উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব তিন


ডাক্তারের কাছে।

যাও। তােমার আব্বা কতাে নম্বর কেবিনে?

দুই শত দশ নম্বর কেবিনে।

ঠিক আছে। আমি পরে তােমার আব্বার সাথে দেখা করবাে।

স্যার!

বলাে।

আপনি হসপাতালে কেন?

আমার চাচা, যিনি জুট মিলে চাকরি করতেন, উনি অসুস্থ। খবর পেয়ে দেখতে এসেছি।

এখন উনি কেমন আছেন?

অনেকটা ভালাে। দু’এক দিনের মধ্যে আমরা চলে যাবাে।

স্যার, আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা ছিল।

ঠিক আছে। একদিন শুনবাে।

হাবীব গিয়েছিল কামরুজ্জামান মােল্লাকে দেখতে। ইস, লােকটার দিকে তাকানাে যায় না। তাগড়া স্বাস্থ্য শুকিয়ে আমচুর। অসহায় ঘােলাটে চোখ। কথা বলেন অস্পষ্ট। ওকে দেখে খুশি হয়েছেন। হাত ইশারায় পাশে বসতে বললেন। বসে হাবীব। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছেন। তারপর একসময় ঘুমিয়ে গেছেন। প্রমিলাই সেবাযত্ন করে।

স্যার?

বলাে প্রমিলা।

আপনি আমার ওপর রাগ করেছেন?

ওরা দু’জন বিকেলের ম্লান আলােতে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। লােকজন তেমন একটা নেই। দূরে ভৈরব নদীতে সাম্পান, মাছ ধরা ট্রলার ভাসে। সঙ্গে নৌকাও আছে।

ছিল, এখন নেই।

কেন?

তুমি অযথা একটা ভুল করেছিলে। তখন কষ্ট হয়েছিল। এখন সেই কষ্টটা নেই। আমার ধারণা, তুমিও তােমার ভুল বুঝতে পেরেছিলে। ভুলকে ভুলে যাওয়াটাই ভালাে।

জানেন, আপনি চলে যাওয়ার পর আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি।

কেন?

ক্ষমা চাওয়ার জন্য। আমি তখন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বারবার আপনিআমাকে অস্বীকার করছেন। আব্বাকে বলে আমি তার প্রতিশােধ নিতে চাইলাম।

প্রমিলা─ থাক, আর বলতে হবে না।

না, স্যার। আমাকে বলতে দিন। নইলে আমি শান্তি পাবাে না।

প্রমিলার চোখে পানি। হাবীব অপলক তাকিয়ে দেখে। নদীর স্রোতের মতাে মেয়েটা শান্ত; কিন্তু চলমান। অকারণে একটা ব্যথ্য বহন করে চলেছে। মানুষ যেমন অন্যায় করতে পারে আবার ক্ষমাও করতে পারে। এই মুহূর্তে প্রমিলাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে হাবীবের। আবেগ গোখরো সাপের ফণা তােলে হৃৎপিণ্ডে। লাগাম টেনে ধরে হাবীব। যা গেছে, যাক। দুঃখ করার প্রয়ােজন নেই। আগামীদিন এর চেয়েও উজ্জ্বল। শুধু জীবনে জটিলতা বাড়ানো কেন?

যে গল্প শেষ হয়েছে সে গল্প শুনে কী লাভ? তার চেয়ে বলাে তােমার

পড়াশোনার খবর কী?

আপনি চলে যাওয়ার পর আমার আর লেখাপড়া হয়নি।

বলাে কি! বিস্মিত হাবীব।

জী, স্যার। সারাটা সময় আমি অপরাধে ভুগতাম। ভাবতাম আমার নিজস্ব খামখেয়ালির জন্য আপনার মতাে একজন অসাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। যদি আপনার ঠিকানা জানতাম─ গ্রামে চলে যেতাম। আব্বা অবশ্য অনেক টিচার রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি পড়িনি। কায়সার পড়েছে। পড়াশােনার প্রতি আমার বিরক্তি এসেছে। আব্বার আশা আমি পূরণ করতে পারিনি। এ দুঃখ আমার কম নয়।

ঘড়ির দিকে তাকায় হাবীব─ প্রমিলা, সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। এখনই চাচার কাছে ডাক্তার আসবে। আমি যতদূর জানি─ ডাক্তার এলেই চাচাকে নিয়ে বাসায় যাবাে। আগামীকাল ঢাকায় যেতে হবে। আমার ক্লাস চলছে। ভাবিনি তােমার সাথে এভাবে দেখা হবে। তবুও হয়ে খুব ভালাে লাগলাে। আমি তােমার সাফল্য কামনা করি।

সামনে পা বাড়ায় হাবীব।

স্যার? ব্যাকুল হাহাকার প্রমিলার কণ্ঠে।

থমকে দাঁড়ায় হাবীব─ বলাে।

আর একটু থাকুন স্যার।

কেন?

আমার আরাে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে আপনাকে।

সেই না বলা কথাগুলো জমা থাক তোমার কাছে। আর সত্যি আমার কাছে সময় নেই।

আমাদের কী আর কখনও দেখা হবে না? আকুল আগ্রহ প্রমিলার কণ্ঠে।

কি জানি! হবে─ হয়তো হবে না। আজকে যেমন দেখা হলো হাসপাতালের সিঁড়িত, সেরকমভাবে একনি দেখা হতে পারে ট্রেনের কোনো কম্পার্টমেন্টে, নয়তো বাসে। অথবা রৌদ্র ছড়ানো কোন পথে, তখন আবার আমরা কথা বলবো। তোমার কাছে জমা রেখে যাওয়া কথাগুলো আমি গভীর আগ্রহে কুড়িয়ে নেবো সেদিন। কেমন?

স্যার─ প্রমিলার কণ্ঠস্বর বুঝতে পারে হাবীব। মেয়েটা অনেক কষ্ট বুকের উত্তাল কান্নাকে দমানাের চেষ্টা করছে। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে একটা বাজে দৃশ্যের সৃষ্টি হবে।

তাহলে তােমার সঙ্গে এই কথাই রইলো। আসি!

হাবীব দ্রুত─ লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায়। যতাে তাড়াতাড়ি সম্ভব চোখের আড়ালে যেতে চায়। বুঝতে পারে প্রমিলা জলভরা চোখ নিয়ে ওর পেছনে তাকিয়ে আছে। থাক, তাকিয়েই থাক।

বিকেল পাঁচটা।

হাবীব দাঁড়ানো মােহসীনদের বাসার সামনে। গত তিন দিন হাবীব নিজের উপর অমানুষিক অবদমনের অত্যাচার করছে রাত-দিন, সকাল-বিকাল, সন্ধ্যা যেখানে যেভাবেই থাকুক চোখের মায়াবি-পর্দায় কেবল মালবিকা হককে দেখতে পায়। নিজের গালে নিজে থাপ্পড় দিয়েছে — ছিঃ আহসানুল হাবীব। অন্যায়! মারাত্মক অন্যায়!! বন্ধুর বােন নয়─মা, পরম পূজনীয়। তাকে নিয়ে ওভাবে ভাবতে নেই।

কে শােনে কার কথা, শরীরের গহিন সোপানে মালবিকা হক স্থায়ীভাবে খােদিত হয়ে গেছে। কোনােভাবে হাবীব তাকে মুছতে পারছে না। গত রাতে একটুও ঘুমায়নি। ঘুম আসেনি চোখের পাতায়। ভেবেছে। অজস্রভাবে ভেবছে। কীভাবে মুক্তি পাবে এই অসহ্য পরিস্থিতি থেকে? শেষ রাতে হঠাৎ মনে এসেছে, যদি মালবিকা হকের কাছে সবকিছু স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে হয়তাে মন, শরীর এবং যৌবনের দরজায় অপ্রতিরোধ্য প্লাবনের প্রাপ্ত কোনাে প্রতিবােধ গড়ে উঠবে। সেইভাবে সারাদিন মনে মনে নানাভাবে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে মালবিকা হকের কাছে। মােহসীন আজও ক্লাসে যায়নি। নিশ্চয়ই আসেনিই মামা বাড়ি থেকে। এই সুত্রটাই সে ব্যবহার করবে। দ্বিধায় দাঁড়িয়ে আহসানুল হাবীব কলংবেলে হাত রাখে। ও ভেতরের কেউ ওকে কলিংবেল টিপতে নিষেধ করেছে। কিন্ত কামনায় শিখা ওকে বেল টিপতে প্রেরণা জোগায়। কলিংবেলে চাপ দেয়া হাবীব।

প্রায় মিনিটখানেক পর দরজা খুলে যায়। পুরাে দরজাজুড়ে মালবিকা হক। আলুথালু শাড়ি। চোখে ক্লান্তিকর ঘুম। কপাল কুঁচকানাে। কাঁপছে শুষ্ক ঠোট দুটো।

ওকে দেখে অমায়িক হাসলেন–এসাে।

যন্ত্রচালিতের মতাে হাবীব ভেতরে ঢােকে। দরজা বন্ধ করেন মালবিকা। সামনে হাবীব। পেছনে মালবিকা। দু’জনে ঢােকে ড্রয়িংরুমে। বসে সোফায় দু’জন পাশাপাশি।

আপনাকে কেমন যেন লাগছে? প্রশ্ন করে হাবীব।

ও কিছু না। বলাে তুমি কেমন ছিলে?

আমি?

হ্যাঁ।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে হাবীব। বুকটা ধুক ধুক করছে। কী বলবে সে? মুখ জিহ্বা শুকিয়ে গেছে। অনেক অনেক কথা হাবীব ভেবে এসেছিল । হাত- পা কাঁপছে তার। কিন্তু এখন সে কোনাে কথা খুঁজে পায় না।

আমি এক গ্লাস পানি─কোনােভাবে উচ্চারণ করে হাবীব।

পানি খাবে? বসাে তুমি─আমি নিয়ে আসছি।

মালবিকা হক উঠে চলে যান। হাবীবের একবার ইচ্ছে হয়, এই ফাঁকে দরজা খুলে সে চলে যায়। পালিয়ে যাবে মালবিকা হকের পৃথিবী থেকে। মালবিকা হক একদিনেই তার অস্তিত্বের শিকড় ধরে টান দিয়েছেন। দূরে, দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে। যেখানে মালবিকা হকের মুখােমুখি হতে হবে না। তার চোখের দিকে তাকালে হাবীব তলিয়ে যায় অতলে। নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না । কী এক আশ্চর্য সম্মােহনী আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য! উঠে দাঁড়ায় হাবীব। সময় থাকতে থাকতেই তাকে পালাতে হবে। মালবিকা হকের অমােঘ আকর্ষণের নাগপাশ থেকে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব দুইউপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার ।। চার >>

One thought on “উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব তিন

  • জুলাই ১৯, ২০২১ at ১১:২১ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    গল্পের উপমা ও কল্পচিত্র অপূর্ব
    খুব ভালো লাগল গল্পটি ভাইয়া
    শুভ কামনা রইল।

    Reply

Leave a Reply to Habiba Begum Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *