ছোটগল্প।। আড়াল।। কানিজ পারিজাত
সন্ধ্যা হতে আর বেশি বাকি নেই। খুব দ্রুত আলমারি থেকে ন্যাপথালিনের গন্ধযুক্ত মাফলারটি বের করে নেয় নওরোজ শাহ। শীত ভালো করে এখনো আসেনি। তবে শীত নয়, মাফলারের প্রয়োজন অন্য কারণে। মাথা ও মুখে এমনভাবে মাফলার পেঁচিয়ে নেয় সে, যেন হঠাৎ তাকালে তার চেহারা ভালো করে বোঝা না-যায়। দূরের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে মসজিদের উঁচু মিনার দেখা যায়। সাদা দেয়ালের গায়ে সবুজ সবুজ তারা বসানো, দূর থেকে চিক্চিক্ করে। ছোটবেলায় বিকেল হলেই দোতলার এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের উঁচু মিনার সে দেখত─ খুব ভালো লাগত তার। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। চারিদিকে কী এক অদ্ভুত আলো ছায়ার খেলা। এটাই উপযুক্ত সময়, আস্তে আস্তে পা ফেলে দোতলা থেকে নিচে নেমে আসে নওরোজ শাহ। কয়েক পা এগিয়ে বাইরের কাঠের গেট ঠেলে রাস্তায় পা রাখে। সন্ধ্যার আঁধারে তার চেহারা এখন আর বোঝা যাচ্ছে না। দুই পাশে গাছপালা ঘেরা ইঁট বিছানো সরু রাস্তার খানিকটা পেরোলেই পিচঢালা সদর রাস্তা। নওরোজ শাহ ধীরে ধীরে হাঁটছে। বাতাসে কেমন একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে। কেমন যেন এক ধরনের বুনো পাতার ঘ্রাণ─ অনেকটা এলাচের সুবাসের মতো। পুরনো হলেও তার নানাবাড়িটা মন্দ নয়। মন্দ নয় প্রাচীন এই জেলা শহরও। ভাবতে ভাবতে সদও রাস্তায় এসে দাঁড়ায় সে। হাতের ইশারায় একটা রিকশা থামায়─ জোনাকি সিনেমা হল। টুংটাং বেল বাজিয়ে রিকশা ছুটে চলেছে। দুই পাশে সারি সারি দোকান, শোরুম─ নিয়ন আলোয় সজ্জিত শহরটিকে দারুণ লাগছে। দোকান থেকে সন্ধ্যার ধূপ ও আগরবাতির ঘ্রাণ ভেসে এসে মিষ্টি এক ঘোর তৈরি করছে যেন। রিকশা এসে থামল জোনাকি সিনেমা হলের সামনে। সন্ধ্যার শো শুরু হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। সিনেমা হলের গায়ে বড়ো করে নায়ক নায়িকার পোস্টার লাগান। সিনেমার নাম─ “অভিমান”। সেদিকে তাকায় নওরোজ শাহ। হৃদপিন্ডটা যেন একবার নেচে ওঠে। তারপর সোজা সিনেমা হলের দরজায়। তাকে দেখেই চিনে ফেলে সুলেমান─ ইশারা বুঝে তাকে নিয়ে বসিয়ে দেয় দর্শকসারির মাঝের কোণায় এক সিটে। পর্দায় তখন নায়ক নায়িকার সংলাপ। নায়িকা ভাবাবেগে কথা বলতে বলতে নায়ককে জড়িয়ে ধরেছে। এই সময় নায়িকার বাবা এসে ঘরে ঢুকল─ দরিদ্র নায়ককে ভারি ভারি কথায় তিরস্কার─ বেরিয়ে যেতে বলছে। নায়ক ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। নায়িকা তার পেছন পেছন ছুটে যেতে চাইলে, নায়িকার বাবা তাকে আটকে দেয়। নায়ক বিষণ্ন চোখে একবার পেছন ফিরে তাকাল─ দর্শক সব চুপ। মৌন হয়ে দেখছে─ এই সময় বেল বেজে উঠল। পর্দায় বড়ো করে লেখা ভেসে উঠল─ বিরতি।
মিরিন্ডা, কোলা আর বাদাম পাপড়ি হাতে হকারেরা ঢুকছে। নওরোজ শাহ এক হকারের কাছ থেকে মিরিন্ডা নিল। দামটা বাড়িয়ে দিতেই দেখে হকার বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর প্রথমে বিড়বিড় করে, তারপর বেশ জোরে জোরে ‘নওরোজ শাহ’ ‘নওরোজ শাহ’ বলে চিৎকার করতে থাকে সে! কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই হলভর্তি দর্শক যেন তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কেউ ছুঁয়ে দেখতে চায়, কেউ হাত রাখে কাঁধে। নায়ক বলে কথা! তাও চলতি সিনেমার নায়ক নওরোজ শাহ স্বয়ং বসে আছে তাদের মাঝে! আটাশ বছরের সুদর্শন নায়কের তখন ভারি বেহাল দশা। শত জোড়া চোখ তার দিকে চেয়ে, হাতগুলো তার দিকেই এগিয়ে আসছে─
একটু আড়াল প্রয়োজন তার। সবার থেকে সরে এসে একটু আড়াল। সময় বড়ো বিচিত্র। যৌবনের ফেলে আসা সময় স্মৃতির প্রজাপতি হয়ে মনের জানালায় বারবার উঁকি দিয়ে যায়।
দুই
হোটেলের জানালার পাশে আবছা আলো আঁধারে দাঁড়িয়ে আছেন নওরোজ শাহ। ভোর হয়ে আসছে। আঁধার সরে একটু একটু করে ফুটে উঠছে আলো। যেন আলো আঁধারের এক অদ্ভুত ছায়া ছায়া খেলা─ দারুণভাবে টানছে তাকে। তার সারাটা জীবন আলো আঁধারের এমন আবছা ছায়ায় কেটেছে। নওরোজ শাহ জানালা থেকে সরে এসে বাথরুমে ঢোকেন। গায়ে ঠান্ডা জল ঢালতেই মায়ের কথা মনে পড়ে। ছোটবেলায় মা তাকে গোসল করাতো জলচৌকিতে বসিয়ে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান─ ভারি আদরের ছিল নওরোজ। নওরোজের দেখভালের জন্যেই তার মায়ের দূরসম্পর্কেও এক বোন এসে থাকতে শুরু করে তাদের বাসায়। ছোট্ট নওরোজের দেখভালের সাথে সাথে নওরোজের বাবারও দেখভাল করতে শুরু করে দেয় সে। তারপর একদিন তার বাবার নতুন স্ত্রী হয়ে এসে ঢোকে তাদের ঘরে। নওরোজের অভিমানী শোকপাথর মা পরদিন খুব ভোরে তার হাত ধওে নানাবাড়ি এসে ওঠে। নওরোজ বা তার মা আর কখনো মুখোমুখি হয়নি তার বাবার।
ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে। নওরোজ শাহ তৈরি হয়ে নিচ্ছেন, বাইরে বেরোতে হবে। হোটেল রুমের এক কোণায় রাখা পুরনো ধাঁচের ড্রেসিং টেবিলটার মলিন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ষাটোর্ধ্ব এই বয়সেও মেদহীন সুগঠিত শরীর তার। তিনি এখনো সুদর্শন। শুধু বয়স যেন তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যেই কোথাও কোথাও কিছু জ্যামিতিক ছাপ এঁকে রেখে গেছে। নওরোজ শাহ একটি অফহোয়াইট শার্টের সাথে কালো রঙের প্যান্ট পরেছেন– খুবই সাধারণ পোশাক। তবু এই সাধারণ পোশাকেই তাকে দেখতে যেন একটু আলাদা লাগছে, কী এক ভিন্নতা আছে তার মধ্যে। আর এই ভিন্নতার কারণেই বুঝি প্রথম জীবনে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নজরে পড়ে যান চলচ্চিত্র পরিচালক বিনয় চক্রবর্তীর। প্রথম সিনেমা ‘জেগে ওঠো’-তে পার্শ্বচরিত্র, দ্বিতীয় সিনেমা ‘মেঘের ছায়া’তে নায়ক। ছিলেন সাধারণ এক মানুষ, হয়ে গেলেন অসাধারণ এক নায়ক। সামাজিক-পারিবারিক সিনেমাগুলোতে নওরোজের বিকল্প ছিল না। নওরোজ-সুলতা জুটি মানেই হিট। পরিচালক- প্রযোজকেরা পেছন পেছন ছুটত। নওরোজ অবশ্য কোনো কিছুর পেছনেই ছোটেননি─ অর্থ, বাড়ি, গাড়ি বা নারী। নিরহঙ্কার, খেয়ালি, ভাবুক নওরোজ খ্যাতির শীর্ষে থেকে হঠাৎই কেন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, চলে গেলেন সিনেমাজগতের বাইরে, চেনা মানুষের আড়ালে।
ওয়েটার রবিউল এসে নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করে যায়। গত কয়েক মাস ধরে নওরোজ শাহ বিভিন্ন হোটেলে থাকছেন। প্রথমে বনানীর কাছে এক হোটেলে, তারপর আরো কয়েকটি জায়গা হয়ে পুরনো ঢাকার এই হোটেল ‘নবারুণ’। একটু সহজলভ্য। সময় গড়াচ্ছে, অনিশ্চয়তা বাড়ছে, তিনিও চুড়ো থেকে ধাপে ধাপে পা ফেলে নেমে এসেছেন সমতলে। নওরোজ শাহ হোটেল থেকে বেরিয়ে রিকশা নিলেন─ সেগুনবাগিচা যাবেন, সাদেকের অফিসে। আজ হ্যাট পরতে ভুলে গেছেন অবশ্য হ্যাট না পরলেও চলে। মানুষ তো আর আগের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে না। যদিও চলার পথে কেউ কেউ তাকায়─ হয়ত চেনা চেনা লাগে। রিকশা অলিগলি পেরিয়ে ছুটে চলেছে─ নওরোজ শাহের কাছে সবকিছুই কেমন অচেনা লাগছে।
শহর─ মানুষ─ সময়─ সবকিছু।
তিন
সাদেকের অফিসটা বেশ অভিজাত। ঝকঝকে, সুন্দর। দেয়ালে দেয়ালে বিদেশি পোর্টেট। রিসিপশনের ডান দিকের দেয়ালে ঝোলানো একটি বিদেশি পোর্ট্রেটে চোখ আটকে যায় নওরোজ শাহের। সমুদ্রে ভাসমান একটি কাঠনৌকা পাহাড় ঘেষা তীরের কাছে─ যেন নোঙর ফেলার অপেক্ষায়। কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিক। মনে হয় সন্ধ্যার দৃশ্য─ সুন্দর। নওরোজ শাহ নিজেও তো নোঙর ফেলতে পারেননি কোথাও─ দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন, ভিত্তি গড়েননি। শেষ জীবনটা দেশে কাটিয়ে দেবেন─ ফিরে এসে দেখেন ঘনিষ্ঠজনের স্বার্থের থাবায় লুণ্ঠিত তার সবকিছু।
─স্যার আপনাকে কি চা দেব?
রিসিপশনের মেয়েটির কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন। সাদেকের এই অফিস মূলত প্রযোজনা ও বিজ্ঞাপন নির্মাণের প্রতিষ্ঠান। জমজমাট বাণিজ্য। শিল্প এখন বাণিজ্যই বটে! নওরোজ শাহ কখনো বাণিজ্যের কথা ভাবেননি। সাদেকের মতো অনেকের দুর্দিনে সহায়তা করেছেন─ বিনা পারিশ্রমিকে অভিনয় করে দিয়েছেন। সাদেককে কয়েক বছর আগে একটি বড়ো অঙ্কের টাকা ধার হিসেবেও দিয়েছিলেন─ আজ নিজের দুর্দিনে টাকাটা ভীষণ প্রয়োজন তার।
─`স্যার’আপনার চায়ে কি চিনি হবে?
নওরোজ শাহ সোফায় বসে আছেন। রিসিপশনের মেয়েটার কথায় মুখ তুলে তাকালেন। মেয়েটার সাথে সুলতার কম বয়সের চেহারায় কেমন একটা মিল যেন। মেয়েটার মুখটা গোল, সুলতার মুখটা ছিল পানপাতার মতো। তবে কোথায় যেন একটা মিল। খুব সম্ভবত চোখে। দুজনেরই চোখ খুব মায়াবী। সুলতার আসল নাম ছিল রেখা। মফস্বলের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে, অভাবের কারণে যাত্রা ও মঞ্চে অভিনয় করে। এক মেকআপম্যান নিয়ে আসে নওরোজের কাছে তার সিনেমার প্রযোজককে বলে দিতে; ছোট একটি চরিত্র দেওয়ার জন্য। নওরোজ-গুলশান, নওরোজ-পিয়াসা জুটি তখন দারুণ চলে। সুলতা মানে রেখাকে প্রথম নজর দেখেই কেমন একটা মায়া পড়ে যায় নওরোজের।
তার সিনেমায় ছোট বোনের চরিত্রে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। মেয়েটা মেধাবী ছিল, ওইটুকু চরিত্রেই সে ভালো কাজ দেখিয়েছিল। পরবর্তী সিনেমা ‘রাজভিখারী’তে নায়িকা হিসেবে নওরোজ নিজে তার নাম প্রস্তাব করে। সেটি খুব ব্যবসাসফল না হলেও ‘হারিয়ে পাওয়া’ সুপার ডুপার হিট। সুলতাও ততদিনে নায়িকা─ আচার রপ্ত করে নিয়েছে বেশ ভালোভাবে। লম্বা করে কাজল আঁকা চোখ, চুল টেনে ঢাউস খোঁপা বাঁধা ছিপছিপে সুলতা তখন অন্য নায়িকাদের ঈর্ষার পাত্রী। শুধু নিজের খোঁপাই বাঁধেনি সুলতা, নওরোজকেও বেঁধেছিল─ মনের বাঁধনে। অন্য কোনো নায়িকার সাথে জুটি হলে সুলতা মনে কষ্ট পাবে, তাই নওরোজ সুলতার সাথে একক জুটি গড়ে তোলেন। নওরোজ-সুলতা দেয়ালে দেয়ালে সিনেমার পোস্টার। হলগুলোতে দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। খেয়ালি নওরোজ মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে হলে গিয়ে সে-সাফল্যের স্বাদ আস্বাদন করেছেন।
─’স্যার, আপনাকে কি আর একটু চা দেব? আমাদের স্যার একটু আউটডোরে আছেন।’
গত কয়েকদিনে নিজের প্রাপ্য টাকার জন্য সাদেকের কাছে একাধিকবার এসেছেন। প্রতিবারই সাদেক হাসিমুখে কথা বলে─ চা-সিংগারা খাওয়ায়। তারপর কথায় কথায় মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে আসে। নওরোজ শাহ টাকার বিষয়টি মনে করিয়ে দিলে হাসতে হাসতে খুবই আন্তরিকভাবে ─ “আপনি কোনো চিন্তা করেন না ‘নওরোজ ভাই’, আজ একটি ঝামেলা হয়েছে। তা না হলে আজই পেতেন। অসুবিধা নাই, আগামীকাল সকালেই আমি ব্যবস্থা করছি।”পরপর দুটো সকাল পেরিয়ে গেলেও সাদেকের ব্যবস্থার ব্যবস্থা হয়নি। আজ সাদেকের দেখাও পাননি। নওরোজ শাহের কেন যেন মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই তিনি সাদেকের দেখা আর পাবেন না। মাথার ভিতর কেমন যেন হাতুড়িপেটা হচ্ছে।
বিকেলের দিকে সাদেকের অফিস থেকে হোটেলের দিকে পা বাড়ান তিনি। ধীর পায়ে হেঁটে চলেছেন। পকেটে যা আছে তা খুবই সামান্য। সর্বোচ্চ তিনদিন চলতে পারবেন, তারপর? তারপর কী হবে? কালই তাকে রিয়াজুলের অফিসে যেতে হবে। নওরোজ শাহ হেঁটে চলেছেন। একটু একটু ঘাম হচ্ছে তার। রোদের তেজ এখনো কমেনি। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। খুব চেনা একটি ঘ্রাণ এসে নাকে লাগছে─ হরলিক্সের ঘ্রাণ। ছোটবেলায় জ্বর হলে, কিংবা বিকেলে স্কুল থেকে নানাবাড়ি ফিরলে মা তাকে হরলিক্স খেতে দিত। মামা-মামিদের যৌথ পরিবারে বারবার নওরোজকে খেতে দিতে বলতে মার হয়ত অস্বস্তি হতো, রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত তাই বিভিন্ন অসিলায় মা নওরোজকে হরলিক্স বানিয়ে দিত। মগজের হাতুড়ি পেটা এখনো থামেনি। তার কি কোনো হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? তিনি সব জায়গায় হরলিক্সের ঘ্রাণ পাচ্ছেন কেন? সারাশহর যেন হরলিক্সের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে।
চার
বিকেলের মাথা ধরাটা এখনো কমেনি নওরোজ শাহের। হোটেলের অন্ধকার রুমে তিনি শুয়ে আছেন চোখ বন্ধ করে। সুলতারও সেদিন মাথা ধরেছিল। সেবার ‘মন দেয়া-নেয়া’ সিনেমার শুটিং করতে তারা গিয়েছিলেন সিলেটে। প্রচন্ড বৃষ্টিতে কাজ বারবার আটকে যাচ্ছিল। সেদিন বৃষ্টিতে শুটিং বন্ধ থাকায় যে যার মতো এদিক সেদিক বেরিয়েছিল। ফুলছড়ি টিলার চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় নিমন্ত্রণ করেছেন─ সুলতাকে বলতেই সে জানায় ‘তুমি যাও, আমার মাথাটা ভীষণ ধরেছে, একটু রেস্ট নিব।’ আরো ২-৩ জনের সঙ্গে নওরোজ গিয়েছিল। কিন্তু কেন যেন মনটা ভালো লাগছিল না। কেমন এক ধরনের স্নায়বিক অস্বস্তি হচ্ছিল তার। ইদানীং সুলতার কী হয়েছে, কেমন যেন প্রচ্ছন্নভাবে তাকে এড়িয়ে যায়। গোপনে তাদের বাগদান হয়ে গেছে। আর দু’বছরের মধ্যেই সুলতাকে বৌ করে ঘরে তুলবে নওরোজ– শুধু প্রযোজক-পরিচালকদের অনুরোধে দেরি করছে। বিয়ে হলে তাদের জুটির আকর্ষণ নাকি কমে যাবে! সন্ধ্যার একটু আগে নওরোজ হোটেলে ফিরে আসে একাই। বাকিরা তখনও কেউ ফেরেনি। সুলতার রুমে বাইরে থেকে তালা দেওয়া। কেমন এক ধরনের অজানা শঙ্কা হতে থাকে তার। সুলতার তো একা কোথাও যাবার কথা নয়। এক ধরনের চাপচাপ অস্বস্তি হতে থাকে। কোথায় যেতে পারে সুলতা? নিচে গিয়ে হোটেলের ডেস্কে জিজ্ঞেস করবে নাকি? কোথাও যেতে দেখেছে কিনা? নামার সময় মনে হয় হোটেলের করিডোরের শেষ রুমে যেন লোক আছে। ওটা তো কায়েসের রুম, সিনেমার ভিলেনের চরিত্র করছে যে নতুন ছেলেটি। ও কি কিছু জানতে পারে? দরজায় দুবার নক করতেই অর্ধ উদোম শরীরে বিরক্ত মুখে দরজা খোলে কায়েস─ ‘বললাম না আধাঘণ্টা পরে ড্রিংকস ২টা পাঠাতে’─নওরোজকে দেখে শেষের কথাগুলো আটকে যায় অপ্রস্তুত কায়েসের। আর নওরোজের চোখ আটকে যায় কায়েসের বিছানায়– অসংবৃতা, এলোমেলো, ক্লান্ত সুলতার দিকে। সে-রাতে নিজের কাছে নিজেই কেমন কুঁকড়ে গিয়েছিল নওরোজ। রাবণের কাছে রামের পরাজয়।
পাঁচ
ভারি সুন্দর অফিস রিয়াজুলের। নওরোজ শাহকে দেখেই রিয়াজুল ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। রিয়াজুল একসময় তার কাছেই থাকত─ এখন নামি নির্মাতা, একের পর এক টেলিফিল্ম, সিনেমা নির্মাণ করছে। রিয়াজুলের রুমটা ছিমছাম সাজানো─ মানিপ্ল্যান্ট ও অর্কিডে সাজানো রুমটিতে যেন সবুজের ছোঁয়া। সত্যিই ভিন্ন এক মাত্রা এনে দিয়েছে যেন। সামনে বসা দুটি ছেলের দিকে তাকিয়ে রিয়াজুল বলে ‘বুঝলা জামাল, ইনি হলেন এক সময়ের বিখ্যাত নায়ক নওরোজ শাহ। আমি তো ভাই এর কাছেই মানুষ। আমার যখন কিছু ছিল না, ভাইয়ের বাসায়, ভাইয়ের কাছেই থাকতাম। অনেক করছেন ভাই আমার জন্য। নওরোজ-সুলতা জুটি নাম শুনছিলা? এক সময়ের সুপারহিট জুটি ছিল।’ আবারও সুলতা? ভুলতে চাইলেও যেন ভুলতে পারেন না তিনি। সেদিনের সন্ধ্যার পর পরদিন সকালে শট দেবার সময় তিনি বা সুলতা কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছিলেন না। একটার পর একটা শট বাদ হয়ে যাচ্ছিল। ইউনিটের সবাই কানাঘুষো করছিল। শুধু একজনকে দেখা গিয়েছিল বুকচিতিয়ে হাঁটতে─ সে হলো কায়েস। বড়লোক বাবার ছেলে, সিনেমার পেছনে ঢালার মতো প্রচুর অর্থ ছিল তার। আরও একটা জিনিস ছিল, সুঠাম শরীরের ভেতর থেকে যা উঁকি দিত─ তা হলো আদিম বন্যতা। কোনটা ভালোবেসেছিল সুলতা? কায়েসের অর্থ নাকি ওই আদিম বন্যতা?
─নওরোজ ভাই আপনার মামাতো ভাই গিয়াস নাকি আপনার সবকিছু নিজের করে নিছে?
ওর সাথে যৌথ অ্যাকাউন্ট খুলছিলেন ক্যান? পাওয়ার অব এটর্নি বা দিছিলেন ক্যান? মানুষওে কোনোদিন এত বিশ্বাস করতে হয়?
─তাও ভালো─ খালাম্মা বাঁইচা নাই, বাঁইচা থাকলে আপনার এই কষ্ট সে সহ্য করতে পারত না।
নিজের একান্ত বিষয়গুলো মানুষের সামনে খুলতে খুব একটা অভ্যস্ত নন নওরোজ। তার কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। রিয়াজুলের কথার প্রসঙ্গ ঘুরাতেই তিনি বলেন─ ‘তুমি তো এখন অনেক বড়ো নির্মাতা।’
─হো হো করে হেসে ওঠে রিয়াজুল─ কিসের বড়ো নির্মাতা? এখন তো সিনেমা বানানো খুব সহজ। খালি বানানোর মসলাটা জানতে হয়। এই যেমন ধরেন তিন ঘণ্টার একটা সিনেমার জন্য ৬টি গান, ৬টি মারপিট আর ২/৩টি ধর্ষণদৃশ্য রেডি করলেই সিনেমার ৮০ ভাগ শেষ– এর সাথে জোড়া লাগাবেন খানিকটা গল্প। আর গানের শুটিং যদি দেশের বাইওে করতে পারেন তাইলে তো কথাই নাই। হইবো সিনেমা হিট। নওরোজ শাহের হঠাৎ মনে পড়ে যায় কায়েসের প্রযোজনায় সুলতা একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করে যাচ্ছে─ সম্ভ্রমহানি আর জলে ভেজার দৃশ্যে। চারিদিকে যেন রগরগে দৃশ্যের জোয়ার। নওরোজ সে জোয়ারে গা ভাসাতে পারেননি। সুলতার দিকে কোনোদিন আর ফিওে তাকাননি। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সিনেমা থেকেও। ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না নওরোজ ভাই, আমি তো আছি। আপনার কাছেই মানুষ আমি, আপনার জন্যেই এতদূর আসছি। ভুলি নাই। কাল এগারোটার সময় এখানে একটু আসবেন।’ আসার সময় গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায় রিয়াজুল। নওরোজ শাহের বুকটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। সবাই তাহলে এক নয়। কেউ কেউ মনে রাখে।
ছয়
রিয়াজুলের অফিসে কীসের একটা ছোটাছুটি। সবাই খুব ব্যস্ত। ক্যামেরা, লাইট আর যন্ত্রপাতি নিয়ে কিছু মানুষ ছোটাছুটি করছে। নওরোজ শাহকে দেখে জামাল এগিয়ে আসে─ যত্ন করে বসিয়ে কফি খেতে দেয়। ‘রিয়াজুল কোথায়’─জিজ্ঞেস করতেই জামাল বলে ‘স্যার এখনই এসে পড়বে, আপনি একটু এপাশে আসেন।’ বাইরের রুমে দুই তিনজন বয়স্ক মানুষ বসে আছে একটু মলিন পোশাকে। নওরোজ কী হচ্ছে জানতে চাইলে জামাল বলে─
আপনি জানেন না? আপনাদের তো শুটিং।
নওরোজ শাহ অবাক হন।
─শুটিং? কিন্তু আমাকে তো স্ক্রিপ্ট দেয়া হয়নি? কীসের অভিনয়?
─ওই শুটিং নয়। স্যার একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছেন─ দুঃস্থ শিল্পীদের উপর। শুটিং শেষে আপনাদের ভালো একটি অর্থ সাহায্য করা হবে। এ ব্যাপারে আমাদের স্যার খুবই আন্তরিক।
─দুঃস্থ শিল্পী!!
নওরোজ শাহের কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে। তিনি হঠাৎ করেই আবার হরলিক্সের ঘ্রাণ পেতে শুরু করেছেন। মার কথা খুব মনে পড়ছে তার। মার কাছে যেতে খুব ইচ্ছে করছে।
─‘একটু আসছি’বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে পড়েন রিয়াজুলের অফিসে থেকে। মাথার ভিতর অজস্র শব্দ─ হাতুড়ি পেটা হচ্ছে যেন─ ক্যামেরা─ লাইট─ অ্যাকশন─ দর্শকের হাততালি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আর বেশি বাকি নেই। নওরোজ শাহ বসে আছেন যাত্রী ছাউনিতে─ গন্তব্যহীন, নির্লিপ্ত মুখে। হোটেল ছেড়ে দিয়েছেন। পকেটে মাত্র সতের টাকা। মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। লাল নীল সবুজ মরিচ বাতিতে রাতের শহর যেন ঝলমল করছে। আজ কোনো উৎসব আছে বোধ হয়। নওরোজ শাহ মাঝে মাঝেই হাততালির শব্দ শুনছেন, আবার কখনো কখনো হরলিক্সের ঘ্রাণ পাচ্ছেন। কেউ কেউ যাবার সময় তার দিকে তাকাচ্ছে।
নওরোজশাহ বিড়বিড় করছেন─ ‘আড়াল। আড়াল। আড়াল।’একটু আড়াল প্রয়োজন তার।
গল্পটা পড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। বাস্তবের খুব কাছাকাছি ঘটে যাওয়া গল্প। একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতার করুণ পরিণতির গল্প। পাত্র পাত্রীদের নামগুলো সুন্দর। সঙ্গে সিনেমাগুলোরও। দুটো ভিন্ন সময়কে খুব অল্প কথায় সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে। শেষের দিকে বাস্তবের মুখোমুখি হতে না পেরে আড়াল খুঁজার চেষ্টা – খুব কষ্টের। অপ্রিয় বাস্তবতা। অনেক ধন্যবাদ সুন্দর গল্পের জন্য।