শিশুতোষ গল্প।। ছানা ও মা-কাঠবিড়ালি ।। জনি হোসেন কাব্য

— ভালো একটি বাগান দেখে বাসা বানাতে পারলে না, মা?
কাঠবিড়ালির প্রথম ছানাটি বলল। 
মা-কাঠবিড়ালি জানতে চাইলেন,
— কেন, কী হয়েছে?
— এই বাগানে বাতাবিলেবু ছাড়া আর কী আছে?
প্রথম ছানাটির কথা শেষ হতে-না-হতেই দ্বিতীয় ছানাটি বলল,
— প্রতিদিন এই একই ফল খেতে আর ভালো লাগে না। 
তৃতীয় ছানাটি মাথা নাড়ল।
মা-কাঠবিড়ালি চোখ টিপটিপ করে বললেন, 
— ভালো বাগান দেখেই বাসাটি বানিয়েছিলাম। দেখিস-না, এখানে কত সুপারি ও নারিকেলগাছ!
— তাহলে ঐ ফলগুলো আনো না কেন!
তৃতীয় ছানাটি জানতে চাইল।
জবাবে মা-কাঠবিড়ালি বললেন,
— থাকলে তো আনব! তোরাও এসব খাওয়ার উপযোগী হলি এদিকে মানুষরাও ফলগুলো পেড়ে নিয়ে গেল। এখন পুরো বাগান খালি। তবুও ভাগ্য ভালো, কাছেই একটি বাতাবিলেবুর বাগান ছিল। তা-না-হলে তো না খেয়েই মরতে হতো।
মায়ের কথা শুনে ছানা তিনটি মুখ গোমড়া করে রইল।
— তোরা আরেকটু বড় হয়ে নে৷ ভালোমতো হাঁটা-চলা করতে শিখ। তারপর আমরা অন্য একটি বাগানে চলে যাব। সেখানে হয়তো বাহারি রকমের ফল থাকবে। 
— কী কী ফল থাকবে, মা?
ছানারা জানতে চাইল। 
— আম, জাম, পেয়ারা, বাদামসহ আরও অনেক ফল।
মা-কাঠবিড়ালির কথা শুনে ছানা তিনটের মন এক নিমিষেই ভালো হয়ে গেল।

ছানাদের মন ভালো হওয়া দেখে মায়েরও নিশ্চয়ই মন ভালো হবার কথা? কিন্তু তা হলো না। 
কারণ কিছুদিন ধরে এ বাগানে একটি দুষ্টু ছেলের দল যাতায়াত করছে। প্রতিদিন তারা গাছথেকে লেবু ছেঁড়ে। ছেঁড়ার পর সেসব এদিক-ওদিক ছুঁড়ে নষ্ট করে৷ 
এভাবে কিছুদিন চলতে থাকলে সব লেবু শেষ হয়ে যাবে। শেষ হয়ে গেলে কাঠবিড়ালি ও তার ছানারা খাবে কী!

একদিন মা-কাঠবিড়ালির খুব খিদে পেল। সে আর দেরি করল না। বাতাবিলেবুর বাগানে গিয়ে বড় একটি পাকা লেবু পছন্দ করল। উপর দিয়ে ফুটো করে একমনে খেতে লাগল সেটি৷ খেতে খেতে একটাসময় কাঠবিড়ালি বাতাবিলেবুটির ভেতরে ঢুকে পড়ল। ঠিক তখনই বাগানে প্রবেশ করল সেই দুষ্টু ছেলের দল। প্রতিদিনের মতোই তারা লেবু ছিঁড়তে এলো। এসে দেখল, একটি বড় পাকা লেবু বাতাস ছাড়াই অনবরত নড়ছে। সেটার ভেতর থেকে কুটকুট শব্দ ভেসে আসছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেল তারা। ভাবল, লেবুটির ভেতরে ভূত আছে। সবাই ‘বাবাগো!, মাগো!’ বলে চিৎকার করে পালাল। 
চেঁচামেচি শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কাঠবেড়ালি। দেখল, দুষ্টু ছেলেরা দৌড়ে পালাচ্ছে৷ মাথা চুলকালো সে৷ কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। সেদিনের পর থেকে দুষ্টু ছেলের দলটি আর এ বাগানে প্রবেশ করেনি। মা-কাঠবিড়ালি চিন্তামুক্ত হলেন।

বাগানটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লম্বা একটি খাল। খালের ওপারে বিশাল বড় ক্ষেত। সেই ক্ষেতে বাদাম চাষ করা হয়৷ এত্ত এত্ত বাদাম। ক্ষেতের আশেপাশে কয়েকটি পেয়ারাগাছও রয়েছে। সেখানে ঝুলে আছে বড় বড় পেয়ারা৷ শুধু কি তাই? সারি সারি কলাগাছও দেখা যায়। থোকায় থোকায় কলা ধরে আছে। কয়েকদিন পরেই হয়তো পাকতে শুরু করবে। 
এ খালেই প্রতিদিন পানি খেতে আসে মা-কাঠবিড়ালি৷ খাওয়া শেষে খালের পাশে বেড়ে ওঠা লম্বা একটি সুপারিগাছে উঠে যায় সে। তারপর ক্ষেতের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে, ইশ! বাসাটি যদি খালের ওপারে হতো, তাহলে ছানাদের কত বাহারি রকমের ফল খাওয়ানো যেত। নিশ্চয়ই খেতে পেরে খুব খুশি হতো তারা! হয়তো তাদের কাছথেকে ‘সেরা মা’—এর খেতাবটিও পাওয়া যেত!

প্রতিবেলায় একই ফল আনে বলে সেদিন একটি ছানা তো বলেই ফেলল, ‘পচা মা’। শুনে কী যে কষ্ট হয়েছিল মা-কাঠবিড়ালির! তাদেরই-বা দোষ কোথায়? ছানারা প্রায়ই ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখে, মা তাদের জন্য বাদাম, পেয়ারা, কলাসহ নানান স্বাদের ফল নিয়ে এসেছে৷ কিন্তু সেসব স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। পূরণ হয় না কখনোই।

কাঠবিড়ালির খুব ইচ্ছে করে লম্বা সেই সুপারিগাছটি থেকে লাফ দিয়ে খালের ওপারে যেতে। কিন্তু এত বড় লাফ তো সে দিতে পারবে না। দিলে নির্ঘাত পানিতে গিয়ে পড়বে৷ হাবুডুবু খেয়ে মারা যাবে। সে মরে গেলে ছানাদের কী হবে! এসব কথা চিন্তা করে গাছ থেকে নেমে আবার বাসায় ফিরে আসে কাঠবিড়ালি।

সেদিন রাতে প্রচণ্ড ঝড় হলো৷ সকালের খাবার খেয়ে পানির জন্য খালে চলে গেল মা-কাঠবিড়ালি। গিয়ে ভীষণ অবাক হলো! খুশিতে তার মন টগবগ করে ওঠল। সে দেখল, রাতের ঝড়ে লম্বা সেই সুপারিগাছটি উপড়ে গিয়ে খালের ওপারে নুয়ে পড়ে আছে। 
কী মজা! এখন সে অনায়াসেই খাল পাড়ি দিতে পারবে। ওপারে যাবার জন্য আর কোনও বাধা রইল না। এবার খুব সহজেই ছানাদের জন্য নানানরকম ফল নিয়ে আসা যাবে।

সেটাই করল কাঠবিড়ালি। নুয়ে থাকা সুপারিগাছটি দিয়ে খালের ওপারে চলে গেল। টুপ করে ক্ষেতে ঢুকে পড়ল। ইচ্ছেমতো বাদাম খেয়ে নিল। পেয়ারা গাছে উঠল। পেট ভরে পেয়ারা খেল। 
কলাগাছেও গিয়েছিল। কাঁচা হবার কারণে একটি কলাও খায়নি সে। ২-১ দিন পরেই পাকবে। তখন খাওয়া যাবে৷ 
এবার ফেরার পালা। ছানাদের জন্য সে গালভরা বাদাম ও হাতভরা পেয়ারা নিয়ে নিল। খেয়ে কী যে খুশি হবে তারা! ভাবতেই ধেইধেই করে নাচতে ইচ্ছে করল কাঠবিড়ালির। তারপর ক্ষেত থেকে বেরিয়ে খালের দিকে এগিয়ে গেল সে।

খালের কাছাকাছি পৌঁছাতেই কাঠবিড়ালির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! 
সে দেখল, কয়েকজন মানুষ উপড়ে-পড়া সুপারিগাছটি কেটে ফেলছে। নিশ্চয়ই গাছটি এখান থেকে কেটে বাড়ি নিয়ে যাবে তারা৷ যদি সেটাই হয়ে থাকে তাহলে ছানাদের কাছে সে ফিরবে কীভাবে! 
খুব কান্না পেল মা-কাঠবিড়ালির। সে একটি গাছের ডালে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদল৷ একনাগাড়ে কয়েকঘন্টা কান্না করল। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে এলো। 
ছানাগুলো ছাড়া এই পৃথিবীতে তার আর কেউই নেই। ভীষণ মনে পড়ল তাদের বাবার কথা। ওরা তখন আরও ছোট। খাবার আনতে গিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেলেন, আর ফিরে এলেন না৷ এখন সেও যদি বাসায় ফিরতে না পারে তাহলে মা-বাবার প্রতি সারাজীবন অভিমান থেকে যাবে ছানাদের৷ 
নাহ, যেভাবেই হোক তাদের কাছে ফিরে যেতে হবে৷

কাঠবিড়ালি একটি সিদ্ধান্ত নিল। কঠিন ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত। সে খালের এপারের গাছথেকে ঝাপ দিয়ে ওপারে যাবার চেষ্টা করবে৷ এতে যদি পানিতে পড়ে মারা যায়, যাবে৷ ছানাগুলো ছাড়া তার বেঁচে থেকেই-বা লাভ কী! সে একটি গাছের নিচে পেয়ারা ও বাদামগুলো রেখে দিলো৷ তারপর জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাটি দেওয়ার জন্য খালটির দিকে এগিয়ে গেল।

‘একী! এখানে সাঁকো এলো কোত্থেকে!’ অবাক হলো কাঠবিড়ালি। ভালোভাবে তাকাল। দেখল, লম্বা সেই সুপারিগাছটি কেটে সঙ্গে কিছু বাঁশ জুড়ে দিয়ে মানুষরা দারুণ একটি সাঁকো তৈরি করে ফেলেছে৷ 
‘বাহ, আর কোনও ভয় নেই। এবার নিশ্চিন্তে এপার থেকে ওপারে যাওয়া যাবে।’ ভাবল কাঠবিড়ালি। সে খুশি-মনে নাচতে নাচতে সাঁকোটি পার হলো। 
হঠাৎ তার মনে পড়ল, ‘আরে! এটা আমি কী করলাম! ফলগুলো রেখে এসেছি কেন? সুযোগ যেহেতু আছে, যাই, নিয়ে আসি।’

মা-কাঠবিড়ালিটি পেয়ারা ও বাদাম নিয়ে বাসায় ফিরল। ছানারা ফলগুলো পেয়ে গাপুসগুপুস খেল। খেয়ে ভীষণ খুশি হলো। তারপর জড়িয়ে ধরল মাকে। বলল, ‘তুমি হচ্ছো পৃথিবীর সেরা মা।’ 
ছানাদের মুখে সেরা মায়ের খেতাবটি পেয়ে মনের সকল কষ্ট মুছে গেল কাঠবিড়ালির। আনন্দে চোখ ভিজে এলো তার। অথচ ছানাগুলো বুঝতেই পারল না, সেরা মা হতে গিয়ে কত সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। হয়তো তারা যেদিন মা হবে সেদিন বুঝতে পারবে সব!

সাঁকোটি হবার কারণে বেশ উপকারই হলো ছানা ও মা-কাঠবিড়ালির। এখন আর প্রতিদিন বাতাবিলেবু খেতে হয় না তাদের। একেকদিন একেকরকম ফল খেতে পারে। কী মজা…!

One thought on “শিশুতোষ গল্প।। ছানা ও মা-কাঠবিড়ালি ।। জনি হোসেন কাব্য

  • আগস্ট ২৩, ২০২০ at ৩:৫৬ অপরাহ্ণ
    Permalink

    গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগলো।অভিনন্দন

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *