উপন্যাস।। মরুঝড়।। মোহিত কামাল।। শেষ পর্ব

।। সতেরো।।

নিজের নৈতিকতার অহংকার যেন মিশে গেল মাটিতে। গলার স্বর চেপে ধরল যেন কেউ। স্পষ্ট শব্দ আর বেরোতে পারছে না কণ্ঠনালি থেকে। অসীম শূন্যতার অনুভবে ডুবে গেল আপন সত্তা। তবু ফ্যাসফেসে গলায় কোনোরকমে বলল, ‘ফোনটা মায়ের হাতে দাও।

রুশনা বেগম ফোন হাতে নিয়ে বললেন, ‘বউমা নিজে থেকেই পালিয়ে গেছে বাপের বাড়ি। খুঁজে খুঁজে দিশেহারা হয়েছি আমরা। পরে খবর পেয়েছি নিজের গ্রামেই চলে গেছে সে।

জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড়ের পর স্বজনহারা মানুষ যেমন অনুভূতিশূন্য নির্বাক হয়ে বসে থাকে, রুস্তমের অবস্থাও তেমন। সামনে তাকাল। চোখের আলো দৃশ্য ধারণ করছে বলে মনে হলো না। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তন্ময়। খেয়ালই করল না।

হঠাৎ তন্ময় বলল, ‘এই নিন। আপনার মোবাইল ফোনসেট, আর বাড়ি থেকে আসা খামটি।

পৃথিবীতে যেন একফোঁটা বাতাস নেই। এমনি শূন্য অনুভব নিয়ে খাম আর ফোন হাতে নিল রুস্তম। ডান হাতে কানের কাছে ধরা ফোনে শান্তকণ্ঠে একবার প্রশ্ন করল, ‘কেন চলে গেছে কলি, আম্মা?’

তোমার খোঁজ নিতে গিয়েছিল উপজেলা অফিসে। সেখানে এক অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। তিনি মোবাইল ফোন উপহার দিয়েছিলেন বউমাকে। গোপনে কথা বলত বউমা। পুরো গ্রাম তার এই কুকীর্তির কথা ছড়িয়ে গেছে। নিয়ে বকা দিয়েছিলাম। ওই রাতেই পালিয়ে গেছে বাপের বাড়ি।

মায়ের ব্যাখ্যা শুনে চট করে মনে পড়ে গেল কুফিয়ার কথা।পাথরের মতো নিস্প্রাণ হতে হবে। শক্ত হতে হবে। যে উটকে এত যত্ন করি, সেটিও লাথি মারতে পারে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? আপন মাও অনেক সময় চড় দেয়, দেয় না? মায়ের জ্বালায় বউ ছেড়ে গেছে আমার সংসার। মা লাথি না দিলেও বড়ো আঘাত এসে পড়েনি জীবনে?’ এবার বিস্মিত হলো না। বিশ্বাসও করল না মায়ের কথা। বরং বিপরীত ভাবনার উদয় হলো মনে। কোনো অবিচারের শিকার হয়নি তো কলি? যেমনটি ঘটেছে নিজের জীবনে, তেমন কোনো ঘটনার বলি হয়নি তো সে? অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে ঘটনাটা চট করে বিশ্লেষণ করার পরপরই রুস্তমের হৃদয়মন জুড়ে বয়ে গেল একটা স্বস্তির বাতাস। হঠাৎ তার ধ্যানভঙ্গ হলো মায়ের কথা শুনে, ‘বাবা, তুমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না!’

উত্তর দেওয়ার কিছু নেই, আম্মা। আপনার ছেলে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। ভুল শুনেছেন। ভুল খবরের কি কোনো উত্তর হতে পারে?’ প্রশ্ন করেই লাইন কেটে দিয়ে তন্ময়ের দেওয়া খামটির ওপরে লেখা দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না কলির হস্তাক্ষর। দ্রুত খামটি খুলে ভেতরের সাদা কাগজটির কয়েকটি লাইনের ওপর চোখ বোলাল রুস্তম :

আমি নূরে জান্নাত (কলি), রুস্তম আলির প্রথম স্ত্রী। আমার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে আমার অনুমতি রয়েছে। তিনি আইন লঙ্ঘন করেননি। তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হোক। আমি তার মুক্তি চাই। ইতি, নূরে জান্নাত কলি।

ভয়াবহ খবরের পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে বিষের জ্বালা। বিষের আক্রমণে নিশ্চয় নীল হয়ে গেছে কলি। নীল যন্ত্রণা বুকে পুরেও স্বামীর মুক্তি চেয়েছে সে! চোখের জল আর আটকে থাকার সুযোগ পেল না। গড়িয়ে এলো অশ্রুধারা।

তন্ময় প্রশ্ন করল, ‘সে কি! কাঁদছেন কেন?’
ঠোঁট কামড়ে অশ্রুধারা আটকে রুস্তম বলল, ‘চিঠিটা পড়ুন।
আপনার স্ত্রীর চিঠি?’
হ্যাঁ।
এই চিঠি পড়া কি ঠিক হবে?’
হবে। বুঝতে পারবেন কী ঝড় বয়ে গেছে আমার প্রিয়তমার ওপর দিয়ে। কত বড়ো স্বার্থত্যাগ করে আমার মুক্তি চেয়েছে, দেখুন!’

হাতে নিয়ে মুহূর্তেই চিঠিটা পড়ে হতবাক হয়ে গেল তন্ময়। মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, ‘দ্রুত কল করুন তাকে।
বিমূঢ় রুস্তমের হুঁশ ফিরে এলো। আচ্ছন্নতা পুরোপুরি কাটল না। ধোঁয়াটে চিন্তনে এখনো জট বেঁধে আছে অস্বচ্ছতা। সমাধান খুঁজে না পেয়ে পালটা প্রশ্ন করল, ‘সে তো চলে গেছে বাপের বাড়ি। তার হাতে মুঠোফোন নেই।

আপনার শ্বশুরবাড়িতে কারও মুঠোফোন নেই?’
আছে।
নম্বর আছে সেটার?’

আছে। মনে পড়ল মাঝে মাঝে কথা বলত শাশুড়ি। নিজেদের নম্বরে নয়। ওই বাড়ির আরেকজনের ফোন থেকে কল করত। সেটা স্টোর করা আছে নিজের ফোনসেটে। দ্রুত সেট অন করে লাইন কানেক্ট হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মনিটরে ঘুরছে একটা লালবৃত্ত। লাইন কানেক্ট হওয়ার সংকেত ঘোষণা করছে বৃত্তটি। ঘূর্ণমান বৃত্তের দিকে তাকিয়ে মনে হলো লাল সিগন্যাল ধারণ করে চক্রাকারে ঘুরছে কলির মুখ। ঘুরছে আগুনচিহ্ন। সেইসঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠেছে রুস্তমের বুকও। দুর্ভাবনার মাঝদরিয়ায় নিজেকে সমর্পণ করে আগুনের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে মনে হলো, জনম জনমই কি ঘুরতে থাকবে বৃত্তটি? থামছে না কেন? কেন এত দেরি হচ্ছে লাইন কানেক্ট হতে?

ঘূর্ণমান বৃত্ত থেমে যাওয়ার পর ফোনবুক থেকে বের করল শাশুড়ি জোছনা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর। কল করল দ্রুত। রিংটোন শোনা যাচ্ছে। লাইন কানেক্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাঙায় ছটফট করতে থাকা মাছের মতো যেন হঠাৎ পেয়ে গেল জলের সন্ধান। জলের মুগ্ধতায় পূর্ণ হয়ে উঠে অপরপ্রান্তের পুরুষকণ্ঠের হ্যালোর জবাবে বলল, ‘পাশের ঘরের জোছনা বেগম, আমার শাশুড়ি। তাঁর সঙ্গে কথা বলব।

পুরুষকণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো, ‘জি। বুঝতে পেরেছি। দুবাই থেকে কল করেছেন। একটু আগে আপনার শাশুড়িকে দেখলাম পুকুরপাড়ে। তবে আপনার স্ত্রী আছে ঘরে, তাকে দিই। লাইনে থাকুন।অপেক্ষমাণ সময়টাকে মনে হলো ধারালো ব্লেডের মতো তীক্ষ্ন। সেই ব্লেডের প্রতিটি পোঁচে সাঁই সাঁই কেটে যাচ্ছে সেকেন্ডের প্রতিটি ঘর। তবুও প্রলম্বিত হচ্ছে সময়। প্রলম্বিত সেই সময়ের চাকা আকস্মিক থেমে গেল কলির কণ্ঠস্বর শুনে।

আমি কলি বলছি।
আমি রুস্তম। দুবাই থেকে।
জি। বুঝতে পেরেছি আপনি রুস্তম আলি।শীতল গলায় বলল, ‘আপনি তাহলে ছাড়া পেয়েছেন জেল
থেকে?’
পেয়েছি।

কবর থেকে যেভাবে নির্বিকার ডোম হাড় কুড়িয়ে নেয়, যেখানে মমতার চিহ্নমাত্র থাকে না, মানবিকতা যেখানে স্থান পায় না, তেমনি নিরাসক্ত কণ্ঠে কলি বলল, ‘আপনার মুক্তি চেয়েছি আমি। মুক্তি পেয়েছেন। নতুন জীবন শুরু করুন, আশা করছি।

খুশি হয়েছ তুমি?’
আপনার মুক্তি চেয়েছি। পেয়েছেন সেটা। চাওয়া পূর্ণ হলে মানুষ খুশি হয়। আমিও তাই খুশি।
দুটো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?’
করুন?’
সমাজসেবা অফিসের কারও কাছ থেকে ফোন নিয়েছিলে? কথা বলতে তার সঙ্গে?’
হ্যাঁ। নিয়েছিলাম। কথাও বলেছি তার সঙ্গে।
ওঃ! কারণেই তোমার নামে বদনাম রটেছে?’

বদনাম রটেছে বলে শুনিয়েছেন আপনার বোনমা। বেশ্যা, ছিনাল বলে গাল দিয়েছেন, লাথি দিয়েছেন, মেরেছেন!’
শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল রুস্তম। অপরপ্রান্ত থেকে আর কোনো প্রশ্ন আসছে না বুঝে কলি বলল, ‘আপনি কি লাইনে আছেন?’
হ্যাঁ।
লাইন কেটে দিতে ইচ্ছা করছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না। লাইন কি কেটে দেবো?’
না। লাইন কেটো না। আমিই কাটব।
আর কী জানতে চান, প্রশ্ন করুন।
কেন গিয়েছিলে উপজেলায়?’

আমার স্বামীর খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। আপনার
মায়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঘরের ফোন। আপনার খোঁজ পেলে, আমাকে জানাবেন বলেছিলেন ভদ্রলোক। তাই জোর করে হাতে গুঁজে দেওয়া সেটটি নিতে বাধ্য হয়েছিলাম এই ভেবে যে, অন্তত স্বামীর খোঁজ পাব। তিনিই জানিয়েছিলেন, প্রথম পক্ষের অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করায় জেলে আছেন আপনি। আমার স্বামীর জেলমুক্তির জন্য যা যা করার দরকার, সব করেছি আমি। অনুমতিপত্রও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, শুনেছি সে কারণেই ছাড়া পেয়েছেন, খবরটা সত্য নয়?’

ছাড়া পেয়েছি সত্য। সে কারণে ছাড়া পেয়েছি সত্য নয়।
ছাড়া পেয়েছেন, সেটা তো সত্য। কী কারণে ছাড়া পেলেন, সেটা জানার আগ্রহ নেই। আমি এবার রাখি?’
না। রাখবে না।
আপনার কথা শুনব কেন আমি?’
শুনবে, কারণ তুমি আমার স্ত্রী।
কারও প্রথম স্ত্রী হয়ে থাকতে চাই না আমি। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো।
ডিভোর্স লেটার পাঠাতে পারবে না। পাঠালে আরেকটা ভুল করবে। সেই ভুল শোধরানোর সুযোগ পাবে না জীবনে।

জীবনের প্রয়োজন নেই আমার। রাখি।
শৌর্যের কথা কিছু বলো। না বলে রেখো না।
কী বলব?’
যা ঘটেছে তাই বলো।
কিছুই ঘটেনি। শৌর্য আমার সমবয়সি। বন্ধু। কুটুমবন্ধু। খেলার সাথির মতো সহজসরল বন্ধু। আর কোনো ঘটনা নেই। বাকিটা ভুল, অতিকথন। অতিরঞ্জন।
রুস্তম বলল, ‘আমি জানি।
জানলে প্রশ্ন করলেন কেন?’
তুমি সব সময় সত্য কথা বলো। জানি আমি। মিথ্যা বলা শেখোনি। তাও জানি। তোমার মুখ থেকে সত্যটা জেনে নিলাম।
শৌর্যের কথাও কি তাহলে সত্য?’ প্রশ্ন করল কলি।
কী কথা?’
শৌর্য বলেছেভাইজান কখনো আরেকটা বিয়ে করতে পারবে না?’
সত্যই কি তাই বলেছে?’
বলে সান্ত্বনা দিয়েছে আমাকে।
তুমি কি বিশ্বাস করেছ তার কথা?’
বিশ্বাস করেছি। কিন্তু পরে বুঝেছি, ভুল বলেছে শৌর্য। সমাজসেবা অফিস থেকে আসল খবরটা জেনেছি।
কী খবর?’
আপনার দ্বিতীয় বিয়ের খবর, জেলে থাকার খবর।
খবর আংশিক সত্য। বাকিটা ভুল।
ভুল মানে? কোন অংশ ভুল?’
আরেক বিয়ের খবর ভুল। শৌর্যই সত্যি।

তীব্র খরার পরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে যেন। ঝমঝম বৃষ্টিপাতের সঙ্গে কাঁপছে পুরো আকাশ। কনকনে শীতেও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কোত্থেকে আসছে বৃষ্টি! বৃষ্টির মাঝেও ঘনীভূত হচ্ছে আকাশের নীল! নীলও পুড়ছে। নীল আগুনে পুড়ছে বুকে জমতে থাকা এতদিনের পোড়া ছাইভস্ম! ছাইও পোড়ে! পুড়ে পুড়ে বিলীন হয়েও জেগে ওঠে সোনার মেয়ে কলি! রুস্তমের বউ। রুস্তম প্রশ্ন করল, ‘এখন কি ফোন রেখে দেবো? লাইন কেটে দেবো? কথা বলছ না কেন?’

চিৎকার দিয়ে কলি বলল, ‘না।
নাশব্দটি ভেঙে চৌচির হয়ে ছড়িয়ে গেল আকাশে। ভাঙা শব্দের সহস্র কণা থেকে উচ্চারিত হতে লাগল নানানানানা।

আঠারো

দেরা দুবাইয়ের গোল্ড সুকের উত্তর পাশের রাস্তায় গাড়িজটে বসে আছে একটা কালো লিমুজিন। ভেতর থেকে ডানে দেখা যাচ্ছে হোটেল হায়াত রিজেন্সির উঁচু বিল্ডিং। বিল্ডিঙের সামনে সুসজ্জিত সড়ক, সড়কের পাশে সাবওয়ে রেলে আউটপাস গেট। তারও উত্তরে কৃত্রিম নদীতে চলছে দর্শনার্থীদের নৌবিহার। দুবাইয়ের সৌন্দর্য টানছে না ভেতরের অস্থিরমনা যাত্রীকে। হঠাৎ যানজট ছুটে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আরাম করে বসলেন যাত্রী। একসময় নামলেন গাড়ি থেকে, দৃপ্তপায়ে এগিয়ে গেলেন গোল্ড সুকে হেরা জুয়েলারির দিকে। আগাগোড়া কালো আবায়ার আড়ালে ঢাকা ভেতরে ঢুকে তিনি দাঁড়ালেন ক্যাশের পাশে হেড চেয়ারে বসা রুস্তমের সামনে।

মগ্ন হয়ে কাজ করছিল রুস্তম। হঠাৎ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবেন?’
‘জি। বলব।’
কণ্ঠ শুনেও চিনতে পারল না রুস্তম।
বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলো, ‘বলুন। কী উপকার করতে পারি?’
‘এখানে বলা যাবে না। চেয়ারম্যানের রুমে আসুন।’
‘জি?’
‘চেয়ারম্যানের রুমে আসুন। আপনার চেয়ারম্যান সাহেবা কি রুমে আসেন না কখনো?’
‘না। সব দায়িত্ব আমার ওপর দিয়ে রেখেছেন।’
‘কেন আসেন না? এত বিশ্বাস কীভাবে অর্জন করলেন?’
‘জানি না।’
‘জানতে চাই। চেয়ারম্যান হিসেবে বলছি, আসুন।’
আকস্মিক কেঁপে উঠল রুস্তম। বুঝল, এই প্রতিষ্ঠানের কফিল (মালিক) কলির সঙ্গে কথা বলছে সে।
রুমে ঢুকে চমকালো দুবাই-কলি। ঝকঝকে রুমে যে কেউ আসে না, সে-চিহ্ন নেই। মনে হলো প্রতিদিনই চেয়ারম্যান সাহেবা আসেন। বসেন। এবং অফিস করেন।
চেয়ারে বসে মুখের নেকাব খুলে দুবাই-কলি প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছেন?’

‘ভালো আছি।’
‘আপনার বউকে তো নিয়ে এসেছেন, মাকে আনলেন না কেন?’
‘মা আসেননি। বউ এসেছে। ইমার স্কয়ারের ফ্ল্যাটেই থাকছি আমরা।’
‘মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছেন মায়ের জন্য?’
‘জি।’
‘মা কষ্টে নেই তো?’
‘টাকা পাঠাচ্ছি। টাকার কষ্টে নেই। মমতার কষ্টে আছেন নিশ্চয়ই।’
‘নিয়ে এলেই তো পারেন।’
‘চেষ্টা করেছি। এলেন না তিনি। বাবার ভিটে ছেড়ে কোথাও যেতে চাইছেন না।’
‘জি।’
‘আমার কাজিন কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। আপনার বরাদ্দকৃত টাকা যথানিয়মে পৌঁছে যাচ্ছে। সুখে আছেন কি না জানি না। তবে ভালো আছেন। কথা বলবেন?’
‘না। কথা বললে মায়া বাড়বে। মায়া বাড়লে কষ্ট পাবে সে। আমিও কষ্ট পাব। এই-ই ভালো— ওর জীবনে সুখী ও। ওর সুখই আমার সুখ। বলতে বলতে গভীর জলে হঠাৎ যেন ডুবসাঁতার দিলো দুবাই-কলি। হঠাৎ করেই তলিয়ে গেল অতলে। আকস্মিক আবার ভেসে উঠে নীরবতা ভেঙে বলল, ‘আপনি ভালো আছেন?’

‘ভালো আছি।’
‘সুখে আছেন? আপনি─ আপনার বউ, কলি?’
‘আছি।’
‘আমার খবর রাখেন? জানেন কিছু?’ হঠাৎ বেদনার খোলস ঝেড়ে প্রশ্ন করল দুবাই-কলি।
‘জি। জানি।’
‘কী জানেন?’

‘আপনার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। পাকাপাকি হলে রটে যায় যে এর আগে আপনার বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশের এক যুবকের সঙ্গে। বরপক্ষ তখন কেটে পড়ে।’
‘জি। ঠিকই শুনেছেন। ভালো পাত্র আসছে না আর। সব বুড়ো বুড়ো লোক আসে বিয়ে করতে। ধনবান হলেও বুড়ো লোক বিয়ে করতে চাই না। কী বলেন আপনি, বিয়ে করা উচিত?’

‘না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করা উচিত নয়।’
‘একটা উপকার করতে পারবেন আমার?’
‘কী উপকার?’
‘আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। যোগাযোগ করে দেবেন?’

‘আপনি আমার কফিল। আপনি চাচ্ছেন। অবশ্যই কথা বলবেন।’ বলতে বলতে নিজের মোবাইল অন করে কানেক্ট করল কলির সঙ্গে।
রুস্তম বলল, ‘আমার চেয়ারম্যান সাহেবা এসেছেন অফিসে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কথা বলো।’ বাংলায় বলল স্ত্রীকে। কী বলল, বুঝতে পারল না দুবাই-কলি।
ফোন হাতে ধরিয়ে সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল রুস্তম।
ইশারা করে দুবাই-কলি বলল, ‘সামনে থেকে যাবেন না। থাকুন। আর বাংলাদেশের কলির উদ্দেশে মুখে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম! আপা আপনি! আমার সঙ্গে কথা বলবেন!’ এরই মধ্যে আরবি শিখে নিয়েছে কলি। উল্ল­সিত হয়ে আরবিতে অভিব্যক্তি জানান দিলো।
‘জি। কথা বলব। আপনার সঙ্গে দেখা করা উচিত ছিল। নিমন্ত্রণ করা উচিত ছিল। করা হয়নি। সবার উপরে আপনি আমার মিতা। একই নামের কারণে সাজা পেয়েছেন রুস্তম সাহেব, আপনিও।’

‘আপনিও তো পেয়েছেন। এখনো পাচ্ছেন।’
‘আপনি জানেন সব, কলি?’
‘হ্যাঁ। স্বামীর জানা মানে, স্ত্রীরও জানা। আমরা একে অপরকে সব শেয়ার করি।’
‘আপনারা খুউব সুখী, তাই না?’
‘জি। আল্লাহর রহমতে আমরা সুখী। এই সুখের জন্য আপনার অবদানই বড়ো।’
‘আপনাদের সুখে ভাগ বসাতে চাই। দেবেন একটুখানি সুখ?’
‘জি? কী বলছেন আপা?’
‘আপনি তো স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন।’
‘জি। দিয়েছিলাম স্বামীর মুক্তির জন্য।’
‘সত্যিকারের অনুমতি দেবেন?’
‘কী বলছেন?’

‘বলছি, রুস্তম সাহেবের দ্বিতীয় বউ হতে চাই আমি! দেবেন অনুমতি? এটা আমার প্রাণের দাবি, দেবেন?’
নক্ষত্ররাজি যেন খসে পড়তে লাগল আকাশ থেকে। অন্ধ নীহারিকাপুঞ্জ যেন উত্তপ্ত আগুনে ঝলসে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল একবার। মুহূর্তেই নিভে গেল আবার।
স্তব্ধ হয়ে রুস্তম তাকিয়ে রইল দুবাই-কলির মুখের দিকে।

আপন বলয় চূর্ণ করে বেরিয়ে এলো বধূ কলি। সেই বিচূর্ণ শক্তি থেকে উৎসারিত হতে লাগল, ‘না..না…না…সব দিতে পারব, স্বামীর ভাগ দিতে পারব না। দেওয়ার শক্তি নেই আমার, সামর্থ্য নেই। আপা, ক্ষমা করুন আমাকে। আমার ক্ষুদ্রতাকে ক্ষমা করুন। আপনার মহত্ত্বে বরণ করুন আমার দীনতা। যা দিয়েছেন আমাদের সব ফিরিয়ে নিন। আমার স্বামীর ভাগে হাত দিবেন না প্লিজ।’

‘আমি মহৎ নই। ক্ষুদ্র। ক্ষুদ্র বলেই ভাগ বসাতে চেয়েছি অন্যের অধিকারে। আপনিই মহৎ, কলি। আপনিই বড়ো। আপনার মহত্ত্বের কাছে প্রাণভরে চাইছি, আপনার অধিকারে অংশীদারিত্ব চাইছি।’

বধূ কলি এবার কঠোর কণ্ঠে একবারমাত্র বলে উঠল, ‘না।’

দুবাই-কলির মনে হলো লক্ষ-কোটি ‘না’ছেয়ে ফেলেছে তার আকাশ, খোলা পৃথিবী। আর রুস্তমকে মনে হলো ওই দূর আকাশের এক অসামান্য নীহারিকা। ওই নীহারিকা কখনো ছুঁতে পারবে না সে। কখনো ছোঁয়ার জন্য লোভী হওয়া উচিত নয় ভেবে শান্ত গলায় দুবাই-কলি বলল, ‘আপনি অনেক বড়ো কলি। আকাশের চেয়েও বড়ো। স্বামীর অধিকার যে ছাড়তে চায় না, হৃদয়ের আঙিনায় যে সযত্নে ধারণ করে স্বামীর মমতা, তার অন্তর ভরে থাকুক স্বামীর সোহাগে।’

পৃথিবীর কতশত বাহারি বাগানে পুষ্পকলিরা দল মেলে, সৌন্দর্যের আলো ছড়ায় চরাচরজুড়ে। আবার কত-না কলি বিকশিত হওয়ার আগেই হাহাকার করতে করতে হারিয়ে যায়। ঝরে পড়ে মাটিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *