় মারা অনুমতিপত্র, তিনি তা সবাইকে দেখিয়ে বললেন, মানব ক্লোনিং মানুষের রোগমুক্তির জন্য অপরিহার্য। ভ্রুন ক্লোন করে এর থেকে স্টেম সেল বিযুক্ত করে স্টেম সেলের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা হবে, গবেষণায় সৃষ্টি হবে নিত্য নতুন ওষুধ, সেরে ওঠার উপায়। মানুষ অমর হতে চায়, আর এভাবেই সম্ভব অমরত্ব প্রাপ্তি। কে দেবে স্টেম সেলের জন্য ভ্রুন? জোর জবরদস্তি হবে না। স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবেন মানুষ। এর জন্য ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির কাজ শুরু হয়ে গেছে। এগুলো ছিল কাগুজে কথা। সবার সাথে কথা শেষ হবার পর আরথার কোনান ডয়েলের সাথে একা কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন ড. বেঞ্জামিন হল। ফিসফিস করে বললেন,

মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ পশুর ডিম্ব ক্লোনিং প্রক্রিয়াতে কাজে লাগনো হচ্ছে,

কিন্তু—বাকিটা শেষ করলেন আরথার কোনান ডয়েল। বললেন, কিন্তু এর কোনটা থেকেই মানুষের ভ্রুন তৈরি সম্ভব হয়নি।

আই নো।

হুয়াং উ-সুক-এর কথা তো জানেন। ড. বেঞ্জামিনের মতোই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন আরথার, জানি।

কোরিয়ান এই বিজ্ঞানী দাবী করেছিলেন যে তিনি পশুর ডিম্ব থেকে মানুষের ভ্রুনের ক্লোন করতে পেরেছিলেন।বোগাস! আরথারের চোখ কেন যেন ঘোলা হয়ে উঠল। ফ্রড একখান! আরথারের চোয়ালের পেশিও কেন যেন শক্ত হয়ে উঠতে দেখল হ্যারি মুর। কানে এল কেবল এই কথা,

লেট আস টক প্রাইভেটলি।

ড. বেঞ্জামিন আপত্তি করেননি। আরথারের বিশাল অফিস রুম পার হয়ে একান্ন তলার উপরে বিশাল সুইমিং পুলের পাশে বারে বসলেন মুখোমুখি। আকাশের রং দেখতে দেখতে দুজনেই নিশ্চুপ ছিলেন অনেকক্ষণ। এক সময় আরথার কোনান ডয়েল ফিসফিস করে বললেন,

দে আর সো ম্যানি।

মানে?

মেয়েগুলোর শরীরে হরমোন ইনজেকশন দিতে হয় ডিম তৈরির জন্য। ব্যাপারটা বিপদজনক। এই বিপদজনক খেলায় অংশ নিতে হয়েছে কত শত নারীকে, তার হিসাব আমার জানা নেই।

বাট আই ডোন্ট ফিল স্যরি।

ওদেরকে মেডিকেল বেনিফিট যা দিয়েছি, তা দিয়ে তো ওদের চৌদ্দগুষ্টি বসে খাবে। স্টক মার্কেটের পারদ কিভাবে ওঠাতে হয়, তা আমার জানা আছে। সমস্যা অন্য জায়গায়। ড. বেঞ্জামিনের বমি বমি লাগছিল।

সমস্যা কোথায়, জানেন?

ডিম নেওয়া হয়, কিন্তু বেশির ভাগই তো নষ্ট হয়ে যায়।আরথার কোনান ডয়েল দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে দিলেন একান্ন তলার উপরের বাতাসে। স্বগতোক্তির মতো করে বলতে থাকলেন,

হুয়াং উ-সুক আমার হয়েই কাজ করছিলেন।

তিনি যে দাবী করেছিলেন, তা সত্য ছিল। আফসোস, তা স্বীকার করা গেল না। সরকারের চাপ ছিল। ২০০৫ সালের কথা, তখন মানুষও নিতে পারত না সত্যটা, নেয় ওনি। বেচারাকে ফ্রড তকমা লাগিয়ে দেওয়া হ’ল। ব্যবসার কথা ভেবে চুপ থাকতে হ’ল আমাকেও। তবে যেটুকু অগ্রগতি হাতে এল, তা তো আর হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। সংরক্ষণ করে রেখেছি। এত বছর পর সরকারের মাথায় হাত বুলিয়ে নীতি-নৈতিকতার কবুল বলে কাজ শুরু করব, সেই কাজ শুরু হবে সেই আগের কাজ থেকেই। মানুষের ভ্রুন তৈরি করব। কিভাবে? ড. বেঞ্জামিন ঘামছেন। কি পরিকল্পনা এই বুড়োটার মাথায় খেলছে, তা তিনি পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও আতংকের হিমঠান্ডা কেন যেন তার বুকের ভেতরটা কুঁকড়ে দিচ্ছে। আরথার কোনান ডয়েল সরাসরি প্রস্তাব করলেন, আপনি আমার সাথে থাকছেন। সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার শখ হ’ল আরথার কোনান ডয়েলের। খানিকক্ষণ হেঁটে এসে বসলেন আগের জায়গায়। ড. বেঞ্জামিন হলের হাতটা বন্ধুত্বপূর্ণ আবেগ দিয়ে চাপ দিয়ে বললেন,

ইন্টারস্পেসিসিস ক্লোনিং প্রজেক্ট। মানে? খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কপূর্ণ প্রজাতিগুলোর মাঝে ক্লোনিং করাকে বলে ইন্টারস্পেসিসিস ক্লোনিং।

ধরুন বুনো ষাঁড় জন্মাতে চান, বেছে নিলেন গরুর ডিম্ব।

আপনি কি করতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না।

ক্লোন বানরের জিন গরুর ডিমে ঢুকিয়ে সফল হতে পারেননি ড. সিবেল্লি। ভুল হচ্ছে কোথাও। এমনও তো হতে পারে বিবর্তনের গাছে প্রজাতির সে সম্পর্ক আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার ভেতরে কোথাও কোন গলদ আছে। গলদটা ধরে ফেলতে পারলেই সম্ভব হবে মানুষের ভ্রুন তৈরি করা। ড. বেঞ্জামিন হল না বলেছিলেন সেদিন। আরথার কোনান ডয়েল মিষ্টি করে হেসে

‘ওয়েলডান’

বলে পিঠে মৃদু চাপড় দিয়েছিলেন। আমেরিকান বিজ্ঞানীরা মানুষের চিকিৎসাবিদ্যাগত ক্লোনিং তৈরিতে সাফল্যের খুব কাছে পৌঁছে গেছেন বলে দাবি করলেও চাঁদে মানুষ পাঠানোর মতো প্রতিযোগিতায় যা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে কতটা সত্য উঠে আসছে তা গবেষণার বিষয়। এই প্রতিযোগিতায় সাফল্য আসবে কি আসবে না, তা নিয়ে ভাবছেন না বিজ্ঞানী ড. বেঞ্জামিন। তিনি এই গবেষণায় ব্যবহৃত প্রাণীদের অসহায়ত্বের সুযোগে প্রাণের চরম অমর্যাদার বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। ক্লোন পশুর কোষ থেকে স্টেম সেল তৈরির প্রক্রিয়া সমর্থন করেননি ড. বেঞ্জামিন হল। এ রকম প্রয়াসের খবর যখনি পেয়েছেন, তখনি সোচ্চার হয়েছেন তিনি। আরথার কোনান ডয়েলের সাথে কথোপকথনের পর আরো জোর আওয়াজ তুলবেন বলে গোছগাছ শুরু করলেন। প্রেস ব্রিফিং-এর আয়োজন হবে বলে ড. বেঞ্জামিন হল ও সমমনা বিজ্ঞানী-পেশাজীবি-সমাজকর্মী-রাজনীতিবিদদের স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে ওঠা প্রাণবাদী সংগঠন ‘উইআরঅললিভিং’ এক হয়েছিল। সেখানে ক্লোন বানরের কোষ থেকে স্টেম সেল তৈরির চেষ্টাকে পশু অধিকার আইনের বরখেলাপ বলে যুক্তি সাজানো হ’ল।ছুটির দিনের সুযোগ নিয়ে হ্যারি মুরকে নিয়ে আশফাক চলে এসেছিল সানফ্রান্সিসকো। ড. বেঞ্জামিন হলকে ফোন দিয়ে হাই হ্যালো জানাবে, তার একটা সাক্ষাৎ পেলে ভাল হ’ত, এসব ভেবে ফোন করে বিজ্ঞানীকে। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে থাকা ড. বেঞ্জামিন ওকে তক্ষুণি চলে আসতে বলে ম্যাডোনা টাওয়ারের চব্বিশ তলায়। এখানেই অফিস ‘উইআরঅললিভিং’-এর।ড. করিম নায়েরনিয়া-র টিমের সাথে আশফাক স্টেম সেল নিয়ে যা করছে, তা আসলে বোন ম্যারো থেকে স্টেম সেল তৈরির নির্দোষ এবং প্রচলিত গবেষণার অংশ। পুর্ণবয়স্ক স্টেম সেলে ভর্তি বোন ম্যারো থেকে তৈরি করা এই স্টেম সেলগুলো রক্ত, হাড়, মাংসপেশী এবং এরকম আরো অনেক কিছুর টিস্যু বা কলা তৈরির জন্য কাজে লাগে। ড. করিম নায়েরনিয়া দেখিয়েছেন, পুরুষের অন্ডকোষে স্পার্ম তৈরির জন্য এবং নারীর ডিম্বাশয়ে ডিম্ব¦ তৈরির জন্য যে রকম কোষ থাকে, তার খুব কাছাকাছি নির্দিষ্ট টিস্যুই তৈরি করতে পারে বোন ম্যারো সেলের স্টেম সেল। বন্ধ্যা পুরুষের বোন ম্যারো সেলকে স্পার্মে পরিণত করা সম্ভব। তখন সে সহজেই বাবা হতে পারবে। ইঁদুরের বোন ম্যারো থেকে স্পার্ম সেল তৈরি করা হয়েছে, ইঁদুরের ডিম্বাশয়ে নিষিক্ত করায় জীবন্ত ইঁদুরের জন্ম হয়েছে। মেয়ে ইঁদুরের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা এরকমই ঘটে। বোন ম্যারে সেল পরিণত হয় এগ সেলে।মানুষের বোন ম্যারো থেকে স্টেম সেল তৈরির ক্ষেত্রেও ফ্যাক্টরি উৎপাদনের মতো বড় স্কেলে স্টেম সেল তৈরির কাজটি করা সম্ভব হচ্ছে না। আর তাই পোষাচ্ছে না আরথার কোনান ডয়েল এবং তার মতো ব্যবসায়ীদের। পশুর কোষ থেকে স্টেম সেল বানাও, এ আগ্রহ এক দলের। আরেক দল মানবীর শরীরে হরমোন ঢুকিয়ে বেশি বেশি ডিম তৈরি করিয়ে সেগুলো থেকে স্টেম সেল তৈরি করতে চায়।  অস্ট্রেলিয়ায় রেসাস বানরের ভ্রুন কোষ থেকে ভ্রুন স্টেম সেল তৈরি করার দাবী করা হয়েছে। খবরটা জানা আছে বিজ্ঞানীদের সবারই। অস্ট্রেলিয়াতে এক সম্মেলনে প্রকাশ্যেই এই কৃতিত্বের খবর জানানো হয়েছে। মেলবোর্ন ভিত্তিক মোনাশ য়্যুনিভার্সিটির স্টেম সেল সেন্টার-এর কীংবদন্তী বিজ্ঞানী আলান ট্রনসন হাসি মুখে বলেছেন, অনেক জটিল রোগের ওষুধ তৈরিতে আমরা এখন এগিয়ে যাব।আশফাক বিড়বিড় করে বলল, ইট য়্যুড বি আ ওয়ার্ল্ড ফার্স্ট ব্রেকথ্রো।হ্যারি মুর বলেন, এর চেয়ে বড় খবর তো ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই মিডিয়াতে চলে এল।ড. বেঞ্জামিন হ্যারির কথার সুর ধরে বললেন, সত্যিই চলে এল। শুকরাত মিটালিপভ। অরেগন ন্যাশনাল প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টারের এই বিজ্ঞানী পরিমার্জিত সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার বা এসসিএনটি ব্যবহার করে ডিম কোষের নিউক্লিয়াস সরিয়ে ফেলে দাতা নিউক্লিয়াসে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।আশফাক জানে এরপর কি হয়েছিল। ডিম কোষটি খুব দ্রুত আদিম ভ্রুনে পরিণত হয়েছিল, যার ভেতরে দাতা জৈবদেহের ডিএনএ-র সাথে খুব মিল এরকম ডিএনএ আছে।দশ বছর বয়সী পুরুষ রেসাস বানরের ত্বকের কোষ ব্যবহার করেছিলেন বলে মিটালিপভ দাবী করেছিলেন। ঐ কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন ড. বেঞ্জামিন। শুকরাত মিটালিপভ যে প্রমাণ হাজির করেছিলেন, তা ছিল একটি স্লাইড শো। কি দেখেছিলেন, তা বললেন এখানে। ভ্রুন কোষগুলো পাল্টে হৃৎকোষ এবং নিউরনে পরিণত হচ্ছিল। বিষণ্ন হাসি হেসে বললেন, ধারণা করা হয়েছিল প্রচলিত পদ্ধতির মতো ল্যাবওয়ার্কে রঞ্জন পদার্থ এবং আলট্রাভায়োলেট লাইট ব্যবহার না করে পোলারাইড লাইট ব্যবহার করা হয়েছিল বলে ওরকম ব্রেকথ্রো এসেছে।এভাবে তো সাফল্যকে ধ্রুব বলে মেনে নেওয়া যায় না। আশফাক জোর গলায় বলে বসল।ড. বেঞ্জামিন হলের মুখে বিষণ্ন হাসিটা আরো চওড়া হ’ল। তিনি বললেন, সাফল্য কার হাতে ধরা দেবে তা নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তাতে এরকম সাফল্যের খবর ঘন ঘন আমাদের কান পাকাতে থাকবে। সাফল্যের জন্য আড়ালে চাপা পড়ে যাবে পশুদের আর্তনাদ, আর…নারীর কান্না। পুুরুষ কাঁদাবে, নারী কাঁদবে বরাবরের মতোই।এই নারী হোমো সেপিয়েন্স-এর অর্ধেক অংশীদার কিন্তু।কাজী নজরুল ইসলামের সেই কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল আশফাকের। এই বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি, তার অর্ধেক কৃতিত্ব পুরুষের আর বাকি অর্ধেক নারীর। এই বিশ্বের যা কিছু ধ্বংস, যুদ্ধ-অত্যাচার, তাতে কিন্তু নারীর হাত খুব কম পড়েছে। কিন্তু অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে নারীকেই। গণহত্যা-যুদ্ধের আদিমতায় কোরিয়ান যুদ্ধ কিংবা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রতি যে জঘন্য অত্যাচার হয়েছে, অধুনা তালেবান-আইএস মার্কা মধ্যপ্রাচ্যীয় যুদ্ধে নারী কেনাবেচার হাট দাঁড়িয়ে গেছে, এসব কিছুর দায় কেবলি পুরুষের। নারী শ্বাশুড়ি কিংবা পুত্রবধু কিংবা সৎ মা-বোন হয়ে ঘরে তান্ডব করেছে, প্রেমিকের মন ভেঙ্গেছে, পরকীয়ায় মেতে স্বামীর বিশ্বাসভঙ্গ করেছে, কিন্তু গণহত্যা-গণধর্ষন-ধর্ষনের মতো বৃহৎ মানবিক বিপর্যয়ের মতো অন্যায় কখনো কোথাও করেনি।চরম আধুনিক বিশ্বে পুরো মানবজাতি নতুন একটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গেছে। স্টেম সেল তৈরির যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধ বলা যায় কি না, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে ভোগবাদী অর্থনীতি যুদ্ধের সূচনা করে ছেড়েছে, আর সেই যুদ্ধে এবারও আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু নারী।আশফাক পুরো বিষয়টি যখন বুঝতে পারল, তখন ওর বুকের গভীরে লরার কোমল মুখটি ভেসে উঠল। এই লরা এখনকার লরা নয়। স্টুডেন্ট লাইফে আশফাকের জন্য মরতে চাওয়া লরাটা এখনকার এই আশফাককে কাঁদিয়ে দিল। বাকিরা ওর চোখে অশ্রু দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে শপথ নিলেন, কোন অন্যায় তারা হতে দেবেন না। যত রকমের জায়গা থেকে প্রতিবাদ জোরালো করা যায়, তা-ই করা হবে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব দশধারাবাহিক উপন্যাস।। এক্স-পেরিমেন্ট।। নাসরীন মুস্তাফা।। পর্ব বারো >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *