উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব দুই

জানেন?
থামলে কেন?
বলে আমি আমার এই জীবনে মা ছাড়া কোনাে মেয়ে বা মহিলার সঙ্গে এতােক্ষণ এমন করে কথা বলিনি।
হাবীব, তােমার যন খারাপ লাগবে— বাসায় এসাে। আমি সাধারণত অফিস থেকে সােজা বাসায় চলে আসি এবং বাসায়ই থাকি। খুব জরুরি কোনাে প্রয়ােজন হলে আমি বাইরে তেমন একটা যাই না।
ঠিক আছে, আসি!
এসাে।
হাবীব সিড়ি বেয়ে নিচে নামে। যতক্ষণ জুতাের শব্দ শােনা যাচ্ছিল ততােক্ষণ মালবিকা হক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন। শব্দ মিলিয়ে গেলে তিনি দরজা বন্ধ করে দরজার পিঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়ান এবং হু হু করে কেঁদে ফেলেন। দীর্ঘ আঠারাে বছরের বহন করা জমাট বাধা ব্যথা, সংগ্রাম আর না পাওয়া ভালােবাসার বরফ গলে গলে চোখ ফেটে রক্তের ধারায় নামতে থাকে।

গ্রামের নাম বরইতলা।

আশেপাশে কোনাে স্কুল নেই। বরইতলা থেকে প্রায় চার কিলােমিটার দূরের গ্রাম বােথলায় একটি স্কুল আছে। গ্রামের ঘাসে ঢাকা পথ ধরে ঝড়ে বৃষ্টিতে ভিজে, রৌদ্রে পুড়ে একটি বালক প্রায় প্রতিদিন বরইতলা থেকে বােথলা হাই স্কুলে যায়। গ্রামে অর্ধ শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষেরা সেই ছেলেটাকে খুব মনে করে। ছেলেটার নাম হাবীব। পিতার নাম কেরামত আলি। কেরামত আলির পাঁচ মেয়ে তিন ছেলে। খুব কষ্টে চলে সংসার। এতােবড় সংসার টানা খুব কঠিন। টানতে টানতে তার মেরুদণ্ডে অনেকগুলাে ফাটল ধরেছে। কেয়ার করে না কেরামত আলি। কেয়ার করতে গেলে সংসার চলবে না। লেখাপড়া করে কোনাে ছেলেমেয়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে সেটা ছিল কেরামত আলির স্বপ্নেরও অগােচরে। সেই অগােচরের স্বপ্ন বাস্তবের সড়কে নিয়ে এসেছে তার চতুর্থ সন্তান আহসানুল হাবীব। হাবীবের এখন তিমির অতিক্রান্ত। তার জীবনে প্রেম এসেছিল দূরের জানালা পথে বারবার। হাতছানি দিয়ে ডাকবার সাহস পায়নি হাবীব। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে প্রমিলা নামের একটি মেয়ে—কমলাবতী মেয়ে—কারণে অকারণে ইশারায়, কটাক্ষে, মান অভিমানে অনেকবার ডেকেছিল। প্রমিলা ছিল তার ছাত্রী। সে ছিল প্রমিলাদের বাসায় লজিং।

মেট্রিক পাস করার পর হাবীবের এক দূর সম্পর্কের চাচার সহায়তায় ভর্তি হয়েছিল খুলনায় বিএল কলেজে। সেখানে পড়ার সময় সে স্থানীয় এক শেঠের বাড়িতে লজিং পায়। নবম শ্রেণীর ছাত্রী প্রমিলা আর ছােট ভাই কায়সারকে পড়ায় সে। থাকা-খাওয়া ফ্রি। চমৎকার আয়ােজন। একটি মেয়ের সাথে প্রেমের খেলায় নেমে হাবীব তার নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার আশ্রয়টুকু হারাতে চায়নি। প্রমিলা অবশেষে ঘৃণা করেছে। আশ্চর্য মেয়ে! যে বিষয়টিকে ভয় পেয়েছিল হাবীব শেষ পর্যন্ত সেই বিষ তাকে পান করতে হয়েছিল পেয়ালা ভরে। বারবার সাড়া না পাওয়ায় প্রমিলা ওর বাবাকে জানায়—স্যার আমাকে ঠিকমতাে পড়ায় না বাবা।

ভাত খেতে খেতে প্রমিলার বাবা কামরুজ্জামান মােল্লা প্রশ্ন করেন—কেন?
জানি না।
কী বলে তােকে?
আজেবাজে কথা বলে। তােমাকে বলতে আমার লজ্জা করে।

কামরুজ্জামান মােল্লার সঙ্গে ভাত খাচ্ছিল কায়সার। সে প্রতিবাদ করে—আপা, তুমি স্যারের নামে মিথ্যা বলছাে কেন?
কী মিথ্যা বলছি?
স্যার তােমাকে কতাে কষ্ট করে পড়াতে চায়। তুমিই তাে কিছু করতে চাও না। বসে থাকো আর বলাে, ভাল্লাগে না।
চুপ। ক্লাস ওয়ানে পড়িস তুই। লেখাপড়ার কি বুঝিস?

হয়েছে। অনেক হয়েছে। কামরুজ্জামান মােল্লা ছেলেমেয়েকে থামিয়ে দেন— আমি ব্যাপারটা দেখছি।

সারা দিন রাতের পরিশ্রম শেষে হাবীব ঘুমিয়েছিল।দরজায় টোকা পেয়ে উঠে দরজা খােলে। সামনে দাঁড়ানোে কামরুজ্জামান মােল্লা। মুখে সিগারেট। চারপাশে ঘন ধোঁয়া। প্রায় বছর দু’য়েক হলাে হাবীব এ বাড়িতে আছে। কখনও ঘরে আসেননি মােল্লা। যদি প্রয়ােজন হতাে ডেকে পাঠাতেন।
চাচা?
আলাে জ্বালাও। তােমার সাথে কথা আছে।

সুইচ টিপে আলাে জ্বালায়। ঘন অন্ধকার সরে গিয়ে আলােয় ভরে উঠেছে কক্ষটি। চোখে ঘুম হাবীবের। ঘটনাটা কী? কোথাও একটা সাপের লকলকে জিহ্বা নিয়ে এগিয়ে আসছে বুঝতে পারছে সে। আলাে জ্বালানাের পর কামরুজ্জামান মােল্লা রুমে ঢুকে বিছানায় বসলেন। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছেন। মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আহসানুল হাবীব ঘামছে।

দূর সম্পর্কের চাচা মােশারফ হােসেন চাকরি করেন খুলনার একটি জুট মিলে। বংশের একমাত্র মেট্রিক পাস ছেলেকে গর্বের সঙ্গে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।

আর এক বন্ধুর সহায়তায় এই লজিংয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়। লজিং, দু’একটা টিউশনি মিলে চমৎকার সময় যাচ্ছি। এখনও মনে আছে চাচার বন্ধু, চাচা আর হাবীব তিনজনে মিলে একটির সকালে কামরুজ্জামানের বাসায় আসে।

চাচার বন্ধু আনােয়ার হােসেন পরিচয় করিয়ে দেন—ও হাবীব। খুব ভালাে ছেলে। মেধাবী ছাত্র। আপনার সন্তানদের খুব যত্নের সঙ্গে পড়াবে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কামরুজ্জামান বলেছিলেন—দেখেন, আমরা হলাম গিয়ে স্থানীয় লােক। বাপের জায়গা-জমি আছে। লেখাপড়া শিখি নাই। দরকার হয় নাই। কিন্তু এখন জগৎ বদলে গেছে। টাকা পয়সা থাকুক আর না থাকুক, লেখাপড়াটা থাকা চাই। নইলে সমাজ দাম দেয় না। আমার একটি মেয়ে একটি ছেলে। মেয়েটা বড়।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—

চাচা মােশারফ হােসেনকে হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেন কামরুজ্জামান মােল্লা—আপনার ভাইপাে আমার বাসায় আপন মানুষ, নিজের ছেলের মতাে থাকবে। কোন সমস্যা হবে না। বিদ্যার দাম আমরা দিতে জানি। কিন্তু—

কিন্তু কী আবার?
কোনাে বদনাম সহ্য করব না।

অবাক মােশারফ হােসেন—বদনাম! বদনাম হবে কেন?
আজকাল অনেক ছেলে গ্রাম থেকে এসে শহরে লজিং থাকে। লেখাপড়া করে। ঐ লেখাপড়ার ফাঁকে ছাত্রীদের সঙ্গে অকাজে কুকাজে জড়িয়ে পড়ে। শেষে মান সমান বাঁচাতে বিয়ে দিতে বাধ্য হয় মেয়ের মা-বাবা।

হাবীব লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চায়। সে এসব করতে আসেনি। জীবনের একটাই ধ্রুব। লেখাপড়া শেখা। প্রতিষ্ঠিত হওয়া।

কামরুজ্জামান মােল্লাকে ভরসা দেন আনােয়ার—ভাই সাহেব, এইসব বিষয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের হাবীব খুব ভদ্র আর শান্ত ছেলে। এর দ্বারা কোনাে অপকর্ম হবে না।

না হলেই ভালাে।

কামরুজ্জামান মােল্লা সেইদিন তাদেরকে যেতে দেননি। দুপুরে খাওয়ার পরে যেতে দিয়েছেন। মানুষটাকে বড় ভালাে লেগেছিল হাবীবের। এলাকায় প্রভাবশালী মানুষ হলেও ভেতরে ভেতরে খুব নরম মনের মানুষ কামরুজ্জামান। কিন্তু এখন এই মাঝরাতে ঠিক কী কারণে রুমে এসেছেন, বুঝতে পারছে না হাবীব।

শােনাে—গম্ভীর কণ্ঠ কামরুজ্জামান মােল্লার। চোখ তুলে তাকায় হঠাৎ, বিষয়টা আমার মেয়েকে ঘিরে, নইলে মাটির সঙ্গে পুঁতে ফেলতাম তােমাকে কাক পক্ষীও টের পেতাে না। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তুমি আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবে। চব্বিশ ঘণ্টা পর আর যাতে না দেখি তােমাকে আমার বাসায়। কথা ক’টা উগড়ে দিয়ে কামরুজ্জামান মােল্লা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

হাবীব পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাে। সর্বনাশের ভেলায় চড়ে সে ভাসছে তীব্র স্রোতের প্রতিকূলে। মাস তিনেক পর ফাইনাল পরীক্ষা। হঠাৎ কোথায় যাবে? তবুও হাবীবকে যেতে হয়েছিল। কী কথা গিয়ে বলবে চাচাকে? যে কথাই সে বলুক কেউ বিশ্বাস করবে না। সারারাত ঘুমাতে পারেনি হাবীব। বসে কাটিয়েছে সে। মায়ের মুখ বারবার মনে পড়ছে। বাবা আশায় আছেন। হাবীব অলরেডি বুঝতে পেরেছে সে এই সংসারের আকাঙ্খার একটি সােনার রাজহাঁস। সে পারবে স্বাচ্ছন্দ্য এবং সুখের লাগাম ধরিয়ে দিতে। অথচ এখন তাকে একেবারে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। খুব ভােরে ঘুম থেকে উঠে হাবীব। কলেজের বন্ধু কাজলের মেসে যায়। কাজলকে সব বলে আশ্রয় চায়। কাজলের সঙ্গে একই মেসে উঠে আসে হাবীব। পড়ে অবশ্য আরেকটা লজিং জুটিয়ে নেয় হাবীব।

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরে একবার খুলনায় গিয়েছিল হাবীব।

চাচা মােশারফ হােসেন অসুস্থ। ক্লিনিকে চিকিৎসা চলছে। ঐ ক্লিনিকে দেখা হয়েছিল প্রমিলার সাথে। প্রমিলার বাবা কামরুজ্জামান মােল্লা পক্ষাঘাতে জর্জরিত। ঐ হাসপাতালে তারও চিকিৎসা চলছে। হঠাৎ মুখােমুখি সিঁড়িতে দেখা দু’জনার। হাবীব উঠেছে। প্রমিলা নামছে।

কেমন আছাে প্রমিলা?

অবাক প্রমিলা। হাবীবকে দেখে দুটি চোখ ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। তীব্র উত্তেজনায় থিরথির কাঁপছে প্রমিলা।
ভালাে স্যার। আপনি?
আমিও ভালাে। হাসপাতালে কেন?
আব্বা হাসপাতালে।
কী হয়েছে?
তার ডান পা-টা অবশ।
তাই নাকি? কতােদিন থেকে?
প্রায় বছর খানেক।
তুমি কোথায় যাচ্ছো?

Series Navigation<< উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব একউপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব তিন >>

One thought on “উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার।। পর্ব দুই

  • জুন ৩০, ২০২১ at ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    চমৎকার লাগল।
    ধন্যবাদ ভাইয়া

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *