সায়েন্স ফিকশন

ধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব তিন

কাল কেন ছিল?
লরা আর আশফাক মুখোমুখি বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আকাঙ্খা ফার্টেলিটি সেন্টার ওরা দুই বন্ধু মিলেই গড়ে তুলেছিল, অথচ ব্যস্ততার জন্য এখন দিনের পর দিন কথা হয় না, দেখা হয় না। শুধু মাঝে মাঝে মাস দু’মাস পর ছুটির দিনে কখনো কখনো আশফাক, কখনো লরাই নেমšতন্ন করে পরস্পরকে। চলে আসে এখানে। স্টুডেন্ট লাইফে এই জায়গাটাই ওদের সবার পছন্দের ছিল। এই রে এতোরাতে চুপিচুপি কথা বলতে হবে, এমন বিধি নিষেধ নেই বলেই এত ভাল লাগে।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে লরা প্রশ্ন করে, এ্যাশ, ড. বেঞ্জামিনের নাম শুনেছিস্ ? বেঞ্জামিন হল। নিউলাইফ বায়োসায়েন্স নামের একটি বায়োটেক কোম্পানির সিইও এবং য়্যুনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মেডিসিন, সোসাইটি ও টেকনোলজি বিষয়ক প্রোগ্রামের পরিচালক। শুনেছিস্ ?
বছর দুই আগে আমেরিকায় এক সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম। আর্টিফিসিয়াল ফার্টিলিটি এন্ড আনইউজুয়াল প্রব্লেমস ইন ব্লা ব্লা ব্লা…বিশাল একটা শিরোনাম ছিল। ড. বেঞ্জামিন এসেছিলেন অতিথি বক্তা হয়ে। ছোটখাট লোকটার কণ্ঠস্বর দারুন। টিভি-সিনেমার অভিনেতাদেরও এত ভাল, এত ভরাট কণ্ঠ হয় না। হলরুম গমগম করছিল। ভাললাগা নিয়েই কথাগুলো বলে আশফাক।
বলেন ভাল। খুব গুছিয়ে বলেন, স্পষ্ট উচ্চারণ। শুনতে বেশ লাগে।
তুই শুনলি কোথায়? ডেট করেছিলি নাকি?
আশফাক হাল্কা মুডে কথাটা বললেও স্পষ্ট দেখতে পায় লরার গাল লাল হয়ে গেছে। বলে, উনি যদি চাইতেন তাহলে আমি অবশ্যই করতাম। ডিসকভারি চ্যানেলে একটা প্রোগ্রামে এসেছিলেন, তখন শুনলাম উনার কথা। দুর্ভাগ্য আমার, উনি আমাকে কখনো দেখেননি, দেখে পাগলও হননি। ইন ফ্যাক্ট, আমাকে দেখে কেউই কখনো পাগল হয়নি, হওয়ার কথাও না।
খুব সিরিয়াসলি জানতে চায় আশফাক, কেন জানতে চায় নিজেও ঠিক জানে না। বলে, তুই কি চাস্, কেউ তোকে দেখে পাগল হোক্?
উম্ম…! লরা ভাবছে।
চাস্ কি না বল্।
চাইলে কি হবে ?
আমি তোকে দেখে পাগল হব।
তুই !
লরার মতো বিস্মিত আশফাক নিজেও, এরকম হাল্কা কথাবার্তা ও আগে কখনো বলেনি। লরার চোখের দিকে ভালভাবে তাকিয়ে আশফাক বলে, ছোট বোনটা প্রেম করে মরেছিল। সেই থেকে প্রেমে আমার এলার্জি। কিন্তু এখন, পৃথিবী থেকে যখন নারী-পুরুষের প্রেম বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তখন আমার ভেতরে আমি প্রেম টের পাচ্ছি।
লরা ঠান্ডা হয়ে বলল, প্রেমের টেস্ট নিতে চাইছিস্? খেয়ে দেখি না কেমন লাগে, তাই না ?
আশফাক ওর কথার জবাব না দিয়ে বলল, তুই যদি রিফিউজ করিস্…
সেটাও বেটার। প্রেমের টেস্ট, প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার টেস্ট সব পেয়ে যাবি। আনন্দে আমার তো হাততালি দিতে হচ্ছে। দিই?
লরার দুহাত হাততালির ভঙ্গিতে জড়ো হতেই আশফাকের মনে হয় ওর হাতের ভেতরে পুরে নেবে ও দুটো। ঠিক তাই, আশফাক লরার হাত নিজের হাতের ভেতরে পুরে নেয়।
নারী অধরা হতে চাইছে বলেই তাকে ধরার জন্য উতলা হয়েছ। লরা মন খারাপ করে বলে, সেকেন্ড ইয়ারে আমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল মনে আছে?
এক গাদা ঘুমের ঔষুধ খেয়েছিলি।
কেন, জানিস্? প্রেমে পড়েছিলাম। যে গাধাটার প্রেমে পড়েছিলাম, সে কিছু বোঝেনি। আমি কেন তাকে বলতে পারি না আমার কি হয়, এই দুঃখে আমি মরতে চেয়েছিলাম।
তারপর?
দেখলাম গাধাটা এরপরও বুঝল না।
তখন?
প্রেমের স্বাদ ভুলে গেলাম। মরাটরা বাদ দিয়ে বেঁচে থাকা শুরু করলাম।
আশফাক লরার হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে খুব শক্তভাবে বলল, আমি তোমার জন্য মরব। যদি তুমি ফিরিয়ে দাও। প্রমিজ।
লরা হেসে দেয় কান্ড দেখে। বলে, গাধা!
একটু পর। দুজন পাশাপাশি হাঁটছিল। লরা দুহাত বুকের উপর আড়াআড়ি বেঁধে তাকায় আশফাকের দিকে। বলে, আমি কার জন্য মরতে চেয়েছিলাম, তুমি কখনো জানতে চাওনি।
আশফাক পায়ের নিচে পড়া সফট ড্রিংক্স-এর বোতল দূরের ঘাসের বুকে উড়িয়ে দিয়ে তাকায় আকাশের দিকে। রাতের আকাশে তারার মেলা বসেছে। সাবিনা, ওর ছোট বোনটা এবং আরিফের প্রতারিত প্রেমিকা দোলা ঐ আকাশের তারা হয়ে জ্বলছে কি? আশফাক সাবিনার মুখটা দেখতে চায় আকাশে। ওদিকে লরা বিষণœ উচ্চারণে বিড়বিড় করে বলে, তুমি কখনো জানতে চাওনি। বন্ধু হিসেবে জানতে চাওয়াটাই কি স্বাভাবিক ছিল না?
আমি জানতাম।
আশফাকের কথা শুনে থেমে যায় লরা।
হু।
ও !
আশফাক জানত লরা তাকেই ভালবাসে। জেনেও কোন দুঃখবোধ কিংবা মমতা কিংবা সহানুভূতি কিংবা এরকম কোন আবেগ ও দেখায়নি লরার জন্য। তার মানে লরার কষ্টে ওর কিছু এসে যায়নি? অথচ এত বছর পর সবকিছু যখন চুকেবুকে গেছে, তখন সেই আশফাক, যার জন্য লরা মরতে চেয়েছিল, সে নতজানু হয়েছে লরারই সামনে? মানেটা কি এ সবের?
লরা ঘাড় শক্ত করে তাকায় আশফাকের দিকে। কঠিন গলায় বলে, যখন ভালবেসেছিলাম, তখন তোমার সময় হয়নি ভালবাসার। এখন সময় হয়েছে? ভেবেছটা কি? তুমি যখন চাইবে, তখনই হবে সবকিছু?
আশফাক লরার হাত ধরতে গেলে ও ছিটকে সরে যায়। তবুও এগিয়ে আসে আশফাক। বলে, তুই যেদিন মরতে চাইলি, তার ঠিক এক দিন আগে আমার ছোট বোনটা মরে গেল। ওর লাশ পড়ে আছে মর্গে, আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি সেই কালপ্রিটকে। হোস্টেলে, য়্যুনিভার্সিটিতে, যেখানে যত ঠিকানা জানা ছিল, খুঁজছি আর খুঁজছি। শয়তানটাকে মেরে ফেলার জন্য খুুঁজছি। কোথাও পাওয়া গেল না। ওদের বাড়িতে গেলাম। সে কী অপমান ! শয়তানটার মা পর্যšত তেড়ে এসে বলল, তোমার বোনই খারাপ, চরিত্রহীনা। আমার সাবিনা, আমার সাবিনা নাকি খারাপ। চরিত্রহীনা।
আশফাক বসে পড়ে ঘাসের উপর। ওর গাল ভিজে গেছে, ভেজা গালে তারারা আলো ছিটাচ্ছে – নরম আলো। লরা আশফাকের পাশে বসে ওর গালে হাত রাখে, হাতটাকে তারার আলোয় ভেজাতে চায়। আশফাকের চোখের পানিতেই বরং ভিজে গেল হাত।
কুকুরটা ভারতে পালিয়েছিল বলে খবর পেলাম। আমি ওটাকে তাড়া করব, ডিসিশানও নিয়েছিলাম। মা আমাকে জাপটে ধরে বললেন, মেয়েটাকে হারিয়েছি, তোকে হারালে আমার আর কি থাকবে? আমি আমার মায়ের আন্ধার ঘরের মানিক হয়ে জ্বলতে লাগলাম। মায়ের চাপাচাপিতেই ফিরে এলাম মেডিকেলে। শুনলাম, তুই মরতে বসেছিলি। আমার খুব আশ্চর্য লেগেছিল ব্যাপারটা। সাবিনা কালপ্রিটটার ভালবাসার ভার সহ্য করতে না পেরে মরল। আর তুই তোর নিজের ভালবাসার ভার সহ্য করতে না পেরে মরতে গেলি।
বাবা-মা-ভাই সবাই বারবার জানতে চাইত, লরা কোন্ দুঃখে মরতে গিয়েছিল? ও কিছু বলেনি। মা বারবার প্রশ্ন করত, তুই কি কাউকে ভালবাসিস্? বাবা বলত, কাকে ভালবাসিস্ বল্ মা, আমি যেভাবে পারি ওকে তোর করে দেব। ও বলেনি আশফাকের কথা। বলে কি লাভ? কোথায় আশফাক? হাসপাতালে শুয়ে আশফাকের অপেক্ষায় থাকত লরা। আশফাকের খবর কেউ দিতে পারে না। বন্ধুদের কেউ-ই জানে না আশফাক কোথায় উবে গেছে। সিমি একটু সন্দেহ করেছিল আশফাকের ব্যাপারে। লরাকে প্রশ্ন করেছিল, এ্যাশের সাথে ভজঘট বেঁধেছিল নাকি? আগে তো কিছুই টের পাইনি। কিন্তু তুই মরছিলি আর এ্যাশও ঠিক তখনি উধাও ! হ্যাভ য়্যু সেক্স উইথ হিম? নাও ইন ট্রাউবল? ডাক্তার হয়ে কিভাবে আনসেফ সেক্স এলাউ করলি বুঝলাম না।
তুই থামবি?
লরার রাগে ফেটে পড়া চেহারা দেখে সিমির কথাবার্তা থেমে গেছিল। ও শুধু নরম গলায় জানতে চাইল, তাহলে তুই মরতে চাস্ কার জন্য?
মা-ও প্রশ্ন করেন, কার জন্য মরতে চাস্?
আমার জন্য। আমার নিজের জন্যই আমি মরতে চাই।
কেউ বুঝতে পারে না ওর কথা। লরা তখন হাসিতে ভেঙ্গেচুরে বলে, এই যে আমার নাকটা বোঁচা, গায়ের রং কাল, চুলটা আউলাঝাউলা- এসব কিছুই আমার পছন্দ হয় না। তাই মরতে চেয়েছিলাম। ইন ফ্যাক্ট আই ওয়ান্ট টু গিভ গড এনাদার চা›স টু মেক মি বেটার। না মরলে তো তিনি আবার আমাকে নতুন করে বানাতে পারবেন না। হা হা হা।
আশফাক বলছে, তোর শুকিয়ে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখখানা দেখে বুকের ভেতরে মোচড় দিয়েছিল। বন্ধুর জন্য কষ্ট টের পেয়েছিলাম, কিন্তু জানিস্, ভালবাসা টের পাইনি। খুব চেষ্টা করেছি, তোর জন্য আমার ভেতরে ভালবাসা আনতে। পারিনি। মিথ্যেমিথ্যি ভালবাসার ভান করে তোর কষ্ট কমাতে পারতাম। তাহলে তো সাবিনার খুনীটার সাথে আমার কোন পার্থক্য থাকত না।
এ্যাশ্, চল্ আমরা অন্য কিছু নিয়ে গল্প করি।
লরা, আমি এখন সত্যিই আমার ভেতরে ভালবাসা টের পাচ্ছি।
সেটা তোর ব্যাপার।’
তুই? তুই আমাকে ভালবাসিস্ !
বাসতাম। এখন, সত্যি বলছি, আমার ভেতরে আমি আর ভালবাসা টের পাই না।
আশফাক তিক্ত হাসি হেসে বলে, যখন আমার জোয়ার এল, তখন তোমার নৌকা নাই…একটা গান শুনেছিলাম। এ দেখি সেরকম ব্যাপার।
কী করব বল্? তুই কি চাস্, আমি তোর সাথে ভালবাসার অভিনয় করি?
না। আমি সত্যিকারের ভালবাসা চাই।
কাজেই, বাদ দে।
আশফাক আর কিছু বলতে পারে না। লরা এগিয়ে যাচ্ছে। ও ঘাসের উপর বসে বসে লরার এগিয়ে যাওয়া দেখছে। একটু পর লরা থেমে বলে, ঊনচল্লিশ বছর না হ’ল তোর? উনিশ বছরের ছোকরার মত ক্রাশড হলে মানায়? চল্, বাড়ি চল্।
আশফাক আরেকবার আকাশের তারাগুলো দেখে উঠে পড়ে। লরার সাথে সাথে এগুচ্ছে এখন।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস //এক্স-পেরিমেন্ট// নাসরীন মুস্তাফা//পর্ব দুইধারাবাহিক উপন্যাস // এক্স-পেরিমেন্ট // নাসরীন মুস্তাফা // পর্ব চার >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *