সায়েন্স ফিকশন

ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব নয়

এক্সপেরিমেন্ট- ।। ৯।।

লরা আশফাকের এই কণ্ঠ চেনে। চুপ হয়ে যায় আচমকা। ভুলে যায়, ফোনটা সোহাকে দেওয়ার কথা। ও প্রান্তে আশফাক কি ভাবল কে জানে, একটু পর কথা বলে ওঠে। লরা বুঝতে পারে না, আশফাক এসব কাকে বলছে? হয়তো সোহাকে। হয়তো কেন, আশফাক তো সোহার সাথেই কথা বলতে চেয়েছিল।
আশফাক বলছে, সোহা, তুমি কি একটু আমার হয়ে লরাকে বলবে, বলবে যে আমি আসলে ঘুমের ঔষুধ খেয়ে মরতে বসা লরার শুকনো মুখটাকে ভুলতে পারি না। তুমি কি বলবে, আমি লরার হাত দু’টো ধরতে চাই? তুমি কি বলবে, আমার আসলেই ওকে প্রয়োজন। বলবে?
লরা সোহা হয়ে জবাব দেবে, এই সাহস পায় না। ফোনের সুইচটা অফ্ করে দেয় শুকনো মুখে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি যে সোহাওর দিকে তাকিয়ে ছিল বিশাল প্রশ্নচিহ্ন হয়ে। লরার মুখ শুকিয়ে গেছে, অহেতুক রাগ জমছে ভেতরে ভেতরে। সোহা ওর কাছে এগিয়ে এসে বসে। ওর হাতে হাত রেখে বলে, এবার উনি ফিরলে—
লরার রাগ বিস্ফোরিত হয় ওকে কোন রকমের আত্মনিয়ন্ত্রনের সুযোগ না দিয়েই। এরপর আর সোহা লরার কাছে আশফাক ও লরার বিয়ের বিষয়ে কিছু বলেনি। লরা যখন আশফাকের কাছ থেকে আসা মেইল ওকে পড়ে শোনায়, তখনো না। কেন যেন ওর মনে হয়েছে, এই দু’টো অতি বুদ্ধিমান মানুষকে বলে কয়ে কিছু করানো যাবে না। ওরা নিজেরাই এক সময় বুঝে নেবে, কি করতে হবে। যদি এক হতে চায়, হবে। যদি না চায়, হবে না। কিশোর বয়সের প্রেম তো নয় যে বন্ধুর মুখের কথায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রেম করতে এগিয়ে যাওয়া যায়।
খাওয়ার পর ছুটির দিনের আমেজ পেতেই ঘুমিয়ে গেল লরা। ছোট্ট বাচ্চাদের মত শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। এলোমেলো চুলগুলো মুখটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। সোহার খুব মায়া হচ্ছিল চুলে ঢাকা মুখটার জন্য। বেচারি লরা, কোন্ দুঃখে একা একা জীবন কাটাচ্ছে, কে জানে? আশফাকের জন্য কি? সরাসরি জবাব দেয় না, কিন্তু সোহার কেন যেন মনে হয়, আশফাকের সাথে একটা ঘনিষ্ঠতা আছে বটে, তবে লরা একা থাকছে অন্য কারণে। দোক্লা থাকার শক্তিটা হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। সংসার করার জন্য উৎসাহমূলক, উদ্দীপনামূলক শক্তির কিন্তু খুব প্রয়োজন। লরা সেই শক্তির খোঁজ পায়নি। সোহা পেয়েছিল। লাভ কি হয়েছিল তাতে? এখন সোহা কিছুতেই আর নিজের ভেতরে সংসার করার মত শক্তিকে খুঁজে পায় না। আরিফের সাথে দিনযাপনের শখ ওর বুঝি চিরতরেই মিটে গেছে। আরিফের কি সোহার জন্য আফসোস নেই? সোহার অফিসে দু’দিন এসেছিল আরিফ। কথা বলতে চেয়েছে। সোহা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আরিফকে নিয়ে গেছে ক্যান্টিনে, চা খেতে খেতে এবং খাওয়াতে খাওয়াতে শুনবে, আরিফ নামের ভদ্রলোকটি কি বলতে চায়? আরিফ ওর সাথে কথা বলতে চায় শুনে কিন্তু ওর ভেতরে কোন ঢেউ ওঠেনি। আরিফের জন্য ওর মনটা মরে গেছে, এটা খুব স্পষ্ট করে টের পায় সোহা। তখন কখনো কখনো ওর মরে যাওয়া মনটার জন্য দুঃখ হতে থাকে।
আরিফ ফিরে যাওয়ার কথা বলেছিল। আর কেউ না থাকুক, ওরা দু’জন তো এখনো বেঁচে আছে। সোহা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে মনে আওড়ায় আরিফের উক্তিটি। আমরা দু’জন তো এখনো বেঁচে আছি। হাসি পায় সোহার।
আরিফ বলেছিল, কত মানুষেরই তো সন্তান থাকে না। তাই বলে কি স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যায়?
এবারো হাসি পায় সোহার। কথা বলতে ইচ্ছে করে না বলে করে না। অনেক স্বামী স্ত্রীর অক্ষমতার জন্য স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যায়। অনেক স্ত্রীও স্বামীর অক্ষমতার জন্য স্বামীকে ছেড়ে যায়। যেতেই পারে। তবে সোহা তো আরিফকে ছেড়ে এসেছে অন্য কারণে। আরিফের সন্তান উৎপাদনের অক্ষমতা নয়, আরিফের ভালবাসার অক্ষমতা সোহাকে মৃত বানিয়েছে।
আরিফ কাতর কণ্ঠে বলে, রাগের মাথায় আমি অনেক বাজে কথা বলেছি। আমার দোষ আমি মাথায় পেতে নিচ্ছি, সোহা। তুমি আমাকে প্লিইজ ক্ষমা কর। ফিরে চল। আমার খুব একা একা লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আত্মহত্যা করি। বিশ্বাস কর।
সোহার তবুও মায়া হয় না। ওর খুব হাসি পায়। আরিফ এত বোকা, কেন যে ভাবে সোহা এখনো বোকা আছে? আরিফের নিত্য নতুন বান্ধবী জোটানোর খবর কানে আসে সোহার। ওর ছোট ভাই অপু পর্যন্ত একদিন কোথায় নাকি আরিফকে কার সাথে দেখেছে। অপুর কষ্ট হয়েছিল, সোহাকে বলার সময় কেঁদে ফেলেছিল। সোহার কষ্ট হয়নি। বিরক্ত লাগছিল খুব। আরিফ আবার কাকে বোকা বানাচ্ছে, কার বারোটা বাজাচ্ছে, এটা ভেবে বিরক্ত লাগছিল। একবারও কিন্তু মনে ঈর্ষা জাগেনি, অথচ ওটাই স্বাভাবিক ছিল। হয়তো ছিল। এখন কিছুই স্বাভাবিক নয়। দোলা নামের অদেখা একটি মেয়ের সর্বনাশ আরিফের স্ত্রী হিসেবে সোহা নিজের শরীরে-মনে নিয়ে ফেলেছে। যদি কখনো দোলার সাথে দেখা হ’ত, সোহা যদি দোলার পা দু’টো ওর বুকে নিয়ে ক্ষমা চাইতে পারত, তাহলে বোধহয় আবার সব স্বাভাবিক হতে পারত। আবার হয়তো ওর মনটা জেগে উঠত। আবার হয়তো ও আরিফের হাত ধরতে পারত। কিন্তু, সে তো হবার নয়। দোলার খবর আরিফ নিজেও জানে না। সোহার শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। আরিফ কখনো দোলার খবর জানতেও চায়নি। এই অমানুষটার সাথে সোহা ঘর করেছে, বিছানায় গেছে, ওর সন্তান গর্ভে নিতে চেয়েছে ভাবনাটা যতভার ওর মগজে ঠাঁই নেয়, ততবার ওর বমি বমি ভাব হয়। কিছু খেতে পারে না। দারুন অস্বস্তি নিয়ে গলার ভেতরে আঙ্গুল ঠেলে বমি করে এবং তারপর খানিকটা সুস্থির হয়।
আরিফ এখন সোহার একটি অসুখের নাম। এই অসুখের হাত থেকে রেহাই পেতেই ওর মনটা মরে গেছে। ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় ও ভাল থাকতে চায়। অফিস করে। শপিং করে। ভর দুপুরে গনগনে রোদে হাঁটে। এরকম এক দিন, ঘেমে নেয়ে ওঠা সোহার সাথে পরিচয় হয়েছিল আফতাবের। আকাশের সূর্যটা যেন নেমে এসেছিল ওর সামনে। কী তার তেজ!
কি কাজে আফতাব ওর অফিসে এসেছিল, তা জানা হয়নি। তবে, দুপুরের লাঞ্চের সময় অফিসের ক্যান্টিনে খেতে বসা সোহা কেঁপে উঠেছিল একটু দূরে বসা অপরিচিত এক মানুষের প্রাণখোলা হা হা হাসি শুনে। পুরো পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেল। সবার মনের ভেতরের পাখিটা যেন এক লাফে ডানা মেলে বেরিয়ে এল। এক্ষুণি উড়তে শুরু করবে।
সোহার মতো অবস্থা আর কারোর হয়েছিল কি না, তা-ও জানা হয়নি। জানার উপায়ও ছিল না। তবে সোহার মুখভর্তি খাবার মুখেই আটকে থাকল, সোহা নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল সেই হাসির দিকে। যেন পুরোপুরি দেখে নিতে হবে, চোখের মনিতে আটকে নিতে হবে দুর্লভ হাসিটুকু। সোহার ঐ অবস্থা দেখে হাসি থামানো মানুষটা আবারো হাসতে শুরু করে। তার হাসি দেখে লজ্জা পায় সোহা। আর মানুষটার সাথে থাকা সোহার কলিগ রেহমান পেছন ফিরে বলে, এ একটা আস্ত পাগল! আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
রেহমানের বন্ধু আফতাব। সোহার সাথে পরিচয় হ’ল। সোহা কিছুতেই নিজেকে ঠেকাতে পারল না। নিজে থেকেই ফোন করল আফতাবকে। মানুষ কি মানুষের সাথে মিশবে না, এই যুক্তি দেখিয়ে আফতাবের সাথে কথা বলতে চাইত, আসলে আফতাবের হাসি শুনতে চাওয়াটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। একটা বয়সে নারী পুরুষের আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করে, আর সোহা সে বয়সটা পার হয়ে এসেছে বলে পুরুষকে আমন্ত্রণ জানাতেই পারে, এই যুক্তি দেখিয়ে বিয়ে-টিয়ে নয়, ও সোজা বলে বসল, আমি তোমার সন্তানের মা হতে চাই।
সোহা আসলে এমন একটি সন্তানের মা হতে চাইছিল, যে আফতাবের মতো হা হা করে হাসতে পারে।
সোহার কথা শুনে আফতাব হেসেছিল। হা হা হাসি। তারপর যা বলেছিল, তা আর মনে করতে চায় না সোহা। আফতাব মেয়েদের প্রতি কখনোই আকর্ষন বোধ করে না। আফতাব ভালবাসে যাকে, সে মেয়ে নয়। আর এই ভালবাসাবাসিতে সন্তানের কোন উপস্থিতির সম্ভাবনা নেই, কেননা সব ভালবাসার শেষ পরিণতি সন্তান নয়।
সোহা কাঁদেনি। কেন যেন ওর হাসি পেয়েছিল খুব। ওকে নিয়ে এমন এক খেলা চলছে, যার কোন তল নেই, এমনি মনে হয়েছিল ওর। আর সেই খেলার নিষ্ঠুরতা ওকে হাসিয়ে দিল। অথচ ওর কান্নার প্রয়োজন ছিল খুব।
সোহা কাঁদেনি।
তবে স্রেফ বন্ধু হয়ে থাকা আফতাবের সাথে এক দিন ওকে দেখে ফেলেছিল আরিফ। আফতাবের প্রতি ওর আর কোন আকর্ষণ ছিল না, স্রেফ আফতাবের মনের অলিগলি সম্বন্ধে এক ধরণের কৌতুহল রয়ে গেল বলে দেখাটেখা হলে কথা হ’ত, আড্ডাও হ’ত। আফতাব সোহার মতো আকর্ষণহীন এক নারীর সাথে এমনভাবে গল্প করত, বন্ধুরা বন্ধুর সাথে যেমন করে সেভাবে। বন্ধুর সাথে নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে কথা বলা যায়, আফতাব বলতেও চেয়েছিল, ডিটেইলস-এ যেতে পারেনি সোহা নিজেই। ওর গা গুলিয়ে উঠেছিল বলে থাক্ থাক্ করে থামিয়ে দিলে আফতাব অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল।
আফতাবের সাথে সোহাকে দেখে আরিফ অবাক হয়ে তাকাতে পারেনি, ও তাকিয়েছিল বিস্ময় নিয়ে। ওর বুকের ভেতরে মোটা দাগে বসে যাচ্ছিল ছুরির ফলা, চোখ জ্বলছিল খুব। চিৎকার করে সোহাকে ডেকে গালাগাল করতে চেয়েছিল, মুখ হা হয়েছিল তবে কোন আওয়াজ বের করতে পারেনি গলা থেকে। বুকটা বাতাসশূন্য হয়ে গেল বলে আরিফের আর্তনাদ বেরই হতে পারল না। তবে দু’দিন পর সামলে নেওয়া আরিফ সোহার অফিসে গিয়ে সোজা সোহার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিল, তুমি আসলে কি চাও?
সোহা ক্লান্ত চোখে আরিফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটার উত্তর নিয়ে ভাবছিল। ওর দৃষ্টি আরিফকে আরো রক্তাক্ত করে তুলেছিল। সোহার হাত ধরে উঠিয়ে দিয়েছিল চেয়ার থেকে। সোহা বিরক্ত ভঙ্গিতে আরিফের হাত সরিয়ে হাঁটল, ক্যান্টিনের পাশে খোলা বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তরটাকে উড়িয়ে দিল আকাশেই। বলল, আমি আমাকে চাই। কেবল আমাকে।
আরিফ দু’দিন আগে গালি দিতে পারেনি, তাতে কি? সেদিন পুষিয়ে দিল। চিবিয়ে চিবিয়ে গালির ঝর্ণা বইয়ে দিয়ে বলল, পেটে কি টুলেট লাগিয়েছ তুমি?
সোহা থু করে থুতু ছিটিয়ে দিলেও থামেনি আরিফ। প্রশ্ন করে, নতুন মরদ জুটেছে, না? ওর সন্তান নেবে তুমি?
সোহা হাহাকারের কান্না ওড়না দিয়ে থামিয়ে দিয়ে গোঁয়ারের মতো বলে, নেব!
সোহা এরপর ছুটে পালিয়ে যায় আরিফের সামনে থেকে। খুব ভাল হ’ত, আরিফের সাথে আর যদি ওর দেখা না হ’ত! এই চিন্তা সোহাকে আত্মহত্যার সম্ভাবনার ভেতর পাক খাওয়াতে থাকে বেশ কিছু দিন। এক সময় আত্মহত্যা কাজটি ওর কাছে খুব সহজ মনে হতে থাকে। এক সময় আত্মহত্যার সব আয়োজন যখন সম্পন্ন করে ফেলে, তখন গোঁয়ারের মতোই নিজেই নিজের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, আমার যা খুশি আমি করব। তবু মরব কেন? কার জন্য মরব? আরিফের সামনে না দাঁড়ানোর যন্ত্রণাকে ভয় পেয়ে আমি আমার সুন্দর জীবনটাকে কেন ধ্বংস করব? আরিফের সামনে দাঁড়ানোর আনন্দ সৃষ্টি করতেই বেঁচে থাকব আমি।
খুব সহজেই নিজেকে নিজে শুনিয়ে দিয়ে ভাবনায় পড়ে সোহা। আরিফের সামনে গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়ানোর আনন্দ সৃষ্টি করতে চায় ও। কিন্তু কিভাবে?

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব আটধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব দশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *