উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব এক

চব্বিশ বছরের যুবক আহসানুল হাবীব জীবনে প্রথম যে নারীর মধ্যে যৌবনের গন্ধ
এবং স্বাদ পেলাে, পেলাে বুকের দুই আলতাে কবুতরের মাঝে নাক ডুবিয়ে বকুল
কুড়ানাের মর্মরিত সুখ আর বর্ণনাতীত রােমাঞ্চ— সেই নারীর বয়স আটচল্লিশ। তিনি
মালবিকা হক। তার চমৎকার দোহারা গড়ন। নিকষিত টাটকা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ তার
শরীরের রঙ। যে কেউ মালবিকা হকের সঠিক বয়স না জানালে বিভ্রান্তির মায়াজালে
আটকা পড়বে। অলৌকিক এক সাধনায় শরীরের বাঁধন, সৌন্দর্যের টানটান রূপরেখা,
চোখের তীব্র কটাক্ষ ধরে রেখেছেন। সবটুকু মিলিয়ে চেহারায় প্রখর আভিজাত্য আর
সার্বভৌম শ্রদ্ধার পলল দেখে দূরের মানুষেরা ছটফট করে, দগ্ধ হয়,
পুড়ে পুড়ে ছাই হয়। কাছে যাবার প্রবল লােভ জাগে কিন্তু সাহস পায় না।

বছর দুয়েক আগে ফুল কুড়ানাের এক ফাগুনের বিকেল।

আরামবাগের প্রধান সড়কের চব্বিশ নম্বর বাড়িটার তিন তলায় ডান পাশের
কলিংবেলে টিপ দিয়ে অপেক্ষায় থাকে হাবীব। বাসা খোজা একটা বিড়ম্বনা। চেনা
থাকলে ভালাে লাগে। হাবীব প্রায় আধঘণ্টা ধরে বাসাটা খুঁজছে। ঢাকা শহরের
বাড়ির নম্বরগুলাে নিয়ে চলছে একটা তােঘলগী কাণ্ড। রাস্তার মাথায় যদি পঁচিশ নম্বর
বাড়িটা থাকে, পরের ছাব্বিশ নম্বর পাওয়া যাবে অনেক দূরে। অন্য গলিতে। এক
অদ্ভুত গােলক ধাঁধার আসর আর কী! হাবীব অনেকটা বিরক্ত। যদিও স্থির
তার ধারণা— কষ্ট করে হলেও সে সঠিক বাড়িটা এবং নম্বর খুঁজে পেয়েছে এতােক্ষণে।
আরে বাবা, খুলছে না কেন? বাড়িতে কেউ নেই নাকি? দরজায় তাকিয়ে দেখে, লক
সিস্টেম, তালা নেই। ভেতর বা বাইরে থেকে চাবি দিয়ে বন্ধ করলেই হলাে। বাড়ির
দরজা বন্ধ করে সবাই বাইরে গেল নাকি? বিরক্তি বাড়ছে। তাহলে উপায়? প্রায়
মিনিট খানেক— ষাট সেকেন্ড পার হয়েছে। দরজার সামনে দাড়িয়ে বেল টিপে
অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্তকে দীর্ঘ রাস্তা পারাবার সমান মনে হয়। ফিরে যাবার জন্য
হাবীব পা বাড়ায়। হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আবার ডান হাত ওঠায় কলিংবেলে
চাপ দেয়ার জন্যে। ঠিক তখনই দরজা খুলে যায়। হাবীব হতচকিত। সামনে
দাঁড়ানাে একজন মহিলা। ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। চোখে মুখে ঘুমের মৌন
মুখােশ। চোখ দুটো তারার প্রকৃতি নিয়ে তাকিয়ে থাকে হাবীবের দিকে।
এটা মােহসীনদের বাসা? জিজ্ঞেস করে হাবীব।

হ্যা।
আপনি?

আমি ওর বন্ধু। ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, একসাথে।
আসুন, ভেতরে আসুন।
ও বাসায় নেই?
না।

তাহলে আমি যাই। পড়ে আসবাে।
কেন এসেছিলেন? মহিলা স্থির তাকিয়ে কথা বলছেন।
ওর কাছে আমার কিছু নােট ছিল।
ভেতরে আসুন— মহিলার কণ্ঠে একটা মাধুর্য ঢেউ খেলে যায় এবং দরজা থেকে
সরে দাঁড়িয়ে ওকে ভেতরে ঢােকার জন্য হাত ইশারা করে। হাবীব আর ভেতরে
প্রবেশ না করে পারে না। ভেতরে ঢুকে সামান্য লম্বা প্যাসেজ পার হয়ে দু’জনে ডান
দিকের কক্ষে ঢােকে। পেছনে হাবীব সামনে মহিলা। সুন্দর, রুচিসম্মতভাবে
সাজানাে ড্রইংরুম।

আপনি বসুন, আমি আসছি।

ভদ্রমহিলা চলে যান। হাবীব সােফায় বসে চারদিকে তাকায়। সাদা দেয়াল।
নিচে কার্পেট। দেয়ালে বেশ কয়েকটা পেইনটিং। দেখে চিনে ফেলেছে
হাবীব— পেইনটিংগুলাে কাইয়ুম চৌধুরীর। শােকেশে সাজানাে পাথরের শৌখিন
দ্রব্যাদি। ছােট একটা বইয়ের তাকও আছে। জনপ্রিয় ধারার নয়─ এমন কয়েকজন
মেধাবী লেখকের বইয়ে ঠাসা। বেশ ভালাে লাগলাে হাবীবের। গরম লাগছিল। উঠে
ফ্যানটা চালায়। মুহূর্তে বাতাসে ভরে যায় কক্ষটা। সামনের দেয়ালে রঙওঠা, জীর্ণ,
প্রায় অস্পষ্ট-একটা ছবি খুব যত্নের সাথে বাঁধানাে। হাবীব কাছে যায়। ছবির
মানুষটাকে চেনার চেষ্টা করে।

দাড়িয়ে কেন? বসুন।

চমকে পেছনে তাকায় হাবীব। মহিলা, এতক্ষণে মনে মনে একটা ধারণা
করেছে এই ভদ্রমহিলা মােহসীনের মা। তিনি নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

ছবির দিকে ইঙ্গিত করে হাবীব— ছবির এই অস্পষ্ট মানুষটা কে?
আপনার বন্ধু মােহসীনের বাবা।
আপনার?
অদ্ভুত সুন্দর হিরন্ময় হাসি ভদ্রমহিলার ঠোটে সেতার বাজায়─ আমার স্বামী।

কথা বলতে বলতে হাবীব সােফায় বসে। মােহসীনের মা’ও বসেন সামনের
সোফায়। পায়ে একজোড়া।সূতি মিহি টিয়ারঙ শাড়ি পরনে। মুখে সামান্য
প্রসাধন। নিষ্পাপ, সম্ভম জাগানাে মসৃণ মােলায়েম সিঙ্কের মুখ তার। নাটোরের না
দেখা বনলতা সেনের কাছ থেকে পাখির নীড়ের মতাে অদ্ভুত সবুজ জল পড়ে পাতা
নড়ে চোখ দু’টো ধার করেছেন তিনি — ভাবে হাবীব।

ওনার ছবিটা অতাে অস্পষ্ট কেন?
ছবিটা ভালােই ছিল। গত কয়েক বছরে কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেছে।
মানুষের জীবনই যেখানে অস্পষ্ট সেখানে ছবি তাে সামান্য!
মােহসীন কোথায়?
মােহসীন গেছে ওর মামা বাড়ি।
ও আচ্ছা। সাধারণত ও নিয়মিত ক্লাস করে। গত সাত আট দিন না দেখে
ভেবেছি, এরকমই একটা কিছু ঘটেছে।

তুমি─ মানে তােমাকে তুমি করেই বলছি।
জী, সেটাই তাে বলা উচিত।
মােহসীন তােমার কেমন বন্ধু?
মানে?
মুখে মৃদু হাসি মালবিকা হকে— না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ও খুব একরােখা
আর চাপা স্বভাবের মানুষ। ওর বন্ধুদের সংখ্যাও খুব কম। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি
হবার পর ওর খোঁজে তুমিই প্রথম এলে আমাদের বাসায়।

সেটা ঠিক। ও একটু চাপা। তবে মানুষ হিসেবে বেশ উদার।

ঠিকই বলেছে-কিন্তু মানুষ গভীরভাবে না মিশলে সেটা বুঝতে পারে না অথচ
দূর থেকে ভুল বুঝে ওকে। আচ্ছা তুমি বসাে, আমি দেখি ওর টেবিলে তােমার
নােটগুলি আছে কিনা। উঠে দাঁড়ান মালবিকা হক। পা বাড়ান সামনে। আবার ঘুরে
তাকান হাবীবের দিকে─ তােমার নামটা কিন্তু জানা হলাে না।

আমার নাম হাবীব। আহসানুল হাবীব।
ভালো নাম।

মালবিকা হক চলে গেলেন। হাবীব বসে বসে আবার ড্রয়িংরুমটা দেখে।
কিছুক্ষণ পর দরজায় এসে দাঁড়ান মালবিকা হক— এসো।

উঠে দাঁড়ায় হাবীব— কোথায়?

প্রথম বাসায় এলে, একটু চা খাবে না! নরম কণ্ঠস্বর মিষ্টি সুর তােলে। মালবিকা
হকের পেছনে পেছনে হাবীব ঢােকে ডাইনিংরুমে। মনে মনে স্বীকার না করে
পারলাে না হাবীব। ডাইনিং ঘরটাও রুচিসম্মতভাবে সাজানাে। অনেকটা মালবিকা
হকের মতােই। টেবিলে অনেক প্রকার খাবার। একটা পটের নল থেকে চায়ের
ধূমায়িত ধোঁয়া উড়ছে।

এতােসবের কী প্রয়ােজন?
কথা না বলে বসাে। যা ইচ্ছে খাও। কিছু না খেয়ে চলে গেছ— মােহসীন এসে
শুনলে আমাকে বকবে।

বসছি। আপনিও বসুন।

হ্যাঁ বসছি । আমি বিকেলে এ সময়ে এক কাপ চা খাই।
একটা বিস্কুট কামড় দিয়ে বলে হাবীব─ বাসায় আর কেউ নেই?
না।
একা থাকেন কী করে?
বাসায় আর কতটুকু সময় থাকি? অফিসে সারাদিন চলে যায়।
চাকরি করেন নাকি?
হ্যাঁ। সংসার চালাতে হবে না! সংসারের খরচ আছে না? মােহসীন পড়ছে─
কেন আংকেল?

মালবিকা হক চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আলতােভাবে কাপটা নামিয়ে রাখলেন
টেবিলে– তােমাকে মােহসীন কিছু বলেনি?

আসলে পারিবারিক বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে তেমন কোনাে আলাপ হয়নি।
মােহসীনের বয়স যখন দেড় বছর, আর ওর বােনের বয়স পাঁচ বছর তখন
ওদের বাবা, কামরুল হক মারা যান স্ট্রোক করে। হঠাৎ─
দুঃখিত─

না হাবীব, দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। মৃত্যু হচ্ছে একমাত্র শব্দ — যে শব্দ সত্যের
কেবল পৌষ পার্বণের পাতা ঝরার স্মৃতি। চারপাশে এতাে উৎসব, কলরব
আনন্দ — সবকিছুর মাঝে আমি একা — একদম একা একজন।
খারাপ লাগে না আপনার?
আলতো হাসি মালবিকা হকের উদাস মুখে─ না, অভ্যস্ত হয়ে গেছি এই
জীবনের সঙ্গে।

চা খাওয়া শেষ । দেয়াল ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা । মালবিকা হকের কথাগুলো।
কষ্টের আলপিন হয়ে গেঁথে যায় হাবীবের গভীরে। খুব খারাপ লাগে। আহা, মহিলা

জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন একা, সঙ্গোপনে, নীরবে। দুঃখের আনন্দের ভাগ
নেয়ার কেউ নেই। মনে পড়ে ওর নিজের মা-বাবাকে। গ্রামের মানুষ তারা। বয়স
হয়েছে। কিন্তু এখনও বাবা – মা সুখ – দুঃখের সমান অংশীদার । দুজনার মাঝে
ঝগড়া হয়। আবার মিলেও যায়। বাবা কেরামত আলি এখনও স্ত্রী আলামতারা
ছাড়া কিছুই বোঝেন না। বাবার একটু অসুখ হলে মা কী ছটফট করেন। নাওয়া
খাওয়া ভুলে যান। অথচ পরিপাটি সাজানাে গােছানাে জীবনের পেছনে কী বিষন্ন
বেদন দুকিয়ে আছে মােহসীনের মায়ের।

কী ভাবছে হাবীব?
ভাবছি! ভাবছি আপনারই কথা। এই একঘেয়ে জীবন কীভাবে কাটান?
মালবিকা হকের উজ্জ্বল মুখে শীর্ণ হাসির রেখা─ তুমি বসাে। আমি আসছি।

কিছুক্ষণ পরে এসে মালবিকা বলেন─ হাবীব, কোথাও তােমার নােট খুঁজে
পেলাম না। মােহসীন এলে আমি বলবাে তােমার কথা। তুমি এসেছিলে─
ও কবে আসবে?
হঠাৎ টেলিফোন পেয়ে চলে গেছে। ওর বড় মামার নাকি অসুখ। জানি না কবে
আসবে। হয়তাে আজকালের মধ্যেই।

উঠে দাঁড়ায় হাবীব। আজ আমি আসি। খুব ভালাে লাগলাে আপনার সাথে কথা বলে।
আমারও। তবে কী জানাে─ আমার অবাক লাগছে নিজের প্রতি।
কেন?
কামরুল মারা যাবার পর এই দীর্ঘ, সতেরাে-আঠারাে বছর বাইরের কারাে সঙ্গে
এতােক্ষণ ধরে কোনাে ব্যক্তিগত একান্ত কথা বলিনি। কেন তােমাকে দেখে আমার
অন্যরকম লাগলাে বুঝতে পারছি না। তুমি এসাে মাঝে-মধ্যে। হলে কী খাও-না
আসবাে।

মালবিকা হক সামনে। পেছনে হাঁটছে আহসানুল হাবীব। পাশাপাশি লম্বা কিন্তু
ছোট করিডাের ধরে দরজার দিকে যাচ্ছে তারা। হাবীব চমৎকার অপার্থিব একটি
মানবিক গন্ধ পাচ্ছে। নাক টেনে গন্ধটা বুরে গভীরে নিয়ে যেতে চায় সে। টানছে।
বুকটা ভরছে না।গন্ধের স্বাদ পারার জন্য বুকটা হাহাকার করছে। দরজার সামনে
দাড়াঁয় মালবিকা। নিজের হাতে দরজা খোলে। দু’জন তাকায় দু’জনের দিকে।
তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। হাবীব চোখ নামিয়ে নেয়। দরজা পার হয়ে সিঁড়িতে
এসে দাঁড়ায় হাবীব। মালবিকা হকের জন্য বুকটা তার কেমন করে উঠছে! দরজা
জুড়ে দাঁড়ানাে মালবিকা হক।

Series Navigationউপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব দুই >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *